১
উত্তাল জনসমুদ্র। চাপা নিঃশ্বাস। উত্তেজনা।
আজ বিচার হবে।
২
যখন মুক্তদেশের বাতাসে শ্বাস চুরি করে নিত বুকে; অথবা যখন বাহনে উড়তো জাতীয় পতাকা পতপত করে, যখন ধর্মোপদেশ ভেসে আসতো চারকোণা বাক্স কিম্বা জনসমাবেশ থেকে, আর যখন বোকা মানুষগুলো তন্ময় হয়ে স্বর্গের টিকেট যোগাড় করতো; কিম্বা যখন রক্তের দামে কেনা ভাষায় গলা কাঁপানো ভাষন শোনা যেত; কিম্বা যখন ক্ষমতার নেশায় রাজনৈতিক দলগুলো চুমো খেত সেই কুৎসিত পায়ে; এবং যখন দেশমাতৃকার রক্ত মাখানো সেই হাতে উঠতো সেই দেশেরই প্রভু হবার শাসনদন্ড।
তখন আকাশ থেকে নেমে আসতো না কোন পূণ্যাত্মা; এই জনপদের পাপ গায়ে লেগে নোংরা হয়ে যাবার ভয়ে। আর জমিনের উপর বোবা মানুষগুলো এই অবিচারে গুমরে কাঁদতো।
আর ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষায় থাকতো বিদ্রোহী ছন্নছাড়া’দের।
৩
একদিন সব পালটে যাওয়ার স্বপ্নে আক্রান্ত হোল বোবা মানুষগুলো। মহামারী হয়ে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ল মুক্তদেশের দিগদিগন্তে। স্বপ্নভঙ্গ হবার যন্ত্রনায় ধুঁকে ধুঁকে মরে যাওয়ার আগে সবাই স্বপ্ন দেখেছিল অবিচারের অবসানের, পেট পুরে দুইবেলা খাওয়ার, স্বচ্ছলতার। কেউ কেউ স্বপ্ন দেখলো ত্রাসবিহীণ এক রূপকথার রাজ্যের, যেখানে তরুণরা অমানুষ নয়, যেখানে বিশ্বজিতের গায়ে থাকে লাল নয়, সাদা শার্ট।
তারপর মরে গেল স্বপ্ন দেখা বোবা মানুষগুলো। বেঁচে রইল শুধু স্বপ্ন না দেখা বোবা মানুষ। বিদ্রোহী ছন্নছাড়া’রা তখনো ঘুমিয়ে...
৪
দানব’দের রাজত্ব যখন; মুক্তদেশ যখন বন্দী; চারদিকে শুধু ধ্বংস আর অত্যাচার; দুনিয়ার বুক থেকে বোবা মানুষ’এর জাতটাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার নীল নকশা। লাখ লাখ নিরস্ত্র নিরপরাধ মানুষকে নির্মমভাবে খুন, নিষ্ঠুর গণহত্যা, নির্বিচার নারী ধর্ষণ, বসত বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ এবং ধর্মান্তরে বাধ্য করা; কষ্টকল্পনাযোগ্য এমন কোন মানবতাবিরোধী অপরাধ বাকি ছিলোনা, যা এই বোবা মানুষদের উপর প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের মতো বয়ে যায়নি। পূণ্যাত্মারা সাত আসমান উপর থেকেও আতঙ্কে শিউরে উঠতো, আর জল ভরা চোখে অস্ফুটে বলতো, “আহারে...”
বিদ্রোহী ছন্নছাড়া’র দল তখন ঘুমিয়ে ছিল অঙ্কুর হয়ে...
৫
দেবতারা মানুষরূপে লুকিয়ে ছিলেন মুক্তদেশের কালো মাটিতে। এই কালো মাটির ভালোবাসা’কে হাতিয়ার বানিয়ে সেই দেবতা’রা যুদ্ধ ঘোষণা করলেন দানব’দের বিরুদ্ধে। খুন হয়ে যাওয়া লাখো বোবা মানুষের প্রেতাত্মারা হাতে হাত রেখে ঘিরে রেখেছিল মুক্তদেশের সীমানা; যাতে পালাতে না পারে একটি দানব’ও। অবশেষে একদিন রক্তক্ষরণে কালো মাটি লাল হয়ে জয় হোল শুভ শক্তির। বেঁচে যাওয়া গুটিকয় পরাজিত দানবেরা রূপ বদলে মিশে গেল জনপদে, দলে, উপদলে। বোকা বোবা মানুষেরা তাদের অসুরিক ক্ষমতাকে দৈব ভেবে ভুল করলো।
দানবেরা বদলে গেল ছদ্মবেশী দেবতায়। কায়েম হোল ক্ষমতার লোভ আর পাপ’এর রাজত্বের।
তখন আকাশ থেকে নেমে আসতো না কোন পূণ্যাত্মা...
৬
স্বপ্ন না দেখা মানুষগুলো হঠাত একদিন চোখ কচলে ভাবলো, তারা কি আবার স্বপ্ন দেখছে? ধরা পড়ছে সেই ছদ্মবেশী দানবগুলো! রাজ দরবারে তাদের বিচার হবে। কিন্তু শুধু দলে মিশে যাওয়া দানবগুলো কেন? উপদলে মিশে যাওয়া দানবগুলোর কথা কেন কেউ বলছেনা? কোন কোন দানব রাজাকার হলেও যুদ্ধাপরাধী নয়, কেন এ বিভাজন? মানবতা বিরোধী এ অপরাধের বিচার কি শুধু রাজনৈতিক দাবার সূক্ষ্ম চাল?
ইতিহাসের দায় মেটাতে তখন ঘুম ভাঙছে বিদ্রোহী ছন্নছাড়াদের।
৭
গণহত্যার একটি, হত্যার তিনটি, ধর্ষণের একটিসহ আটটি অভিযোগে অভিযুক্ত; শিরোচ্ছেদের শাস্তি হোল এক দানবের। কিন্তু অচিন নর্দমায় লুকিয়েছে সেই দানব; তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা, অথবা খুঁজে পাওয়া হচ্ছেনা।
স্বপ্নবাজ এক তরুণকে দুদিন ধরে নির্যাতন করে হত্যা, কবি’কে জবাই করে মুক্তচিন্তা রোধ করার অপচেষ্টা, ১১ বছরের এক বালিকা’কে ধর্ষণ করে হত্যা; ৬ টি অভিযোগ আরেক দানবের বিরুদ্ধে। এইসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে সিদ্ধান্ত নেয়া হোল; বিশাল এক লোহার কলসের মুখ বন্ধ করে তাতে পুরে রাখা হবে এই দানব’কে; মাত্র ২০ বছরের জন্য!
দানবের দোসর’রা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে দিল, এইসব সামান্য অপরাধে মৃত্যুদন্ড বড় বে-ইনসাফ হয়ে যায়! নিঃশব্দ অট্টহাসি শোনা যেতে লাগলো দানব’দের। আঙ্গুলে বিজয় চিহ্ন।
স্বপ্ন না দেখা মানুষগুলো অবিচার আর পাপের রাজত্বের পুনরাবৃত্তির আশংকায় কুঁকড়ে গেল। আর ঘুম ভাঙ্গা বিদ্রোহী ছন্নছাড়া’র দল বিদ্রোহী হয়ে প্রত্যাখ্যান করলো দানবকূলের এ বিচার। তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠতে লাগল মুক্তদেশের স্বপ্ন দেখা আর না দেখা সব বোবা মানুষেরা।
৮
কিন্তু অবাক বিস্ময়ে দানব আর দেবতা’র ফারাক ক্রমেই বিলীণ হয়ে যাচ্ছে। প্রহসনের বিচারে দানবেরা রূপ বদলাচ্ছে আবার। চিরতরে নিকেশ করার বদলে দানবের দলের সংশোধনের পালা শুরু হোল। এবং আবার সেই বোবা মানুষদের রক্ত চোষার নেশায় দানবের পদ চুম্বন; এই শুরু হোল বলে। নিকষ কালো পুরনো হতাশা।
বিদ্রোহী ছন্নছাড়া’রা শান্ত হয়ে গেল। তারুণ্য আজ অদ্ভুত শান্ত। অদ্ভুত বিষন্ন সময়।
ঝড় আসছে...
৯
আর মহাকাশ চিরে এল প্রবল মত্ত ঝড়। হিংস্র কাল বৈশাখীর শতগুণ তীব্রতা নিয়ে। বিদ্রোহী ছন্নছাড়া’দের ঝড়। বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ড সব তছনছ করে দিতে লাগল সেই ঝড়। মহাবিশ্বের প্রতিটি পাতা, প্রতিটি পাথর, প্রতিটি মানুষ কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল সেই পাগলা ঝড়ে। জিউসের বজ্র আঘাত হেনে চিরে ফেললো পসাইডনের মহাসমুদ্র।
একসময় থেমে এল ঝড়। ভীত বোবা মানুষেরা একে একে আশ্রয় থেকে বেরুতেই তাদের চোখে পড়লো এক অদ্ভুত দৃশ্য। বেমানান শান্ত সৌম্য ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে বিদ্রোহী ছন্নছাড়া’র দল। আর তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে কাঁপছে সব দানবেরা। সৃষ্টিজগত মন্থন করে একটি একটি করে খুঁজে আনা হয়েছে আজ সব।
১০
উত্তাল জনসমুদ্র। চাপা নিঃশ্বাস। উত্তেজনা। অতৃপ্ত প্রেতাত্মারা আবার ভীড় জমাচ্ছে সীমানায়।
আজ বিচার হবে!
মুক্তদেশের রাজ বাগিচায় আজ সব দানবের বিচার হবে! স্বপ্ন দেখা, স্বপ্ন না দেখা সব বোবা মানুষের আদালতেই আজ বিচার হবে!!
উতসর্গ - শাহবাগ চত্বর, আর সারা দেশ'কে যারা শাহবাগ চত্বর রূপে রূপায়িত করে ফেলেছে, সেইসব বিদ্রোহী ছন্নছাড়া'দের উদ্দেশ্যে
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২৫