somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

খোরশেদ খোকন
আমার জন্ম টাঙ্গাইলের হামজানি গ্রামে। শৈশব, কৈশোরে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে ছিলাম; বাবার সরকারী চাকুরীর জন্যে। কলেজ ছিল টাঙ্গাইল জেলায়। তারপর পড়াশুনা ঢাবি'র ফিন্যান্স বিভাগ। গত নয় বছর যাবত প্রাইভেট ব্যাংকে কর্মজীবন চলছে। www.facebook.com/khokonz

স্মৃতির জোনাকিরা... (শৈশবের দিনগুলি-০৫)

২৪ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটু ভুমিকা করে নেই। আসলে, অতীতটা ঠিক মতো গুছিয়ে লেখা হচ্ছে; পুরানো গল্পের বইয়ের মতোই। যাকে একবার পড়া মানে একবার নতুন করে অতীতে ফিরে যাওয়া; আবার বর্তমানে চলে আসা...। আমি আমার অতীত নামের শৈশব পুস্তককে বার বার পড়তে চাই। পড়তে চাই স্মতির চোখ দিয়ে...।

ভেবে দেখুন, শৈশব মানুষের জীবনে এমন এক দুরন্ত অধ্যায়ের নাম। যে অধ্যায়ে একটা সুতাছেঁড়া ঘুড়ির পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে পার হয়ে যাওয়া যায় তেপান্তরের মাঠ। একটা ফড়িংয়ের পিছু নিয়ে মনের ভুলেই কাটিয়ে দেওয়া যায় সকাল-দুপুর-বিকেল। একটি বালক কিংবা বালিকার চোখে তার শৈশবটা কি মধুর, তাই না!

যাই হোক, আমার বড়বোন রোজী’র জন্ম হয়েছিল নানার বাড়ীতে মানে টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার আনেহলা গ্রামে আর আমার জন্ম হয়েছিল দাদার বাড়ীতে মানে টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি থানার হামজানি গ্রামে।

বাবা তখন জামালপুর থানায় চাকরী করতেন। গ্রীষ্মের কিংবা শীতের ছুটিতে গ্রামে বেড়াতে যাবার কথা উঠলেই আমি বলতাম দাদার বাড়ীর কথা আর আমার বোন বলতো নানার বাড়ীর কথা।

আমার বোন বরাবরই নানার বাড়ী খুব পছন্দ করতো। আমার নানা মানে জব্বর মণ্ডল বিয়ে করেছিলেন দুইটা। আমার মা হচ্ছেন ছোট-নানির মেজ-মেয়ে। নানাকে প্রথম বিয়েটা করিয়েছিলেন তার বাবা। শুনেছি, নানার বাবা তার বন্ধু (নাম হাফিজ উল্লাহ্‌) এর মেয়েকে পছন্দ করে নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন।

এদিকে, নানা (নাম জব্বর মণ্ডল) বড় হয়ে যখন বিয়ে বিষয়টা বুঝতে শিখেন তখনও বড়-নানি (হাফিজ উল্লাহ্‌র মেয়ে) তার বাবার বাড়িতেই থাকতেন। নানা বড়-নানিকে তালাক দেন নাই কিন্তু নিজে পছন্দ করে দ্বিতীয় বিয়েটা করেন (আমার নানিকে)। শুনছি, দ্বিতীয় বিয়ের পরেই দুই নানি একসাথে মিলে সংসার শুরু করেন। এখনও আমার বড়নানি জীবিত আছেন; আর ছোটনানি মারা গেছেন তাও দুইবছর অতিবাহিত হতে যাচ্ছে...।

আমার বড়নানির একছেলে (নাম দুলাল মণ্ডল) ও একমেয়ে (নাম ফুলে)। আর ছোটনানির ছয়মেয়ে (জবেদা, খাদিজা, রহিলা, আম্বিয়া, বেগম, সেলিনা) ও একছেলে (নাম জালাল মণ্ডল)।

তার মানে; আমার দুইটা মামা আর ছয়টা খালা (আমার মায়ের নাম খাদিজা, তাকে হিসাব থেকে বাদ দিয়েই ছয়জন)। আমাদের খালার সংখ্যা বেশী থাকাতে নানার বাড়ীতে সব-সময়ই একটা উৎসবের মতো পরিবেশ লেগে থাকতো। খালা/মামা সবাই মিলে আমার বোন আর আমাকে কোলে-পিঠে করে সারাদিন আদর করতো, ঘুরে বেড়াতো...।

আমার বড়মামা (নাম দুলাল মণ্ডল) আগেই বলেছি, সে বড়নানীর একমাত্র ছেলে। সে তেমন পড়াশুনা করেন নাই। আমি জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি বড়মামা জমিজমা দেখাশুনা করছেন। আর মামি বাড়ীর এতোগুলো মানুষের খাবার দাবার নিয়ে ব্যস্ত দিন অতিবাহিত করছেন।

আমি অবাক হতাম এটা ভেবে যে, আমি রাতে যখন ঘুমাতে যেতাম তখন দেখতাম মামি কাজ করছেন; আবার সকালে ঘুম থেকে উঠেও দেখতাম মামি কাজই করছে। সংসার চালানো এতো কষ্টের আর ঝামেলার বিষয় তা মামিকে দেখে বোঝার কোন উপায় ছিলনা...! তিনি যেনো সারাদিন বাড়ীর সবার আবদার/অনুরোধ/ইচ্ছা রাখতে পারার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পেতেন।

আমার ছোটমামা (নাম জালাল মণ্ডল) মানে আমার ছোটনানীর একমাত্র ছেলে। সে আমার চাইতে বয়সে একমাসের ছোট ছিল। আমার সাথে তার বরাবরই বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আমি আর ছোটমামা (আমি আসলে জালাল নামেই ডাকি, মামা বলিনা...!?) মিলে একত্রে সারাটা গ্রাম ঘুরে বেড়াতাম, লাটিম ঘোরাতাম, ঘুরি ওড়াতাম, পুকুরে সাঁতার দিতাম, হা-ডু-ডু/ফুটবল খেলতাম।

আমার নানার বাড়ীর সামনে পূর্বদিকে বিশাল ক্ষেত/মাঠ, সেই মাঠ পেড়িয়ে আরও পূর্বে গেলেই ডাকাতিয়া বিল। বর্ষা মাসে বড়মামার সাথে আমি সেই বিলে যেতাম ডিঙ্গি নৌকায় চরে। বিলের স্বচ্ছজলে বুক-পরিমাণ পানিতে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমি শাপলা ফুল তুলতাম, পানিতে ডুব দিয়ে কাঁদা-মাটি থেকে তুলে আনতাম শাপলা ফুলের গাছ। শাপলা গাছের গোঁড়ায় যে শালুক ফল হতো, পানিতে ডুবে ডুবে আমি সেই কালো রঙের শালুক ফলও তুলে আনতাম।

শাপলার সাদা-হলুদ ফুল আর কচুরি-পানার সাদা-বেগুনি ফুল ফুটে থাকতো চারিদিকে। কচুরি-পানা আর শাপলা ছাড়াও আরও অনেক ফুল ফুটে থাকতো নল-খাগড়া আর হেলেঞ্চার ডগায়, আমি সেসব ফুল আর ফলের নাম ভুলে গেছি...।

আমি দেখতাম, কৃষি-কাজ করা খেটে-খাওয়া দেহাতী মানুষগুলো পানিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে কাস্তে দিয়ে কালো রঙের এক প্রকার ধান কাটতো (ধানের নাম ভুলে গেছি...)। গভীর পানিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে কাস্তে দিয়ে পাট গাছ কেটে ডাঙ্গায় নিয়ে আসতো একদল কৃষক আর ডাঙ্গায় উঠেই হুক্কা/বিড়িতে বড় করে ফুঁ দিতো। দেখে মনে হতো, হুক্কা/বিড়িতে ফুঁ না দিলে তারা এই কাজটা করতেই পারবে না...!?

বিলের মাঝে সারি সারি পাট গাছের লাইন থাকতো; পানিতে পাট পচিয়ে আশ ছাড়ানোর জন্য বাধের মতো করা হতো। আমি ডিঙ্গি নৌকা থেকে পাটের লাইনে নেমে হেঁটে হেঁটে বিলের জমিন পেড়িয়ে যেতাম। লাফিয়ে লাফিয়ে এক লাইন থেকে অন্য লাইনে চলে যেতাম। পাটের লাইনে কেবল শিশুরাই হাটতে পারতো কেননা পাটগাছের সারি তেমন একটা ওজন নিতে পারতো না।

পাটের আশ ছাড়ানোর কাজটা দেখতে এতো চমৎকার লাগতো, যেন একটা শিল্প কর্ম দেখছি...। একটা রিদমের মধ্য দিয়ে কাজটা শুরু হয়ে আবার অন্য একটা রিদমের মধ্যে দিয়ে কাজটা শেষ হতো...।

দুপুর রোদে পাটগাছের বাঁকল (আঁশ, চামড়া) আর পাটগাছের সোলা (কাণ্ড, পাটখড়ি) শুকাতে দেয়ার দৃশ্য কল্পনা করলেই মন ভাল হয়ে যায়। সারি সারি বাঁশের লাইনের উপর রোদে পাটের বাঁকল শুকান হতো, গ্রামের মেয়েরা/মহিলারা সুন্দর করে চুল বাধাঁর মতো করে পাটের আশের বেনী বাঁধতো। একবার বেণী বাধার পরে রোদে পাটের আঁশের একপাশ শুকিয়ে গেলে অন্যপাশটা শুকানোর জন্য সেই বেণীটা খুলে নতুন করে বেণী বাঁধা হতো...।

পাটের শোলা (পাট খড়ির) শুকানোর জন্য রোদে পাটঘড়ির আঁটি বাঁধা হতো, তারপর সেই বাঁধা আঁটি গোল গোল ঘরের মতো করে শুঁকাতে দেয়া হতো। পাটখড়ির সেই গোল গোল ঘরে, বাচ্চা ছেলেমেয়েরা খুব সহজেই লুকাতে পারতো। আমরা পাটখড়ির আটিতে লুকিয়ে লুকিয়ে চোর-পলান্তি খেলা খেলতাম...।

বিলের পানি যে নালা দিয়ে নামে যেতো, সেই নালা/খালের উপরে বড়মামা বাঁশ দিয়ে মাচা বানাতো। বাঁশের মাচায় বসে জাল (খরা-জাল) দিয়ে মামার মাছ ধরা দেখতে, এতো আনন্দ লাগতো...।

বাঁশের মাচার কাছে ছোট ছোট চাঁদা মাছ ঘুরাঘুরি করতো। আমি জালে উঠা চাঁদা-মাছের পিঠের কাটায় কচুরিপানার ডগা কিংবা নল-খাগড়ার ডগা লাগিয়ে দিতাম। চাঁদা মাছ সাঁতার দিতো কিন্তু ডুবতে পারতো না। চাঁদা মাছটা সাঁতার দিয়ে কোথায় যাচ্ছে; তা দেখা যেতো বহুদূর পর্যন্ত...।

সারা বিকেল খরা-জালে মাছ ধরে আমরা সন্ধ্যায় আগেই বাড়ী ফিরে আসতাম। খালই ভর্তি মাছগুলো উত্তেজনা নিয়ে লাফা লাফি করতো, (এখন অনেক মাছের নামও ভুলে গেছি...)।

আমার বোন নানার বাড়ী পছন্দ করার কারন বাড়ীতে এতোগুলো খালা মিলে হই-হুল্লোড় করা। সে সময় খাবার মানেই ছিল বিভিন্ন ঋতুতে যে সকল ফল হতো, সেগুলো খাওয়া আর আড্ডা দেয়া।

বিকেল বেলা ফেরিওয়ালা আসতো বাড়ীর উঠানে, আমার খালারা স্কুলের টিফিন থেকে জমানো টাকা দিয়ে দুহাত ভরে খাবার-দাবার মানে চকলেট, আইসক্রিম, বাদাম, নাড়ু, বিস্কিট, চানাচুর, গুরের টানা, বাদাম টানা ইত্যাদি কিনতো (অনেক খাবারের নাম এখন মনে পড়ছে না...)।

বাড়ীর উঠানে আর বারান্দায় বসে বসে ক্যারাম, লুডু আর দাবা খেলা হতো। সেই সময় বাদাম আর পানি থেকে তুলে আনা পানি-ফল (সিঙ্গারা) খাওয়া হতো। বিভিন্ন শিমের আর কাঁঠালের বীচি ভেঁজে খাওয়া হতো। প্রতিটা খাবার আমরা খুব উৎসাহ নিয়ে প্রতিযোগিতা করে খেতাম...।

শীতের দিনের মজা ছিল অন্যরকমের...। বাড়ীর পাশে ছিল মেঠোপথ, খুব সকালে কুয়াশা জড়ানো শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমরা গিয়ে উঠানে বসতাম সূর্যের আশায়...। কেউ কেউ ধানের-খড়, নল-খাগড়া, পাট-খড়িতে আগুন জ্বালিয়ে তাপ পোহানোর আয়োজন করতো। সেই তাপ পোহানোর আগুনে বিভিন্ন কালাই/শিম পোড়ানো হতো আর আড্ডা দিতে দিতে খাওয়া হতো।

সে সব গ্রামেই দুই/তিন জন করে গপ্প বলার লোক ছিল। তাদের কাজ ছিল শুধুই গপ্প বলা। কেউ তাদের একবেলা খাবার দিলেই তারা সারারাত গপ্প করে কাটিয়ে দিতো। বিভিন্ন নবী আর রূপকথার গল্প ছিল তাদের বিষয়। নানা আর নানি আমাদের গল্প বলতো কিন্তু গপ্প বলার লোকের গল্প শুনতেই বেশী ভাল লাগতো। মনে হতো, এদের গল্প যদি কোন দিন শেষ না হতো...।

রাস্তা দিয়ে তাল আর খেজুরের রস নিয়ে যেতো গ্রামের গাছী। আমরা শীতে কাঁপতে কাঁপতে তাল আর খেজুরের রস পান করতাম, মনে হতো যেনো অমৃত পান করছি।

শীতের রাতে পিঠা বানানো শুরু হতো, চুলার পাশে গোল হয়ে বসে পিঠা বানানো দেখা আর গরম গরম পিঠা খাওয়ার আনন্দ ছিল অন্যরকম।

চুলার চারদিকে আমরা জটলা করে বসে থাকতাম, একটা করে ভাপা পিঠা ভাপে-সিন্ধ হতো আর আমরা গরম গরম সেটাকে খেতাম। চুলার চারদিকে কাঠ-পুরানো ধোঁয়ার অন্যরকম একটা মায়াবী আঁধার নেমে আসতো...।

নানার বাড়ীটা ছিল স্বপ্নের মতো সুন্দর...। কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেই বাড়ীর আঙিনা, কিছুটা উঠান পাড় হলেই কাচারি ঘর, যেখানে অপরিচিত অতিথিদের বসতে দেয়া হতো। নিকট আত্মীয়-স্বজন যারা বাড়ীতে বেড়াতে আসতো তারা কেউ কাচারি ঘরে যেতো না, তারা সরাসরি ভেতর বাড়ীতেই চলে আসতো।

ভেতর বাড়ীতে প্রথমেই বড় একটা উঠান তার চারপাশে টিনের চৌচালা ঘর। একপাশে গোহাল ঘর। বাড়ির চারধারেই গাছ পালা। পশ্চিমের সীমানায় বাথরুম, গোছল-খানা, কুয়াতলা, টিউবওয়েল আর বাড়ীর সীমানা ঘেসে খাল। কুয়াতলা জায়গাটা ঘন বাঁশঝাড় দিয়ে ঘেরা, রাতে কেউ একা যাবার সাহস পেতো না...।

সামনের কাচারি বাড়ীতে বসে রাস্তা দিয়ে কে যাচ্ছে সেটা দেখা যেতো। আমরা সারাদিন পরিচিত/অপরিচিত মানুষের যাতায়াত দেখতাম। আনেহলা গ্রামে কোন হাট-বাজার ছিল না। আমরা ৩/৪ মাইল হেঁটে হেঁটে দূরের নারিন্দা হাটে যেতাম।

হাটে যাবার সময় যদি গ্রামের কোন গপ্প বলা লোক জুটতো তাহলে আর কথাই থাকতো না। তাদের হাটে নিয়ে কোন একটা খাবার খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেই তারা গল্প শুরু করে দিতো...। তারা গল্পটা এমনভাবে বলতো, ঠিক হাটে পৌছানো পর্যন্তই কাহিনীটা চলতো...। ভাবতে অবাক লাগে যে, তারা গল্পের কাহিনীটাকে রাস্তার দূরত্বের অনুপাতে বলায় খুবই পারদর্শী ছিল...।

পৌষ মাঘ মাসের শীতে স্থানীয় হাটুরে লোকজনকে দেখতাম গায়ে কাঁথা কিংবা চাদর মুড়ি দিয়ে কথা বলতে-বলতে, বিড়ি-সিগারেট টানতে-টানতে, পান-সুপারি চিবাতে-চিবাতে কাচারি ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতো আর বাজারে কি কি কত টাকায় কিনেছে তার হিসাব করতো...। কেমন জেনো একটা প্রাগৈতিহাসিক ছন্দ ছিল তাদের কথা বলা আর হেঁটে চলায়...।

আমার বড়খালা (নাম জবেদা বেগম), আর সেঝখালা (নাম রহিলা বেগম) দুজনের বিয়ে হয়েছিল ঘাটাইল থানায় ক্যান্টমেন্ট এলাকার পাশের চৈথট গ্রামে। দুই খালার স্বামী মানে আমার দুই খালু ছিল আপন ভাই। তারা ঘাটাইল থেকে নানার বাড়ী আসতো, সঙ্গে নিয়ে আসতো মৌসুমি ফল। ঘাটাইল-মধুপুর এলাকাটা বাংলাদেশে আনারস, কাঁঠাল আরও অন্যান্য মৌসুমি ফলের জন্য এখনও বিখ্যাত...।

বড় নানীর একমাত্র মেয়ে ফুলে খালার বিয়ে হয়েছিল নানার বাড়ীর পাশের গ্রামে। আমরা গ্রামে বেড়াতে গেলে যতদিন থাকতাম, ফুলে খালাও তার বাবার বাড়ী ততদিনই থাকতো। তার সে সময় সন্তানাদি ছিল না বলে, আমার বোন আর আমাকে নিয়ে সারাদিন কাটাতো...।

আমার ছোটনানীর চতুর্থ মেয়ে মানে আম্বিয়া খালার বিয়ে হয়েছিল নানার বাড়ীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে চার/পাঁচটা বাড়ী পরেই। খালা সারাদিন তার ৪/৫ বছরের একমাত্র ছেলে স্বপনকে নিয়ে নানার বাড়িতেই থাকতো। কেবল মাত্র রাতে খালা স্বপনকে নিয়ে শশুর-বাড়ী মানে স্বামীর বাড়ীতে চলে যেতো...।

আমার বোন আর আমি যখন খুব ছোট্ট ছিলাম, তখন মাকে সাহায্য করার জন্য আমাদের বাসায় আম্বিয়া খালা প্রায় দুই বছরের মতো ছিল। সে জন্যই দেখছি, নানার বাড়ী গেলে আম্বিয়া খালা আমার বোন আর আমাকে সারাদিনই মায়ের মতোই চোখে চোখে রাখতো।

আমার মনে হতো, আমাদের সব খালার চাইতে আম্বিয়া খালার মমতা আমাদের দুই ভাই-বোনের জন্য সব সময়ই একটু বেশী বেশী। সে আমাদের তার নিজের ছেলেমেয়েই মনে করতো। তার জীবনের প্রথম ছেলেমেয়ে কোলে পিঠে করে মানুষ করার অভিজ্ঞতা মানেই ছিলাম আমরা দুই ভাইবোন।

আমার পঞ্চম খালা যাকে শুধু বেগম নামেই ডাকতাম সে তখনও স্কুলে পড়ে। আমার দেখা সব চাইতে সহজ সরল মানুষ হচ্ছেন বেগম খালা। খালার সরলতার গল্প মনে হলে, এখনও আমার খুবই হাসি পায়...।

আর, ষষ্ঠ খালা মানে সেলিনা খালাও তখন স্কুলে পড়তো। খালাদের মধ্যে ষষ্ঠ খালাই ছিল সবচাইতে বুদ্ধিমতী। নানা মারা যাবার পরে নানার বাড়ী পরিচালিত হতো ছোটখালার বুদ্ধি মতো, ভাবতে অবাক লাগে...!?

সবচাইতে ছোট খালাই সব ভাইবোনের খোঁজ খবর রাখেন; আর গ্রামের বাড়ীতে সবাইকে ডেকে নিয়ে এখনও প্রতি বছর শীতের পিঠার অনুষ্ঠান আয়োজন করেন...।

আম্বিয়া খালার একমাত্র ছেলে মানে স্বপন ছিল আমার চাইতে ২/৩ বছরের ছোট। সে জালাল মামা আর আমার পেছনে সারাদিন ঘুরে বেড়াতো। আমি আর জালাল মামা খুবই বিরক্ত হতাম। আম্বিয়া খালা রাগ করবে বলে তাকে কিছু বলতেও পারতাম না, আবার তাকে সাথেও রাখতে পারতাম না...।

আম্বিয়া খালার স্বভাব ছিল, কিছু হলেই কেঁদে-কেটে বাড়ী মাথায় তোলা, তাই তাকে একটুও বুঝতে দিতাম না যে স্বপনকে ফাঁকি দিয়েই আমরা ঘুড়ি উড়াতে যাই...। এখনও আমি নানার বাড়ী গেলে আম্বিয়া খালা কেঁদে-কেটে বাড়ী মাথায় তুলে... আশ্চর্য লাগে !?

আমাদের জামালপুরে বাসায় আমার সুন্নৎ-এ-খাতনা উপলক্ষ্যে একবার আম্বিয়া খালা, খালু আর স্বপন বেড়াতে গিয়েছিল। স্বপন তখন সারাদিন আমার সাথেই খেলাধুলা করতো। আমার খেলনা পিস্তল, ঘুড়ি, লাটিম, মার্বেল আরও কতো কি আমি ওকে দিয়েছিলাম সেই সময়...।

আমি পড়তে বসলে সে আমার টেবিলের পাশে বিছানায় বসে আমার বই-খাতা, কলম-পেন্সিল নিয়ে আঁকিবুঁকি করতো। খালা রাগ করবে বলে, আমি স্বপনকে কিছুই বলতাম না। স্বপন চিকেন (মুরগীর) রান চিবিয়ে খেতে খুবই পছন্দ করতো। তাকে যদি বলতাম, ‘এই, তুই কি খাস?’ সে বলতো, ‘আমি নিচ্চ খাই’। সে গোশত (মাংস) বলতে পারতো না, সে বলতো নিচ্চ। আমরা খুবই হাসাহাসি করতাম।

যাই হোক, এক গ্রীষ্মকালের ছুটিতে আমাদের পরিবারের সবাই জামালপুর থেকে বাসে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা এলাম। তারপর এলেঙ্গা থেকে বাসে নারিন্দা হয়ে ভ্যানে নানার বাড়ী আনেহলা গেলাম। নানার বাড়ী গিয়ে দেখি, বাড়ীর সবাই কেমন জেনো নিশ্চুপ হয়ে গেছে। কোথায়ও কোন কোলাহল নেই, উত্তেজনা নেই, উচ্ছ্বাস নেই।

সারা বাড়ীতে একটা অচেনা, অজানা হাহাকার...। নানার বাড়ী থেকে হেঁটে হেঁটে আম্বিয়া খালার বাড়ী গেলাম মায়ের সাথে। মাকে দেখেই আম্বিয়া খালা কান্না কাটি শুরু করে দিল। আমি ভাবলাম বরাবরের মতো কাঁদছে আর ঘরের আশেপাশে স্বপনকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু বাড়ীর উঠান, কাচারি, পেছনের ডোবা পুকুর, সামনের মাঠ কোথায়ও স্বপনকে দেখলাম না। আমি বললাম, খালা স্বপন কই? খালা কিছুই বলল না, শুধু দেখলাম খালা কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা গেলো...।

আমার খালু চোখ মুছতে মুছতে মাকে বললেন, হঠাৎ দুইদিন জ্বরে ভুগে স্বপন পনের দিন হলো মারা গেছে...। আশেপাশে ডাক্তার না থাকলেও জ্বরের তীব্রতা এতোটা বেশী ছিলনা যে শহরে নিয়ে যেতে হবে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ছেলেটা মারা গেছে। বলতে বলতে সেও মূর্ছা যাবার যোগার হল...।

আমি দেখলাম, আমার মা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে আর শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছার চেষ্টা করছে। খালু বলল, স্বপনের মা স্বাভাবিক হতে পারছে না গত ১৫ দিন যাবত। ছেলেটাকে গ্রামের গোরস্থানে কবর দেয়া যায়নি, আম্বিয়ার কান্না-কাটির জন্য। বাড়ীর আঙিনায় স্বপনের কবর দেখিয়ে খালু বলল, আম্বিয়া সারাদিন এই কবরের পাশেই বসে থাকে...।

আমাদের এই বাড়ীর আঙিনায় স্বপনকে কবর দেয়াই ঠিক হয় নাই...।

ইদানীং সে তার বাবার বাড়িও যায় না। আমার মনে হয়, এই গ্রামের বাইরে কোথায়ও নতুন করে বাড়ী বানিয়ে চলে গেলে, আম্বিয়া ঠিক হয়ে যাবে...। আপনি কি বলেন?

আমার মা কিছুই বলল না, আমাকে নিয়ে মা হাটতে হাটতে নানার বাড়ী চলে আসলো...।
-------------------------
১৫ আগস্ট ২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:৫৬
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×