ফুঁটিফাটা মাঠ গুলোর বুক চৌচির করে ছুটে চলেছে কালামান এক্সপ্রেস তার গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে। চারপাশের দৃশ্য গুলো মনে ধরার মত ই। একজোড়া কপোত কে উড়ে যেতে দেখল ঠিক তার ই কেবিনের পাশে; দরজার ওপাশে কোন এক শব্দে বাঁয়ে তাকাল নীহারিকা, টিটি এসেছে টিকেট চেক করতে।
টিটিঃ মেম, কোথায় নামবেন?
নীহারিকাঃ চর মৃত্তিকা ।
টিটিঃ টিকেট ছিঁড়ে নিয়ে, এই নিন। আর যাত্রা উপভোগ করুন ।
নীহারিকাঃ ধন্যবাদ।
আবার সেই নিরবতা তার সঙ্গি হল। নিরব ই বলা চলে, একঘেয়ে রেলের শব্দ আর কত ই বা সঙ্গ দিবে? চৌঠা ফাল্গুন। ট্রেন ছেড়েছিল সেই দ্বিপ্রহরে, সময় যেন তার উপস্থিতি জানান না দিয়ে ই বয়ে যাচ্ছে। জীবনের সকল আলো আঁধারি এসে ভিড় জমায় নীহারিকার মনে; নিজেকে ই প্রশ্ন করে, "কেন আমি ট্রেন এর মত না? ট্রেন টা তো ঠিক ই তার দুপাশে ফেলে যাওয়া স্মৃতিসূচক দৃশ্য গুলো উপেক্ষা করে সামনে ছুটে চলছে তার আপন গতিতে, আমি কেন পারছি না? "
অজান্তে ই ক'ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল সদ্য কাটা টিকেট টার উপর, ওদিকে নজর যেতে ই টিকেট টি ভাঁজ করে ব্যাগ এ রাখল। চেইন মারার সময় ডায়েরীর কার্নিশ টা চোখে পড়ল। তার একাকীত্ব আর ডায়েরীর লড়াই সেই শৈশব থেকে; সেই এক যুগ আগের দিন টি থেকে যা আজও তার চোখের সামনে ভাসছে । নিজের অজান্তে ই আবার ডুকরে কেঁদে উঠলো তার হৃদয়। পেছনের দিনগুলোর পঞ্জিকা বার বার কড়া নাড়ে, বার বার যেন জানান দিয়ে যায় "আমরা ই তোমার পরিচয়, নীহারিকা।" সেই কড়া নাড়ার ডাকে সাড়া দিয়ে নীহারিকা চলে যেতে বাধ্য হয় তার পুরনো অতীতে, সুদূর অতীতে; তার জন্মের ও আগের অতীতে, কেননা পূর্ব-সূত্র ছাড়া তার জীবন নামক ছবি টি ধূধূ চারণভূমি তে মরীচিকার ন্যায় ! ডায়েরীর প্রথম পাতা গুলো জীর্ণ , হয়ত তার অজান্তে প্রথমাংশের কয়েকটা পাতা হারিয়ে ও গিয়েছে, কিংবা তার স্মৃতিশক্তির ধারন ক্ষমতার পরিসীমার অপর পার্শ্বে থাকায় কোন কোন স্মৃতি ঠায় পায়নি অন্যগুলোর সাথে। তার পরে ও দৃশ্যমান প্রথম পাতা থেকে ই আবার নিজেকে হারিয়ে খুঁজে পেতে অধীর প্রচেষ্টা নীহারিকার।
সিহা সদ্য এসএসসি শেষ করে পরীক্ষা নামক দাহ্য দাবানল থেকে সবে মাত্র রেহাই পেল; কয়েকটি দিন বন্ধু দের সাথে জম্পেশ আড্ডা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু অগত্যা তাকে গ্রামের বাড়ি তে চলে আসতে হবে বলে বাবা আদেশ দিয়ে দিয়েছেন। হঠাৎ করে ই মন টা মোচড় দিয়ে উঠলো; বন্ধু দের সাথে পরিকল্পিতভাবে ঘুরতে না পারার জন্য নয়, অর্ক-র জন্য। অর্ক আর সিহার সম্পর্ক সেই প্রাথমিক সমাপনীর পর থেকে ই। “স্থায়ী শালিকজোড়” নামে বেশ পরিচিতি ছিল ওদের ক্যাম্পাস জুড়ে। কি জানি কত গুলো মুহূর্ত অর্ক কে ছাড়া থাকতে হয় সিহার তা চিন্তা করে ই হয়ত নিজের অজান্তে ই এক প্রকার বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে নিজের ললাটের প্রতি। কিন্তু, আছে যাহা ভালে, ঠেকায় কে কোনকালে?
"দেখ না, ট্রেন ছাড়তে আর মাত্র ৮ মিনিট বাকি, দূরালাপনে নির্মা কে বলছিল সিহা অত্যন্ত ক্রন্দনরত সুরে, অর্কের আসার নাম নেই রে, ফোন টা ও বন্ধ।" আর মাত্র মিনিট চারেক বাকি, সিহা তার মাথার উপর একটি অজ্ঞাত প্রাণীর বিচরণ অনুভব করল। ভয় পেয়ে প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠতে চাইল কিন্তু অর্কের হাতের মৃদু চাপের কাছে তার কণ্ঠ অসহায়। পিছন ফিরে অর্ক কে দেখে জড়িয়ে ধরে পরক্ষণে ই আবার ছেড়ে দিল অভিমানে। অর্ক সিহার হাত ধরে তার দিকে ফেরাল, হাঁটু গেঁড়ে বসে তার সাথে আনা শালিক টি আকাশে মুক্ত করে দিয়ে বলল, “সিহা, এই শালিক টি এখন মুক্ত হয়ে আকাশে মনের সুখে উড়ে বেড়াবে, তার মনে এখন কোন ভয় নেই। কেন জান? কারণ, সর্বদা, সর্বত্র, বিশাল আকাশ টা তাকে আগলে রাখবে আকাশের ই সীমানায় এই ভরসায়। আমি আকাশ হওয়ার মত এত বড় ক্ষমতা আমার নেই , কিন্তু আমার এই শালিকটির জন্য আমি মহাকাশ হয়ে থাকতে চাই। ডুকরে কেঁদে উঠলো দুইজন ই, সিহা আর থাকতে পারল না, নীরব বিদায় জানাল অর্ক কে।
ক্যাবিনের দরজায় টোকার শব্দে সম্বিত ফিরে পেল নীহারিকা; তার অতীত-আর্তি তে বাধা পড়ল, একরকম বিরক্তির গলা নিয়ে ই আগন্তুকের পরিচয় জিজ্ঞেস করল। “আমি এই ক্যাবিনের গ-৩ এর যাত্রী”, অপর পাশ থেকে ভেসে আসল......... (পরবর্তী খণ্ডে অব্যাহত থাকবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ২:১৪