"দেয়ালে দরোজাটা আসলে আঁকা!" পথচারী কেউ এক ঝলকে বলেই হাঁটা দেয় নিজ গন্তব্যে।
কথাটা খুব সম্ভব সত্যি। আঁকাটা বিশ্বাসযোগ্য হলেও অঙ্কনের সব ছাপও ওতে সুস্পষ্ট। কিন্তু দেয়ালের ওপাশ থেকে ভেসে আসা মধুর টুং টাং, মৃদু মদির হাসি বড় মন্ত্র-মুগ্ধ করে রাখে। দরোজার ঘন্টি বাজাই, কান পাতি, ওইতো তার শব্দও শোনা যায়। দরোজা খোলে না।
খোলে না দরোজা, ক্রমে বাড়ে ভীড়। কত বিচিত্র নর-নারী, আমার কি সাধ্য হবে এদের টপকাই! "নিজেদের যোগ্য করে তোলো, নির্বাচিতরাই কেবল প্রবেশের অনুমতি পাবে!"- সহসাই গুজব রটে। "যে কোন নারীকে আমি তৃপ্তি দিতে সক্ষম", "আমার সতীত্বমূল্য চির প্রশ্নাতীত", "যৌবনের স্থায়িত্ব নিয়ে গবষেক আমি", "আমি অপরিহার্য, আমি পরিচ্ছদ সাজাই", "যে কোন নতুন মাল আমি বেঁচে দেই নতুন কৌশলে"- আরও কত কত স্বর। "আমি কবিতা করি, আমি কবিতা করি"- মিনমিনে কণ্ঠ বলে এক কোন থকে। "চোপরাও সব! আমি দণ্ড আর বিধান দাতা, আমাকে জায়গা ছেড়ে দাও!" হুকুম করে এক বজ্রকণ্ঠ।
বজ্রকণ্ঠ আমাকেও দমিয়ে দেয়। আমার কি হবে স্থান! বিশেষ কেউ যে নই আমি, তাই এক কোনে বসে দুলি নিরাশার দোলে। ক্রমে দরোজার সামনে গড়ে ওঠে কোলাহল ভরা মাঠ, দালালে র্পূণ গণিকালয় আর হতশ্বাসপ্লাবিত শুঁড়িখানা। তাদের উচ্চস্বরে দেয়ালের ওপারের মৃদু শব্দ প্রায়শঃই ঢাকা পরে যায়। প্রায়শঃই ভ্রম হয়, ওই পারে কখনোই কিছু ছিল না। কখনো মনে হয়, এপারেই, এরই মাঝে, কোথাও আছে নিষ্কৃতি।
নিষ্কৃতির খোঁজে তাই বেশি বেশি বেচি, কিনি আরও বেশি। ক্রমশঃ যোগ্য হয়ে উঠি। আকণ্ঠ পানে আর এলোমেলো রমণে ডুবে যেতে চাই বিস্মৃতির অতলে। আর কী অভিশাপ দেখো! প্রতিটি সফল সওদা শেষে বুঝি নিষ্কৃতি নেই। মগজের কোষগুলো সুরায় ডোবালে আরও যেনো বেশি বেশি জেগে ওঠে তারা। প্রতিটি তুমুল সঙ্গম শেষে বোধ করি আরও বেশি একা।
একা একা তাই হেঁটে চলে যাই মায়া দরোজার সামনে। "দরোজা খোলো। খুলে দাও এই রূদ্ধ কপাট। এই আমি, অসহায় একা, আত্মসর্মপণ করছি। নিয়ে নাও আমাকে। মেনে নেব সব র্শত, পরিশুদ্ধ হব আত্মায়। গ্রহণ করো আমাকে।" করাঘাত করি, মাথা ঠোকরাই। নতজানু হই। নিথর সেই দরোজা।
দরোজার সামনে ক্রমে জমে ওঠে মৃত কত সভ্যতার স্তুপ; তাদের মজ্জা শুষে গড়ে ওঠে আরও শত শত। হট্টগোলে চাপা পড়ে গেছে ওপারের মৃদু সব ধ্বনি! ছুটতে ছুটতে একজন ঘোষণা করে "শো-নো-ও, দরোজার ওপারে সব মৃত বহুকাল, কেউ শুধু পায়নিকো টের!" বলে সে নিজেও ঢলে পড়ে শান্তির ঘুমে। অস্থি আর কঙ্কালের স্তুপে বসিয়ে দূরবীণ কেউ কেউ দেখে নিতে চায় ওপারে জগত, মায়াদেয়ালও ক্রমশঃ উচ্চতর হয়...।
মায়া দেয়াল উচ্চতর হয়, বিস্তারিত হতে থাকে আমাদের মায়া বাজারখানা। ক্রমশঃ আদিগন্ত ছড়িয়ে পড়া সেই র্সবগ্রাসী নগরে, রোজ রাতে বুনো এক মোষ বুকের ভেতরে ডেকে ওঠে আ-ড়-ড়-ড়-ড়-ড়... আহ্-হাহ্-হা...
আর যে পারি না।
প্রভু, একবার দয়া কর, একবার।
ডিসেম্বর ০৭
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০০৯ ভোর ৫:২৯