somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প লেখার সহজ পাঠ (শিক্ষা)

০১ লা জুলাই, ২০১৮ রাত ২:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পৃথিবীতে মানব জাতির গোড়াপত্তনের শুরু থেকেই গল্পের ভাবনা শুরু হয়। প্রতিটি মানুষের জীবন এক-একটি বড় গল্প; জীবনের প্রতিটি বাঁক এক-একটি গল্পের প্লট। জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা, উত্থান-পতন, চিন্তা-চেতনা, অজানা-কৌতুহল, চাওয়া-পাওয়া, জীবন-জীবিকা, আনন্দ-বেদনা ইত্যাদির মিলিত রুপ-ই গল্প। যে জীবনটাতে বৈচিত্র যত বেশি থাকে সে গল্পের গাঁথুনি তত মজবুত হয়, অলঙ্কার সমৃদ্ধ হয়। পাশাপাশি মানুষের জীবন-ভাবনার সাথে যোগ হয় প্রকৃতি, পরিবার, সমাজ, গোত্র, জাতি, ধর্ম ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার। অজানা আর কৌতুহল থেকে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন কল্প কাহিনী ও ভৌতিক চরিত্রের। আর এ সবগুলো মানব চরিত্রের সাথে মিশে বিভিন্ন ফ্লেভার যুক্ত করে অসংখ্য গল্পের জন্ম দেয়। সভ্যতার বিকাশের আগ পর্যন্ত এসব গাল-গল্প মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হত। মানুষ লেখতে শেখার সময় থেকে গল্পগুলো লেখ্য রীতিতে স্থানান্তর শুরু হয়; যার ফলশ্রতিতে গল্প এখন কথা সাহিত্যের অন্যতম অধ্যায় হিসাবে প্রচলিত।

পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোতে অনেক দিন থেকে গল্প লেখার প্রচলন শুরু হয়। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় শিল্প-সাহিত্যের চর্চা সবচেয়ে বেশী হতো বলে সেখানে গল্প লেখার প্রচলনও সর্বপ্রথম শুরু হয়। অন্যন্য উল্লেখযোগ্য প্রাচীন সভ্যতা গুলো হলো- ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা, হিব্রু সভ্যতা, গ্রীক সভ্যতা, রোমান সভ্যতা এবং ইনকা সভ্যতা।

বাংলা কথা সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা হলো ছোট গল্প। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলা সাহিত্যে এ ধারাটি সংযুক্ত হয়। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বাংলা ছোট গল্পের জনক বলা হয়। আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রণাথ ঠাকুর হলেন বাংলা তথা বিশ্ব সাহিত্যের ছোট গল্পের অন্যতম "কথা শিল্পী"।

ছোটগল্পের প্রকৃতি সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর "বর্ষাযাপন" কবিতায় বলেছেন-

"ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা ছোটো ছোটো দুঃখকথা
নিতান্তই সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত,
অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল,
অকালের জীবনগুলো, অখ্যাত কীর্তির ধুলা,
কত ভাব, কত ভয় ভুল।"

ছোটগল্পের কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো- এর ক্ষুদ্রায়তনের মধ্যে বৃহতের ইঙ্গিত থাকবে; এর আরম্ভ ও উপসংহার হবে নাটকীয়; এর বিষয়বস্তু সাধারণত স্থান, কাল ও ঘটনার ঐক্য মেনে চলবে; এতে মানবজীবনের কোনো একটি বিশেষ মুহূর্ত, ভাব বা চরিত্রের একটি বিশেষ দিক উজ্জ্বল হয়ে উঠবে; যেকোনো ধরনের বাহুল্য বর্জনের মাধ্যমে গল্পটি হয়ে উঠবে রসঘন; এতে থাকবে রূপক বা প্রতীকের মাধ্যমে অব্যক্ত কোনো বিষয়ের ইঙ্গিত ইত্যাদি। সর্বোপরি গল্প সমাপ্তির পরেও পাঠকের মনের মধ্যে এর গুঞ্জরণ চলতে থাকবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায় বলতে পারি, "শেষ হয়েই হইল না শেষ"। এমনটি হলেই তা স্বার্থক ছোটগল্পে পরিণত হবে।

ছোটগল্পের সংজ্ঞা নিয়ে সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে। অনেকের মতে, যে গল্প অর্ধ হতে এক বা দুই ঘন্টার মধ্যে এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, তাই ছোট গল্প। তবে বেশিরভাগ আধুনিক কথা সাহিত্যিকদের মতে, ছোটগল্প ১০ থেকে ৫০ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া বাঞ্চনীয়। বিশ্ব বিখ্যাত আমেরিকান গল্পকার ''এডগার এলান পো'' (Edgar Allan Poe) ছোট গল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, A short story should be read in one sitting; anywhere from a half hour to two hours.

বাংলা ছোটগল্পের স্বার্থক রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর ''ঘাটের কথা'' ছোটগল্পটি বাংলাভাষার প্রথম সার্থক ছোটগল্পের স্বীকৃতি পেয়েছে। অতঃপর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বনফুল (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়), বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, জগদীশ গুপ্ত, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, মনোজ বসু প্রমুখের রচনা নৈপুণ্যে বাংলা ছোটগল্প নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে।

পৃথিবীর সেরা গল্পকারদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করলে সবার আগে আসবে মার্কিন "এডগার এলান পো"-র (Edgar Allan Poe) নাম। এছাড়া বিখ্যাত গল্পকারদের মধ্যে অন্যতম হলেন; চেক রিপাবলিকের "ফ্রেঞ্জ কাফকা" (Franz Kafka); রাশিয়ান "এন্থন চাখাব" (Anton Chekhov); যুক্তরাষ্ট্রের "মার্ক টুয়েন" (Mark Twain); "আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ে" (Ernest Hemingway); "উইলিয়াম ফকনার" (William Faulkner); আর্জেন্টাইন স্পেনিশ ভাষার লেখক " জর্জ লুইজ বার্জেস" (Jorge Luis Borges); বাঙালি "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর"; আইরিশ "জেমস জয়েস" (James Joyce); রুশ "লিও টলস্টয়" (Leo Tolstoy); "উইলিয়াম সমারসেট মম" (W. Somerset Maugham); যুক্তরাষ্ট্রের "ফ্লানেরি ও'কোনার" (Flannery O'Connor); ফরাসি "গাই দ্যা মোফাসাঁ (Guy de Maupassant); জাপানের হারুকি মুরাকামি (Haruki Murakami); ইউক্রেনের "নিকলাই গোগল ভিলকি সোরসিনছি" (Nikolai Gogol Velyki Sorochyntsi); কলম্বিয়ান "গ্যাবরিয়েল গার্সিয়া মারকুইজ" (Gabriel García Márquez); ফরাসি তোরভিলে-ছুর-আরকুয়েজ" (Tourville-sur-Arques)।

লেখক হওয়ার বিষয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি নিবন্ধে লেখেন, "রাতারাতি লেখক হওয়ার ম্যাজিকে আমি বিশ্বাস করি না; লেখক হতে হলে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করতে হয়। আর এ প্রস্তুতি শুরু হয় সাহিত্য ও জীবন নিয়ে লেখকের চর্চা ও ভাবনা থেকে; আর এসব ভাবনা কলমের ছোয়ায় শৈল্পিক উপায়ে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে। এটি একটি শিল্প; অন্যভাবে বললে,"কথাশিল্প"। এ শিল্পের একজন দক্ষ কারিগর হতে প্রয়োজন জ্ঞান অর্জন, জীবন দর্শন ও লেখার অনুশীলন। এর কোন বিকল্প বা সর্টকার্ট পথ নেই।

এ বিষয়ে প্রয়াত হুমায়ুন আহমদ স্যারের গল্পকার হয়ে উঠার কাহিনীটা শেয়ার করা যায়; ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ার সময় থেকে তিনি পাঠ্য বইয়ের পরিবর্তে অপাঠ্য বই বেশী পড়তেন। তিনি বলেন, "স্কুলের পাঠ্য বই পড়তে মোটেও ভাল লাগতো না আমার; হাতের কাছে যে বইটি পেতাম বাছ-বিচার না করে তা মনযোগ সহকারে পড়তাম। বিশেষ করে গল্পের বইয়ের প্রতি আমার খুব ঝোঁক ছিল। পাশাপাশি, যে বিষয়টি ভাল লাগতো তা নিয়ে লেখতাম আমি; লেখার ভাল-মন্দ বিচার করতাম না। এভাবেই লেখালেখিতে আমার হাতে খড়ি।"


বাংলা ছোট গল্পের আরেক নক্ষত্র শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখালেখির প্রেরণা পান তাঁর বাবার কাছে থেকে। স্কুলে পড়ার সময় থেকে তিনি বাড়ির আলমারীতে রাখা বাবার সংগৃহীত গল্পের বইগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তেন। তিনি বলেন, " একদিন বাবার ভাঙ্গা আলমারি থেকে চুপিচুপি বের করলাম "হরিদাসের গুপ্তকথা"; বইটি একটু পরিণত বয়সের পাঠকদের জন্য লেখা। এজন্য বাবা যাতে টার না পান সেজন্য গোয়াল ঘরে গিয়ে বইটি পড়তে হয়েছিল!" আরেকটি কথা, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাবার লেখালেখির অভ্যাস ছিল। কিন্তু লেখাগুলো সমাপ্ত না করেই তিনি আলমারিতে রেখে দিতেন। বাবা যখন বাড়িতে থাকতেন না তখন কিশোর শরৎচন্দ্র এসব অসমাপ্ত লেখাগুলো পড়তেন এবং পরবর্তী কাহিনী কী হতে পারে তা নিয়েই সারাদিন ভাবতেন; ভাবনা শেষ হলে চুপি চুপি নিজের মতো করে লেখতেন।

....................গল্পের প্লট,
প্লট মানে পর্সন বা খন্ডাংশ বুঝায়; অপরদিকে গল্পের প্লট বলতে বাঁক, কৌশল, অলঙ্কার, সিকুয়েন্স ইত্যাদি বুঝায়। একটি গল্পকে কাহিনী হিসাবে উপস্থাপন করা হয় বিভিন্ন প্লট বা টুইস্টের মাধ্যমে। গল্পের ঘটনাগুলো কেন ঘটছে তা জানা যায় গল্পের প্লট বা বাঁক থেকে; আর এই প্লটগুলো পাঠককে গল্প পড়তে প্রেরণা যোগায় এবং তাদের মনযোগকে আকৃষ্ট করে গল্পের গভীরে নিয়ে যায়। আর এর মাধ্যমে পাঠক মূল চরিত্রের পরিণতির ইঙ্গিত পান; এগুলো পাঠককে কৌতুহলী বানায়। এগুলো হলো গল্পের অলঙ্কার; লেখক চরিত্রের প্রয়োজনে এসব অলঙ্কার শৈল্পীকভাবে গল্পে উপস্থাপন করেন।

গল্পের প্লটকে উপকরণ, উপাদান, অনুসঙ্গ ইত্যাদি যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এই প্লটের উপরই গল্পের ভীত রচিত হয়; এটাকে অনেকে গল্পের ফ্রেমওয়ার্ক বলে থাকেন। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্লটগুলো প্রধান চরিত্রের সাথে মিশে গল্পের অলঙ্কার বাড়িয়ে কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যায়; এর পাশাপাশি যুক্ত হয় একটি ছোট্ট কাহিনী/সমস্যা, আর সেই সমস্যাটিকে সমাধান করতে উপস্থিত হয় আরেকটি চরিত্র। আর এসব ঘটনা ও চরিত্রের আবর্তে ঘুরতে থাকেন লেখক-পাঠক উভয়ই।

কথা সাহিত্যিকরা গল্পের প্লটকে চারভাগে বিভক্ত করেছেন-
(১) এক্সপজিশন (ভূমিকা/শুরু)
(২) কম্পলিকেশন (জটিলতা)
(৩) ক্লাইমেক্স (দ্বন্দ্ব-সংঘাত)
(৪) রি-সল্যুশন (চূড়ান্ত পরিণতি)।

তবে গল্প লেখায় একই নিয়ম বা ফর্মুলা মেনে চলতে হবে তা কিন্তু নয়; গল্প লেখায় লেখকের অনেক স্বাধীনতা থাকে যা অন্য বিষয়ে লেখতে তেমন পাওয়া যায় না।

যদিও আমাদের সাহিত্যে গল্পকে একটি নির্দিষ্ট ছকে ফেলা হয়; তবে বিশ্ব সাহিত্যে গল্পের ধরাবাঁধা কোন ছক নেই। ফরাসি, স্পেনিশ, পর্তুগীজ, জার্মান, রুশ ও পার্সিয়ান সাহিত্যের গল্পগুলো পড়লে তা বুঝা যায়। আধুনিক বাংলা গল্পের পথিকৃত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন গল্প লেখা শুরু করেন তখন সমসাময়িক লেখকরা তাঁকে নিয়ে টাট্টা মশকরা করতেন। স্বীকৃতি পেতে উনাকে ধৈর্য ধরে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এছাড়া, হুমায়ুন আহমদ স্যার সবচেয়ে বেশি খ্যাতি পেয়েছেন উপন্যাস নয়, ছোট গল্প লেখে। উনার লেখার স্টাইল কারো সাথে মিলে না। কিন্তু পাঠক মুগ্ধ হয়ে উনার গল্পগুলো পড়েন। গল্পের ভাষা ও টুইস্টগুলো খুব সহজ হওয়ায় সব শ্রেণীর পাঠক তা বুঝতে পারেন। তিনি যখন প্রথম গল্প লেখা শুরু করেন, অনেকে এটিকে নিছক পাগলামি বলেছেন।

অনুগল্প, ছোট গল্প ও বড় গল্পের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। ছোট গল্পে প্রতিটি চরিত্রের গভীরে যাওয়ার সুযোগ নেই বড় গল্পের মত। এজন্য লেখককে বিষয়বস্তুর দিকে সবচেয়ে বেশি মনযোগী হতে হয়। কঠিন কথাটি আরো কঠিন করে নয়, কঠিন কথাটি আরো সহজতর করে বলা ও সমাজে সুন্দর একটি ম্যাসেজ দিতে পারাটাই গল্পের সার্থকতা। তবে সব গল্প শিক্ষনীয় ও টুইস্ট নির্ভর হতে হবে তা কিন্তু নয়; নিছক আনন্দের জন্যও গল্প লেখা যায়। তবে গল্পটি হতে হবে সহজপাঠ্য।

.....................গল্প লেখার শুরু,
আমরা সবাই কিন্তু কমি বেশী গল্প জানি; চাইলে দুই-চারটি গল্প আমরা অনায়াসে বলতে পারি; তাই না? কিন্তু যদি বলা হয়, আপনার জানা যে কোন একটি গল্প লেখে দেন তো!! পারবেন? আপনার জবাব হবে, না ভাই এইসব লেখালেখি আমার দ্বারা হবে না। এর কারণ কী জানেন? কারণ হলো আপনি কখনো গল্প লেখেন নাই অথবা জানেন না কিভাবে গল্প লেখতে হয়। গল্প বলা যতটুকু সহজ গল্প লেখা ঠিক ততটুকু কঠিন; এছাড়া গল্প লেখতে নিজে থেকে গল্পের কাহিনী বানাতে হয়। গল্প লেখা সাহিত্যের সবচেয়ে কঠিন বিষয়। এজন্য যে কোন বিষয়ে লেখালেখি শুরুর আগে লেখালেখির অভ্যাস থাকাটা জরুরী। আপনি যত লেখবেন লেখার হাত তত পাকা হবে; এটি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ফিচার যে কোন বিষয়ের উপর হতে পারে।

আপনি যদি মনে করেন জীবনের প্রথম লেখা গল্পটি হিট হবে; সবাই বাহবা দেবে তাহলে আপনাকে গল্প লেখা ছেড়ে দিতে হবে। এটা অনেকটা অভিনয়ের মতো। অভিনয় করতে করতে অভিনয় শিল্পীরা বিভন্ন চরিত্রে অভিনয় করতে নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তোলেন; এই অভিজ্ঞতা এক দিনে হয় না, এজন্য বছরের পর বছর অভিনয়টা চালিয়ে যেতে হয়। একজন কথাশিল্পীকেও এই নিয়মের মধ্যে দিয়ে উঠে আসতে হয়। এজন্য দরকার নিষ্ঠা, একাগ্রতা, জ্ঞান অর্জন এবং বিভিন্ন অখ্যাত-বিখ্যাত দেশী বিদেশী লেখকদের গল্প মনযোগ দিয়ে পড়া এবং চরিত্রগুলোকে নিজের মতো করে ভাবা।


গল্প লেখার বিষয় কী হবে? অথবা গল্পের কাহিনীর বিস্তার কিভাবে হবে তা নির্ভর করে লেখকের পছন্দ ও বিষয়টির উপর তার জানার পরিধির উপর। অনেকে বলে থাকেন গল্প লেখতে হলে বেশী গল্পের বই পড়তে হবে। আমি এ বক্তব্যের সাথে পুরোপুরি একমত নই। হ্যা, গল্প লেখতে হলে গল্প পড়তে হবে ঠিক আছে; কিন্তু গল্প লেখতে সবচেয়ে বেশী দরকার বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করা। এজন্য মানুষের জীবন-দর্শন, আবেগ-অনুভূতি; সাফল্য-ব্যর্থতা ইত্যাদি বিষয়গুলো জানাটা জরুরী। এছাড়া রাষ্ট্রনীতি, ভূগোল, সমাজনীতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান থাকাটা আবশ্যক। শুধু গল্প পড়ে গল্পের লেখক হওয়া সম্ভব নয়।

আপনি যে ভাষায় গল্প লেখতে চান, সে ভাষা ও সেই দেশ/জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানতে হবে; জানতে হবে মাটি, মানুষ ও প্রকৃতিকে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সেই ভাষার বিখ্যাত লেখক ও গবেষকদের বিষয়ে জানা; তাদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে পড়াশুনা করা। কোন কোন লেখার জন্য মাঝে মাঝে গবেষণা করাও জরুরী। যেমন, আপনি ঊনিশ শতকের প্রেক্ষাপঠে যদি কোন গল্প লেখতে চান, তাহলে গল্পের বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে সে সময়কার মানুষের আচার-ব্যবহার, সামাজিক পরিবেশ, পারিবারিক জীবন ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশুনা করা আবশ্যক।

অনেকে বলে থাকেন, আপনার গল্পটি মৌলিক নয়!! সত্যি সত্যি কী আপনার গল্পটি মৌলিক হতে হবে? বিশেষজ্ঞদের মতে সারা পৃথিবীতে মৌলিক গল্প ১০-১২টির বেশি নেই!! কথাটি কতটুকু সত্য বলতে পারবো না; তবে যারা গল্প লেখতে চান তাদের উচিৎ এসব ভারী প্রশ্ন ও প্রশ্নকারীকে এড়িয়ে চলা। গল্পের কাহিনী নিজের অভিজ্ঞতা, সমাজ ও ইতিহাস যে কোন বিষয়ে হতে পারে। অথবা নিজের পড়া কোন গল্পের বাঁক থেকে/শেষ অংশ থেকে। তবে কখনো শুধু একজন গল্পকারের লেখা গল্প পড়া যাবে না; এতে লেখার সময় ঐ লেখকের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রণাথ ঠাকুরের গল্পের খুব ভক্ত ছিলেন; এজন্য তাঁর প্রথম দিকের লেখা অনেক গল্প রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সাথে মিশে যেত; এজন্য অনেক গল্প লেখার পর ছিড়েও ফেলে দিয়েছেন। হুমায়ুন আহমদ স্যারের লেখা গল্প উপন্যাসের বেলায়ও এখন তাই হচ্ছে। শুধু হিমু চরিত্র নিয়ে হাজারের অধিক গল্প লেখা হয়েছে। আপনি সত্যি সত্যি লেখক হতে হলে এমনটি করা যাবে না। কখনো না।

গল্পের উপস্থাপনা, ডায়লগ, টুইস্ট এবং সমাপ্তিতে থাকতে হবে নিজস্বতা। এটাই একজন নতুন লেখকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার বিষয়। যারা নিজেকে অন্য লেখকদের কাছ থেকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হন তারাই ঠিকে থাকেন। গল্প লেখায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে টাইম ফ্রেম। এজন্য দেখা যায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্ধ্যোপাধ্যায়ের গল্পের সাথে এ যুগের হুমায়ুন আহমদ, ইমদাদুল হক মিলন এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসদের লেখার বিষয়-বস্তু, শব্দ চয়ন ও বর্ণনায় অনেক তফাৎ আছে।

আপনি হয়তো একটি কাহিনী মনে মনে নির্দিষ্ট করলেন লেখার জন্য। কিন্তু লেখতে গিয়ে পড়লেন বিপত্তিতে কিভাবে শুরু করবেন!! এই শুরু করতে না পারার কারণে অনেকের আর গল্প লেখা হয়ে উঠে না। একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে গল্প লেখার উপস্থাপনায় যাতে নিজস্ব একটা স্টাইল থাকে। লেখার শুরুতে গল্পের একটি স্ক্রেচ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ভেবে নিতে হবে; প্রয়োজনে লেখে রাখতে হবে। তারপর ভাবুন ভূমিকা কী দিয়ে শুরু করবেন; বের করুন একটি চমৎকার আইডিয়া। আইডিয়াটি যত নাটকীয় হবে, পাঠকরাও গল্পটি পড়তে তত আগ্রহী হবে। তবে মনে রাখতে হবে উপস্থাপনাটি অবশ্যই গল্পের মূল বিষয়বস্তুর সাথে যাতে সামঞ্জস্য থাকে। এছাড়া গল্পের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিকতা থাকতে হবে।

ধরে নেয়া যাক, একটি গল্প শুরু হলো এভাবে, "রাত এগারোটা বাজতে সাত মিনিট বাকি। সিলেট থেকে নয়টা কুড়িতে ট্রেন ছাড়লে অনেক আগেই তা মাইজগাঁও স্টেশনে পৌছার কথা। উদয়ন এক্সপ্রেসের যাত্রী আমি। যাব চট্টগ্রাম স্টেশনে। ভোরে চট্টগ্রামে পৌছে সেখান থেকে বাসযোগে খাগড়াছড়ি। অনেক লম্বা জার্নি। ট্রেনের আসার বিলম্বের সাথে আমার কর্মস্থলে পৌছার সময়টাও চুইংগামের মতো লম্বা হবে। বিষয়টি ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার। এমনিতেই ট্রেন জার্নি পছন্দ না তার উপর অপেক্ষা।".............

এখন ধরুন রাতে কোন কারণে ট্রেন আসলো না; অথবা ভোরের দিকে ট্রেন আসবে অথবা আগামী দুইদিন কোন কারণে এই লাইনে ট্রেন চলবে না; এখন লেখকের দায়িত্ব হলো কাহিনীর রুট পরিবর্তন করা; আর পরিবর্তনটি হতে পারে স্টেশনের কোন চরিত্র, অতীতের কোন স্মৃতি কিংবা আবার বাড়ি ফিরে যাওয়ার ঘটনা। মনে রাখতে হবে এটাই গল্পের বাঁক বা প্লট; এখান থেকে গল্পের গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় বা চরিত্র বেরিয়ে আসতে পারে। আর এই চরিত্রকে এগিয়ে নিতে জন্ম নেবে এক বা একাধিক ঘটনা বা চরিত্রের। এগুলো হলো গল্পের অলঙ্কার। মনে রাখতে এসব কিছু করতে হবে গল্পের মূল বিষয়বস্তুকে মাথায় রেখে।

গল্প লেখা হয় তিনভাবে; উত্তম পুরুষ (লেখক নিজেই এখানে চরিত্র); মধ্যম পুরুষ (পাঠকের দৃষ্টকোণ থেকে); নাম পুরুষ (এখানে তৃতীয় কোন ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গিতে)। সাধারণতঃ উত্তম পুরুষ ও নাম পুরুষেই বেশীরভাগ গল্প লেখা হয়। এখন গল্পটি কোন পুরুষে লেখবেন তা লেখক ঠিক করে নেবেন। অনেক সময় গল্প লেখার শুরুতে যে ভাবনা থাকে, লেখা শেষ হওয়ার মাঝামাঝি দেখা যায় গল্পটি অন্যদিকে মোড় নিয়েছে; কখনো কখনো গল্পের মূল বিষয়বস্তু পর্যন্ত পরিবর্তন হয়ে যায়। এটা হতেই পারে; এটা নিয়ে না ভেবে যা লিখছেন তা গল্পের বিষয়বস্তুর সাথে মিলেছে কিনা যাচাই করে নিন।

গল্প লেখার শুরুতে নাম সিলেক্ট করা যায়, আবার লেখার পরেও নাম নিয়ে ভাবতে পরেন। নামটি হতে হবে চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত ও সুন্দর; তবে অবশ্যই গল্পের বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। গল্প লেখা শেষ হলে বারবার পড়ে নিজে নিজে সম্পাদনা করতে হবে; সঠিক শব্দ ও বাক্য নির্বাচন করতে হবে; অপ্রয়োজনীয় অংশ কেটে দিতে হবে; বানান ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে। সম্ভব হলে পরিবারের কেউ অথবা বন্ধু-বান্ধবকে দিয়ে গল্পটি পড়িয়ে নিতে পারেন; এতে ভুল শনাক্ত করা সহজ হয়। গল্পটি নিজে নিজে সম্পাদনা করার পর যখন মনে হবে, "নাহ, আর কোন ভুল নেই।" তখন এটিকে রেখে দিতে হবে। পরবর্তী এক সপ্তাহ অবসরে গল্পটি নিয়ে ভাববেন। দেখবেন নতুন কোন আইডিয়া পেয়ে গেছেন; যা গল্পের সাথে যোগ করলে তার অলঙ্কার বাড়বে। এভাবে অন্ততঃ তিন মাস রাখতে হবে। আর সপ্তাহে অন্ততঃ একবার গল্পটি বের করে পড়তে হবে।

প্রতি বছর বই মেলা আসলে লেখকদের শুরু হয় তাড়াহুড়ো। অনেক লেখককে বলতে শুনেছি, "হাতে একদম সময় ছিল না; বই মেলার আগে মাত্র দুই সপ্তাহে বিশাল বড় এই উপন্যাসটি লেখেছি; এজন্য খুঁটিনাটি ভুল থাকতে পারে; তবে পরবর্তী মূদ্রণে তা ঠিক করে নেব।" তাহলে প্রশ্ন হলো, যে পাঠক আপনার মূল্যবান বইটি ক্রয় করতে নিজের পকেটের টাকা খরছ করলেন; সেই পাঠক কী আবার নতুন মূদ্রণের আরেকটি বই কিনবেন? এগুলো লেখকদের খামখেয়ালি নাকি পাঠকদের এটা বুঝানো যে, তিনি অতি ব্যস্ত লেখক; তা বলতে পারবো না। যারা বই মেলায় বই বের করবেন তাদেরকে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। কমপক্ষে একমাস আগে লেখা শেষ করে প্রথমে নিজে নিজে সম্পাদনা করতে হবে। আর প্রকাশনীর করা সম্পাদনা বইটি প্রন্ট হওয়ার আগে পড়তে হবে। কারণ, দিন শেষে বইয়ের মান খারাপ হলে পাঠকরা প্রকাশককে নয়; লেখককে দায়ী করেন।


নতুন লেখকদের প্রতি প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১১টি নির্দেশনা -

(১) যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভালো হইবে না। লেখা ভালো হইলে যশ আপনি আসিবে।

(২) টাকার জন্য লিখিবেন না। ইউরোপে এখন অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে, এবং টাকাও পায়; লেখাও ভালো হয়। কিন্তু আমাদের এখনো সে দিন হয় নাই। এখন অর্থের উদ্দেশ্যে লিখিতে গেলে লোকরঞ্জন-প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া পড়ে। এখন আমাদিগের দেশের সাধারণ পাঠকের রুচি ও শিক্ষা বিবেচনা করিয়া লোকরঞ্জন করিতে গেলে রচনা বিকৃত ও অনিষ্টকর হইয়া ওঠে।

(৩) যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন। যাহারা অন্য উদ্দেশ্য লেখেন, তাহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে।

(৪) যাহা অসত্য, ধর্ম্মবিরুদ্ধ; পরনিন্দা বা পরপীড়ন বা স্বার্থসাধন যাহার উদ্দেশ্য, সে সকল প্রবন্ধ কখনো হিতকর হইতে পারে না, সুতরাং তাহা একেবারে পরিহার্য। সত্য ও ধর্ম্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। অন্য উদ্দেশ্যে লেখনী-ধারণ মহাপাপ।

(৫) যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না। কিছু কাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছু কাল পরে উহা সংশোধন করিবেন। তাহা হইলে দেখিবেন, প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য-নাটক-উপন্যাস দুই-এক বৎসর ফেলিয়া রাখিয়া তারপর সংশোধন করিলে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। যাহারা সাময়িক সাহিত্যের কার্যে ব্রতী, তাহাদের পক্ষে এই নিয়ম রক্ষাটি ঘটিয়া ওঠে না। এ জন্য সাময়িক সাহিত্য, লেখকের পক্ষে অবনতিকর।

(৬) যে বিষয়ে যাহার অধিকার নাই, সে বিষয়ে তাহার হস্তক্ষেপ অকর্তব্য। এটি সোজা কথা কিন্তু সাময়িক সাহিত্যে এ নিয়মটি রক্ষিত হয় না।

(৭) বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা করিবেন না। বিদ্যা থাকিলে তাহা আপনিই প্রকাশ পায়, চেষ্টা করিতে হয় না। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা পাঠকের অতিশয় বিরক্তিকর এবং রচনার পারিপাট্যের বিশেষ হানিজনক। এখনকার প্রবন্ধে ইংরাজি, সংস্কৃত, ফরাসি, জার্মান, কোটেশন বড় বেশি দেখিতে পাই। যে ভাষা আপনি জানেন না, পরের গ্রন্থের সাহায্যে সে ভাষা হইতে কদাচ উদ্ধৃত করিবেন না।

(৮) অলংকার-প্রয়োগ বা রসিকতার জন্য চেষ্টিত হইবেন না। স্থানে স্থানে অলংকার বা ব্যঙ্গের প্রয়োজন হয় বটে; লেখকের ভান্ডারে এ সামগ্রী থাকিলে, প্রয়োজনমতে আপনিই আসিয়া পৌছিবে—ভান্ডারে না থাকিলে মাথা কুটিলেও আসিবে না। অসময়ে বা শূন্য ভান্ডারে অলংকার প্রয়োগের বা রসিকতার চেষ্টার মতো কদর্য আর কিছুই নাই।

(৯) যে স্থানে অলংকার বা ব্যঙ্গ বড় সুন্দর বলিয়া বোধ হইবে, সেই স্থানটি কাটিয়া দেবে, এটি প্রাচীন বিধি। আমি সে কথা বলি না। কিন্তু আমার পরামর্শ এই যে, সে স্থানটি বন্ধুবর্গকে পুনঃ পুনঃ পড়িয়া শুনাইবে। যদি ভালো না হইয়া থাকে, তবে দুই-চারিবার পড়িলে লেখকের নিজেরই আর উহা ভালো লাগিবে না—বন্ধুবর্গের নিকট পড়িতে লজ্জা করিবে। তখন উহা কাটিয়া দেবে। সকল অলংকারের শ্রেষ্ঠ অলংকার সরলতা। যিনি সোজা কথায় আপনার মনের ভাব সহজে পাঠককে বুঝাইতে পারেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক। কেননা, লেখার উদ্দেশ্য পাঠককে বুঝুন।

(১০) কাহারও অনুকরণ করিও না। অনুকরণে দোষগুলি অনুকৃত হয়, গুণগুলি হয় না। অমুক ইংরাজি বা সংস্কৃত বা বাঙ্গালা লেখক এইরূপ লিখিয়াছেন, আমিও এরূপ লিখিব, এ কথা কদাপি মনে স্থান দিয়ো না।

(১১) যে কথার প্রমাণ দিতে পারিবে না, তাহা লিখিও না। প্রমাণগুলি প্রযুক্ত করা সকল সময়ে প্রয়োজন হয় না, কিন্তু হাতে থাকা চাই।


এতক্ষণ দীর্ঘ লেখাটি পড়ে নিশ্চয় হাফিয় উঠিছেন;
ঠান্ডা শরবত/কোক/চা/কফি কিছুই তো দেওয়া সম্ভব নয়!! চলুন একজন বিদেশী অসহায় মহিলার একটি দুঃখের কাহিনী শুনে আসি, কী বলেন!!

সময়টা সত্তরে দশক; ইংল্যান্ডের গ্লোস্টশায়ার। গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া দুই বোনের মধ্যে ছোট বোন সব সময় বড় বোনের কাছে গল্প শোনার বায়না ধরতো। কিন্তু প্রতিদিন কী আর নতুন নতুন গল্প বলা সম্ভব!! তাই আদরের ছোট বোনটিকে খুশি রাখতে তিনি শুরু করলেন বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা। যতদিন যায় গল্প বলার পরিধি ও বিষয় বাড়তে থাকে। এক সময় মনে হলো-

হুম, আমি চাইলেই তো এসব গল্প লিখে ফেলতে পারি!!

পড়াশুনা শেষ করে ভাল চাকরি আর ভাল জীবনযাপনের জন্য তিনি চলে আসেন লন্ডনে। কিন্তু সব কিছু কী আর প্লান মাফিক হয়? কিছুদিন পর মনে হলো, দূর এটা কোন কাজ হলো? একটা গৎ বাধা জীনব; নয়টা-ছয়টা অফিস। তাই শেষ পর্যন্ত চাকরিটাই ছেড়ে দিলেন। কিন্তু বাড়িতে ফিরেও তার ভাল লাগছিল না; তাই আবার চাকরি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে এবার পর্তুগালে!! যথারীতি সেখানে এক পর্তুগীজ সাংবাদিকের সাথে পরিচয়, পরিণয়। ফলাফল স্বরুপ একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের মা হলেন।

কিন্ত সেই সুখ ও বেশিদিন সইলো না; হঠাৎ বিচ্ছেদ হয়ে গেল। মেয়েকে নিয়ে একদম একা হয়ে গেলেন তিনি। বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন তিনি। কিন্তু মেয়েটির কথা মনে হতেই নিজেকে কষ্ট করে দমিয়ে রাখতেন; জীবন নিয়ে একদম আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন।

চার মাসের সন্তানকে নিয়ে ফিরে আসেন নিজ ভূমিতে। তখন পুরোপুরি বেকার তিনি। সরকারী ভাতায় কোন মতে দিন যাচ্ছে। নেই কোন স্বপ্ন, নেই কোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। শুধু বাচ্চা শিশুটিই তার বেঁচে থাকার অক্সিজেন ছিল। তখন থাকতেন স্কটল্যান্ডের এডিনবারাতে। সকাল-সন্ধ্যা বাড়ির পাশের টি-স্টলে যখন চা খেতে যেতেন তখন টুকটাক লেখতেন মনের খেয়ালে।

এর কয়েক বছর পর ম্যানচেস্টার থেকে ট্রেনযোগে লন্ডনে যাওয়ার সময় তাঁর মাথায় এক দারুণ গল্প কাহিনীর উদয় হলো। কাহিনীটি এরকম- ছোট্ট একটি ছেলে, যে ট্রেনে চড়ে বড় এক জাদুকরদের স্কুলে ভর্তি হতে যাচ্ছে। যেই ভাবনা সেই কাজ। ১৯৯৫ সাল তিনি এর উপর একটি বই লিখে প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠান। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, কোনো প্রকাশকই বইটি ছাপতে রাজি হয় নাই। তিনি অনেক প্রকাশককে অনুনয় বিনয় করেও বরফ গলাতে ব্যর্থ হলেন।

দীর্ঘ ১২ মাস অনেক চেষ্টার পর একজন প্রকাশক পাওয়া যায়। মূলতঃ তার মেয়েটি লেখাটি খুব পছন্দ করায় প্রকাশক রাজী হন। শুরুর দিকটাতে প্রকাশক খুশি হয়ে অগ্রিম সম্মানী হিসেবে লেখিকাকে ১ হাজার ৫০০ পাউন্ড দেন। প্রথম প্রকাশে বইটির এক হাজার কপি ছাপা হয়। উল্লেখ্য, প্রায় ৫০০ কপি বই-ই বিক্রি করা হয় বিভিন্ন স্কুল, কলেজের লাইব্রেরিতে।

তার পরের ইতিহাস বলবো? এটুকু বলি, তিনি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী লেখিকা। তাঁর নেট ইনকাম প্রায় ৮,৪৩২ কোটি টাকা (প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার)। এতক্ষণে নিশ্চয় লেখিকাকে চিনে ফেলেছেন। তিনি আর কেউ না; সবার পরিচিত।

"জে কে রাউলিং",- হ্যরি পটার সিরিজের লেখিকা।

এখন পর্যন্ত (২০১৭) বিশ্বব্যপী হ্যারি পটার সিরিজের প্রায় ৫০০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে; যা বিশ্বের সবচেয়ে বেশী বিক্রিত বুক সিরিজ হিসাবে স্বীকৃত। এই সিরিজের প্রথম উপন্যাস "Harry Potter and the Philosopher's Stone" বিশ্বব্যপী ১২০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়; এটি বিশ্ব রেকর্ড। ২০১৭ সালে হ্যারি পটার সিরিজের বইগুলো ৮০টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়; এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী ভাষায় অনুবাদকৃত বইয়ের রেকর্ড করে। হ্যারি পটারের "Harry Potter and the Deathly Hallows" বইটি বাজারে আসার ২৪ ঘন্টার মাথায় প্রায় ১৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়।।

অতএব, কে কী বললো আর কে কী ভাববে তা নিয়ে চিন্তা না করে আজ থেকেই গল্প লেখা শুরু করেন; আপনি নিজে "জে কে রাউলিং"-এর মতো বিশ্ব কাঁপানো লেখক/লেখিকা হতে পারবেন না, এটা কে বলেছে? তাহলে মিশনটা আজই শুরু হোক, কী বলেন!!!



ফটো ক্রেডিট,
গুগল।

চাইলে পড়তে পারেন-
আমার সবচেয়ে পঠিত, লাইক ও কমেন্ট প্রাপ্ত পোস্ট।
সবচেয়ে পঠিত প্রবন্ধ।
আধুনিক কবিতার পাঠ (সমালোচনা)
আলোচিত ফিচার 'দি লাঞ্চিয়ন'।
ব্রিটেনের প্রবাস জীবন- স্মৃতিকথা।
সবচেয়ে পঠিত গল্প।
সবচেয়ে লাইকপ্রাপ্ত গল্প।
ছবি ব্লগ (লন্ডনের ডায়েরি-১)।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৫৭
৩৪টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজকের ডায়েরী- ১৩৯

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ সকাল ১০:৪১

ছবিঃ আমার তোলা।

আজকে সাত রোজা।
সময় আসলে অনেক দ্রুত যায়। গতকাল সুরভি আর ফারাজাকে নিয়ে গিয়েছিলাম শপিং করতে। কারন আমি জানি, ১৫ রোজার পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্বাসীকে লজিকের কথা বলার দরকার কি?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:১৭




হনুমান দেবতা এবং বোরাকে কি লজিক আছে? ধর্ম প্রচারক বলেছেন, বিশ্বাসী বিশ্বাস করেছেন ঘটনা এ পর্যন্ত। তাহলে সবাই অবিশ্বাসী হচ্ছে না কেন? কারণ অবিশ্বাসী বিশ্বাস করার মত কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের শাহেদ জামাল- ৭১

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:৫৪



শাহেদ জামাল আমার বন্ধু।
খুব ভালো বন্ধু। কাছের বন্ধু। আমরা একসাথেই স্কুল আর কলেজে লেখাপড়া করেছি। ঢাকা শহরে শাহেদের মতো সহজ সরল ভালো ছেলে আর একটা খুজে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভাবছিলাম ২ লক্ষ ব্লগ হিট উপলক্ষে ব্লগে একটু ফান করব আড্ডা দিব, কিন্তু এক কুৎসিত অপব্লগার সেটা হতে দিলোনা।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:০৫



এটি ব্লগে আমার ২৬০ তম পোস্ট। এবং আজকে আমার ব্লগের মোট হিট ২০০০০০ পূর্ণ হয়েছে। আমি আনন্দিত।এই ছোট ছোট বিষয় গুলো সেলিব্রেট করা হয়তো ছেলে মানুষী। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কট বাঙালি

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৯ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:২৪



কদিন পরপরই আমাদের দেশে বয়কটের ঢল নামে । অবশ্য তাতে খুব একটা কাজ হয় না । বাঙালির জোশ বেশি দিন থাকে না । কোন কিছু নিয়েই বাঙালি কখনই একমত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×