somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মণিপুরি ধর্মের উৎস ও বিবর্তন

০৩ রা নভেম্বর, ২০১০ বিকাল ৪:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মণিপুরি ধর্ম হলো মণিপুরিদের আদিধর্ম, মণিপুরিদের মধ্যে 'আপোকপা ধর্ম' বা 'সানামাহি ধর্ম' নামেও পরিচিত। ব্রিটিশ এবং ভারতীয় বিভিন্ন গবেষকের গবেষনা কর্মে এ ধর্মকে 'Manipuri Religion' বা 'Sanamahism' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাচীন এই ধর্মটি স্বাভাবিক ভাবেই তাদের আদিম সাম্যসমাজের সামগ্রিক জীবন-ভাবনা ও জীবনাচরনের অনুষঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। প্রাক-শ্রেণীসমাজের সর্বপ্রানবাদের সাথে মণিপুরিদের ধর্মধারনার গভীর যোগাযোগ লক্ষ করা যায়। মণিপুরিরা প্রকৃতির বিভিন্ন প্রপঞ্চকে প্রানময় বলে বিশ্বাস করতো, এবং সে বিশ্বাস থেকেই তার প্রাকৃতিক বিভিন্ন শক্তিকে দেবতা হিসাবে কল্পনা করে তাদের উপাসনা করতো। দেবতাকে সন্তুষ্ট করার ধারনা থেকেই মণিপুরি নৃত্য, গীত, বাদ্য, মার্শাল আর্ট ইত্যাদি নানান শিল্পকলার শাখা বিকশিত হয়েছে।

অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মতোই মণিপুরি ধর্মেরও রয়েছে অসংখ্য পবিত্র গ্রন্থ, প্রাচীন পুরাণ, শ্লোকসম্বলিত ধর্মীয় সাহিত্য। এগুলোকে বলা হয 'পুয়্যা'। প্রাচীন মণিপুরি মৈতৈ ভাষায় লিখিত পবিত্র গ্রন্থগুলোতে মহাবিশ্ব ও মহাবিশ্বের সৃষ্টি, জীবনের রহস্য, মানুষের শরীরের ভিতরে আত্মার স্বরূপ ও অস্তিত্ব, প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক বস্তু, মৃত্যূ, প্রকৃতির সাথে জীবনের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে দার্শনিক আলোচনা করা হয়েছে। মণিপুরি ধর্মধারনায় দেবতাদের রাজা পরমপুরুষ 'আত্যিয়াকুরু শিদাবা', বা 'লাইনিঙথৌ সরাহাল'কে বিশ্বজগতের সৃস্টির মুল বলে বর্ণনা করা হয়েছে, এবং তাকে পিতৃজ্ঞানে উপাসনা করার কথা বলা হয়েছে। আর পরমনারী 'ইমা লেইমারেল সিদাবী' বা 'ইমাগিথানী'কে মানুষ থেকে শুরু করে জীবজগৎ, নদী, পাহাড়, সমুদ্র, গ্রহ, নক্ষত্রসব বিশ্বজগতের মাতা হিসাবে গন্য করা হয়েছে, এবং তাকে মাতৃজ্ঞানে আরাধনা করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া পুয়্যাগুলোর বিশেষত্ব হলো এগুলোতে মনিপুরি মিথলজির অসংখ্য দেবদেবীর কথা, উপাখ্যান, তাদের উপাসনারীতি বা 'লেইনিং-লিচেত' আলোচনা করা হয়েছে।



প্রাচীন মনিপুরের ধর্ম-দর্শনের সাম্যবাদী দিকটি হলো মানবজাতি সম্বন্ধে এর সর্ব্বজনীন মতবাদ - সৃস্টিকর্তা নিজের প্রতিকৃতি অনুসারে মানবজাতিকে সৃস্টি করেছেন, মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই কারণ প্রতিটি মানুষই সৃষ্টিকর্তার একেকটি ছায়া। মণিপুরি সমাজের আদিধর্মে আমরা দেখি ধর্ম, জীবনবোধ, বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও নৈতিকতার ঐকত্রিক রূপ। মণিপুরিদের উৎপাদন ব্যবস্থা, জীবনের পদ্ধতিও সে প্রকল্পের সহায়ক ছিল। শ্রেনীসমাজের মতো ধার্মিক না হয়েও ধার্মিকতার ভান করা, বা ধর্মকে শোষনে বা স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার সুয়োগ এখানে নেই, কেননা প্রাচীন ধর্মে 'সালাই' ও 'সাগেই' ভিত্তিক যৌথ সামাজিক জীবনের বাইরে ধর্মচেতনার কোন স্থান নেই।

আধুনিক ধারনায় মণিপুরি ধর্মকে প্রাকৃত ধর্ম বলা হলেও মনিপুরি রিভাইভেলিস্টরা একে দক্ষিন-পুর্ব এশিয়ার প্রাচীনতম প্রাতিস্ঠানিক ধর্ম হিসাবে দাবী করেন। হিন্দুধর্মের শ্রেনীভিত্তিক সমাজচেতনা, আচারসর্বস্ব কাঠামো, উঠতি ব্রাহ্মনশ্রেনীর আধিপত্য ইত্যাদি কারণে বিংশ শতকের প্রথম দিকে পুরাতন ধর্মচেতনায় ফিরে যাবার জন্য রিভাইভেলিস্টদের আন্দোলন শুরু হয়। প্রাচীন ধর্ম নিয়ে গবেষনা, লেখালেখি এবং জনসংযোগ কার্যক্রম শুরু হয়। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে আঠারো শতকে হিন্দু মিশনারিদের প্ররোচনায় ধ্বংসসাধন করা ও নিষিদ্ধ ঘোষনা করা প্রাচীন ধর্মীয় পুস্তকগুলো মণিপুরের কৌব্রু, খোইবু, কোৱাথা, কাকচিং ইত্যাদি অঞ্চলের বিভিন্ন গোপন স্থান থেকে সংগ্রহ এবং পুনরুদ্ধার করার কাজ শুরু হয়। উল্লেখ্য যে ১৭৩২ খ্রীস্টাব্দের মণিপুরি মেরা মাসের ১৭ তারিখে কাংলা ফোর্টের সম্মুখে পুয়্যাগুলো পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। মণিপুরি রিভাইভেলিস্টরা প্রতিবিছর ইতিহাসের অন্ধকারতম দিনটিকে 'পুয়্যা মেইথাবা ' দিবস হিসাবে পালন করে।

একথা সত্য যে মণিপুরিরা তাদের আদিধর্মে স্থির থাকতে পারেনি, কিন্তু এতে কোন সন্দেহ নেই যে অষ্টাদশ শতকে হিন্দুধর্মের বলয়ে আসার পুর্ব পর্যন্ত প্রাচীন ধর্মটি পুর্বপুরুষ পরম্পরায় গভীর মর্যাদার সাথে পালিত হয়ে আসছিল। হিন্দু হবার পরেও মণিপুরিদের সামাজিক বিন্যাসের বৈশিষ্ট্যগুলো অক্ষত রয়ে গেছে। মণিপুরের বাইরে এসেও পুর্বপুরুষের লকেই-সাগেই-শিংলুপ ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, জীবনযাত্রা, বাড়ীঘরের নমুনা, খাদ্যাভ্যাস, পরিধেয়, সামাজিক রীতি-আচার-অনুষ্ঠানের সাথে প্রাচীন ধর্মের আত্মীক সম্পর্কের সূত্রটি ছিঁড়তে পারেনি মনিপুরি মৈতৈ বা মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া কেউই। তাই রথযাত্রা, জন্মাস্টমী, রাসোৎসব, দোলযাত্রা ইত্যাদি হিন্দুধর্মীয় পর্বগুলোও পালিত হয় নিজস্ব আঙ্গিকে, আদিধর্মের আচার-কানুনের সাথে সমন্বয় ঘটিয়ে। এখনো আদিধর্মের দেবদেবীদের হিন্দুদেবদেবীদের সাথে সমান, কখনো কখনো অধিক মর্যাদার আসনে বসানো হয়। এখনো মনিপুরি মৈতৈদের একাংশ এবং মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়াদের একটি ক্ষুদ্র অংশ আদিধর্মে স্থিত রয়েছে।

পরবর্তী পর্ব: আপোকপা (পুর্বপুরুষকে দেবতা জ্ঞানে আরাধনা)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১২:৪৯
৬টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×