somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার আধা-প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথকতা

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দেখতে দেখতে বুয়েটে দুই বছর পার করে ফেললাম। এই তো মনে হয় সেদিনের কথা। দুরুদুরু বুকে যে স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম তার পর্যালোচনা করতে গিয়েই আজকের নোটের সূত্রপাত।

স্বপ্নের কথা বলতে গেলে প্রথমেই প্রশ্ন আসতে পারে স্বপ্ন কি? আমার কাছে স্বপ্ন মানে স্বাধীনতা। আটপৌরে জীবনের রূঢ় বাস্তবতা থেকে পলায়নের একটা উপায়। আজ স্বপ্নচারণ নয় স্বপ্নভাঙার কথকতা করতে এসেছি

ছেলেবেলায় কি না হতে চেয়েছি! অনেকদিন পর্যন্ত ভাবতাম ট্রেনের চালক হবো। এতো ম্যাসিভ পাওয়ারফুল একটা জিনিস কিভাবে মানুষ কন্ট্রোল করে সেটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিতো। একটু বড় হয়ে ভাবতাম অভিযাত্রী হবো , দেশে দেশে ঘুরে বেড়াবো। অস্বীকার করি না সবি ছিলো নিতা্ন্ত ছেলেমী, boyish চিন্তাভাবনা। তবে মনটা সবসময় ছিলো জ্ঞানপিপাসু, বিজ্ঞানপ্রেমী। তখন অন্ত:ত চিন্তার স্বাধীনতাটা বজায় ছিলো

বুয়েটে পড়ার ইচ্ছাটা ঠিক কবে জেগেছিলো তা এখন আর ঠিক মনে পড়ে না।আমার এক কাজিন বুয়েটে পড়তো, সেসময় তার অ্যাটিচুড আর স্মার্টনেস দেখে মনে হতো বুয়েট নিশ্চয়ই একটা অসাধারণ জায়গা, তা না হলে বুয়েটের ছাত্ররা এতো স্মার্ট হয় কেমন করে। হয়তোবা তখন থেকেই অবচেতন মনে বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন দেখে এসেছি।

তারপর কোথাকার জল কোথায় গড়িয়ে গেলো। মফস্বল ছেড়ে ঢাকা শহরে চলে এলাম। গোবেচারা চুপচাপ ভালোমানুষ ছেলেটার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এলো। প্রিয় বন্ধুদের ছেড়ে মোটামুটি একটা বন্ধুহীন পরিবেশে এসে পড়লাম। ফলাফল যা হলো তা হচ্ছে আরো অন্তর্মুখী হয়ে গেলাম(যার প্রভাব এখনো নিজের মধ্যে বর্তমান)। কেবল একটা জিনিস আগের মতো রয়ে গিয়েছিলো, তা হলো পড়ুয়া স্বভাবটা। সময়ে অসময়ে কতবার যে পাঁচতলায় লাইব্রেরীতে ছুটে গিয়েছি তার কোন ইয়ত্তা নেই।এর কারণ জ্ঞানপিপাসা নয়, বইয়ের সান্নিধ্য লাভ করাই বরং উদ্দেশ্য ছিলো। কেননা মফস্বলে থাকতে একসময় পাবলিক লাইব্রেরীতে প্রচুর সময় কাটিয়েছি, কলেজ লাইব্রেরীতে গেলে সেই স্মৃতির কিছুটা ফিরে আসতো।


এরপর কালের স্রোতে ভাসতে ভাসতেই হয়তোবা চলে এলাম বুয়েটে। বলতে নেই বেশ আশাতীতভাবেই এসেছিলাম। মনে পড়ে বুয়েটে চান্স পাওয়ার পর এক শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়া বলেছিলেন "চান্স পেয়েছ, অভিনন্দন। যাচ্ছ কিন্তু জেলখানায়।" কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলাম: "ও দেখা যাবে"। ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতা মাথার ভিতর ঘুরপাক খেত তখন:

"For we are bound where
Mariner has not yet dared to go
And we will risk the ship
Ourselves and all............."

হৃদয়ে তখন অফুরান উৎসাহ। Civil আর EME বিল্ডিং এর মাঝের বুয়েটের রাস্তাটাকে মনে হতো নন্দনকানন! বুকভরা নিশ্বাস নিয়ে ভাবতাম" আমি পাই্য়াছি, আমি ইহাকে পাইয়াছি!!"

ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতে থাকলো, আর আমার স্বপ্নযাত্রাও মনে হয় উল্টোরথে চলা শুরু করলো। হায়, তখনি কেবল কিছুটা হ্বদয়ঙ্গম করতে শুরু করলাম যে আমি "কিভাবে নয়, কেন?" এই প্রশ্নের জবাব চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম বিজ্ঞান জানতে, একগাদা সূত্র মুখস্ত করে বিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটাতে নয়। বিজ্ঞান আর প্রকৌশলের মাঝে differentiate করতে না পারার মাশুল দিতে লাগলাম দিনদিন।যে বিষয়ের প্রতি কোন ভালোবাসা নেই তার প্রতি আনুগত্য আনা যে কি কঠিন তা ভুক্তভোগীই মাত্র জানেন। ধীরে ধীরে মনের সব স্বপ্ন উবে যেতে লাগলো।

নিজেকে মেধাবী দাবী করি না, তবে সীমিত মেধার সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়ে যে মেধার অবক্ষয়ের একটা অবকাঠামোয় ভর্তি হয়েছি সেটাই জীবনের অন্যতম অপরিণত সিদ্ধান্ত।

একসময় চিন্তা করতে চেষ্টা করতাম চুম্বকের নর্থ পোল কেন সাউথ পোলকে আকর্ষণ করে, আর এখন ভাবি সুইচ দিলেই, কারেন্ট গেলেই মোটর ঘুরবে -এটাই তো স্বাভাবিক। এতে অবাক হওয়ার কি আছে!! মন এখন আর বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের মতো উচ্চমার্গীয় মেধার দিকে টানে না, বরং সংগীতের মতো মননশীলতার দিকেই চলে যেতে চায়।এখন আর physics টানে না। মন ধীরে ধীরে Metaphysics এর দিকে ঝুঁকে পড়তে চায়।

আজ বুঝতে কোন দ্বিধা হয় না যে আমার প্রকৌশলবিদ্যা পড়ার পিছনে মূল চালিকাশক্তির কাজ করেছে মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট। আমি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাইনি। ভালো আয়, সম্মানজনক জীবিকা, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি নিশ্চয়ই অবচেতন মনের উপর প্রভাব ফেলেছিল। তাই গতানুগতিকতার বাইরে পা ফেলতে সাহস পাই নি। হয়তো অনেকে বলবেন সেটাতো ডাক্তারী পড়ার বেলাতেও সত্য। সত্য মানছি, কিন্তু ডাক্তারী পড়ায় যে মানবতা রক্ষার সুমহান দায়িত্ববোধ কাঁধে তুলে নিতে হয় সেটার প্রতি পুরোপুরি বিশ্বস্ত থাকতে পারবো না, এই আশংকাতেই ও পথ মাড়াই নি।

আজকে যখন বন্ধুরা বিশুদ্ধ বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে আর প্রকৌশল পড়তে না পারার জন্য আফসোস করে তখন ওদের সামনে কিছু বলি না, আড়ালে গেলে বরং ওদের জন্য কিছুটা ঈর্ষাবোধ করি। আমার দুই প্রাক্তন প্রকৌশলী বন্ধু গণিত আর পদার্থবিজ্ঞান অধ্যয়ন শুরু করেছে। ওদেরকে সাধুবাদ জানাই।

বুয়েট থেকে কি পেয়েছি আর কি পেতে যাচ্ছি তা মাঝে মাঝে চিন্তা করি:
১।প্রকৌশলী নামক পরিচয়: সামাজিক নিরাপত্তার একটা অন্যতম হাতিয়ার
২।A Stash of movies and software
৩। আর??

তবে প্রদীপের উল্টো পিঠও আছে। বুয়েটে এসে পেয়েছি অকৃত্তিম বন্ধুত্ব। কলেজের প্রায় বন্ধুহীন জীবনের তুলনায় তাই একে মনে হয় স্বর্গভূমি। আজ পি এল এ সবকিছু তাই খালি খালি লাগে, জনৈক বন্ধু এটাকেই বলেছে " মায়া, সবি মায়ার খেলা!!" আজ থেকে দুই বছর পরেই কে কোথায় থাকবো কে জানে, কিন্তু সবার স্মৃতি যে হৃদয়ে ভাস্বর হয়ে থাকবে সেটা বলতে কোন দ্বিধা নেই।

আজ আমার মাঝে যে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা তার জন্য আমি বুয়েটকে দোষারোপ করবো না। আমার অপরিণত সিদ্ধান্তের জন্য আমিই কর্মফল ভোগ করবো। সম্পূর্ণ সজ্ঞানে স্বইচ্ছায় এখানে ভর্তি হয়েছি। বু্য়েট তো আমাকে জোর করে ভর্তি করে নি। বরং দেশের প্রিমিয়াম কোয়ালিটির ছাত্র বিবেচনা করে আমাকে আশাতীত সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। আফসোস যে আমি সদ্ব্যবহার করতে পারছি না।

আজকাল আর মাঝরাতে কম্পিউটারের সামনে বসে আর কোড করা হয় না, নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকি। হেডফোনে কানের কাছে Pink Floyd বলতে থাকে

"The Grass was greener
The light was brighter
The taste was sweeter
The nights of wonder................"

Slide Guitar এর আওয়াজ যেনো আমার হৃদয়ের আর্তনাদ হয়ে অনুরণিত হতে থাকে। আর আমি আধো ঘুম আধো জাগরণের একটা ঘোরের মধ্যে থেকে নতুন স্বপ্ন দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকি, নিরন্তর............
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ দুপুর ১২:৪৬
১৫টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজকের ডায়েরী- ১৩৯

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ সকাল ১০:৪১

ছবিঃ আমার তোলা।

আজকে সাত রোজা।
সময় আসলে অনেক দ্রুত যায়। গতকাল সুরভি আর ফারাজাকে নিয়ে গিয়েছিলাম শপিং করতে। কারন আমি জানি, ১৫ রোজার পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্বাসীকে লজিকের কথা বলার দরকার কি?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:১৭




হনুমান দেবতা এবং বোরাকে কি লজিক আছে? ধর্ম প্রচারক বলেছেন, বিশ্বাসী বিশ্বাস করেছেন ঘটনা এ পর্যন্ত। তাহলে সবাই অবিশ্বাসী হচ্ছে না কেন? কারণ অবিশ্বাসী বিশ্বাস করার মত কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভাবছিলাম ২ লক্ষ ব্লগ হিট উপলক্ষে ব্লগে একটু ফান করব আড্ডা দিব, কিন্তু এক কুৎসিত অপব্লগার সেটা হতে দিলোনা।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:০৫



এটি ব্লগে আমার ২৬০ তম পোস্ট। এবং আজকে আমার ব্লগের মোট হিট ২০০০০০ পূর্ণ হয়েছে। আমি আনন্দিত।এই ছোট ছোট বিষয় গুলো সেলিব্রেট করা হয়তো ছেলে মানুষী। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শয়তান বন্দি থাকলে শয়তানি করে কে?

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:২০



রমজানে নাকি শয়তানকে বেধে রাখা হয়,তাহলে শয়তানি করে কে?

বহুদিন পর পর ব্লগে আসি এটা এখন অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। বেশ কিছু বয়স্ক, মুরুব্বি, সম বয়সি,অল্প বয়সি একটিভ কিছু ব্লগার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কট বাঙালি

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৯ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:২৪



কদিন পরপরই আমাদের দেশে বয়কটের ঢল নামে । অবশ্য তাতে খুব একটা কাজ হয় না । বাঙালির জোশ বেশি দিন থাকে না । কোন কিছু নিয়েই বাঙালি কখনই একমত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×