somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নবরত্ন মন্দির – সিরাজগঞ্জ।

০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




কয়েকদিন আগে প্রোগ্রাম হলো পাবনা যাব। বেশ কিছুদিন যাওয়া হয় না! চললাম পরিবারের সবাই। দু’দিন পাবনা থেকে ফেরার পথে সিরাজগঞ্জে ঢুকবো, ঠিক হলো নবরত্ন মন্দির দেখে তারপরে সিরাজগঞ্জ যাব। নবরত্ন মন্দিরের সামনে যেয়ে আমিতো অবাক! হুবহু কান্দজীর মন্দির! খুব ছোটবেলায় দেখেছিলাম, ভাঙাচোরা মন্দিরটি। সংস্কারের পরে আমি আর দেখি নাই।

সিরাজগঞ্জ জেলায়, প্রায় পাঁচশ বছরের পুরানো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির। উল্লপাড়া উপজেলার হাটিকুমরুল ইউনিয়নে এই মন্দিরের অবস্থান।

সিরাজগঞ্জ-বগুড়া মহাসড়কের হাটিকুমরুল বাস স্টেশন। দুইপাশের ধান ক্ষেতের বুক চি্‌ড়ে, সেখান থেকে ছোট্ট একটি মেঠো পথ আঁকাবাঁকা হয়ে চলে গেছে উত্তর পূর্ব দিকে। এই পথে প্রায় এক কিলোমিটার গেলেই দেখা মিলবে পোড়ামাটির কাব্যে গাঁথা অনন্য এক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এই পথে বর্ষাকালে গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এই এলাকার মাটি রৌদ্রে শুকিয়ে গেলে সিমেন্টের মত শক্ত হয়ে যায়, আবার একটু বৃষ্টি পেলেই হাঁটু পর্যন্ত কাদা হয়ে যায়। এই মন্দির সংস্কার এবং রক্ষনাবেক্ষন করছেন স্বয়ং প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর! রাস্তা সংস্কারের দায়িত্ব কাদের, আল্লাহ্‌ই জানেন! বাংলাদেশে যতগুলো পর্যটন স্পট আছে, তার অধিকাংশেরই রাস্তার এই দশা।

(২)

(৩)

তিনতলা বিশিষ্ট এই মন্দিরের চারপাশের দেয়ালে পোড়ামাটির অলঙ্করণে ভরপুর, বাইরে থেকে দেখতে অনেকটাই কান্তজীর মন্দিরের মতো। স্থানীয়ভাবে দোলমঞ্চ নামে পরিচিত, এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবরত্ন মন্দির।


বাংলাদেশে প্রাচীন যেসব হিন্দু মন্দির দেখতে পাওয়া যায় সেগুলোর অন্যতম একটি এই হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির। হিন্দু স্থাপত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন কারুকার্যমন্ডিত নবরত্ন মন্দিরটি উঁচু একটি বেদীর উপর নবরত্ন পরিকল্পনায় নির্মিত, মন্দিরের প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ১৫.৪ মিটার এবং প্রস্থে ১৩.২৫ মিটার। ক্রমহ্রাসমান তিনতলা বিশিষ্ট, এই স্থাপনার উপরের রত্ন বা চূড়াগুলো প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। মূল মন্দিরের বারান্দার বাইরের দিকে ৭টি এবং ভিতরের দিকে ৫টি খিলান বা প্রবেশ পথ। মন্দিরের মূল কক্ষটি বেশ বড়। নীচতলায় ২টি বারান্দা বেষ্টিত একটি গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহের পূর্ব ও দক্ষিন দিকে ২টি প্রবেশ পথ রয়েছে। মন্দিরের ২য় তলায় কোন বারান্দা নেই। ভিতর থেকে মূল ভবনের উপরের ছাদ গোলাকার গম্বুজে আচ্ছাদিত। বর্গাকার এই মন্দিরের আয়তন ১৫ দশমিক ৪ বর্গমিটার। একসময়ে মন্দিরে নয়টি চূড়া ছিলো বলে নবরত্ন মন্দির হিসেবে এটি পরিচিতি পায়।


(৪)

(৫)

(৬)

(৭)


মূল অবস্থায় মন্দিরটি পোড়ামাটির চিত্রফলক দ্বারা সজ্জিত ছিল। এখনও মন্দিরের গায়ে সামান্য কিছু চিত্রফলকের চিহ্ন দেখা যায়। মন্দিরটির ছাদপ্রান্ত আংশিক বাঁকানো।

মন্দিরের নির্মাণ সময় সম্পর্কিত কোনও শিলালিপি পাওয়া যায়নি। তবে কিছু পাঠজাত বিবরণ থেকে জানা যায় যে, নবাব মুর্শিদকুলি খানের শাসনামলে, রামনাথ ভাদুরী নামে জনৈক তহসিলদার ১৭০৪-১৭২৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে, মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। অনেকের মতে রামনাথ জামিদার ছিলেন।


(৮) মন্দিরের স্তম্ভের উপরে পোড়ামাটির সুশোভিত চিত্র ফলক।


মন্দিরের বিশাল চত্বরে বিক্ষিপ্তভাবে আরও ৩টি মন্দির রয়েছে। নবরত্ন মন্দিরের উত্তর পাশেই শিব-পার্বতী মন্দির, তার পাশেই রয়েছে দোচালা চণ্ডি মন্দির, দক্ষিণপাশে পুকুরের পাড় ঘেঁষে রয়েছে পোড়ামাটির টেরাকোটা কারুকার্যখচিত শিবমন্দির। বহুকাল ধরে মহা ধুমধামে এ ৪টি মন্দিরেই পূজা অর্চনা করা হতো। কালের বিবর্তনে ভারত উপমহাদেশে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি, দেশ বিভাগ ও নানা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে হারিয়ে যায় জমিদারের পূর্ব পুরুষরা। অরক্ষিত এ নবরত্নের অনেক মূল্যবান প্রাচীন সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায় দেশি-বিদেশি দুর্বৃত্তরা। স্বাধীনতার পর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ পর্যায়ক্রমে বের করে নিয়ে আসে এর প্রাচীন সৌন্দর্য্য। সবগুলো মন্দিরেরই বর্তমানে দেখাশোনা করছেন সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।


(৯) এটি শিব মন্দির।

(১০)

(১১)

(১২) পোড়ামাটির টেরাকোটা কারুকার্যখচিত শিবমন্দিরটি।

(১৩)

(১৪)শিব-পার্বতী মন্দির।

(১৫) দোচালা চণ্ডি মন্দির।


এ মিন্দরের নির্মাণ নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে এ অঞ্চলে। কথিত আছে, দিনাজপুরের রাজা প্রাণনাথের কাছের মানুষ হয়েছিলেন জমিদার রামনাথ ভাদুরী। প্রাণনাথ দিনাজপুরে ঐতিহাসিক কান্তজী মন্দির নির্মাণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে সংকটে পড়েন। ফলে বছরের রাজস্ব পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়ে পড়েন। সে সময় তাকে সাহায্যে এগিয়ে আসেন বন্ধু রামনাথ ভাদুরী। নিজ কোষাগারের টাকা দিয়ে রাজা প্রাণনাথের বকেয়া শোধ করে দেন তিনি। তবে এই অর্থ ফেরতের শর্ত হিসেবে, দিনাজপুরের কান্তজী মন্দিরের রূপ্‌ হাটিকুমরুলে একটি মন্দির নির্মাণের অনুরোধ জানান। রামনাথ ভাদুরীর শর্তানুসারেই রাজা প্রাণনাথ কান্তজীর মন্দিরের অবিকল নকশায় হাটিকুমরুলে এ নবরত্ন মন্দির নির্মাণ করে দেন। এ মন্দির নির্মাণকালে প্রতিটি ইট ঘিয়ে ভেজে তৈরী করা হয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

আবার অনেকের মতে রাখাল জমিদার হিসেবে পরিচিত রামনাথ ভাদুরী তার জমিদারীর সঞ্চিত অর্থ দিয়েই এ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।

(১৬)মন্দিরের সামনে স্থাপিত পরিচিতি ফলক ।

(১৭)

(১৮) মন্দিরের বিভিন্ন দিকের সৌন্দর্য্য।


***ছোটবেলায় বাড়ি এলে দাদির কাছে গল্প শুনেছি, মন্দিরের পেছনে বিশাল একটি পুকুর আছে। সেই পুকুরে অনেক বড় ধন-রত্ন ভরা একটি সিন্দুক ডুবানো আছে। সেই সিন্দুক উপরে ওঠানো যায় না। কয়েকটা হাতির পায়ে (কয়টা মনে নেই) দড়ি বেঁধে, সিন্দুকের সাথে সেই দড়ির অপর প্রান্ত বেঁধে, সিন্দুক তোলার চেষ্টা চলতো। সিন্দুক উপরে ভেসে উঠত ঠিকই কিন্তু ভেসে ওঠার সাথে সাথেই হাতিগুলো চিৎকার কর মাটিতে পড়ে যেত। সেই সিন্দুক আজও তোলা হয়নি, ঐখানেই আছে!!!

(১৯) মন্দিরে পেছনের সেই ঐতিহাসিক পুকুরটির বর্তমান অবস্থা!

*** মায়ের কাছে আরেক গল্প শুনেছিঃ- নায়েব রামনাথ ভাদুরী একদিন দুপুরে রাজবাড়ীর বাগানে, গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে ছিল। একটি বড় সাপ ফনা তুলে তার পাশে ছিল। রাজবাড়ি থেকে রানী ভবানী এই দৃশ্য দেখতে পেয়েছিলেন। রানী বুঝতে পেরেছিলেন এই রামনাথ এক সময় অনেক ধন-রত্নের মালিক হবে। তিনি একদিন রামনাথকে বলেছিলেন,”তুমি যদি অনেক সম্পদশালী হয়, তবুও কি আমাকে এখনকার মতই এভাবে ভক্তি শ্রদ্ধা করবে?” তার জবাবে রামনাথ সম্মতি জানিয়ে বলেছিল,”আমি যতদিন বেঁচে আছি, আপনাকে সম্মান দেখিয়ে যাব।“ সম্পদশালী হয়ে, রামনাথ ছয়তলা বিশিষ্ট এই নবরত্ন মন্দির তৈরী করেছিল আর তারই চিলেকোঠা থেকে রানী ভবানীর উদ্দেশ্যে প্রণাম করত। মন্দিরে তিন তলা ভুমিকম্পে মাটির নিচে দেবে গেছে, এখন উপরে আছে বাকি তিনতলা!!!

তথ্যসূত্রঃ মন্দির সংলগ্ন পরিচিতি ফলক।


ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:৪৬
৪৯টি মন্তব্য ৪৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

লিখেছেন আবু ছােলহ, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৮

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

গুগল থেকে নেয়া ছবি।

সামুতে মাল্টি নিক নিয়ে অনেকেই কথা বলেন। অনেকের কাছে মাল্টি যন্ত্রণারও কারণ। শুধু যন্ত্রণা নয়, নরক যন্ত্রণাও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×