পশুপতিনাথ মন্দিরঃ- কাঠমান্ডুর পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে পবিত্র বাগমতি নদীর তীরে প্রসিদ্ধ হিন্দুতীর্থ পশুপতিনাথ মন্দির অবস্থিত। নেপাল তথা সমগ্র হিন্দু তীর্থযাত্রীদের সবচেয়ে পবিত্র স্থান। হিন্দু ধর্মাবলম্বী সবার এই শেষ ইচ্ছে থাকে, তার শেষকৃত্য যেন পশুপতিনাথ মন্দিরে করা হয়।
মন্দিরটি ভগবান পশুপতিনাথের জন্য স্থাপিত। এটি ইউনেসকোর “বিশ্ব ঐতিহ্য” (ওয়ার্ড হেরিটেজ) -এর তালিকায় রয়েছে।
পশুপতিনাথ মন্দিরের উৎপত্তি নিয়ে বহুবিধ কাহিনী প্রচলিত আছে। একটি কাহিনী এরকমঃ- শিব এবং পার্বতী তাদের মর্তে সফরকালে কাঠমান্ডু ভ্যালীতে এসেছিলেন এবং বাগমতি নদীর তীরে বিশ্রাম করছিলেন। শিব কাঠমান্ডু ভ্যালীর সৌন্দর্যে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তারা (শিব এবং পার্বতী) হরিণের রুপ ধারন করে বনের মাঝে ঘোরাঘুরি করতে থাকেন। কিছু সময় পর অন্য দেবতারা তাদেরকে খুঁজতে থাকেন। অনেক সমস্যার পরে তারা বনের মাঝে শিবকে খুঁজে পান। কিন্তু শিব ফিরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি ঘোষণা দেন যে, যেহেতু তিনি একটি হরিনের রূপ নিয়ে বাগমতি নদীর তীরে অবস্থান করেছেন, তিনি এর পর থেকে বনের সম্রাট পশুপতিনাথ নামে পরিচিত হবেন।
সেই বাগমতির তীরেই পশুপতিনাথ মন্দির স্থাপিত হয়। বলা হয়, ওই মন্দিরে যে শিবলিঙ্গ রয়েছে, সেটি স্পর্শ করলে পরবর্তি জীবনে কেউ কোন পশুর রূপে জন্মগ্রহন করবে না।
রুপার তৈরি কারুকার্য করা দরজা আর গিলটি করা প্যাগোডাধর্মী মন্দিরের গর্ভগৃহে কালো পাথরের পঞ্চমুখী লিঙ্গ রূপী মহাদেব পূজিত হন। গর্ভগৃহে সাধারনের প্রবেশ নিষেধ, তাই চারদিকের চার দরজা দিয়ে লিঙ্গমুর্তির চতুর্মুখ দেখা গেলেও পঞ্চম মুখের দেখা মেলে না ভক্তদের। প্রতিমাসের একাদশীতে যাত্রী সমাগম হয় অন্য দিনের চেয়ে বেশী। আর শিবরাত্রিতে জমকালো উৎসব হয়। পবিত্র বাগমতির জলে পুণ্যস্নান সেরে পূজা দেয় ভক্তরা শিব/মহাদেবের উদ্দেশ্যে। ভক্তরা বিশ্বাস করে, পশুপতিনাথ দর্শনার্থীদের রুদ্রাক্ষের জপমালা কিনতে হয়, না হলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় দর্শন। নন্দী, ভৃঙ্গী, ভৈরব, বীরভব, গনেশ প্রভৃতি মহাদেবের পার্শ্বচরেরাও আছেন এ চত্বরে। এই মন্দিরে অদূরেই মহাশ্মশান।
অহিন্দুদের প্রবেশ নিষেধ। তাই আমরা "দাহ করা" দেখেছি বাগমতি নদীর অপর তীর থেকে। নদীর উপরে ব্রীজ। মূল মন্দির আর শ্মশান নদীর এক পাড়ে। বাগমতি নদীটি এখন প্রায় খালের আকার ধারন করেছে। আমাদের সাথে অনেক দেশ বিদেশের পর্যটক ছিলেন।
পশুপতিনাথ মন্দিরে তোলা কিছু ছবি আজ পোষ্ট করলামঃ-
পশুপতিনাথ মন্দির (মূল মন্দির)
পশুপতিনাথ মন্দির কমপ্লেক্স
পশুপতিনাথ মন্দির কমপ্লেক্সে এমন ছোট ছোট অনেক মন্দির দেখা যায়
মন্দিরে এমন হনুমান স্তম্ভ এখানে সেখানে দেখা যায়
জীবনে আমি এই প্রথম দেখলাম শ্মশানঘাট; এত কাছে থেকে একটি মৃতদেহকে সৎকার করা। নদীর তীরে সারি সারি চিতার বেদী। অনেক চিতা তৈরি করা হয়েছে। কিছু জ্বলছে, কিছু নতুন। কোনোটা থেকে ধোঁয়া উঠ্ছে, কোনোটা থেকে মাথার খুলি ফেটে যাওয়ার শব্দ আসছে। কোথাও সন্তানের বুকফাটা কান্না, কোথাও সন্তান চিতায় আগুন দিচ্ছে। খুব কষ্ট নিয়ে দেখলাম এই “দাহ প্রথা” আর সেই মৃত আত্মার শান্তি কামনা করলাম!!! একপাশে সারি সারি ছোট ছোট মন্দির। এখানে সম্ভ্রান্ত পরিবার/রাজ পরিবারের মৃতদের দাহ করা হয়েছে। সেখানে ছোট করে মন্দির তৈরি করা হয়েছে। এই মন্দিরগুলোকে চৈতা মন্দির বলা হয়। চিতার উপরের মন্দির, তাই এর নাম চৈতা মন্দির।
মৃতদেহ চিতায় আনা হচ্ছে
মৃতদেহ চিতায় রাখা হলো
হালকা জ্বালানী খড় দিয়ে ঢেঁকে, পরিধেয় শেষ বস্ত্রটিও খুলে নেওয়া হলো
সন্তানের বুকফাটা কান্না
হাতে হাত ধরে সম্ভবতঃ প্রার্থনা করছেন
চিতার চারপাশে আগুন নিয়ে ঘুরে, আগুন লাগানো হচ্ছে
সন্তান আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছেন
জ্বলে উঠলো চিতা
জ্বলছে চিতা
একসময় পুড়ে নিঃশেষ
আরও আসছে মৃতদেহ
আরো চিতা সাজানো হচ্ছে
চৈতা মন্দির
আমি এই ব্রীজের এপাশ থেকে ছবিগুলো তুলেছি
নদীর এপারে (মূল মন্দিরের বিপরীতে) আরো অনেক মন্দির আছে যা আমরা দেখলাম, ঢোকার অনুমতি আছে। তার মধ্যে রাম মন্দির উল্লেখযোগ্য। রাম মন্দিরের পাশে একজন ‘রামভক্ত হনুমান’ সেজে আছেন। ভক্তরা অনেকে তার কাছে আশীর্বাদ নিচ্ছে্ন, সাথে ছবিও তুলছেন। কিছু সাধুবাবা পুরোদস্তুর সাধু-সন্নাসী সেজে বসে আছেন। ছবি তোলার অনুমতি চাইলাম, সুন্দর পোজ দিলেন। ছবি তোলার পরে তাদের বকশিশও দিতে হলো।
রামভক্ত হনুমান
ভক্তরা হনুমানের আশীর্বাদ নিচ্ছেন
মন্দির প্রাঙ্গনের সাধুবাবা
গত ২৫শে এপ্রিল/২০১৫-এর ভুমিকম্পের পরে এই পশুপতিনাথ মন্দিরের শত শত চিতার বেদীতে হাজারো মৃতের সৎকারের স্থান সংকুলান হয়নি।এই নদীর পাড়ে, খোলা মাঠে তাদের দাহ করা হয়েছে। সেই হাজার হাজার মৃত আত্মার মুক্তি কামনা করি, পরকালে শান্তি কামনা করি!!!!
*********************************************************
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০২০ বিকাল ৩:৫৩