ম্যাক্সওয়েল যখন তার তড়িৎ-চুম্বকীয় তত্ত্ব প্রস্তাব করলেন বিজ্ঞানের ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা হলো, তড়িৎ-চুম্বকীয় তত্ত্ব দুটো আপাত:বিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণকে একত্রিত করলো এখানেই এটার সাফল্য সীমাবদ্ধ থাকলো না, একই সাথে প্রতিষ্ঠিত হলো আলো আসলে তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ যা শূণ্য মাধ্যমে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে, ম্যাক্সওয়েলের আগে অনেকেই আলোর গতিবেগ মাপবার বিভিন্ন পদ্ধতি আবিস্কার করেছিলেন, ম্যাক্সওয়েল পরীক্ষাগারে নির্ধারিত "পারমিটিভিটি কনস্ট্যান্ট" এবং "পারমিয়াবিলিটি কনস্ট্যান্ট" এর মাণ দিয়ে আলোর গতিবেগের উচ্চসীমা নির্ধারণ করে দিলেন।
যেকোনো স্বচ্ছ মাধ্যমে তীর্যক ভাবে পরলে আলোর গতির দিক পরিবর্তিত হয়, সভ্যতার ইতিহাসে এই পর্যবেক্ষণ নতুন কিছু নয়, ম্যাক্সওয়েল তড়িৎ-চুম্বকীয় তত্ত্ব প্রকাশের ৫০০ বছর আগে থেকেই মানুষ বিভিন্ন ভাবে এই বিষয়টির প্রায়োগিক ব্যবহার শুরু করেছিলো, আলোর গতির দিক পরিবর্তনের এই পর্যবেক্ষণের ব্যবহারিক প্রয়োগ বিভিন্ন ধরণের আতশীকাঁচ নির্মাণ, সেসবের মাধ্যমে দুরবীন এবং মাইক্রোস্কোপ তৈরি করা হয়েছে। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব আলোর গতিবেগের দিক পরিবর্তনের একটা সাম্ভাব্য ব্যাখ্যা উপস্থাপন করলো, পরবর্তী বিজ্ঞানীরা ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বের বিভিন্ন ধরণের প্রয়োগে সেসব রহস্য উদঘাটন করেছেন।
হেইনরিক হার্টজ ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব ব্যবহার করে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ তৈরিতে সমর্থ হলেন যখন সে সময়ই রেডিও প্রকৌশল জন্ম নিলো, প্রথম পর্যবেক্ষণের পর থেকে সেটার প্রায়োগিক ক্ষেত্র খুঁজে নিতে বিজ্ঞানীদের বেশী পরিশ্রম করতে হয় নি, বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের গবেষণা ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়িয়ে ভারত এমন কি নিউজিল্যান্ডেও প্রসারিত হলো, রাদারফোর্ড তার স্নাতক জীবনে রেডিও ট্রান্সমিটার তৈরির গবেষণা করেছিলেন, পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে এসে তিনি রেডিও ট্রান্সমিশনের পরিধি বৃদ্ধি করে বিনা বাধায় প্রায় মাইল খানেক দুরে তরঙ্গ পাঠাতে সমর্থ হয়েছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় একটা সময়ে বাণিজ্যিক রেডিও তৈরি করা সম্ভব হয়।
যদি বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক পরিবর্তিত হয় তাহলে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ তৈরি করা সম্ভব, বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক পরিবর্তন মানে ইলেকট্রনের গতিবেগের পরিবর্তন, অর্থ্যাৎ ইলেক্ট্রনের গতিবেগ পরিবর্টিত হলে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরিত হয়। ট্রান্সমিটারের এন্টেনায় বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক পরিবর্তন করে হার্টজ তড়িৎ চুম্বকীয় তত্ত্ব প্রমাণিত করলেন, তিনি দেখালেন ট্রান্সমিটারের এন্টেনায় বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক পরিবর্তিত হলে তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকরিত হয়। বিকিরিত তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য এন্টেনার দৌর্ঘ্যের উপর নির্ভব করে ।
হার্টজ তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে গবেষণার সময়ই লক্ষ্য করেছিলেন উচ্চ কম্পাঙ্কের আলো কোনো ধাতুর পাতে পতিত হলে সেখান থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয়, তবে তিনি এই ইলেক্ট্রনের উৎপত্তি কিংবা এর বিভিন্ন বৈশিষ্ঠ্য বিষয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী হন নি।
প্রতিটি বিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণ আলাদা করে ভাবলে বিজ্ঞানের অগ্রগতির দিকটুকু অনুধাবন করা কঠিন, বিজ্ঞান বিভিন্ন পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করতে উৎসাহী হয়ে উঠে, বিজ্ঞানের এই বৈশিষ্ঠ্যটুকু বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যার সময়ে মোটামুটি সন্তোষজনক সমাধান দিয়েছে , তাত্ত্বিক পরিধিতে ব্যাখ্যা না করে তারা বিভিন্ন ধরণের সম্পর্ক আবিস্কার করেছেন, সেসব সম্পর্ক প্রতিটা পর্যবেক্ষণের কার্যকরণ ব্যাখ্যা করেছে, প্রকৃতির আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা আবিস্কারে সহায়ক হয়েছে।
যেকোনো ধাতব তারকে উত্তপ্ত করতে থাকলে সেটা একটা সময়ে লালচে হয়ে জ্বলে উঠে, পরবর্তীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে সেটা সাদা হয়ে যায়, একটি বায়ুশূণ্য কাঁচের ধারকে কোনো গ্যাস রেখে তার ভেতরের তড়িৎক্ষেত্রের প্রাবল্য( ইলেক্ট্রিক ফিল্ড ইনটেনসিটি) বাড়ালে একটা পর্যায়ে গ্যাস আলো বিকিরণ করে, এমন কি যদি হঠাৎ করে উচ্চগতি সম্পন্ন কোনো ইলেক্ট্রন ধাতব পৃষ্টে বাধা পায় তাহলেও তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণ ঘটতে পারে, (এভাবেই এক্স রে তৈরি করা হয় পরীক্ষাগারে), হার্টজের তড়ীৎ চুম্বকীয় বিকিরণ তৈরির আগে এবং সেই একই দশকে বিভিন্ন ভাবে তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ উৎপাদনের কৌশল রপ্ত করেছিলেন বিজ্ঞানীরা, প্রতিটি ক্ষেত্রে তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ তৈরি হলেও এদের ব্যাখ্যা আলাদা, আলাদা আলাদা প্রেক্ষাপটে এসব উৎপাদিত হয় এবং বিজ্ঞানীরা পরবর্তী ৩ দশকে এইসব বিষয়কে বিভিন্ন সময়ে ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হয়েছেন, একই সাথে নতুন ধরনের ধাঁধার মুখোমুখি হয়েছেন, আলো তরঙ্গ এবং আলোর কণিকা বিষয়ক ধাঁধার সফল সমাধান হলেও এখনও কেউই নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেন না আলো আদতে কখনও কণিকার মতো আচরণ করবে, কখন তরঙ্গের মতো আচরণ করবে, পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করবে আসলে আমরা আলোর কোন চরিত্র আবিস্কার করবো।
বৈজ্ঞানিক ব্যার্যার সুবিধার্থে আলোর তরঙ্গ চরিত্র প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষাপট এবং আলোর কণিকা চরিত্র প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন, যখন আলো কোনো ইলেক্ট্রন কিংবা কোনো গ্যাসের অণুর সাথে ধাক্কা খায় তখন সে কণিকা চরিত্র প্রকাশ করে, যখন কোনো মাধ্যম দিয়ে যায় তখন তার চরিত্র তরঙ্গের মতো- এবং সেই মাধ্যমে যাওয়ার সময়ও সে এমন সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারে- তখন সে আদতে কণিকা চরিত্র ধারণ করে না কি তরঙ্গ চরিত্র ধারণ করে সে বিষয়টা মীমাংসিত না, তবে সামগ্রীক বিবেচনায় স্ব্ছ মাধ্যমে আলোর গতির ধরণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় স্বচ্ছ মাধ্যমে আলো মূলত তরঙ্গাকারে প্রবাহিত হয়।
ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ চুম্বকীয় তত্ত্বের ব্যাখ্যানুসারে ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে আলোর গতিবেগ ভিন্ন কারণ প্রতিটি মাধ্যমে পারমিটিভিটি এবং পারমিয়াবিলিটি কনস্ট্যান্টের মাণ আলাদা, সুতরাং আলোর গতিবেগ পরিবর্তিত হবে,
ধাতব পৃষ্টে যখন আলো পতিত হয় তখন সেটা কণিকা চরিত্র প্রকাশ করে, নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের চেয়ে ক্ষুদ্র আলোর তরঙ্গ পতিত হলে ধাতব পৃষ্ট থেকে ইলেক্ট্রন নির্গত হয়, আইনস্টাইন এই পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
কাঁচ কিংবা আলুমিনিয়ামের পাত মাধ্যম হিসেবে ভিন্ন এবং এই দুই মাধ্যমের একটিতে আলোর তরঙ্গ চরিত্র প্রকাশিত হয় অন্যটিতে প্রকাশিত হয় আলোর কণিকা চরিত্র এই ধাঁধার সমাধান কি? আলো কিভাবে নির্ধারণ করে কখন তার কি চরিত্র প্রকাশ করতে হবে?