মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ বাঙালি জাতির জীবনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এক ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশকে বিশ্বসমাজের কাছে তার নিজস্ব জাতিসত্তার বিকাশ ঘটানোর নব অভিযান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তাই আমাদের জীবনে সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং আবেগের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। যদি তাই না হবে তাহলে চল্লিশ দশক পার করেও কেন আমরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ‘তালিকা বিতর্ক থেকে মুক্ত হতে পারছি না।
দুঃখজনক হলেও পরশ্রীকাতর বাঙালি নিজের বিষয়টি ঠিক থাকলে অপরের বিষয়ে আর মাথা ঘামাতে যেন মোটেও আগ্রহী নয়। সেনাবাহিনীর পোশাক থাকলে সৈনিক সম্পর্কে আমরা কোনো প্রশ্ন করি না। অথচ সেনাবাহিনীতে রয়েছেন গাড়িচালক, পরিচ্ছন্ন কর্মী, চিকিত্সকসহ নানা বিভাগে কর্মরত নিরস্ত্র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক বিশাল অংশ, যারা কখনও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন না। তারা সবাই সেনাবাহিনীর মর্যাদা ভোগ করে থাকেন। তাহলে মুক্তিযোদ্ধার ব্যাখ্যা কী?
মুক্তিযুদ্ধ ছিল তাত্ক্ষণিক প্রয়োজনে আকস্মিক গতিতে সংগঠিত অসামরিক জনতার সমর্থনপুষ্ট সশস্ত্র বাহিনী। মাঠে, ঘাটে, হাটে, গ্রামে, গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিপ্লবীদের স্বতঃস্ফূর্ত সংগঠনই আমাদের ঐতিহাসিক ‘মুক্তিবাহিনীঽ। সাধারণ মানুষের বেশে ক্ষেতমজুর, চাষী, জেলে, কামার, কুমার, তাঁতির আবরণে আত্মপরিচয় গোপন করে পাশে অস্ত্র রেখে সারাদেশের অভ্যন্তরে তারা নানাভাবে যুদ্ধ করে মাতৃভূমি বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। নয় মাস যুদ্ধ করেই অনেকে প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন। কেউবা ভারতে আশ্রয় নিয়ে স্বল্পকালীন সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ‘থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে দেশে ফিরে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। কেউবা ভারতীয় পেশাদার সৈন্যদের সঙ্গে থেকে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
আত্মসম্মান বোধের দ্বিধায় অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা কখনও কোনো তালিকাভুক্ত হওয়ার কোনো ইচ্ছাই প্রকাশ করেননি। তাদের ধারণা ছিল, দেশের প্রয়োজনে তারা যুদ্ধ করেছেন। ইতিহাস রক্ষায় সরকারই নিজ দায়িত্বে সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা প্রস্তুত করবে। হিংসা, প্রতিহিংসা, অহঙ্কার মিলে প্রকৃত যোদ্ধারা অবহেলার শিকার হয়ে আজ বিদ্রূপের আঘাতে মর্মাহত। ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে আঞ্চলিক নেতার নির্দেশানুসারে বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করার কারণে অনেকের হাতে পরিচিতরা অস্ত্র দেখেননি বলে তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন, এমন অপবাদ সহ্য করা অনেকের পক্ষেই অসম্ভব হয়ে পড়ায় তারা আবেদন করে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি আদায় করাকে অপমানজনক মনে করেন। যারা সক্রিয় যোদ্ধা এবং যথাসময়ে নিজ নিজ কমান্ডারের মাধ্যমে সার্টিফিকেট গ্রহণ করেছেন এবং তালিকায় নাম প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তারাই আজ ধন্য। অথচ ভারতে শিক্ষা গ্রহণ করে সার্টিফিকেট সঙ্গে রেখে যারা তালিকাভুক্ত হতে পারেননি, তারা নিশ্চয়ই স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি ছিলেন না। এদের অবস্থান কোথায় থাকবে, এটী সবার প্রশ্ন।
পাকিস্তান কারাগার থেকে সদ্য-ফেরত শেখ মুজিব কোনো তথ্য ছাড়াই তাৎণিকভাবে সংখ্যা নিয়ে যে বক্তব্য দিলেন, এতে করে ঝুলে গেল সংখ্যা উদ্ধারের সব চেষ্টা। ফলে মুজিবের কথিত সংখ্যাই প্রতিষ্ঠা পেল। বিষয়টি দাঁড়াল, তাকে সম্মান জানানোর জন্য শহীদদেরও অসম্মান করা যাবে। ফলে নেতার কথা দৈববাণী হওয়ায় ৩০ লাখ না কত, সে বিতর্কে আটকে আছি ৪৪ বছর।
স্বাধীনতার দুই বছর পর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের দালাল আইনে বিচার এবং রাজাকার ও দালালদের শনাক্তকরণের দলিলের তথ্য সরকারের কাছে নেই। স্বরাষ্ট্র, আইন, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়, ঢাকার মহাফেজখানা, বিজি প্রেস, চলচ্চিত্র অধিদপ্তর (আর্কাইভ শাখা), কেন্দ্রীয় কারাগারের কাছে ওই সময় বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের বিচার এবং সংশ্লিষ্ট যাবতীয় প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের কথা থাকলেও তা নেই। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পরবর্তী সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদেরনির্দেশে ১৯৭৩ সালে দালাল আইনে করা মামলার নথিপত্র এবং রাজাকার ও দালালদের শনাক্তকরণের দলিল ধ্বংস করা হয়েছে। চিহ্নিত রাজাকারদের আড়াল করতেই অপকর্মের মাধ্যমে নথিপত্র গায়েব করা হয়েছে
আদৌ কখনো সরকার এসব তালিকা বাস্তবায়ন করবে , নাকি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ইস্যুগুলো বিতর্কিত রেখে দেবে ?
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:০৮