আমি দূর্বল চিত্তের মানুষ। এজন্য নেতিবাচক ও হতাশার সংবাদ বেশি থাকায় বাংলাদেশের পত্রিকা তেমন পড়া হয় না। তবে যদি দেশকে নিয়ে ইতিবাচক কোন সংবাদ পাই, পত্রিকায় সম্ভাবনার কিছু লেখা হয় তাহলে আশাবাদী হই, গর্বে আমার বুকটা ভরে যায়। নিজেকে সান্ত্বনা দেই এই বলে; খামখা দেশকে নিয়ে টেনশন করি, হতাশ হই। গর্ব করে বলি এটাইতো আমার সোনার বাংলা, এই তো চাই আমি। কোন কোন সময় একই নিউজ বারবার পড়ি, অন্যদের জানাতেও উৎসাহী হই। মনের মধ্যে একটি চৈতণ্য আসে, খুশিতে মুখটা উজ্জল হয়ে উঠে। গুগল, ইউটিউবে ''বাংলাদেশের ভবষ্যৎ সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো'', "বাংলাদেশ এমার্জিং নেশন" প্রভৃতি লেখে সার্চ দেই। এটা আমার দেশপ্রেম কিনা জানি না। তবে এই অধম দেশমাতৃকাকে অসম্ভব রকম ভালবাসে এটা বলতে পারি।
কয়েকদিন আগে ফেইসবুকে একটি নিউজ পড়ে অনেক কষ্ট পাই। নিউজটি পড়ে কেন যেন নিজেকে অসহায় মনে হলো, দেশটাকে অভিবাবক হীন মনে হলো আমার। মনে মনে ভাবি দেশটা কী শেষ পর্যন্ত দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ ও দখলদারদের ইচ্ছা মাফিক চলবে, নাকি দেশের প্রচলিত আইন দিয়ে চলবে? সংবাদটি এরকম-
একজন ট্রাক মালিক লিখেছেন; "টাঙ্গাইল থেকে খুলনা যেতে একটি মালবাহী ট্রাকে ১৯ জায়গায় চাঁদাবাজি হয়েছে! রীতিমতো রশিদ দিয়ে চাঁদাবাজি!! তিনি আরো যোগ করেন, এটি ডিজিটাল বাংলাদেশের ডিজিটাল চান্দাবাজি।"
পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি নিয়ে অনেকদিন থেকে লেখার ইচ্ছা ছিল। তবে ব্যস্ততার জন্য হয়ে উঠছিল না। ফেইসবুকের নিউজটি পড়ে অনেকটা বাধ্য হয়ে লেখতে বসা। সরকার যায়, সরকার আসে কিন্তু পরিবহনে চাঁদাবাজি কখনো বন্ধ হয় না, কেউ বন্ধ করে না। পরিবহনের কোথায় নেই চাঁদাবাজি? ট্রাক, বাস, মিনিবাস, পিকআপ, ভ্যান, লরি, লাইটেস, নোহা, টেম্পু, লেগুনা, সিএনজি ইত্যাদি বাহনগুলো প্রতিদিন চাঁদাবাজির শিকার হয়। মালিক ও ড্রাইভারদের কাছে নিয়মিত ঘটনা বলে তারা এটাকে অনেকটা বৈধ ও বাধ্যবাধকতা বলে ধরে নিয়েছেন। ইদানিং তো শুনি রিক্সায়ও চাঁদাবাজি হয়! তবে রিক্সাকে পরিবহনের তালিকায় ধরা যায় কি না জানি না। সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজির শিকার হয় আন্তঃনগর ট্রাক, বাস ও লরিগুলো।
সারা দেশে এক শ্রেণীর পরিবহন সংগঠন, পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক সংগঠনের সমন্বয়ে চলে বিরামহীন চাঁদাবাজি। জেলা শহরগুলোর তুলনায় রাজধানী ঢাকায় এ হার অনেক অনেক বেশি। রাজধানীতে শতাধিক পয়েন্টে প্রতিদিন চলে চাঁদাবাজির রমরমা ব্যবসা। চাঁদাবাজ এ চক্রটি এত ক্ষমতাবান ও বেপরোয়া যে গাড়ির মালিক ও ড্রাইভারদের চাঁদা না দিয়ে কোন উপায় থাকে না। সন্ত্রাসীরা সরাসরি চাঁদা নিলেও পরিবহণ শ্রমিকরা চাঁদা নেয় শ্রমিক কল্যাণের নামে রীতিমত রশিদ দিয়ে। আর পুলিশ চাঁদা নেয় মাসোহারা হিসাবে। এছাড়া আছে রেকার ভাড়া, রাস্তা ক্লিয়ার ফি, ঘাট ও টার্মিনাল সিরিয়াল, পার্কিং ফি নামে অবৈধ চার্জ। সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার নামেও দেদারসে চলে চাঁদাবাজি।
আমাদের সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে, রক্ষক যদি ভক্ষক হয় তাহলে সাধারন মানুষের ন্যায় বিচার পাওয়ার কোন সুযোগ থাকে না। সরকার বলতে আলাদা কোন বস্তু নেই; সরকারী অফিস-আদালত, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় সরকারের দপ্তর, চেয়ারম্যান-মেয়র-এমপি-মন্ত্রীর সমন্বয়ে একটি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা মাত্র। সবাই যার যার অবস্থান থেকে দেশের জন্য ভাল কাজ করলে রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণ সাধিত হয়। কিন্তু এরা সম্মিলিতভাবে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি করলে রাষ্ট্রের ভীত দূর্বল হয়। রাষ্ট্রের চেইন অফ কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে। সাধারন মানুষ শোষিত হয়, অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দেশী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারায়।
পরিবহনে চাঁদাবাজি থামাতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হওয়ার কথা ছিল পুলিশ প্রশাসনের। অথচ তারা মাসোহারার নামে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে। এ টাকার ভাগ পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পৌছায়। স্থানীয় ও জাতীয় কিছু প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ দেশব্যাপী সন্ত্রাসীদের সমন্বয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদা কালেকশন করেন। এসব চাঁদাবাজিতে স্থানীয় অনেক এমপি/মন্ত্রী জড়িত থাকেন বলেও অভিযোগ আছে। কেউ কেউ তো সরাসরি পরিবহন শ্রমিক নেতা। চাঁদাবাজির গড ফাদার অনেক পরিবহন নেতা আমাদের দেশে মন্ত্রী পর্যন্ত হয়। তাই পরিবহনে এসব চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট ভাঙ্গা আর 'অরণ্য রোদন' করা সমান কথা।
আমরা যখন কোন বিপদে পড়ি তখন পুলিশের দ্বারস্থ হই। কিন্তু যেখানে পুলিশ নিজেরাই চাঁদাবাজির মহাউৎসবে যোগ দিয়েছে সেখানে অভিযোগের, সমস্যা থেকে পরিত্রাণের কোন সুযোগ নেই। রাজধানী সহ সারা দেশের সড়ক মহাসড়কে যত্রতত্র পুলিশের বিশেষ চেকিং আর মাসোহারা আদায়ের প্রতিযোগিতা বন্ধের সাধ্য কারো নেই। অভিযোগ আছে রাজধানীর একপাশ থেকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে মালবাহী ট্রাক প্রতি ৫০০-৮০০ টাকা গুনতে হয়। তবে আন্তঃনগর বাসগুলোকে তার চেয়ে বেশি চাঁদা দিতে হয়। পুলিশের টোকেন বাণিজ্যও চলে সমান তালে।
দেশে প্রতিদিন গড়ে এক লক্ষ পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলে। এর কোনটিই পুলিশকে চাঁদা না দিয়ে চলতে পারে না। শুধু এ খাত থেকে পুলিশ প্রতিদিন কোটি টাকার উপরে চাঁদা কালেকশন করে। হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি, বিভিন্ন ফাঁড়ির পুলিশ, জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশ যৌথভাবে এটি করে থাকে।
দেশের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার পর্যাপ্ত যোগানের জন্য নিরাপদ ও দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে সস্তায় পণ্য পরিবহন ভোক্তা পর্যায়ে দাম সহনীয় রাখতে সহজ হয়। এতে দেশের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ উপকৃত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ধাপে ধাপে, নামে বেনামে চাঁদাবাজির ফলে পণ্যের পরিবহন খরছ বেড় যায়। এজন্য ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত পৌছিতে খরছ বেশি পড়ে। ক্রেতারা বাধ্য হয়ে বেশি দামে পণ্যটি কিনতে হয়।
সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে কাঁচামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে। অনেক সময় দেখা যায় কৃষকের কাছ থেকে যে পণ্যটি কিনতে পাইকারী ব্যবসায়ী কেজি প্রতি ১০ টাকা খরছ করেন, সেই একই পণ্য রাজধানী ও জেলা শহরগুলোতে বিক্রি হয় তিন/চারগুণ বেশি দাম। এক্ষেত্রে শুধু পরিবহন চাঁদাবাজি দায়ী নয়, পাইকারদের সিন্ডিকেটও দায়ী।
প্রতিবছর পরিবহণের লাইসেন্স ফি, রোড পারমিট, গাড়ির ফিটনেস ও ইন্সুরেন্সের জন্য মালিকরা হাজার হাজার টাকা খরছ করেন। বিআরটিএর মাধ্যমে সরকার এ টাকা কালেকশন করে। মালিকরা সারা বছর নির্বিঘ্নে গাড়িটি চালানোর জন্য সরকার নির্ধারিত এসব ফি প্রদান করে থাকেন। তাহলে প্রশ্ন হলো, প্রতিদিন ধাপে ধাপে এত চাঁদাবাজি কেন? এসব টাকা তো সরকারি কোষাগারে জমা হয় না। এ অন্যায়-অবিচার দেখার, প্রতিরোধ করার কী কেউ নেই? এজন্য বিআরটিএর কী কোন দায় নেই? অবশ্য বাংলাদেশের সবচেয়ে দূর্ণীতিগ্রস্থ সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকা করলে বিআরটিএর অবস্থান তালিকার উপরের দিকে থাকবে।
বিভিন্ন পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনের সময় প্রচারণা ও টাকা খরছের হিড়িক দেখলে বোঝা যায় এসব পদ কত লোভনীয়। পোস্টারে আর ব্যানারে ছেয়ে যায় পুরো এলাকা। চলে দেদারছে টাকা দিয়ে ভোট কেনার প্রতিযোগিতা। আমার পরিচিত একজন আন্তঃজেলা বাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আছেন। যিনি গত ২৩ বছর আগেও ছিলেন বাসের হেল্পার। পড়াশুনার হাতে খড়ি নাম দস্তখত পর্যন্ত। তবে এখন তার কাড়ি কাড়ি টাকা। শহরে আছে চার-পাঁচটি বহুতল ভবন। আছে নিজের ও পরিবারের নামে প্রচুর সম্পদ ও ব্যাংক ব্যালেন্স। তার দৃশ্যমান কোন পেশা/ব্যবসা নেই। তিনি নিজেকে বিশিষ্ট সমাজসেবী হিসেবে পরিচয় দেন। এখন তিনি নিজে ড্রাইভ করেন না। দামী প্রাইভেট কারের সাথে আছে নিজস্ব ড্রাইভার। রাজনীতিও করেন তিনি। তবে নির্দিষ্ট কোন দলের সাপোর্টার নন, তিনি সব সময় সরকারদলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত। যে দল ক্ষমতায় আসে সে দলের বড় নেতার আশীর্বাদে বহাল থাকে তার পদ/পদবী।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
উৎসর্গ: লেখাটি আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব জনপ্রিয় ব্লগার জনাব চাঁদগাজীকে উৎসর্গ করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৮ ভোর ৪:১৭