somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছাত্র রাজনীতির মরণ নেশা।(একাল-সেকাল) :(( :(( :(( :(( [সমালোচনা] :(( :(( :(( :((

১৬ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ১১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছাত্র রাজনীতি। নাম শুনলেই ভয় লাগে, আতংকিত হই। রাজনীতি তো রাজার নীতি। ছাত্রদের তো রাজা হওয়ার চান্স নেই, তাহলে সে রাজনীতি করবে কেন? আসলে তারা হলো রাজা/রানীর মসনদ চিরস্থায়ী হওয়ার গুটি বা হাতিয়ার। অথবা রাজা/রানীকে মসনদে নিয়ে যাওয়ার লাঠিয়াল। কাঁচা বয়স, শরীরে নতুন রক্তের স্রোত, হিরো হওয়ার নেশা, রঙ্গীন ভবিষ্যতের স্বপ্ন আর নেতা হয়ে প্রভাব প্রতিপত্তি অর্জন এবং মন্ত্রী/এমপি হওয়ার দিবাস্বপ্ন তাদেরকে সর্বনাশের পথে নিয়ে যায়। যে পথ যাত্রায় নেই কোন দিক নির্দেশনা, নেই কোন আদর্শ, নেই কোন দেশপ্রেমর লেশ। এ নেশার শুরু আছে কিন্তু শেষ বলে কিছু নেই। ছাত্ররা এ চক্রে একবার আটকে গেলে শত চেষ্টায়ও বের হয়ে আসতে পারে না। কখনো কখনো তাদেরকে আসতে দেওয়া হয় না! এ নেশার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ইয়াবা, ফেন্সিডিল আর কোকেইনের চেয়ে ভয়াবহ।

কোমলমতি ছাত্ররা কখনো বুঝতে পারে না তারা চ্যাম্পিয়ন এক দাবাড়ুর বাড়িয়ে দেওয়া গুটি মাত্র। যে কখনো নেতা হতে পারবে না অথবা তাকে নেতা হতে দেওয়া হবে না। কারণ নেতা হতে হলে, দেশকে নেতৃত্ব দিতে হলে যে জ্ঞান অর্জন করতে হয়, যোগ্যতা অর্জন করতে হয় তা তার নেই। যে বয়সে এসব জ্ঞান অর্জন করার কথা সে বয়সে সে রাজনীতির নামে সন্ত্রাসী, চান্দাবাজি ও গুটিবাজি শিখে। তার নেতা কখনো তাকে নেতৃত্বগুণ অর্জন করার তাগিদ দেন না বা দিতে প্রয়োজন মনে করেন না। উনারা সারাক্ষণ ছাত্রদের রাজনীতি শেখাতে ব্যস্ত থাকেন, পিকেটিং আর মিছিল-মিটিং নিয়ে ব্যস্ত রাখেন।

নেতৃত্বগুণ অর্জন করার সময় কই!

এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিবেশ তলানিতে পৌছার জন্য ছাত্ররাজনীতির বিষক্রিয়া অনেকাংশে দায়ী। দেশের বাকি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও একই। এখন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা নিয়ে, রাষ্ট্র নিয়ে, পরিবেশ নিয়ে গবেষণা হয় না। হয় রাজনীতি নিয়ে গবেষণা আর রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের প্রেকটিক্যাল ক্লাস। ছাত্রীরাও কম কিসে! বিভিন্ন হলগুলোতে লেডি গুন্ডাদের তান্ডবের খবর সব সময় পত্রিকায় পাওয়া যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই বাদ যাবেন কেন? অনেক শিক্ষক প্রকাশ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলোকে তোষণ করেন। শিক্ষক সমিতির নামে রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেন।

এ বয়সের একটা টগবগে তরুণ রাজনীতির কী বুঝে? এ সময়ে তার পড়ার টেবিলে থাকার কথা জ্ঞান অর্জনের জন্য। কিন্তু কিছু গডফাদারের স্বার্থে কোমলমতি এসব ছেলে রাজনীতির নামে সন্ত্রাসে যোগ দেয় নেতা হওয়ার আশায়, হিরো হওয়ার নেশায়। পরিণামে হয় সন্ত্রাসী, চান্দাবাজ আর বখাটে। তারা কখনো বুঝতে পারে না এসব নেতা তাকে ভবিষ্যৎ নেতা বানাতে চায় না, তাকে লাটিয়াল ও গুন্ডা বানিয় তার আখের গুছাতে চায়। একটা সময় আসে যখন ছেলেটির বয়সের সাথে বুদ্ধি পাকে, হিতাহিত জ্ঞান হয় তখন সব কিছু স্পষ্ট বুজতে পারে, কিন্তু ততোদিনে সব শেষ। পড়ালেখার বয়স শেষ, চাকরির বয়স শেষ, নেতৃত্বগুণ অর্জন করার বয়স শেষ। তখন সংসারের দায়িত্ব পালনের কোন সামর্থ থাকে না, যোগ্যতা অর্জন করা হয় না। ভুল সংশোধনের আর সময় থাকে না।

গ্রাম থেকে শহরে উঠে আসা কোমলমতি তরুণ ছেলেরা বেশিরভাগ সময় এসব নোংরা রাজনীতির শিকার হয়। নেতারা সহজে এদের দলে ভেড়াতে পারে, ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারে। এদের বাবা-মা অনেক স্বপ্ন নিয়ে ছেলেকে শহরে পাঠান একটি উজ্জল ভবিষ্যতের জন্য, সুশিক্ষিত হয়ে সংসারের হাল ধরার আশায় । গ্রামের এসব বেশিরভাগ পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা নেই। কারো বাবা স্কুল শিক্ষক, কেউ বা মুদি দোকানদার, কেউ সামান্য কৃষক, কারো বাবা অসুস্থ, কেউ হয়ত বাবা হারা; অভাবের সংসার। আবার অনেকের বাবা প্রবাসী। যত কষ্টই হোক অভিবাবকরা না খেয়ে, না পরে মাস শেষে ঠিকই তাদের ছেলেদের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা পাঠিয়ে দেন, যাতে আদরের সন্তানের পড়াশুনা ও থাকা খাওয়ার কোন কষ্ট না হয়। আশায় বুক বাঁধেন কখন ছেলে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি পেয়ে পরিবারের হাল ধরবে, বাবা মায়ের মুখে হাসি ফুটাবে, ছোট ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব নেবে।


অনেক সময় ছাত্র রাজনীতি এসব বাবা মায়ের স্বপ্ন চুরমার করে দেয়। ছেলের গায়ে সন্ত্রাসী, চান্দাবাজ আর খুনির স্টিকার লাগে। কখনো আদরের সন্তানকে খুুন হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। কখনো নিজের সন্তানের খুনের আসামী হয়ে কারাগারে ঠাই হয়। কিন্তু তাদের সন্তানকে যারা খুনি বানায়, খুন করে তারা থাকে ধরা ছোয়ার বাইরে। এটা কত কষ্টের তা শুধু ভোক্তভোগী বাবা মায়েরা বুঝেন। ছাত্র রাজনীতি নামধারী এই মরণ নেশা ইয়াবা, কোকেইন, হেরোইন ও ফেনসিডিলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

আগে দেখেছি ছাত্র রাজনীতিতে গ্রাম থেকে শহরে এসে ছেলেরা যোগদান করত। কিন্তু এখন রাজনীতি করতে শহরে পড়ালেখা করতে আসা ছেলেটি গ্রামে যায় রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে। দলগুলোর কত যে কমিটি আর কত যে নেতা গুনে শেষ করা যাবে না। ইদানিং ছাত্র সংগঠনগুলোর গ্রামের হাট-বাজারেও কমিটি আছে! আচ্ছা এসব হাট-বাজারে ছাত্রদের কাজটা কী? বাজারে ছাত্র সংগঠনের কমিটি থাকবে কেন? সে তো সন্ধ্যার পর বাড়িতে পড়তে বসার কথা, ছোট ছোট ভাইবোনদের পড়ালেখা দেখিয়ে দেওয়ার কথা। একটা টিউশনি করলেও তাতে ক্ষতি নেই, এতে জ্ঞান চর্চা হয়, নিজের পকেট মানি হয়। এ ছেলেকে টেনে হাট-বাজারে আনতে হবে কেন? বাজার পলিটিক্স শেখাতে হবে কেন? হোটেলে বসে আড্ডাবাজ বানাতে হবে কেন? রাজনৈতিক দাওয়া-পাল্টা দাওয়ার গুটি বানাতে হবে কেন?

কেউ কি আছেন, জবাব দেওয়ার?
............................জানি নেই।

এলাকার মানুষ যে ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার কথা, গর্ব করার কথা; সে ছেলেটি এই বয়সে বাজারে আসর বসায়, বাহিনী গঠন করে, মারামারি আর বেয়াদবীতে হাত পাকায়। এতে কী স্পষ্ট হয় না রাজনৈতিক দলগুলোর একটাই উদ্দেশ্য ছাত্রদের দিয়ে লাটিয়াল বাহিনী তৈরী করা; আদর্শ ও মেধাবী ছাত্র হিসেবে গড়ে তোলা নয়। রাজার আসন পাকাপোক্ত করা অথবা রাজা/রানীকে মসনদে নিয়ে যাওয়া এসব ছাত্র রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য। কোন অবস্থাতে ছাত্রদের ভবিষ্যৎ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা নয়। তারপরও ছাত্ররা খেলার চালটি বুঝে না। খেলার পরিচালকদের চিনতে পারে না। এরাই হয় তাদের আদর্শ আর ভবিষ্যৎ আইডল।

অথচ নেতা হতে হলে, দেশকে নেতৃত্ব দিতে হলে পড়ালেখার কোন বিকল্প নেই। একজন ছাত্র যে রাজনীতিবিদ হতে চায় তাকে অবশ্যই গণতন্ত্র, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন এবং বিদেশনীতির মতো কঠিন বিষয়গুলোর উপর গভীর জ্ঞান অর্জন করা জরুরী। প্রয়োজন পৃথিবীর বিখ্যাত আদর্শবান রাজনীতিবিদদের জীবনী পড়া, তাদের কর্ম পরিকল্পনা ফলো করা, আধুনিক গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থা নিয়ে পড়াশুনা করা, আধুনিক প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা। সর্বাপরি নিজস্ব চিন্তা চেতনা ও আইডিয়া নিয়ে রাজনীতির গভীরে গিয়ে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করা। তা না করে ছাত্ররা সন্ত্রাস, চান্দাবাজি আর খুন খারাবিতে হাত পাকায়। সর্টকাট পথে নেতা হতে চায়। যদিও সর্টকাট পথে কেবলমাত্র সন্ত্রাসী হওয়া যায়, নেতা নয়।

একজন ছাত্রকে ডাক্তার হতে হলে যেমন চার-পাঁচ বছর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে থিওরী ও প্র্যাকটিকেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ডাক্তার ও সার্জন হতে হয়। একজন ইঞ্জিনিয়ারকে যেমন চার-পাঁচ বছর ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয় পড়াশুনা করে দক্ষতা অর্জন করে সার্টিফিকেট অর্জন করতে হয়। তেমনি একজন রাজনৈতিক নেতাকেও একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উঠে আসতে হয়। রাজনীতি ডাক্তারী, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো একটি গভীর বিষয়। এর পাঠ ঠিক মতো না নিলে দক্ষ নেতা হওয়ার কোন সুযোগ নেই। অথচ বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দল এসবের তোয়াক্কা করে না। যার ফলে গড়ে উঠে মেধাহীন নেতৃত্ব। গড ফাদার, সন্ত্রাসী ও চান্দাবাজরা দেশকে নেতৃত্ব দেয়। এসব মেধাহীন অযোগ্য নেতারা সুযোগের সদ্বব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছায়। কিন্তু দেশ ও দশের সর্বনাশ করে।


রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে গনতন্ত্র ও নেতৃত্বগুণের চর্চা নেই বলে সন্ত্রাসী, খুনি, চান্দাবাজ, দালাল আর মেধাহীনরা আমাদের রাজনৈতিক গুরু হয়। দশ বছর আগে যে চান্দাবাজ, সন্ত্রাসী আর খুনি ছিল দশ বছর পর সে বড় নেতা হয়, দেশকে নেতৃত্ব দেয়। অথচ যে ছেলেটি সারা জীবন কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে পড়াশুনা করে নেতৃত্বগুণ অর্জন করল তাকে কোন দল নেতা বানায় না। সে যাতে নেতা হতে না পারে সেজন্য হাজারো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। পরিণামে তৈরী হয় মেধাহীন একদল নেতার। এরা রাজনীতির নামে গ্রুপিং করে, সন্ত্রাস করে, আর নামে বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়ে। যখন প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় তখন তরুণ এসব ছাত্রদের তারা ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

ছাত্র রাজনীতি করা অবস্থায় যে ছাত্রটি পড়ালেখা বাদ দিয়ে গ্রুপিং, মিছিল মিটিংয়ে রাজা/রানীর বন্ধনা করে, চান্দাবাজি আর বেশী বেশী জেল খাটে; এমপি/মন্ত্রী হওয়ার পর তার দাপট অন্যদের চেয়ে বেশি হয়। উন্নয়নের নামে বেশী লুটপাট করার সুযোগ পায়। দলীয় ফোরামে বীরের মর্যাদা পায়। জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সভা সমাবেশে গলাবাজি বেশি করে। জমি দখল, খুন খারাবি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ সব কিছুতেই নেতৃত্ব দেয়। প্রশাসনকে পাশ কাটিয়ে তিনি হয়ে উঠেন বিকল্প প্রশাসক। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল দল, নীল দল নামধারী মেরুদন্ডহীন কিছু শিক্ষক বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য, ভিসি হওয়ার জন্য তার কৃপাদৃষ্টি চান। এ সুযোগে তিনি গড়ে তুলেন বিশাল এক সিন্ডিকেট ও লাটিয়াল বাহিনী। নিজ এলাকায় রাজপুত্রের মর্যাদা পান। তোষামোদকারী আর সন্ত্রাসীদের নয়নের মণি হয়ে উঠেন। ফুলে ফুলে ভরে উঠে তার বসার ঘর। তার পদধূলি নিতে শত শত মানুষ ছুটে আসেন, মিছিল আর তোষণে প্রকম্পিত হয় তার আঙ্গিনা। তিনি হয়ে উঠেন দেশ ও জাতির মা বাপ। জনগনের পরম বন্ধু!

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ছাত্র রাজনীতি বাংলার রাজনীতিতে নতুন একটি ধারার সৃষ্টি করে। তবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে 'স্বদেশী আন্দোলন' ও 'অসহযোগ আন্দোলন' ছাত্র রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং জমিদারী প্রথার বিরূদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল ছাত্রদের। তবে তখন ছাত্র রাজনীতি ছিল বলেই ছাত্ররা আন্দোলন ও সংগ্রাম করে নাই; বরং সময়ের প্রয়োজনে দেশ ও জাতির স্বার্থে ছাত্ররা এগিয়ে এসেছিল। আজকের দিনেও দেশের সঙ্কটময় সময়ে ছাত্ররা এগিয়ে আসবে; এজন্য ছাত্র রাজনীতির কোন দরকার পড়বে না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোন রাষ্ট্র নায়কই নিকট অতীতে ছাত্র রাজনীতিতে হাত পাকিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে আসেন নাই। বাংলাদেশে যারা ছাত্র রাজনীতি করে উঠে এসে এমপি/মিনিস্টার হয়েছেন তাদের প্রায় সবারই ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস মসৃণ নয়। অনেকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে।

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে সাতচল্লিশে দেশ বিভাগ হওয়া পর্যন্ত উপমহাদেশের ছাত্ররাজনীতির ধারা ছিল এক রকম; আবার সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত এ ধারাটির গতি পরিবর্তন হয়; আবার একাত্তর থেকে একানব্বই পর্যন্ত এ দেশের ছাত্র রাজনীতি ছিল বিভিন্ন ধারা উপধারায় বিভক্ত; আর এ জং ধরা ধারায় এইডসের মড়ক লাগে একানব্বই পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর আমলে; এখন তো ছাত্র রাজনীতি একটি মহামারীতে রূপ নিয়েছে। ছাত্র রাজনীতি এখন আর ছাত্রদের করতে হয় না; এর মালিকানা রাজনৈতিক দল, তাদের নেতা আর অছাত্র, বখাটে, টেন্ডারবাজ আর গুন্ডাদের দখলে। এখানে নীতি আর আদর্শের কোন স্থান নেই।

৯১ পরবর্তী বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে আদর্শ ও দায়িত্বের গুণগত মানে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এখন ছাত্র রাজনীতি চিরায়ত 'গণমুখী' ঐতিহ্য ত্যাগ করে 'ক্ষমতামুখী' আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে। ছাত্র নেতারা এখন পদ পদবীর আশায় কলেজ/বিশ্ব বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ইচ্ছা করেই ফেল করেন; এতে তাদের ছাত্র জীবন দীর্ঘ হয়, পদ পদবীর সুযোগ হয়। নেতাদের পড়াশুনায় নিয়মিত হওয়ার চেয়ে ফেলটুস ছাত্র হয়ে থাকাটাই এখন অধিক মর্যদার। এতে পদ পদবীর পাশাপাশি তাদের পেশি শক্তি বাড়ে, অর্থবিত্ত বাড়ে, বড় নেতার আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার সুযোগ বাড়ে। হাত পাকে তদবীর বাণিজ্যে, হলে সিট বাণিজ্যেে, টেন্ডার বাণিজ্যে। ফলাফল স্বরূপ চাকরি জীবনে প্রবেশের আগেই তিনি হয়ে যান কোটিপতি নেতা।

যারা ছাত্র রাজনীতির পক্ষে সবক দেন তারা ছাত্র রাজনীতিতির অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা বলে আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন; কিন্তু বর্তমানেে কী ছাত্র রাজনীতির সে দিনটি আছে? তা উনারা দেখতে পান না অথবা দেখলেও তা স্বীকার করেন না।


বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস খুব গৌরবজ্জল। মাওলানা ভাষানী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও গ্রহণযোগ্য নেতারা ছাত্র রাজনীতি করেই বিশ্ব বিখ্যাত নেতা হয়েছিলেন। তাঁরা কখনো কর্মীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন নাই। সব সময় আদর্শের শিক্ষা দিয়েছেন। পড়ালেখা করতে উৎসাহ যুগিয়েছেন। তাঁরা রাজনীতিকে হাতিয়ার করে নিজেরা বাড়ি-গাড়ি, সহায় সম্পত্তি করেননি। তাঁদের লড়াই ছিল আদর্শের, মানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের; ভোগ ও প্রতিহিংসার নয়। এজন্য এসব নেতাদের নাম শুনলেই মানুষ শ্রদ্ধায় অবনত হত, আশ্রয় খুঁজত। তাঁদের যে কোন আহ্বানে মানুষ নির্ধিদায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোন, ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন ও বাঙ্গালী জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাধারণ মানুষ আন্দোলন গুলো সফল করেছিল। যার ধারাবাহিকতায় আমরা পেয়েছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। ছাত্র রাজনীতির সোনালী সে দিন আজ শুধু স্মৃতি।

বিশেষ করে ৫২'র ভাষা আন্দোলন; ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন; ৬২'র হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন; ৬৬'র ঐতিহাসিক ৬ ও ১১ দফা; ৬৯'র গণঅভ্যুত্থান; ৭০'র নির্বাচন; ৭১'র মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক বিজয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি ও আন্দোলন সফল করার ভ্যানগার্ড হিসেবে তৎকালীন ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা অপরিসীম। পরবর্তীতে ৯১'র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও এদেশের ছাত্র রাজনীতির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ভূমিকা।

তবে, এখন এগুলো কেবলই স্মৃতি।

আমরা রাষ্ট্র হিসেবে এসব তরুনদের কী সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পেরেছি? তাদের প্রয়োজনীয় বিনোদন দিতে পেরেছি? কর্মসংস্থান করতে পেরেছি? নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ করতে পেরেছি? চরম বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করতে পেরেছি? কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ দিতে পেরেছি? দেশের যোগ্য নেতৃত্বগুণ অর্জন করার সুযোগ করে দিতে পেরেছি? রাজনীতি বাদ দিয়ে পড়াশুনায় মনোযোগ দিতে বাধ্য করেছি? যে সকল নেতা রাজনীতির নামে গ্রুপিং আর সন্ত্রাসে জড়িত তাদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পেরেছি? যারা রাজনৈতিক দলের নামে বিভিন্ন লুটপাট আর ধান্দাবাজিতে ব্যস্ত তাদের বিচারের সম্মুখিন করতে পেরেছি? উত্তর হল, না। রাষ্ট্র হিসাবে আমরা তা পারিনি। রাষ্ট্র হিসেবে এগুলো ব্যর্থতা নয় কী?

পড়াশুনার তাগিদে বেশ কয়েক বছর লন্ডনে থাকায় সে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম কাছে থেকে দেখেছি। পর্যবেক্ষণ করেছি। কয়েকবার পার্লামেন্ট ইলেকশনে ভোট দিয়েছি। সেখানে ছাত্র রাজনীতি নামক কোন বস্তুর অস্তিত্ব নেই। নেই রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা, প্রশাখা, উপশাখা। তরুণরা ভুলেও রাজনীতি নিয়ে ভাবে না, সরাসরি রাজনীতি করা তো অনেক পরের কথা। যারা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আগ্রহী, ভবিষ্যতে পলিটিশিয়ান হতে চায় তারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি সম্পৃক্ত বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করে, লেখালেখি করে, গবেষণা করে। গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার নতুন নতুন আইডিয়া উদ্ভাবন করে। ছাত্রাবস্তায় এদের কোন পরিচিতি থাকে না। এমনকি এমপিদেরও অনেকে চেনে না। দলগুলো নমিনেশন দেওয়ার আগে প্রার্থীর অতীত ইতিহাস যাচাই করে। কোন ক্রিমিনাল অফেন্স আছে কিনা নিশ্চিত হয়। ছাত্র জীবনের অর্জনগুলোকে মূল্যায়ন করে। সবশেষে যদি মনোনয়ন বোর্ড তাকে যোগ্য মনে করে তাহলে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করে। এখানে নেই কোন স্বজনপ্রীতি, নেই কোন পারিবারিক দাপট, নেই টাকার খেলা। এজন্য দলের মনোনীত পার্থীকে ভোটাররা বিশ্বাস করে। প্রার্থীকে চেনার কোন প্রয়োজন মনে করে না।

তাই তরুনদের প্রতি অনুরোধ যারা বুঝে অথবা না বুঝে ছাত্র রাজনীতি করেন, আশা করি নিজে থেকে বিষয়টি নিয়ে একটু গভীর মনযোগ সহকারে ভাববে। ভাল মন্দ বিচার করার যোগ্যতা তোমাদের নিজে থেকে অর্জন করতে হবে। আমার বিশ্বাস তোমরা তা পারবে। এখনই সতর্ক না হলে রাষ্ট্র নামক সন্ত্রাসের ড্রাগটি তোমাদের গিলে ফেলবে, ধ্বংস করে দেবে তোমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। রাজা/রানীর ক্ষমতা ঠিকয়ে রাখতে এসব সন্ত্রাসী গ্রুপ লিডারদের রাজনৈতিক দলগুলোর খুব প্রয়োজন। এজন্য দলগুলো তাদের নেতা বানায়, তোয়াজ করে ও হিরোর সম্মান দেয়। দলগুলো এসব গড ফাদারদের লাটিয়াল হিসাবে তোমাদের ব্যবহার করে, নেতা বানাতে নয়।

রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রদের নেতা বানাতে চায় না, পিকেটার বানায়। হলগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে চায় না, দখল করতে শেখায়। ভদ্রভাবে কথা বলতে শেখায় না, মিথ্যা গলাবাজি শেখায়। স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখায় না, দলকানা বানায়। হাতে কলম তুলে দেয় না, অস্ত্র চালাতে শেখায়। সমাজকর্মী বানায় না, চান্দাবাজি শেখায়। নীতি ও আদর্শ শেখায় না, সন্ত্রাসের পাঠ শেখায়। সমাজের সবাইকে নিয়ে চলতে শেখায় না, অন্য মত ও পথকে কঠোর হস্তে দমন করতে শেখায়। দেশপ্রেম শেখায় না, লুটপাট শেখায়। সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে না, মিথ্যা চেতনা আর মিথ্যা ইতিহাস শেখায়। সত্যবাদিতার শিক্ষা দেয় না, মিথ্যা মিথ্যা আশ্বাস দিতে শেখায়। ফলশ্রুতিতে এতো এতো প্রেকটিক্যাল পরীক্ষা দিতে দিতে পরিণত বয়সে ছাত্রটি হয়ে উঠে দক্ষ পলিটিশিয়ান, পাকনা গুটিবাজ।।



ফটো ক্রেডিট,
গুগল।

চাইলে পড়তে পারেন-
আমার সবচেয়ে পঠিত, লাইক ও কমেন্ট প্রাপ্ত পোস্ট।
সবচেয়ে পঠিত প্রবন্ধ।
আধুনিক কবিতার পাঠ (সমালোচনা)
আলোচিত ফিচার 'দি লাঞ্চিয়ন'।
ব্রিটেনের প্রবাস জীবন- স্মৃতিকথা।
সবচেয়ে পঠিত গল্প।
সবচেয়ে লাইকপ্রাপ্ত গল্প।
ছবি ব্লগ (লন্ডনের ডায়েরি-১)।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১৮ ভোর ৪:৫১
৩০টি মন্তব্য ৩২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×