১
ওর কথা শুনে বুকের ভিতর ছ্যাঁৎ করে উঠে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে খটকট ঘটঘট শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়। টিংটিং। ঠ্যাংঠ্যাং। ঠাঠা ট্যাঁসট্যাঁস। ধাঁই ধুম ধুপ্পুস শুনে আমার তো মগজ বিকল। চিন্তা করতে পারছিলাম না, চিত্তবৈকল্য হয়েছিল। তবুও অগাচণ্ডি খামোখা আমাকে খুঁচিয়েছিল। অমন অলোকসামান্য সময়ে কার মনে কামেচ্ছা জাগবে? অপ্রতীয়মান নগ্নাট গড়নপেটন দেখে থরহরিকম্পিত গা-গতরে তাপন উঠলেও তরাসে প্রথমরিপু তেরিমেরি করেনি। গলা শুকিয়ে কলিজা শুঁটকি হওয়ার উপক্রম। হাত পা অবশ হয়ে মগজকে বলেছিল, তুই খামকাজ কর আমরা একটু জিরিয়ে নেই। মন কাকুতি মিনতি করে বলেছিল, শুঁটকিশুরুয়া দিয়ে কেউ আমাকে চারটা ভাত দাও রে, দোয়া করব। তখন কেউ দোয়া চায়নি এবং বাথরুম প্রায় দশ বারো হাত দূরে ছিল। প্রয়োজন হলে হাঁটতে হবে। প্রথম তেমন চিন্তিত ছিলাম না কিন্তু আলো ভরতা দিয়ে ভাত খেতে না পেরে পানি গিলে পেট ভরেছিলাম। জঠরজ্বালা নিবাবার জন্য বেআক্কেলের মত তিন গেলাস পানি গলাধঃকরণের ফলে আক্কেল সেলামিতে ঘাম দিতে হয়েছিল। জানলে নৈশ্যভোজন করতাম না। হঠাৎ তলপেটে নিম্নচাপ অনুভব হলে পেটনামবে ভেবে শিউরে উঠেছিলাম। কেমিস্ট ফার্মেসি ডাক্তারখানার পাশে কিন্তু ঔষধালয় অনেক দূর। গরলনাশক আনার জন্য বেরোলে মাঝপথে সূর্যোদয় হবে। বিধায় দাওয়াইর দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে বদনায় পানি আছে না নেই জানার জন্য তন্ময় হলে শুনতে পেয়েছিলাম, মেনিবিড়ালের সবিনয় ম্যাও ম্যাও শুনে নিষ্ঠুর কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ধমকাচ্ছে। রাতজাগা পাখির ডাকে মন প্রায় বিমনা। আমার আহল দেখে খিলখিল করে হেসে কুটিপাটি হয়েছিল দিগম্বরী। ভেটকি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু গলা শুকিয়ে জিবেগজা হয়ে তিলকুটের মত কটকট করছিল। মন লাড্ডু খেতে চেয়ে না পেয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছিল, কেউ আমারে একটা কাঁচাগোল্লা দাও। মনের আকুতি কাকুতি শুনে পাষাণী মুখ ভেংচিয়ে বলেছিল, ‘আমার উরে আয়! আদর করে আনন্দনাড়ো খাওয়াব।’
ওর কথা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে এবং নির্জন নিরালা থেকে ভূতপ্রেত্নীর পদধ্বনি ভেসে আসলে মন সভয়ে বলেছিল, ‘সব নিয়ে গেলেও আমি নিচে যাব না।’
মনের কথা শুনে আমি হতাশ হয়ে পেটে মৃদু ছাপ দিয়ে অনুভব করতে চেয়েছিলাম শৌচাগারে যেতে হবে কি না? পেট ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছিল, ‘বদনা লাগবে না কিন্তু পানি কমাতে হবে। আমার জবর কষ্ট হচ্ছে।’
পেটের হাত বুলিয়ে বলেছিলাম, ‘সক্কালে কমালে ভালো হবে রে।’
পেট গুড়ুম করে বলেছিল, ‘পক্কাধানে ঠাসাঠাসি। কারো সাথে হাতাহাতি করলে গরম জলে জাতকুল যাবে। ইজ্জত হারিয়ে আজ বেইজ্জত হব।’
মহা সমস্যা! নিশির ডাক শুনে আমাকে হায় হায় করতে দেখে অশরীরী বলেছিল, ‘ওই! রেচনে যাচ্ছিস না কেন?’
‘পথঘাট চিনি না, কোন পথে যাব?’
‘আস্তে ধীরে দাঁড়িয়ে সোজা হেঁটে দরজা খুলে ডাইনে মোড়ে বউড়ির মত কদম গুনে জলদি যা নইলে ভূতপূর্ণিমায় ইজ্জত হারাবি।’
‘ভয়ে হাত বিবশ। নির্ভিয়ে নির্ভীক হতে চাই। ’
‘অসমকালীন হলেও আমরা সমবয়সী। আমার সাথে ভাব জমালে আমি তোকে চোখে চোখে রাখব। ভাবুক হয়ে ভাব জমাবি?’
‘চাইলেও এখন আমি ভাবভোলা হতে পারব না। সদয় বল তারপর কী করব?’
‘একটা রসের চুটকি বলি?’
‘নামটা জানতে পারব?’
‘পৌষ্প।’
‘ওঃ-অ্যাঁও।’
‘এই! কী হয়েছে?’
‘এত সুন্দর নাম আমি ইতিপূর্বে শুনিনি।’
‘সত্যি বলছিস?’
‘কিরা খাই না আমি তিন সত্য করে বলছি, অলোকসুন্দরী তুই। তোর দেহে যৌবনমদের টইটম্বুর।’ বলে আমি আস্তে আস্তে হাঁফ ছাড়লে ও খিলখিল করে হেসে বলেছিল, ‘পঞ্চশরের বাণে কামিনীর কলশি কানা করতে চাস নাকি?’
‘আরে না, আমি মজা করছিলাম। জানিস! তোর সাথে কথা বলে প্রাণ সত্যি প্রাণবন্ত হয়েছে।’
‘মতন মতলব বাদ দিয়ে আমার সাথে গপসপ কর। তোকে আমি বিত্রস্ত করব না।’
‘তুই মনমোহিনী। মনের কথা খুলে বললে মন মননশীল হবে। আমার মনে মৎসর আছে সন্তাপ। মনস্তত্ত্বে মনস্তুষ্টি হয় না। মৎসরি না মনস্তাত্ত্বিক হব তা স্থির করতে পারছি না। মনশ্চাঞ্চল্যে মনস্বী হওয়া যায় না। মহত্ত্বে মহিমান্বিত হতে চাই।’
‘তোর অন্তরে আন্তরিকতা আছে। মনে রাখিস! অন্তর্দশায় অন্তর্দশন হয় না। অন্তর্বাষ্পে অন্তর্দাহ নিবে না। অন্তর্ধানে অন্তরিত হওয়া যায় না। আমি অন্তর্নিহিত হতে চাই। আমাকে অন্তর্লীন কর। অন্তর্গূঢ় রহস্যে তুই মনীষী হতে পারবি। অন্তর্মাধুর্যে তোর অন্তর্দীপন হবে।’
‘অন্তর্নিবিষ্ট কষ্টের অন্তর্গূঢ় রহস্য জানতে চাই।’
‘সুখিনী হওয়ার জন্য ভালোবেসেছিলাম। অকালবসন্তে মরে শঙ্খিনী হয়েছি। মনের জ্বালা নিবারণ করার জন্য জ্যোৎস্না পানে তৃপ্ত হব চকোরিণী। নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা দেখে নিত্যবৃত্ত অতীতে ফিরে যেতে চই। তখন নিত্যানন্দে দিন কাটত। এখন নিদারুণ কষ্টে সময় কাটে। আমার সাথে কেউ কথা বলে না। একান্তবাসীর মত এক কোণে বসে থাকি। রগরগ করে রাগ চরমে উঠলে আছাড় দিয়ে রসেরহাঁড়ি ভাঙি। সন্ন্যাসিনীর মত মহানিশায় নিদিধ্যাসনে বসে আমি গৃহিণী হতে পারিনি।’
‘আমার নানিজান আমাকে খুব আদর করতেন। কোনো কারণে বেজার হলে গালে কপালে চুমু দিয়ে বলতেন, আমার মনোরাজ্যের রাজকুমার তুই বড় হলে তোর জন্য সব পেয়েছির দেশের রাজকুমারী আনব।’
‘তোর নানি সর্বার্থসাধিকা ছিলেন। উনার কথা সত্য হবে।’
‘জানিস! ভাদ্রমাসে তৃষ্ণার্ত পশুপাখির জন্য গাছের ছায়ে ঠাণ্ডা পানি রেখে আমার নানিজান আমাকে বলতেন, ভুখাকে অন্য দিবি তৃষ্ণার্তকে পানি। নানিজানের মত হতে হলে কী করতে হবে?’
‘আত্মানুশাসনে আত্মোন্নতি হলে আত্মা আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়। অলোকদৃষ্টে অদৃশ্য দেখা যায়। স্বার্থত্যাগী হলে তুই সত্য পুরুষ হবে।’
‘উপদেশের জন্য অশেষ ধন্যবাদ।’ বলে কৃতজ্ঞতা প্রাকশ করতে চাইলে পৌষ্প গম্ভীরকণ্ঠে বলেছিল, ‘কৃতার্থ করতে চাই না আমি তোর কল্পনা হতে চাই।’
‘ঠিকাছে! নিরক্ষবৃত্তে বাড়ি বানিয়ে আমি কল্পনাপটু হব।’ বলে বিছানা থেকে নেমে কামরার বাতি জ্বালাবার জন্য হাতিয়ে সূইচ পেয়ে টিপে দিয়ে দেখি বাল্বের জীবনায়ূ ফুরিয়েছে। পৌষ্প খিলখিল করে হাসলে মিনতি করে বলেছিলাম, ‘দয়া করে দেউড়ির বাতিটা জ্বালিয়ে দে। তোর জন্য দোয়া করব।’
‘তুই এত ভিতু কেন?’
‘বাতি জ্বালিয়ে দিলে সক্কালে আমি বীরপুরুষ হব। দয়া করে বাতিটা জ্বালিয়ে দে।’ বলে দরজা খুলে হাত বারিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস অনুভব করে সপাৎ করে গুটালে, পৌষ্প কপাল কুঁচকে বলেছিল, ‘কী হয়েছে?’
‘বাসরে! বাতাস এত ঠাণ্ডা কেন?’
‘ডর-তরাসে তোর রক্ত ঠাণ্ডা হতে শুরু করেছে।’
‘গরম করব কেমনে?’
‘গড়াগাড়ি লাফালাফি করলে সহজে গরম হবে।’
‘আজ না আরেক দিন।’
‘আজ না কেন?’
‘পেটে ঠাসাঠাসি এখন নড়তে পারছি না। বেশি তিড়িংবিড়িং করলে গরম জলে ভিজে লজ্জায় লাল হব।’ বলে লজ্জায় সংকুচিত হলে পৌষ্প খিলখিল করে হেসে বলেছিল, ‘লাজাঞ্জলির মত তুই এত লাজুক কেন?’
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৫:০০