ঘুম ভাঙ্গার পর এখন আর আমি স্বপ্নের মানে খুঁজি না, এক সময় এসব নিয়ে অনেক ভাবতাম, লিখেও রাখতাম, এখন সেই সময় কোথায়, আমি যে মহা ব্যস্ত, দিনরাত সহপাঠীদের সাথে গ্রুপ ডিসকাশন, পড়ালেখা আর একটানা ক্লাস। সেই বাচ্চা বেলার পড়া গুলোতে আবার নতুন করে হাতেখড়ি। ফাঁকিবাজি করার আর সুযোগ নেই। তারপর আবার যখন শুনেছি শাম্মি প্রিলিমিনারির আগের দিন রাতে দু’টাকার বিনিময়ে মানে শুধু নিজের জন্যে ফটোকপিতে ইনভেস্ট করে প্রশ্নপত্র পেয়েছিলো, তখন মনে ভয়ানক এক খটকা লাগে, একই সঙ্গে এই প্রশ্নও জাগে এমন বাজে অবস্থায় চরম এই প্রতিযোগিতার মানে আসলে কী ?
যাই হোক, পরদিন কাফনে জড়ানো আম্মাকে দেখে সেই স্বপ্নটার কথা আবার মনে পড়লো। মনে প্রশ্ন জাগছিলো আচ্ছা ছয়টা বেলুন দিয়ে কী বোঝায় ? আমার মায়ের ছয় সন্তান কি এখানে সিম্বল হিসেবে এসেছে ? বেলুন গুলো যে বাতাসে উড়ে উড়ে একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলো তারই বা মানে কী ? প্রচণ্ড শোক গ্রস্থ হবার কারণে এর পরের কয়েক মাস জাগতিক অনেক বিষয়ে মনে উঁকি দেয়া প্রশ্নগুলো সব বেমালুম গায়েব হয়ে গেলো। কতদিক দিয়ে সেই স্বপ্নটা মিলেগিয়ে ছিলো সেটা নিয়ে মনে মনে একটা হিসেব কষতে বসলাম আরো অনেকদিন পর ততদিনে দীর্ঘ সেই স্বপ্নের অনেকখানি ভুলে গেলাম, যেমন করে প্রতিরাতে দেখা স্বপ্নগুলো ভুলে যাই।
যে স্বপ্নগুলো কোথাও না কোথাও লেখা রয়েছে সেগুলো পড়েও অনেক সময় স্মরণ করতে পারিনা। স্বপ্নের স্মৃতিরা মনে হয় এমনই ভঙ্গুর হয়।
স্বপ্ন লিখার আগে আরেকটা জিনিস লিখে রাখার অভ্যাস আমার ছিলো। তা হল ভাবনা। শৈশব কিংবা তারও অনেক আগে থেকে নিয়মিত একটানা বিচিত্র সব ঘটনা নিয়ে ভাবতাম। এই ভাবনার বাঁধাধরা কোন সময় ছিলোনা। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা যখনই সময় পেতাম ডুব দিতাম কল্পনার সেই নিজস্ব ভুবনে। সেই জগতটা একান্তই আমার। আমিই সেখানে নায়ক, না নায়ক নয়, মহা নায়ক। সুপার পাওয়ারের অধিকারী অভিনব এক সুপারম্যান। কখনওবা ইনক্রেডিবল হক, বায়োনিক ওমেন সেখানে নায়িকা। আরো সব জমকালো ঘটনায় নায়িকা হিসেবে এসেছে কল্প জগতের অনেক সুন্দরি মহিলারা। এদের কয়েক জন আবার ছিলও অতি সাধারণ। এই সব ঘটনা প্রবাহের মাঝে সব সময়ই আমি থাকতাম পরিণত এক যুবক হিসেবে। বই-খাতা-পেন্সিলের ভীরে একটা গুচ্ছ কাগজ আমার কাছে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাবনা রেখে কখনো অন্য কোন কাজে বা বন্ধুদের খেলার আড্ডায় যোগদিতে যাবার সময়, স্কুলে রওনা দেবার সময় শেষ দৃশ্যটির মনে পড়ার মত কোন একটি শব্দ সেখানে টুকে রেখে যেতাম। ফেরার পর আবার যাতে আগের জায়গা থেকেই ভাবতে বসা যায়। কল্পনার কত পাত্র পাত্রি আর দৃশ্যের আনাগোনা জটিল সেই ঘটনা প্রবাহের মাঝে বুদ হয়ে থাকতাম প্রায় সবটা সময়। আমার ভাবনা খাতায় তাই সম্পূর্ণ কোন কাহীনি লেখা হয়ে ওঠেনি কখনই। কেবল নানান ঘটনার এদিক সেদিক কিছু অসম্পূর্ণ লাইন, কয়েকটি করে শব্দ। একটা সুবিধা এতে ছিলো, ভাইবোন বন্ধুবান্ধব কারো পক্ষেই আমার নিজস্ব জগতে প্রবেশ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যেমন তারা সবাই এক সময় জেনে গিয়েছিলো আমার কাব্য প্রতিভা সম্বন্ধে। তখনো তেমন কিছুই গুছিয়ে লিখতে পারিনা। কেবল দু’এক লাইন, আর নিজের নাম। কিন্তু নিজের মাঝেই মাঝে মধ্যে যেনও ভাবের ভর হতো। কথা আসতো, অদ্ভুত সেই কথা। বড়রা সন্ধ্যার পর শব্দ করে পড়ার সময় কবিতা মুখস্থ করতো। আমার তাই আগ বাড়িয়ে তেমন কিছু পড়ার দরকার হয়নি, তাদের উঁচু ক্লাসের কবিতা যে আমার আগেই মুখস্থ। আদর্শলিপির কথা গুলো তাই একটানা পড়তে ঘ্যাণ ঘ্যাণানির মত লাগতো। স্লেটে লেখার ফাঁকে বড় ভাইকে অনুরোধে মাথায় আসা সেই লাইন গুলো লিখিয়ে নেই, কুড়িয়ে পাওয়া বিআরটিসি বাসের একটা টিকিট বইয়ের পেছনে। বইটা এক সময় আধা আধি ভরে আসে। ভাবি, আরও কী লেখা যায়। সব সময় কেনো এমন সুন্দর জিনিস মাথায় আসে না ? দিনের বেলায় আবার সবাই স্কুলে থাকায় লিখে দেয়ার লোক পাওয়া যায়না। সেই সময় মাথায় আসা কোন একটা লাইন বার বার আওড়াতে থাকি, লিখে দেবার মত কাউকে না পাওয়া পর্যন্ত। আগের কবিতা গুলো একটি একটি করে পড়ি। আর বড় হয়ে নজরুলের মত বড় কবি হবার স্বপ্ন দেখি। ভাইরা ‘সকাল বেলার পাখি’ মুখস্থ করে, আর আমি কল্পনায় সকালের রাজ্যে ঘুরে আসি সেই ফাঁকে। রাতের বেলায় ঘুমাবার ভান করে একটানা ভাবতে থকায় আমার সেই প্রতিটি সকাল আর যত্ন দিয়ে দেখা হয় না। দেরি করে ঘুম ভাঙ্গে। সারা রাত ধরে টিনের চালে শিশির আর পাকা বড়ই ঝড়ে পড়ার শব্দ হয়, শব্দ হয় বাদুরের পাখা ঝাপটানো, রাতের সব ধরনের শব্দই তখন আমার কাছে অধীভৌতিক ঠেকে। খুব ভোরে অন্যেরা সেই সব বড়ই কুড়িয়ে আনে, তাতে আমি কমবেশী ভাগ পাই ঠিকই। কিন্তু তাদের মাঝে কবিতা লিখিয়ে নেবার বিস্বস্ত লোকের কমতি টের পাই। আমার সেই শঙ্কা চূড়ান্ত ফলে যায়, বড় ভাইকে দিয়ে একবার কবিতা লেখাবার পর। একদিন বার কতক কবিয়াল ডাকার পর কাউকে দিয়েই কবিতা লেখানোয় আর ভরসা পাই না। যত ক্ষণ মাথায় থাকে ততক্ষণই, তারপর আবার নতুন একটা। টিকেট বইটা সময় সুযোগ পেলে তখনো লুকিয়ে পড়ি, পাখি-ফুল-পাতা নিয়ে দু’চার লাইনের নানান কবিতা। টিকেটের ছাপা অংশের উল্টো পাশ থেকে লেখা প্রথম কবিতাটা শুরুতে থাকায় বেশী করে চোখে পড়তো, তাই সেটাই তখন বার বার পড়ি:
মানুষ হবেনা তুমি/
রবে ফুলের কলি/
ফুল যদি হতে চাও/
তোমার নাম ফুলই/
তবু মানুষ হবেনা তুমি...এর বেশী আর কিছু অনেক চেষ্টা করেও মাথায় আসেনা, প্রতিবার আবৃতি করে তার পরে আর কী আসতে পারে ভাবি, তবু মাথায় কিছুই আর আসেনা, এসব কথার মানে যে কাকে জিজ্ঞেস করি, এমন কোন বন্ধু সুলভ লোকও আশপাশে খুঁজে পাই না। মাঝের কবিতা গুলো তেমন একটা পড়া হয়ে ওঠেনা। ভালোও লাগেনা। বাড়িওয়ালার বাসায় বেড়াতে আসা কালো চশমা পড়া দাদু আমাকে ডেকে নিয়ে দু’এক লাইন ইংরেজি কথা জিজ্ঞেস করে, আমার সেই কবিতাটা বার বার শুনে, বুদ হয়ে বসে থাকে আর আমারকে নিয়ে আরো বেশী আগ্রহী হয়ে ওঠেন। একদিন সেও চলে যান। টিকেট বইয়ের পেছনে লেখা আমার সেই কবিতার খাতাও এক দিন হারিয়ে ফেলি, সেই সঙ্গে তখনকার মত হারিয়ে ফেলি কবিতা লেখার ঝোঁক। তারপর অনেক দিন আর মাথায় কোন কবিতা আসেনি। কল্পনার সুপার ম্যানেরাও কখন যে কোথায় হারিয়ে গেল টেরই পাইনি। ভাবনা খাতা এখন আর হাতের কাছে না থাকলেও সেই সব বিচিত্র কথা-কাহীনি ভেতরে ভেতরে এখনো আমাকে তাড়া করে ফেরে। আজকের সব কঠিন বাস্তবকে পিছু ফেলে দেবার সাহস বোধহয় সেখান থেকেই আসছে। স্মৃতির অতলে হয়তো সেসব কোথাও লুকিয়ে আছে, যেমন লুকিয়ে আছে অজস্র স্রোতের স্মৃতি। লঞ্চে করে নানা বাড়ি যাবার সময় সারাটা পথ নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকা আমার সব সময়ের অভ্যাস। সেই সব স্রোতের ভীরে কী খুঁজতাম জানিনা, শুধু শুধুই যে তাকিয়ে থাকতাম তাও না। ঢেউ কেটে লঞ্চ এগিয়ে চলতো, কখনো কখনো জলের মাঝে দূরে কোথাও মুহূর্তের জন্যে একটা দু’টা শুশুকের দেখা মিলতও। সঙ্গে সঙ্গে আবার পেয়ে বসতো শুশুক দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। একটানা তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত চেতনা এক সময় আমাকে নিয়ে পারি জমাতো কোন নতুন কল্পলোকে। স্রোতের ছন্দের সাথে চলতো কল্পনার অবুঝ মিশ্রণ, যা কথায় ধরা দেবার মত নয়। ঠিক যেন “...শুধু রূপ কথাতেই যার পরিচয়।” রূপ কথার এই পরিচিত কথাটির বাস্তব অনুভূতি। লঞ্চে তখন একটার পর একটা খাবার খেতাম। তারপরও কল্পনায় খেতাম তার চাইতে ঢের বেশী। আর সেই জন্যেই মনে হয় আম্মা যখন আমাদের নিয়ে পাড়া বেড়াতে বের হতেন তখন কারো দেয়া খাবারই আমার মুখে রুচতো না। এমনকি ভদ্রতা করে একবারের জন্যেও প্রিয় সেই মুড়ি-মুড়কি ছুঁয়ে না দেখার কারণে অনেক দিন পর্যন্ত আম্মার ভৎসনা শুনতে হয়েছিলো। সেবারের ভ্রমণটা ছিল বর্ষার সময়। লঞ্চে করে কালিপুরা ঘাটে পৌছার পর আবার ঘণ্টা খানেকের পাল তোলা নৌকার পথ। বাসা থেকে রওনা হবার আগের দিনই আম্মা বলে রেখেছিলো নৌকায় করে যাবার সময় আমাদের নিয়ে পাকা পেঁপে খাবে। তারপর অনেক দিন পর্যন্ত আমি কল্পনায় পালতোলা নৌকায় বসে বসে আয়েসি ভঙ্গিতে পাকা পেঁপে খেয়েছিলাম যে সামনা সামনি পাবার পর আর সেটা খাবার ইচ্ছেই হতোনা। নৌকায় বসে বসে ঢেউ দেখতাম আর বিলের পানিতে সবার অলক্ষ্যে হাত ডুববার চেষ্টায় থাকতাম। কালেভদ্রে সফলও হতাম। আহ্ জলের সেই শীতল অনুভূতি আর নির্মল বাতাসের সেই সজীবতা আজ আর কোথাও পাইনা। সাদা শাপলা, শালুক ফুল সহ কতযে জলজ উদ্ভিদের দৃষ্টি নন্দন ফুল আর পাতা পানির উপরের তলে ভেসে বেড়ায় আর ঢেউয়ের সঙ্গে দোল খায়। এদের মাঝ দিয়েই নৌকা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে, জোড়া তালি দেয়া পাল বাতাসে ফুলে ফেঁপে থাকে। নৌকা সামনে এগিয়ে যাবার পর সেই জলজ গাছেদের ডুবে যাওয়া ফুল আর পাতারা আবার আগের মতই জেগে ওঠে। এবাড়ি ওবাড়ি মিলিয়ে গ্রাম গুলো তখন ছোট ছোট দ্বীপ। আবার এমন দ্বীপও রয়েছে যেখানে কোন জন বসতি নেই, শুধুই গাছ গাছড়া, আগাছা আর গোটা কতক কবর। এই জায়গা গুলোকে ছাড়াবাড়ি নামে ডাকা হয়। আম্মা প্রায়ই বাসায় গল্প করার সময় এই ছাড়াবাড়ির কথা বলতো। কোন এক পূর্ণিমার গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাবার পর, মেহেদি ফুলের মৌ মৌ গন্ধে জানালা দিয়ে চাঁদের আলোয় দাদীকে মেহেদি পাতা পাড়তে দেখে দাদীকে সঙ্গদিতে বাইরে বেরিয়ে আসেন তিনি। তারপর কাছে এসে ডেকে উঠে আঁচল ধরে টান দিতে গেলেই নাকি তিনি লম্বা হতে হতে ছাড়াবাড়ির দিকে হেটে চলে যেতে থাকেন। এর পরই তাঁর প্রচণ্ড চিৎকারে আর সবার ঘুম ভাঙ্গে। পাশে ঘুমিয়ে থাকা ঘুমন্ত দাদীও জেগে উঠে। সেই ছাড়াবাড়ির এক কোনে নাকি রাতে সব সময় আগুন জ্বলতে দেখতেন সবাই, আবার দিন হলে সব ঠিক। আগের রাতের কথা তখন কারই আর মনে থাকতো না।
ভয় একটি সংক্রামক ব্যাধি। আমার ভেতরে ভয়টা সেভাবেই বাসা বেঁধেছিল কিনা জানিনা এক সময় আমার ভাবনার রাজ্যে ভয় নামের নতুন এক অনুষঙ্গ ঢুকে পরে। নিজের মতন করে অদৃশ্য সব সত্তাদের নিয়ে ভাবি। সেই সাথে মনের ভেতর ভয় আরো বাসা বাধতে থাকে। সব সময় বুজির কোলে কোলে থাকি। আর দরকার পড়লেই বলি বিলকিস আমারে কোলেনে, সবার সামনেও বিছানা থেকে পর্যন্ত পানামাতে ভয়। সব ধরনের ভুত নিয়ে মাসের পর মাস ভাবার পর, এখন আশপাশের সব কিছুতেই যেনো ভুত সেঁধিয়ে গেছে। আপারা লিলিপুটের গল্প পড়ে, আমার কল্পনায় ছুড়ি চাকু তির ধনুক ওয়ালা লিলিপুট ভুত ঢুকে পড়ে। ওরা সব সারা ক্ষণই যেন আমার অপেক্ষায় বিছানা টেবিল চেয়ারের তলে, সোকেসের পেছনে। আর রাতের উঠনে আরো সব ভয়ঙ্কর ভুত। ওদের চোখে আগুনের ফুলকি জ্বল জ্বল করে। একবার বেড়ালের মত কী যেন কী দেখে ভয়ানক চিৎকারে পাড়া মাথায় তোলার পর আম্মার টনক নড়ে। নারিন্দার পীর সাহেবের কাছ থেকে পানি পড়া আনা হয়। এর পরও ভয়তো মোটেই কমেনা বরং বন্ধুদের কাছে সেই ভয়ের গল্প করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে আরো সব ভয়ানক ভুত, আমারা সবাই ঘুমতে গেলে রাতে নাকি নিশিরা চারদিকে চলাফেরা করে। এরই মধ্যে একদিন স্বপ্নের মাঝে পেছনের মাঠে হাঁটছিলাম, মাঠের এক কোনায় কাঁটাখুদিরার ঝোঁপের মাঝে উঁকি দিবার পর স্পষ্ট দেখতে পেলাম কিছুদিন আগে মারা যাওয়া বয়স্ক এক মহিলা, সুন্দর পোষাকে হুইল চেয়ারে বসে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর পরপরই স্বপ্ন ভাঙ্গে ঘর কাঁপানো চিৎকারে। সে সময় সব স্বপ্নই যে ভয়ের ছিল তা কিন্তু নয়। স্বপ্ন আর কল্পনার দিন যাপনের কালে রোমান্টিক অনেক ভাবনাও আমাকে বিবশ করতো। একবার কলাবাগানে আমাদের সেই ভাড়া বাসার দক্ষিণ দিকে একটা বাসা পর নতুন ভাড়াটিয়া আসে। ওদের সঙ্গে কিন্তু আর বন্ধুত্ব জমে ওঠেনা। কারণ ওরা সবার মতন মাঠে খেলতে আসতো না। কেমন যেন একটা দূরত্ব। পরীর মতো দেখতে লাগতো সেই বাসার নিভাকে। ওর ছোট ভাই আশিক কিন্তু আবার লুকিয়ে চুকিয়ে মাঠে ঠিকই আসতো। এবার একটা আশা দেখাদিলো, কদিনের মধ্যে নিভাও নিশ্চয় আসবে মাঠে, সেই সুযোগে ভাবও হয়তো হবে। ওদের রান্না ঘরের পেছন বরাবর ছাদ থেকে নেমে আসা একটা নল থেকে অনবরত ঝর্নার মত পানি পড়তো, সেই পানির ধারায় পুষ্ট হয়ে পাক ঘরের পেছনে সুদৃশ্য তিত বেগুনের ঝোপ বেড়ে ওঠে। সেই ঝোপ দেখতেগিয়ে একদিন নিভার কান্নার শব্দে মন ভেঙ্গে ফিরে আসলাম। আহারে বেচারি কিযে কান্না !
এবার খেলার মাঠে আশিকের সঙ্গে কঠিন করে ভাব জমালাম। একটা চকলেট বাড়িয়ে ধরতেই সেদিন আর ও আমার পিছু ছাড়ে না। নিভার সেই কান্নার কথা জানতে গিয়ে ওর কাছে জানলাম ওর বাবা একজন স্মাগলার, তাই ওদের সবার সাথে মিশতে দেয়না সে। আগের বাসায়ও কারো সাথে খেলতে যেতে দিতো না। এখানেও না। আমার একদমই ওর কথা বিশ্বাস হয়নি তখন হয়তো চকলেটের লোভে বানিয়েও বলতে পারে। তাই অন্য দু’জনের কাছে এব্যাপারে জানতে চাইলাম। ওরা দু’বোন আবার নিভার সাথেই পড়ে, লেকসাকার্সে। সেই সুবাদে ওদের বাসার উঠানেই ইদানীং ওরা এক সঙ্গে খেলে। তাই সব দিন ওদেরও আবার মাঠে পাওয়া যাচ্ছিলো না।
তারপর দিন দেখি ওই দু’জনকে সঙ্গে করে নিভা মাঠ পেরিয়ে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। আমার দিকে ওর এই এগিয়ে আসার সময়টুকুতে আমি অনন্ত এক কল্পনার রাজ্যে ডুব দেই। আর সে কারণেই কল্পনার সেই অনন্ত শেষে কারো জেরার মুখে পরার জন্যে অপ্রস্ততও ছিলাম। সঙ্গে দু’দুজন সাক্ষী নিয়ে এসেছে ও। দেখি খুব ভালো করেই আমার নাম ধরে ডাকলও। আমি এগিয়ে আসার আগেই আমার সামনে এসে চোখে চোখ রেখে দাঁড়ালো, তারপর ভয়ানক হিংসা মাখা চাহনি দিয়ে তাকিয়ে থেকে বললো, “ আমার আব্বুকে নাকি তুমি স্মাগলার বলে বেড়াচ্ছো, সবার কাছে ?” কথাটা আমি আশিকের কাছেই শুনেছি, নানা ভাবে সেটা ওকে বুঝাতে ব্যর্থ হলাম। ওর কথাতেই অনড়সে। তার বাবাকে নিয়ে কখনই যেনো আর কারো কাছে কোন ধরনের বাজে কথা না বলি, এই বলে সাশিয়ে অন্যদের নিয়ে ধীর পায়ে হেটে চলে গেলো। ওর সেই চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থেকেও আমি অনন্ত বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছিলাম।
(অনন্ত প্রহর ওর সাথে পাশাপাশি বসে গল্প করবো, এক সাথে খেলাধুলা করবো, অনেক দূরের পথ এক সাথে হেটে যাবো ....) তারপর থেকে দূর হতে অনেকবার চোখাচোখি হলেও আর কখনই একটি বারের জন্যও কথাবলা হয়ে ওঠেনি। ভুল বোঝাবুঝিটা শেষ পর্যন্ত থেকেই গেলো। শৈশবের বন্ধুরা না বুঝে আমার এমন আকাঙ্ক্ষার একজন মানুষকে চির দিনের জন্য দূরে সরিয়ে দিতে পারলো ?
আমার নিজস্ব ব্লগ http://www.sohrabsumon.me/?p=110 এ প্রকাশিত।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০১১ বিকাল ৪:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




