১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ এ ঢাকায় এসে পৌঁছান পাকিস্তানের গভর্ণর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্। তার আগমনে ২১ মার্চ এক গণ-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে তিনি ভাষণ দেন এবং তাঁর ভাষণে তিনি বলেন, "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, এবং যারা পাকিস্তানের শত্রু তাদের কখনোই ক্ষমা করা হবে না"। [ সূত্র: "Federalism and Pakistan" 1954, P -139 ]
আবার ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়েও তিনি একই ধরণের বক্তব্য রাখেন। "একই দিনে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম,তাজউদ্দিন আহমদ, নঈমুদ্দিন আহমদ সহ প্রমুখ জিন্নাহ্'র সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়। [সূত্র: Banglapedia]"
"পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ১৮ নভেম্বর তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান,তাজউদ্দিন আহমদ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একটি স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের কাছে পাঠান কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রেও কোনো সাড়া দেননি। [অমর একুশে ও শহীদ মিনার, ঢাকা, পৃ: ৬১ - ৮৪]"
"১৯৪৮ সালের ২৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে এক ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। ঐ সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের তরফ থেকে প্রদত্ত মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হয়।
এই মানপত্রটি পাঠ করেন ইউনিয়নের তৎকালীন সেক্রেটারি গোলাম আযম। আসলে এটি পাঠ করার কথা ছিল ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট অরবিন্দ বোসের। কিন্তু লিয়াকত আলীকে ভাষা আন্দোলনের দাবি সংবলিত মানপত্র পাঠ একজন হিন্দু ছাত্রকে দিয়ে করালে তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে এ আশংকা থেকেই একজন মুসলমান ছাত্র হিসেবে সেক্রেটারি গোলাম আযমকে সেটা পাঠ করতে দেয়া হয়েছিল। [ সূত্র: ২৭ জুলাই ২০০৮ তারিখে যুগান্তরে প্রকাশিত বদরুদ্দীন উমারের কলাম]"
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর 'দৈনিক জিন্দেগী' ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র। এই জিন্দেগী পত্রিকায় লিয়াকত আলীর ঢাকা সফরের সময় তাকে দেওয়া ডাকসুর মানপত্রের কথা খবরে উল্লেখ করা হয়েছিল। তাতে মাত্র এক লাইনে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া মানপত্রে ছাত্রসমাজ বাংলাকে প্রদেশের সরকারি কাজ কর্মের ভাষা করার দাবি করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। মানপত্রে এই এক লাইনের একটি দাবি পাঠ করে গোলাম আযম ভাষা সৈনিক হয়ে গেলেন? এই হলো ভাষা আন্দোলনে গোলাম আযমের 'বিরাট' ভূমিকা। তাছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রদের চাপে বাধ্য হয়ে গোলাম আজম মানপত্রটি পড়েছিলেন।
কারণ গোলাম আজম তার নিজের লেখা বইয়ে লিখেছেন," উচ্চশিক্ষিতদের জন্য ইংরেজি কমন ভাষা হলেও সকলের জন্য উর্দুর কোনো বিকল্প নেই। [সূত্র: গোলাম আজমের আত্মজীবনীর ৩য় খন্ডের ১০৫ পৃষ্ঠা]"
এতেই কিন্তু বোঝা যায় গোলাম আজম কেমন ভাষা সৈনিক ছিলেন আর বাংলা ভাষার উপর তার কেমন মমত্ববোধ ছিল॥
এই মহান (!) ভাষা সৈনিকের পরবর্তীতে জামায়াতে যোগ দেওয়ার পর করাচি সফরে গিয়ে এক সভায় বলেন, "তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে, বাংলা ভাষার আন্দোলনে অল্প সময়ের জন্য হলেও সমর্থন দিতে যাওয়া। এ জন্য তিনি এখন অনুতপ্ত। [সূত্র - বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস- ড. মোহাম্মদ হাননান পৃষ্ঠা - ৩৯৯]"
যাইহোক,আবার ইতিহাসে ফিরে যাই -
"১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সরকার ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরিষদের কিছু সদস্য নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার পক্ষে থাকলেও, সবশেষে ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। [ সূত্র: ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস। সেলিনা হোসেন, পৃষ্ঠা: ৫- ২৮ ]"
"২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সলিমুল্লাহ হলে ফকির শাহাবুদ্দীনের সভাপতিত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শাহাবুদ্দিন আহমদের প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে এই সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নেন আবদুল মোমিন॥ [সূত্র: একুশের সংকলন, গাজীউল হক,১৯৮০, পৃষ্ঠা: ১৩৭- ৩৮]"
২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে। কিন্তু পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিক ঘিরে রাখে।
"বেলা সোয়া এগারটারদিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়। [সূত্র: Banglapedia]"
বেলা ২টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের বাঁধা দেয়। কিন্তু পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যখন কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেয় তারা আইনসভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবে। ছাত্ররা ঐ উদ্দেশ্যে আইনসভার দিকে রওনা করলে বেলা ৩টার দিকে পুলিশ দৌঁড়ে এসে ছাত্রাবাসে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশের গুলিবর্ষণে জব্বার এবং রফিক ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তাছাড়া বরকত, সালামসহ আরও অনেকে সেসময় নিহত হন যা সবারই জানা আছে।
উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত লেখা পড়লে এবং ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সহজেই বোঝা যায়,একুশে ফেব্রুয়ারিতে আরোপিত ১৪৪ ধারা ভাঙা বা ভাষা আন্দোলনের জন্য প্রবীণ ও নবীন নেতাদের কোনো গোপন ও প্রকাশ্য সভাতেই গোলাম আজমকে অংশ নিতে দেখা যায়নি। তাহলে তিনি ভাষা সৈনিক হলেন কীভাবে? কেবল ১৯৪৮ সালে লিয়াকত আলীর ঢাকা সফরের সময় বাধ্য হয়ে পড়া একটি মানপত্র পাঠ দ্বারা ভাষা সংগ্রামী, ভাষা সৈনিক হয়ে গেলেন?
ঐ জন্য কামাল লোহনী গত ৫ই সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায়, লিখেছিলেন গোলাম আজম কখনোই ভাষা সৈনিক ছিলেন না।
ভাষা আন্দোলনের সামনের কাতারের নেতা ছিলেন আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, গাজীউল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখ।
দেখা যাচ্ছে, জামায়াত নেতা গোলাম আযম এবং জামায়াত শিবিরের নেতাদের কথাবার্তার ভেল্কিবাজি ও নৈতিক অধ:পতনের তুলনা নেই। ভাষা আন্দোলনে গোলাম আজমের অংশ গ্রহণের কাহিনী, তারপর ১৯৭০ সালে তাতে অংশ গ্রহণে দু:খ প্রকাশ ও ভাষা আন্দোলনকে বেঠিক কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা আবার ১৯৯২ সালে নিজেকে ‘ভাষা সৈনিক’ হিসেবে প্রচার করা এবং রাস্তার দেওয়ালে দেওয়ালে গোলাম আজমকে ভাষা সৈনিক বানিয়ে পোস্টার লাগানো এসবই হলো জামায়াতে ইসলামীর জাদুর খেলা। এর সঙ্গে যে প্রকৃত ইসলামী নৈতিকতার কোন সম্পর্ক নেই একথা সহজেই অনুমেয়॥
ঐ জন্য গোলাম আজম সম্পর্কে শওকত ওসমান বলেছিলেন, "বেশ্যাও এক সময় সতী থাকে॥" আসলেই শওকত ওসমান ঠিক বলেছেন। এরপরও যদি কেউ রাজাকার গডফাদার গোলাম আজমকে ভাষা সৈনিক বলে তবে গ্রাম্য প্রবাদের ভাষায় বলবো, "মুখ না থাকলে সে গু খেতো।"