somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এ কানট্রি ডক্টর (A Country Doctor); ফ্রাঞ্জ কাফকার (Franz Kafka) বিখ্যাত গল্পের অনুবাদ।

০২ রা অক্টোবর, ২০১৮ সকাল ১০:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


খুব অসুবিধায় পড়লাম; সময়টা মোটেও আমার অনুকূলে ছিল না। যাত্রাটি ছিল তাৎক্ষনিক, কিন্তু ভীষণ জরুরী। সেদিন প্রায় ১০ মাইল দূরে একজন খুব অসুস্থ রোগীক দেখতে যাওয়ার ডাক পড়েছিল আমার। রোগীর কাছে দ্রুত পৌছিতে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ভারী তুষারঝড়; ঝড়ে সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। আমার নিয়মিত যাত্রার বাহনটি খুব হালকা পাতলা গড়নের হলেও চাকাগুলো ছিল বেশ বড়; যা আমাদের গ্রামীণ রাস্তায় চলার খুব উপযোগী। ঠান্ডা থেকে বাঁচতে ঊলের কোটটা গায়ে দিয়ে নিজেকে ভালভাবে মুড়িয়ে নিলাম। হাতের ব্যাগে প্রয়োজনীয় ডাক্তারী যন্ত্রপাতি ভরে বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি; কিন্তু এতদূরে যাওয়ার জন্য তখন পর্যন্ত ঘোড়ার কোন ব্যবস্থা হয় নাই!

হ্যা, আমার যাতায়াতের ঘোড়ার জন্য অপেক্ষায় আছি।

এবারের ভারী তুষারপাতের ধকল সহ্য করতে না পেরে গত রাতে আমার ঘোড়াটা হঠাৎ করে মারা গেছে। এজন্য একটি ঘোড়ার ব্যবস্থা করতে কাজের মেয়েটি সারা গ্রাম চষে বেড়াচ্ছে সেই কখন থেকে। কিন্তু কেউ ঘোড়া ধার দেবে বলে মনে হয় না; আশা এক রকম ছেড়েই দিয়েছি। আমি জানি পাওয়া যাবে না। তবুও নিজেকে সান্তনা দিতে বেহুদা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকা তুষারপাতের উপর ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি।

অবশেষে মেয়েটি ফিরলো, কিন্তু একাকী! আমি যেমটা ভেবে ছিলাম ঠিক তাই হলো। সে হাতের ল্যানটন এদিক ওদিক ঘুরিয়ে আমাকে খুঁজতে লাগলো। এই তুষারঝড়ে কে তার প্রিয় ঘোড়াটি ধার দেবে, বলুন? আমি আঙিনায় আরেকটু এগিয়ে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম না কী করবো? চরমভাবে হতাশ হয়ে অব্যবহৃত পুরাতন একটি শুকরের ঘরের দরজায় লাথি দিতে লাগলাম। লাথির জোরে দরজাটি খোলে গিয়ে দোল খেতে লাগল।

একটি অচেনা ঘোড়ার উষ্ণ ঘ্রাণ নাকে এসে লাগল। অবাক হলাম! আরেকটু এগিয়ে যেতেই ভেতরে ল্যান্টনের নিভুনিভু আলো চোখে পড়ল। দেখলাম, নীল চোখের একজন হুডওয়ালা লোক সেখানে পড়ে আছে। "আমি কি ঘোড়াটি এখানে বেঁধে রাখতে পারি।" লোকটি দ্রুত এগিয়ে এসে বিনয়ের সাথে অনুমতি চাইলো। আমি বুঝতে পারছিলাম না জবাবে লোকটিকে কি বলব অথবা আমার কি বলা উচিৎ? একটু কাত হয়ে কৌতুহলী দৃষ্টিতে চারিদিকে আবার চোখটি বুলিয়ে নিলাম এখানে আরো কিছু আছে কিনা। কাজের মেয়েটিও চুপচাপ আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ মেয়েটি বলে উঠলো, "একজন মোটেও জানে না আরেকজন অপরিচিত লোক চুপিচুপি তার ঘরে কি করছে।" তার কথা শুনে আমরা উভয়েই হেঁসে উঠলাম।

অশ্বরোহী আমাদের দেখে হতবিহ্বল হয়ে কেঁদে উঠে বললো, "প্রিয় ভাই ও বোন, দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন।" দু'টি শক্তিশালী ঘোড়া একটার পেছনে আরেকটি গাঁধাগাধি করে আছে। তাদের পা গুলো শরীরের সাথে আঁটসাঁট করে জড়িয়ে আছে; মাথাগুলো দাঁড়িয়ে থাকা উটের মত মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে; পুরো দরজাটির পথ তারা আঁটকে আছে। একটু নাড়াচড়া করতে দেখা যাচ্ছে; লম্বা পা এবং বড় হৃষ্টপুষ্ট শরীর নিয়ে একদম সোজা দাঁড়িয়ে আছে।

আমি চিৎকার দিয়ে কাজের মেয়েটিকে বললাম, "লোকটিকে সাহায্য করতে হবে।" সাথে সাথে মেয়েটি তড়িৎ গতিতে আন্তরিকভাবে ঘোড়ার পিঠে বাঁধা ওয়াগনটিতে হাত দিল। কিন্তু অবাকের বিষয় মেয়েটি অশ্বরোহীর কাছাকাছি যেতেই লোকটি জোর করে তাকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরলো। ভয়ে মেয়েটি চিৎকার দিয়ে নিজেকে ছড়িয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। খেয়াল করে দেখলাম, মেয়েটির গালে দুই পালি দাঁতের কামড়ের দাগ! জায়গাটি লাল হয়ে আছে। আমি খুব রেগে চিৎকার দিয়ে লোকটিকে বললাম, "পশুর মত কেন তুমি মেয়েটিকে কামড়ে দিলে, কেন? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো লোকটি তো আমার অপরিচিত; কোথা থেকে সে এসেছে জানি না। লোকটি আমাকে নিজে থেকে সমস্যা হতে উত্তরণের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে; যেখানে গ্রামের সবাই না করে দিয়েছিল।

লোকটি এমন ভাব করছে যেন, আমি কি ভাবছি তা তার জানা! আমার রূঢ় ব্যবহারে কিছু মনে করবে না তো? আমার দিকে বার কয়েক তাকিয়ে আবারো ঘোড়াগুলো নিয়ে ব্যস্থ হয়ে পড়লো। হঠাৎ বলে উঠলো, "জলদি ঘোড়ায় উঠুন", সব কিছু তৈরী আছে। আমি মনের খুশিতে ঘোড়ায় সওয়ার হতে হতে বললাম, "আমি কখনো এতো সুন্দর ঘোড়ার পালের সাথে যাত্রা করার সুযোগ পাইনি। আমি সামনে থাকব। কারণ, আমি যে পথ দিয়ে যাব তা তোমার অচেনা।" উত্তরে সে সম্মতি দিল। একটু ভেবে আবার বললো, "আমি তোমার সাথে যাচ্ছি না, আমি এখানে রসার সাথে থাকবো।" শুনে রসা চিৎকার করে বলে উঠলো, "না, তুমি আমার সাথে তাকতে পারবে না।" কথাটি বলেই সে বাড়ির পানে দৌড় দিল। অজানা আশংকা ও ভয় অনুভব করলো সে।

আমি দরজার চেইটি টানার স্পষ্ট আওয়াজ শুনতে পেলাম; তালার শব্দও কানে আসলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম কত তাড়াতাড়ি সে বারান্দা পাড়ি দিয়ে দ্রুত পায়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল; যাতে কেউ সহজে তাকে খুঁজে না পায়। "তুমি আমার সাথে যাচ্ছ?" আমি অশ্বরোহীকে উদ্দেশ্য করে জানতে চাইলাম। তুমি আমার সাথে না গেলে আমি যাব না; তা যতই জরুরী হোক না কেন? এ যাত্রার বিনিময়ে আমি কোন অবস্থাতে মেয়েটিকে তোমার হাতে তুলে দিতে পারবো না। "যাও তাড়াতাড়ি", সে হাতে তালি দিতে দিতে বলে উঠলো। ঘোড়া দ্রুতবেগে ছুটতে লাগলো। এটা অনেকটা দ্রুতবেগে চলা স্রোতের মাঝে ভেসে যাওয়া এক টুকরো কাঠের মত।

আমার কানে এখনো বাজছে অশ্বরোহীর আক্রমণে কিভাবে দরজাটি ভেঙ্গে খান খান হয়ে গিয়েছিল; তারপর আমার চোখ-কান এমন একটি গর্জনের সাক্ষী হয়েছিল যা এখনো আমাকে আচ্ছন্ন করে আছে।


ভাবনাটি আর দীর্ঘ হলো না; ততক্ষণে আমি রোগীর বাড়ির উঠানে পৌছে গেছি। শেষ পর্যন্ত আসতে পারলাম! আমাকে দেখে তারা বাড়ির সদর দরজাটি খোলে দিল। ঘোড়াগুলো শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে; তবে তুষাপাত থেমে গেছে। চমৎকার চাঁদের আলোয় চারদিক আলোকিত। আমার উপস্থিতি দেখে রোগীর মা-বাবা তড়িৎ গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন; রাগীর বোনটিও পেছেনে পেছনে আসলো। আমাকে ধরাধরি করে ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামালো। তবে তাদের কথা বার্তার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। রোগীর ঘরটি এতো ছোট যে, মনে হচ্ছিল এখানে একজনও সুস্থভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। দেখলাম অযত্নে পড়ে থাকা চুলা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আমি ঘরটির জানালা খোলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সবার আগে অসুস্থ ছেলেটার প্রতি দৃষ্টি দিলাম।

রোগা চেহারা। তার শরীরে জ্বর-টর আছে বলে মনে হলো না; শরীর গরমও না আবার ঠান্ডাও না। খোলা চোখ, গায়ে কোন জামা নেই। ভারী কম্বলে মোড়ানো শরীরটা টেনে তুলে আমার গলা জড়িয়ে ছেলেটা কানে কানে বললো, "আমাকে মরতে দিন।" আমি চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালাম, না কেউ শুনতে পায়নি। সামনের দিকে ঝুঁকে তার বাবা-মা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে; আমার মতামতের অপেক্ষা করছেন তারা। সেবিকা আমার চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যাগটি রাখার জন্য একটা টুল নিয়ে আসলো। আমি ব্যাগটি খোলে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি খুঁজতে লাগলাম। রোগী বিছানায় শুয়ে অপলক চোখে আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমি তার অনুরোধটি ভুলে না যাই। আমি কয়েটি সন্না বের করে মোমবাতির আলোয় পরীক্ষা করে আবার রেখে দিলাম।

"অসুখটা ঈশ্বরের প্রতি অবিশ্বাস থেকে হয়েছে।" তার বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে আমি বললাম। সাথে যোগ করলাম, এসব ক্ষেত্রে কেবল ঈশ্বর সাহায্য করতে পারেন; একজন ডাক্তারের তেমন কিছু করার নেই।

ঈশ্বর হারিয়ে যাওয়া ঘোড়াটি ফেরৎ দিলেন; জরুরী হওয়ায় সাথে আরেকটি ঘোড়াও যুক্ত হলো! আর উপরি হিসেবে একজন অশ্বরোহীকে পাঠালেন। রসার কথা বারবার মনে পড়ছে আমার। আমি মেয়েটির জন্য কী করতে পারি? কিভাবে তাকে রক্ষা করবো? আমি কিভাবে তাকে অশ্বরোহীর কাছ থেকে বাঁচাতে পারি? এখান থেকে দশ মাইল দূরে তাকে অসহায় হয়ে ফেলে এসেছি।

বাঁধন একটু আলগা হওয়ায় ঘোড়াগুলো বাইরে থেকে দরজা খোলার চেষ্টা করছে। আমি জানি না এটা কিভাবে সম্ভব। তারা যেন জানালার ভেতর দিয়ে অসহায় পরিবারটির দিকে তাকিয়ে আছে। আমার এখনই ফিরে যাওয়া উচিৎ। আমার মনে হয় ঘোড়াগুলো আমাকে নির্দেশ করছে যাতে তাড়াতাড়ি ফিরে যাই। গরমের জন্য আমি কিছুই ভাবতে পারছি না। উলের গরম কোট খুলবো কিনা? সেবিকা জানতে চাইলো। আপ্যায়নের জন্য তারা এক গ্লাস মদ (রাম) নিয়ে আসলো। বুড়ো লোকটা আমার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বললো, সবচেয়ে প্রিয় সম্পদের বলিদান তার নিজের জন্য একটি পরীক্ষা। তার কথা শুনে আমি মাথা নাড়িয়ে দ্বিমত পোষণ করলাম। সংকীর্ণ মনা বুড়ো লোকটি ভাবলো আমি সুস্থ মানুষ নয়! সুস্থ হলে দ্বিমত পোষণ করতাম না। তাদের দেওয়া বিয়ার পান না করার একমাত্র কারণ ছিল এটি।

অসুস্থ ছেলেটির মা বিছানার পাশে বসা ছিলেন, তিনি ইশারায় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। একটি ঘোড়া যখন খুব আতঙ্কিত হয় তখন যে শব্দ করে আমি সেভাবে ছেলেটির বুকের কাছাকাছি মাথাটি নোয়ালাম। আমার ভেজা দাঁড়ির নীচে অদ্ভুত একটি শব্দ শুনতে পেলাম। এবার নিশ্চিত হলাম; ঘটনা যা ভাবছিলাম তাই। ছেলেটি স্বাস্থবান। মা তাকে যত্ন করে কফি খাওয়াচ্ছেন। ছেলেটি খুব সুঠাম ছিল বিধায় আমার ইশারায় এক ধাক্কায় উঠে বসলো। আমি পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে পারবো না, এখন তাকে মিথ্যা বলতে হবে। আমি জেলা প্রশাসনের অধীনে কাজ করি, আমি সব সময় নিষ্টার সাথে রোগীর চিকিৎসার জন্য মনোনিবেশ করি। খুব সামান্য বেতন হলেও আমি সামর্থ্যের সর্বোচ্চ ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করি। সর্বদা অসহায় ও দরিদ্রের সাহায্যে এগিয়ে আসি।

রসাকে দেখে শুনে রাখাও আমার দায়িত্ব। মনে হচ্ছে ছেলেটি মারা যাবে, আমিও চাই সে মরে যাক। কেন যে এতো ঠান্ডা উপেক্ষা করে এখানে এসেছি! আমার ঘোড়াটি মারা গেল; গ্রামের একটি লোকও তাদের ঘোড়াটা কিছু সময়ের জন্য আমাকে ধার দিল না। পরিত্যক্ত শুকরের ঘরটিতে ঘোড়াগুলো না পেলে হয়তোবা শুকরের পীঠে সওয়ার হয়ে এখানে আসতাম! এরা এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। আর জানলেও বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। আমি তাৎক্ষনিকভাবে রোগের ব্যবস্থাপত্র লিখতে পারি; কিন্তু মানুষকে বিষয়টি বুঝানো মুশকিল। আমাকে এবার রোগী দেখার পর্ব শেষ করতে হবে। তারা আবারো চেষ্টা করতে শেষ অনুরোধ করলো। এ বিষয়গুলোতে আমি অভ্যস্থ। রাতের বেলাও এলাকার লোকজন জরুরী সেবার জন্য আমাকে জ্বালায়। সুন্দরী রসাকেও এ জ্বালাতন সারা বছর ধরে সহ্য করতে হয়। এটা মেয়েটার অনেক বড় ত্যাগ আমি তা বুঝি।

আমি হাতের ব্যাগটি গুছিয়ে নিলাম এবং উলের কোটটি এগিয়ে দিতে বললাম। পরিবারের সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার বাবা হাতের বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিতে ব্যস্ত। আর ছেলেটির মা? সম্ভবত আমার উপর নাখোশ। আমার এর চেয়ে বেশি কিছুই করার ছিল না। তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে ঠোঁট কামড়াচ্ছেন। সেবিকা রক্তে লাল রুমালটি দিয়ে ছেলেটার শরীর মুছে দিচ্ছে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছেলেটার উপর অশরীরী কোন আত্মার ছায়া পড়েছে। আমি তার দিকে এগিয়ে যেতেই সে একটি হাসি দিল। আমার প্রস্থান তাকে দারুন এক স্বস্তি এনে দিচ্ছে। হঠাৎ সে 'উহ!' করে একটি নিঃশ্বাস নিল। ঘোড়া দু'টিও সম্ভবত শব্দটি শুনতে পেল। মনে হলো শব্দটি উপর থেকে ভেসে এসেছে আমাকে জানিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি নিশ্চিত ছেলেটা খুব অসুস্থ। দেখলাম ছেলেটার নিতম্বের ডান পাশে খোলা হাতটি রাখা। কিন্তু খোলা হাতের তালুটি দেখতে অনেকটা গোলাপী রঙের। তবে তার উপরের দিকটার রঙ কিছুটা ভিন্ন। ছোপ ছোপ রক্তের দাগ সর্বত্র। দূর থেকে লাইটের আলোর মত লাগছে। কিন্তু কাছ থেকে দেখা যায় না; এজন্য মনযোগ দিয়ে খেয়াল না করলে এটি কারো চোখে পড়বে না। এটি আমার সবচেয়ে ছোট আঙুলের চেয়েও ক্ষুদ্র দেখতে, পাশাপাশি রক্তাক্ত। গভীর মনযোগে দেখলাম, সাদা রঙের ছোট ছোট পোঁকাগুলো কিলবিল করছে। এরা আক্রান্ত জায়গায় একজোট হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে।


বেচারা! কেউ তোমাকে সাহায্য করতে পারছে না। আমিই খুঁজে পেয়েছি তোমার হাতের বড় ক্ষতটি। এই ক্ষতটির জন্য তুমি মরতে বসেছ! আমি তোমার সুস্থতার জন্য চেষ্টা করছি এটা দেখে পরিবারের সবাই বেশ খুশি। সেবিকা ছেলেটার মাকে ক্ষতটির বিষয়ে জানালো, তিনি স্বামীকে তা অবগত করলেন, এরপর বাড়িতে আসা আগন্তুকদের জানালেন। যারা সুন্দর এ জোছনা রাতে দরজার মুখে ভীড় জমিয়ে উঁকি দিচ্ছে।

"তুমি কী আমাকে বাঁচাতে পারবে?" ফিসফিস করে ছেলেটি জানতে চাইলো। সে একটি ককানি দিয়ে আবারো বললো, " আমার জীবনটা এই ক্ষতের মধ্যে সীমাবদ্ধ।" আমাদের এলাকার লোকজন এমনই। তারা সব সময় ডাক্তারদের কাছে অবিশ্বাস্য কিছু আশা করে। তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের বিশ্বাস ভুলে গেছে। একটা সময় যাজকরা বাড়িতে এসে লম্বা গাউন পরে একটার পর একটা মন্ত্র জপ করতেন। কিন্তু ডাক্তাররা তাদের অর্জিত বিদ্যা দিয়ে সবকিছু জয় করতে চায়। এটা ঠিক না।

ভাল কথা, তারা হয়তো এভাবেই ভাবতে অভ্যস্থ; মনে মনে ভাবলাম আমি। কিন্তু আমি চাই না আমার বেলায় এমনটি হোক। তাদের উদ্দেশ্য যদি সৎ হয় তাহলে তাকে মরতে দেখতে আপত্তি নেই। একজন বুড়ো গ্রামীণ ডাক্তার হিসেবে আমার আর কি করার আছে? আমি এত অসহায় যে, কাজের মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গেছে; অথচ কিছুই করতে পারি নাই।

ভাবনার মাঝখানে হঠাৎ গ্রামের আবাল বৃদ্ধ সবাই ছুটে এসে আমাকে আক্রমণ করলো; টেনে হিচড়ে একদম ন্যাংটা করে দিল। ঘটনার আকষ্মিকতায় আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। গান গাইতে গাইতে স্কুলের একদল শিশু তাদের শিক্ষক সহ দলবলে ছুটে এসে বাড়িটার সামনে দাঁড়ালো এবং সুর করে গাইতে শুরু লাগলো-

"কাপড় তার খুলে নাও, যাতে আরোগ্য হয়;
যদি ছেলেটি সুস্থ না হয়, তবে তাকে মেরে ফেল।
একজন ডাক্তার মাত্র, কেবল একজন ডাক্তার।"

এবার আমি বাধ্য হয়ে কাপড় খুলে নগ্ন হয়ে একপাশে কাঁত হয়ে দাড়িতে আঙুল দিয়ে বিলি কাটতে লাগলাম এবং শান্তভাবে তাদের দিকে তাকালাম। এমন পরিস্থিতিতেও আমি পুরোপুরি শান্ত; যদিও তাতে আমার কোন ফায়দা হচ্ছে না। আমি মনে মনে প্রমোদ গুনতে লাগলাম এবং সম্ভাব্য কি ঘটতে পারে তা নিয়ে শংকিত হলাম। আগন্তুকেরা এবার আমাকে মাথা দিয়ে গোতা দিতে লাগলো এবং লাথি দিয়ে টেনে হিচড়ে নীচে ফেলে দিল। তারা ওয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে আমাকে এমনভাবে বসিয়ে রাখলো যাতে অসুস্থ ছেলেটার ক্ষতটা দেখতে পাই। এবার সবাই দরজায় শক্ত করে তালা লাগিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

খেয়াল করে দেখলাম ছোট বাচ্চাদের গান থেমে গেছে। লোকজনের কোন উপস্থিতিও টের পাচ্ছি না। পরিবেশ বেশ শান্ত। মনে হচ্ছে, চাঁদের আলো মেঘে ঢেকে গেছে। তবে আমার বিছানাটি বেশ উষ্ণ। জানালার ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে ঘোড়াগুলোর মাথার ছায়া দেখা যাচ্ছিল।

হঠাৎ শুনতে পেলাম কেউ একজন বলছে, "তুমি কি জানো, তোমার উপর আমার বিশ্বাস খুবই অল্প। আমার তো মনে হয় তুমি নিজের পায়ে এখানে আস নাই। হয়তো উড়ে এসেছ। সাহায্য করার পরিবর্তে তুমি আমাকে মরে যেতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছ। ভাল হয় যদি তুমি নিজের চোখ কচলিয়ে সত্যটা উপলব্ধি করতে পার।"

উত্তরে আমি বললাম, "ঠিক আছে। তবে এটা আমার জন্য ভীষণ অপমানের। একজন ডাক্তারের সাথে এমন আচরণ কখনো কাম্য হতে পারে না। একজন ডাক্তার হিসেবে আমি আর কি করতে পারি?" বিশ্বাস করুন, পরিবেশ মোটেও আমার অনুকূলে ছিল না। এই অজুহাতে আমি কি সন্তুষ্ট? হায়! সম্ভবত তা-ই। আমার সব সময় তাই করার কথা। সে আরো বললো, "আমি পৃথিবীতে খুব সুন্দর একটি ক্ষত নিয়ে এসেছি; আর এতে আমি নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছি।"

"শোন বন্ধু; তোমার ভুল হলো, এর জন্য কোন ভূমিকা ছিল না। আমি ইতিমধ্যেই তোমার ঘরের চারদিকে নজর দিয়েছি। তবে আমি বলতে চাই ক্ষতটি খুব মারাত্মক নয়।

কিন্তু এবার নিজের পালানোর পথা বের করতে হবে। দেখলাম ঘোড়াগুলো শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। দ্রুত কাপড়-চোপড়, কোট-টাই এবং ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। কাপড় পরতে কোন সময় নষ্ট করা যাবে না। আসার সময় যেমন ছিল ঘোড়াগুলো যদি এভাবে দ্রুতবেগে এগিয়ে যায় তাহলে অল্প সময়ে বাড়ি ফিরতে পারবো। তড়িঘড়ি করে আমি লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠলাম। আমাকে উঠতে দেখে একটি ঘোড়া বাধ্য ছেলের মতো জানালাটি খুলে দিল! আমি যাবতীয় জিনিসপত্র গাড়িতে ছুড়ে মারলাম; কিন্তু পশমী কোটটা দূরে গিয়ে একটি হুকে আটকে গেল। আমি লাফ দিয়ে উঠে ঘোড়ায় সওয়ার হলাম। আমি আলগা করে লাগাম টেনে ধরলাম। পাশাপাশি দু'টি ঘোড়া ছুটছে। পেছনে গাড়ির ওয়াগন। তবে চামড়ার কোটটি টিকই সাথে নিয়েছি। গাড়ি ঘুরিয়ে দিলাম টান। আমরা তুষারের মধ্য দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটতে লাগলাম। নিজেকে তখন পরাজিত একজন মানুষ মনে হলো। দেহ ও মন কেমন যেন অসাড় লাগছে। বয়সটা মনে হলো অনেক বেড়ে গেছে। শারিরীক আর মানসিক পরিশ্রম নিজেকে একদম বয়োবৃদ্ধ বানিয়ে দিয়েছে।

উপভোগ কর, আর ধৈর্য্য ধর।
ডাক্তার তোমার সাথে বিছানায় শুয়ে আছে।

আমি হয়তো আর কখনো এভাবে বাড়িতে আসবো না; উদ্যম একদম নষ্ট হয়ে গেছে। একজন উত্তরাধিকারী আমাকে হরণ করেছে। কিন্তু এতে তার কোন উপকার হবে না। সে কখনো আমার স্থান দখল করতে পারবে না। বাড়িতে বিরক্তিকর অশ্বরোহী লোকটা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ধ্বংসলীলা চালাতে পারে। এতক্ষণে হয়তো রসা তার শিকারে পরিণত হয়েছে। আমার মনে হয় না এ থেকে মুক্তি মিলবে। বাজে, অন্ধকার এ সময়টাতে, অসুস্থ পার্থিব অসাড় ঘোড়াগুলো আমি কোন রকমে চালিয়ে নিচ্ছি। চামড়ার কোটটি গাড়িতে ঝুলছে; কিন্তু এত পরিশ্রান্ত ছিলাম যে, তা ধরতে পারছিলাম না।

বিশ্বাস ঘাতকতা! এটি একজন ডাক্তারের সাথে স্রেফ বিশ্বাস ঘাতকতা!!

"রাতে দরজায় ভুল সংকেত পেয়ে অসাবধানতাবশত একবার দরজাটি খুলে দিলে, পরে আর তা শোধরানো যায় না। কখনো না।"


লেখক পরিচিতি -

'Franz Kafka' ১৮৮৩ সালে ৩ জুলাই চেকোস্লোভাকিয়ায় (Czech Republic) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে একজন ঔপনিবেশিক এবং গল্পকার ছিলেন। তাঁকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সফল সাহিত্যিক হিসেবে মনে করা হয়। 'প্রাগের' একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া এ সাহিত্যিক ছিলেন জার্মান ভাষাভাষী। তিনি আইন বিষয়ে পড়াশুনা করলেও চাকরি করতেন ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে। সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি তিনি 'চিটি' লেখতে পছন্দ করতেন।

১৯২৪ সালের ৩রা জুন মাত্র ৪০ বছর বয়সে তিনি অস্ট্রিয়ায় মারা যান।

লেখকের বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো -

(১) The Metamorphosis
(২) The Trial
(৩) In the penal colony
(৪) The castle
(৫) A hunger artist
(৬) Letter to his father
(৭) The complete stories
(৮) Amerika
(৯) Letters to Milena
(১০) A country doctor (etc).


ফটো ক্রেডিট,
গুগল।

চাইলে পড়তে পারেন-

আমার সবচেয়ে পঠিত পোস্ট।
সবচেয়ে লাইকপ্রাপ্ত গল্প-ধূমকেতু
ধর্ষণ ও ধর্ষক (বাংলাদেশ/বহির্বিশ্ব)
অনুবাদ গল্প-(দি নেকলেস)
দি গিফট অফ দ্যা ম্যাজাই
গল্প লেখার সহজ পাঠ
সবচেয়ে পঠিত প্রবন্ধ।
আধুনিক কবিতার পাঠ (সমালোচনা)
আলোচিত ফিচার 'দি লাঞ্চিয়ন'।
ব্রিটেনের প্রবাস জীবন- স্মৃতিকথা।
সবচেয়ে পঠিত গল্প।
ছবি ব্লগ (লন্ডনের ডায়েরি-১)।


সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৮:০৬
৩২টি মন্তব্য ৩২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

আমরা সবাই জানি, ইরানের সাথে ইজরায়েলের সম্পর্ক সাপে নেউলে বললেও কম বলা হবে। ইরান ইজরায়েলকে দুচোখে দেখতে পারেনা, এবং ওর ক্ষমতা থাকলে সে আজই এর অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়।
ইজরায়েল ভাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

নগ্ন রাজা কর্তৃক LGBTQ নামক লজ্জা নিবারনকারী গাছের পাতা আবিষ্কার

লিখেছেন মুহাম্মদ মামুনূর রশীদ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪০

LGBTQ কমিউনিটি নিয়ে বা এর নরমালাইজেশনের বিরুদ্ধে শোরগোল যারা তুলছেন, তারা যে হিপোক্রেট নন, তার কি নিশ্চয়তা? কয়েক দশক ধরে গোটা সমাজটাই তো অধঃপতনে। পরিস্থিতি এখন এরকম যে "সর্বাঙ্গে ব্যথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×