somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বপ্নলোকের ইচ্ছেফেরী

২২ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রাককথন

রাতের প্রথম প্রহর। কৃষ্ণপক্ষের রাত। কিন্তু আকাশে অগুনিত নক্ষত্র মিটিমিটি আলো ছড়িয়ে রাতের কালিমা কিছুটা হলেও দূর করছে। এমনিতর অন্ধকারময় নিশ্চুপ রাতে এক তরুণী নির্নিমেষ দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে দূর আকাশপানে। তারার আবছা আলোয় তার স্পষ্ট অবয়ব দেখা যাচ্ছে। খোলাচুলে সিঁড়িঘরের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে সে। ভালো করে লক্ষ করলে চেহারার বিষণ্ণতাটুকু খুব করে চোখে পড়বে। চোখদুটো গভীর বিষাদে ছেয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে জমাট বাঁধা কষ্ট চেপে রেখেছে , বুকের মধ্যে। হাতে ধরে রাখা বইটা দিয়ে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠলো মেয়েটা। মনের কষ্টগুলো চোখের জলে ভাসিয়ে দিতে চায়। কিন্তু তাতে সায় দিলো না চোখ দুটো। মরা নদীর মতোই শুকিয়ে আছে ও'দুটো। কালের পরিক্রমায় জল বিসর্জন করতে করতে সব পুঁজি শেষ হয়ে গেছে তাদের। তাই চোখ থেকে একফোঁটা জলও গড়ালো না।

ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে অনেক আগের স্মৃতিপট জেগে উঠলো তার।

শেষকথার আগের কথা …

'আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। পড়ার টেবিলে বসে আছি ক্লাসের পড়া শেষ করবার আশায়। কিন্তু পড়ার নামে ঘন্টাটাও হচ্ছে না। বিড়বিড় করে ছোটভাইয়ের মুন্ডুপাত করছি। তিন গোয়েন্দার বইটা ওর চোখে ধরা পড়ে গেছে। সেটা তো বড় কথা নয়, বড় কথা হলো, সে আমাকে হুমকি দিয়েছে! বলেছে, আর কখনো যদি তিন গোয়েন্দা পড়তে দেখে, মাকে বলে পিটুনী দেবে!
পিচ্চি হলে কী হবে, বিচ্ছু একটা! সুযোগ পেলেই ব্ল্যাকমেইল করে। মায়ের কাছে গোয়েন্দা বই ধরিয়ে দেবার হুমকি দেয়। আর আমি ভালো করেই জানি, মায়ের হাতে কোন বই পড়লে, মা সেটাকে আস্ত রাখবে না। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। অথবা চুলোয় ফেলবে। মা গল্পের বই পড়া পছন্দই করে না। দুঃখে কষ্টে চোখ ফেটে কান্না আসছে আমার। ভাইটাকে যে কী করে মানাবো, বুঝতেই পারছি না। এটাই তো তিন গোয়েন্দা পড়ার আদর্শ সময়। অবশ্য আমার মনে হয়, বুড়ো হয়ে গেলেও তিন গোয়েন্দা পড়া ছাড়তে পারবো না আমি।

'মনে মনে কত কিছু ভেবে রেখেছি! আমার যখন অনেক টাকা হবে তখন আমার আলাদা একটা বেডরুম থাকবে। শোবার বিছানার মাথার কাছেই দেয়ালে একটা গোপন কুঠুরি থাকবে। যেখানে সারি সারি বই সাজানো থাকবে। যখন ইচ্ছে করবে তখনই বই পড়তে পারব। আবার কেউ এসে পড়লে চটজলদি লুকিয়েও রাখতে পারব … বই বের করে নিলে কিংবা ঢুকিয়ে রাখার পর অটোমেটিক লক হয়ে যাবে …
কেউ টেরটিও পাবে না …

'মা'র গলার আওয়াজ পেয়ে স্বপ্নের জগত থেকে ফিরে এলাম। পড়া শেষ করার তাগাদা দিচ্ছে মা। একটু শান্তিমত বসে যে সুখস্বপ্ন দেখব, সেই সুযোগটাও নেই। তার উপরে আবার মাথায় "কালো হাত" গল্পটা ঘুরছে। মাত্র ৩৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়তে পেরেছি টিফিন পিরিয়ডে। টিফিন পিরিয়ডের পরের ক্লাসগুলি কড়া কড়া টিচারদের ছিল। টিচারকে ফাঁকি দিয়ে পড়ার সুযোগই পাইনি। রহস্যের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কি পড়ায় মনোযোগ বসবে?

'একটা গল্প পুরোটা শেষ না করতে পারলে কী যে অস্থির লাগে আমার! সারাক্ষণ ওটাই মাথায় ঘুরতে থাকে। মায়ের চোখ এড়িয়ে তিন গোয়েন্দার ভলিউম ২১ মোটা গাইডের মধ্যে রেখে পড়তে শুরু করলাম। এতোটাই তন্ময় হয়ে পড়তে লাগলাম যে কখন মা টেবিলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, বলতেই পারব না।
"কী পড়িস?" আম্মুর গলায় প্রশ্নটা শুনে ভিতরে ভিতরে চমকে গেলাম। হৃদপিন্ডটা যেন লাফ মেরে গলার কাছে উঠে আসতে চাইছে। আম্মু কি ইতিমধ্যেই বইটা দেখে ফেলেছে? জানি না। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার চোর চোর মার্কা চেহারাটা দেখলেই আম্মু বুঝে ফেলবে, কিছু একটা গড়বড় আছে। আম্মুর দিকে না তাকিয়েই গাইডের পৃষ্ঠা উল্টালাম। কণ্ঠ যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললাম, "সমাজের প্রশ্ন পড়ছি।"
আম্মুকে কিছু বলছে না দেখে বই থেকে মুখ তুলে তাকিয়েই হাঁফ ছাড়লাম। টেবিল থেকে যথেষ্ট দূরে আছে আম্মু। এত দূর থেকে মোটা গাইডের মধ্যে লুকানো তিন গোয়েন্দার বইটা আম্মুর চোখে পড়বে না।

'মায়া ম্যাডামের ক্লাসে সব্বাই পড়া শিখে আসে। ক্লাস শুরু হবার আগে বার বার রিভাইস করে। আমি সেদিন পড়াতো শিখিইনি, বরং ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চে বসে উরুর উপর রেখে, মাথা নিচু করে, "কালো হাত"এর বাকি অংশ পড়ছি। বইয়ে এতোটাই ডুবে ছিলাম যে কখন ম্যাডাম ক্লাসে এসেছেন, কখন পড়া ধরতে শুরু করেছেন, টেরই পাইনি। যেহেতু প্রথম বেঞ্চে ছিলাম, তাই আমার ডাক পড়লো তখনই। একই দিনে দ্বিতীয়বারের মত চমকে উঠলাম। গল্পের বইটা পিছনে লুকাতে লুকাতে উঠে দাঁড়ালাম। বুঝতে হবে, চোরের সাত দিন, গেরস্থের এক দিন। আজকে যে গেরস্থের দিন, সকালেই বোঝা উচিৎ ছিল আমার। তখন যেহেতু বুঝিনি, এখন তার খেসারত দিতে হবে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি। কিন্তু আল্লাহ নিশ্চয়ই প্রত্যেকবার আমাকে সাহায্য করবেন না? আমাকে আতঙ্কের সাগরে ডুবিয়ে বাঁজখাই গলায় ম্যাডাম বলে উঠলেন, "হাতে কী তোর?"
সাথে সাথে হাত থেকে বইটা ছেড়ে দিলাম। পিনপতন নীরব ক্লাসরুমে থ্যাচ করে বইটা পড়ার শব্দটা বেশ জোরেসোরেই কানে বাজলো। ম্যাডাম আমার পিছনের মেয়েটাকে বললেন, "দেখ তো কী ফেলেছে সে হাত থেকে?"
মেয়েটা আমার অত সাধের বইটা তুলে ম্যাডামের হাতে দিলো। ম্যাডাম যে কী পরিমাণ ক্ষেপলেন, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একগাদা কথা শোনাতে শোনাতে বেত আনানোর ব্যবস্থা করলেন। তারপর দুই হাতে চার ঘা দিয়েই ক্ষান্ত হলেন। প্রথমবারের মত কোন টীচারের হাতে মার খেয়ে আমি তখন আকুল নয়নে কাঁদছি। যতটা না কষ্ট লাগছে মার খেয়ে, তার চেয়েও বেশি কষ্ট লাগছে, বইটা হারিয়ে। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হয়নি। সে প্রসঙ্গে পরে বলছি।

'কথায় আছে, ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাইই। দুইদিন না যেতেই অন্য আরেকটা বই জোগাড় করে ফেললাম। বইয়ের যা নেশা, দুইদিন আগের মাইর আর অপমানের কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে টেবিলে বসে পড়তে শুরু করলাম। সবাই ঘুমিয়ে গেছে ভেবে মোটা গাইডের আড়াল পর্যন্ত নিইনি। তন্ময় হয়ে পড়ছি আর পড়ছি। হঠাত ধ্যান ভাঙলো আম্মুর গলার আওয়াজে। আম্মু বলছিলো, "কী পড়িস?"
কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, "বই পড়ি।"
"দেখি তো কী বই? নিয়ে আয়।" বিছানায় বসে আম্মু আদেশ দিলো।

'আম্মুর আদেশ শুনে মাথায় তো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। নিজেকে থাপড়াতে ইচ্ছে করলো। এতোটাই বোকামি করেছি যে, সারা পড়ার টেবিলে একটা টেক্সট বইও রাখিনি! এখন কী হবে?

'ডুবে যাওয়া মানুষ খড়কুটা যা পায়, তাইই আঁকড়ে বাঁচতে চায়। আমিও তাইই করলাম। আলগোছে শেলফ থেকে বিজ্ঞান বইটা নিয়ে আম্মুকে দেখাতে চাইলাম, আমি পড়ার বইই পড়ছি।

'কিন্তু তখনো আমি জানি না, আমাকে রাত জেগে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তে দেখে আম্মু চুপিসারে এসে দেখে গেছে, আমি কী বই পড়ছি। পুরো ঘর অন্ধকার ছিল বলে আমি টেরটিও পাইনি। চুরির উপর বাটপারি করার জন্য শেলফ থেকে যে বই নিয়েছি, আম্মু সেটাও দেখেছে। আলোতে থেকে আমি আম্মুকে স্পষ্ট দেখতে না পেলেও আম্মুতো আমার কার্যকলাপ স্পষ্টই দেখেছে। শুধু বসে বসে দেখছিলো, আমি তাঁর সাথে কতটা মিথ্যে কথা বলতে পারি।

'আমাকে একটার পর একটা মিথ্যে কথা বলতে দেখে আম্মু আর নিজের রাগ সামলাতে পারলো না। উঠে এসে আগে আমার গল্পের বইটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করলো। এরপর মনের স্বাদ মিটিয়ে মারলো। কাঁদতে কাঁদতে আমি ঘুমিয়ে গেলাম। কিন্তু আম্মু জেগে বসে রইলো। আম্মু কিছুতেই বুঝতে পারছিলো না, পড়া ফাঁকি দিয়ে গল্পের বই পড়ার মত বদঅভ্যাস আমার কীভাবে হলো। অথবা কীভাবে সেটা দূর করাবে …

'অনেকদিন পর সেই বইয়ের টুকরো গুলো খুঁজে পেয়েছিলাম আমি। বহুকষ্টে টেপ দিয়ে জোড়া লাগিয়ে বইটা পড়ে শেষ করেছিলাম।

'আম্মু যেখানেই আমার কোন গল্পের বই পায়, লুকিয়ে ফেলে। আম্মু ঘরে না থাকলে তন্ন তন্ন করে পুরো ঘর খুঁজি আমি। বেশিরভাগ সময়ই পাই না। কোথায় যে লুকায়, আল্লাহ মালুম!
একবার কী যেন খুঁজতে গিয়ে বিছানার তোষকের নিচে একটা বই পেয়েছিলাম। তখনকার অনুভূতিটা ছিল, ঈদের চাঁদ হাতে পাবার মত।

'লুকানো বইগুলির মধ্যে কিছু কিছু বই ছিল ধার করা। ওগুলি যার যার মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেবার জন্য হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে পয়সা জমাই। কষ্টের পয়সার সেই বই যার যার মালিককে ফিরিয়ে দেবার সময় বুকে তীব্র চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়। বিশেষ করে সুস্মিতার হ্যারি পটারের তিন নাম্বার বইটা যখন বাজেয়াপ্ত হলো, তখন খুব কষ্ট লেগেছিল। ওই বয়সে ৩০০ টাকা জমাতে জান বের হয়ে গিয়েছিল আমার।

'এরপর মাঝের একটা বছর গল্পের বই কম পড়েছিলাম। তাই তখন আর আম্মুর কাছে ধরা পড়ার প্রশ্নই আসে না।
তারপর একদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম। আম্মু তখন খুব অসুস্থ। বিছানা থেকেই উঠতে পারে না। ডাকলো আমাকে। আমিও একদম আম্মুর মুখের উপর ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলাম, "কিছু লাগবে আম্মু?"
আম্মু কয়েকমিনিট কিছুই বললো না। বন্ধ চোখের দুপাশ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল আম্মুর। আবার জিজ্ঞেস করলাম, "কী হয়েছে আম্মু?"
আম্মু গলায় একরাশ হতাশা ঢেলে বললো, "স্কুলে মায়া ম্যাডামের হাতে কবে মাইর খাইছিলি তুই?"
কথাটা শুনে আক্ষরিক অর্থেই আমার দুনিয়া কেঁপে উঠলো। এতদিন পর এইখবর কে দিল আম্মুকে?
"আমি কি তোকে কখনো মানুষ করতে পারব না?"
কষ্টের আতিসাহ্যে গলা ভেঙ্গে এল আম্মুর। গল্পের বই পড়া নিয়ে কখনো কোনদিন আমার মনে অনুশোচনা জাগেনি। কিন্তু সেদিন আত্মগ্লানিতে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমার অসুস্থ আম্মুটা কতোটা কষ্ট পেয়েছে এই খবরটা শুনে; চিন্তা করে মনে মনে নিজেকে তীব্র ধিক্কার দিচ্ছি। আর যে আম্মুকে এই খবরটা দিয়েছে, তার গুষ্টি উদ্ধার করছি।

'তারপর …
তারপর কিছুদিন পর আম্মু মরে গেল। আমার প্রতি সীমাহীন রাগ-অভিমান নিয়ে আম্মু মরে গেল। মারা যাওয়ার সময় আম্মুর পাশে থাকার সুযোগটাও হল না আমার … '


পূর্বকথার পরের কথা…

বাংলোবাড়ির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিপোর্টার নিনিতা রহমান। বাড়ির নেমপ্লেটে জ্বলজ্বলে বেগুনী রঙে লেখা "মায়ানীড়"। প্রখ্যাত তরুণী লেখিকা সাবিহা তানভী'র বাড়ি এটা। কলিংবেল বাজানোর আগে ব্যাগ থেকে টিস্যু বের বের মুখটা মুছে নিলো সে। ভিতরে যাবার আগে পরিপাটী এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিতে হবে। যদিও লেখিকার এপয়েন্টমেন্ট নেওয়া আছে, তবুও বুক দুরুদুরু করছে। প্রিয় লেখিকা বলে কথা! দেরি না করে চেপেই দিলো কলিংবেল।

লন মাড়িয়ে মূল বাড়িতে ঢোকার আগে লনের ফুলের গাছের মাঝের ছোট্ট উঠোনে একটা জিনিস দেখে থমকে দাঁড়ালো নিনিতা। এইজিনিস তো ছবিতে দেখেছে সে। বাস্তবেও আছে, ভাবেনি। ঘরাকৃতির একটা বিশাল বড় বাক্স। বাক্স ভর্তি বই। বাক্সের সামনে ঘরের মতোই দরজা। দরজার উপরে বড় বড় করে বাংলায় লেখা, "বই দাও, বই নাও।"

এগিয়ে এসে দরজার হাতল ধরে টান দিল রিপোর্টার। লক করা। কিন্তু দরজার উপরে চিঠি ঢোকানোর আয়তাকার ছিদ্রের মতো ছিদ্র আছে। তবে তা বেশ বড়। ছিদ্রের উপরে ছোট করে লেখা, "enter"।

অটোগ্রাফ নেবে বলে আসার সময় সাবিহা তানভী'র সদ্য বের হওয়া আধিভৌতিক রহস্যোপন্যাসটা কিনে এনেছিল নিনিতা। কী হবে, কিছু না ভেবেই ওটাই ঢুকিয়ে দিল। প্রায় সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একই ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে এল ফরহাদ চৌধুরী শিহাবের "অমিয়েত্রা"। বইটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইলো নিনিতা।

কিছুক্ষণ ড্রয়িংরুমে বসে থাকার পর লেখিকার কাজের মেয়েটা নিনিতাকে ছাদে যেতে বললো। সেখানেই অপেক্ষা করছেন তিনি।

ছাদে এসে সাবিহা তানভীর রুচির প্রশংসা করতে বাধ্য হল নিনিতা। এত সুন্দর ছাদ খুব কমই দেখেছে সে। দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিলেন তরুণী লেখিকা। নিনিতাকে দেখে উঠে এসে গোল টেবিলে বসলেন। মৃদু হেসে বললেন, "নিনিতা রহমান? বাংলাদেশ সময় পত্রিকার জনপ্রিয় রিপোর্টার। বেশ ভালো রিপোর্ট করেন আপনি।"
সাবিহা'র কথা শুনে হা হয়ে গেল নিনিতা। এই বাড়িতে এসে সে যে কেবল অবাকই হচ্ছে! আরো কি কিছু বাকি আছে অবাক হবার মত? কথাটা জিজ্ঞেসই করে ফেললো রিপোর্টার।
ওর কথা শুনে আবারো মুচকি হাসলেন সাবিহা। বললেন, "বাইরের কেউ কখনো আমার শোবার ঘর দেখেনি। চলেন, আপনাকে দেখাব।"

লেখিকার শোবার ঘরে এসে দিনের সেরা ধাক্কাটা খেল রিপোর্টার। বিছানার মাথার কাছে ছাদ পর্যন্ত লাগোয়া বুকশেলফ। অন্যপাশের খালি দেয়ালে গিটারের আদলে তৈরি করা বুকশেলফ। গিটারের বিভিন্ন ধাপে ধাপে বই রাখা। পুরো ঘরটাই অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো। সেই সৌন্দর্যের প্রধান উপকরণ হলো, বই।
এই ঘর না দেখলে কেউ কখনো বিশ্বাসই করবে না, বই দিয়েও ঘর সাজানো যায়।

যেন নিনিতার মনের কথা বুঝতে পেরেই সাবিহা বলে উঠলো, "আমার কাছে, ঘর সাজানোর জন্য, বইয়ের চেয়ে সুন্দর দেখতে আর কিছুই হতে পারে না।"
একটু থেমে লেখিকা আবার বললো, "ছোটবেলার স্বপ্ন সত্যি করার জন্য বিছানার পাশের বুকশেলফে একটা গোপন কম্পার্টমেন্টও করেছি। যদিও এখন আর কেউ বই পড়তে বাঁধা দেয় না, তবুও! ছেলেমানুষি আর কি!"

"ম্যাম!" আকুল কণ্ঠে ডেকে উঠলো রিপোর্টার, "এই ঘরে আপনার একটা ছবি তুলতে চাই! প্লিজ না করবেন না!"
কী ভেবে, রাজি হয়ে গেল সাবিহা।

রেকর্ডারটা অন করে নিনিতা ওর প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু করছে, "এই প্রশ্নটা আমার প্রশ্ন পত্রে নেই। তবুও জিজ্ঞেস করছি, আপনার লনে একটা বুকহাউজ দেখলাম। আসার পথে আপনার সদ্য বের হওয়া বইটা কিনে এনেছিলাম, অটোগ্রাফ নেব বলে। কিছু না বুঝে ওটা ঢুকিয়ে দিতেই এই বইটা বেরিয়ে এল।" হাতের বইটা নাড়িয়ে বললো নিনিতা, "এত অভিনব আইডিয়া কই পেলেন আপনি? তাছাড়া ওটাকে এত স্বয়ংক্রিয় করে বানালেনই বা কীভাবে?"
হাসলেন লেখিকা।
"বাইরের দেশে এইধরণের বুকহাউজ যত্রতত্র পাওয়া যায়। ওখান থেকেই আইডিয়াটা নিয়েছি। আর কীভাবে এত স্বয়ংক্রিয় বানিয়েছি, সেটা আমার সিক্রেট।"
"ওকে ম্যাম।" নোটবুক খুললো রিপোর্টার, "আপনার লেখালেখিতে কার ভূমিকা বেশি?"
বড় করে দম নিলেন লেখিকা। বললেন, "কিছুক্ষণ আগেও আমি এগুলো নিয়েই ভাবছিলাম। এই ব্যাপারটা আমি একটু অন্যরকম ভাবে বর্ণনা করব। তবে আপনি আমার কথায় কোনরূপ বাগড়া দিতে পারবেন না। আমি টানা বলে যাব।"
মাথা নেড়ে সায় দিলো নিনিতা।

শেষকথা

অনেকক্ষণ ধরে নিজের ছোটবেলার বইপ্রীতির কাহিনি বর্ণনা করার পর, হঠাৎই কিছু না বলে হুট করেই নিচে চলে গিয়েছিলেন তরুণী লেখিকা সাবিহা তানভী। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য ফিরে এসেছেন। ফিরেই বললেন, "কফি বলে এলাম।"
নিনিতা লেখিকার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে, তিনি কি শুধু কফি বলতেই গেছেন? নাকি একজন রিপোর্টারের সামনে নিজের আবেগটা তুলে ধরতে চাননি?

লেখিকা আবার বলতে শুরু করলেন,
"আম্মু মরে যাওয়ার পর শুধরে গেলাম। গল্পের বই পড়া ছেড়ে দিলাম।

'কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারলাম না। আম্মুর গল্পের বইয়ের প্রতি ক্ষোভ ছিল, নাকি পড়া ফাঁকি দিয়ে গল্পের বই পড়ার মধ্যে ক্ষোভ ছিল; সেটা তো আর আমি জানি না। যদি আম্মুর বইয়ের উপর ক্ষোভ থেকে থাকে, তাহলে আমি বলব, আম্মু ভুল ছিল। আম্মু নিশ্চয়ই এটা জানতো না যে বইপ্রীতি কারোর কোন ক্ষতি করেনা। করতে পারে না। তবে, এটা আমি মানি যে, পড়া ফাঁকি দিয়ে বই পড়াটা অবশ্যই ক্ষতিকর। আমার লেখাটা আপনার পত্রিকায় ছাপা হবে জেনেই আমি সবকিছু এত বর্ণনা করে বলছি। আমি চাই আজকের বাবা-মায়েরা জানুক, বইপড়া কোন খারাপ নেশা নয়।

'লেখালেখিটা অবশ্যই বই পড়ার নেশা থেকেই তৈরি হয়েছে। আম্মুকে কিছু কথা খুব বলতে ইচ্ছে করছে।
কিছুদিন আগে আমার নতুন বইয়ের একটা কপি মায়া ম্যাডামকে দিয়ে এসেছি। উত্স্বর্গ পত্রে ম্যাডাম নিজের নাম দেখে চমকে উঠেছিলেন। ম্যাডাম তো আর জানতেন না, আম্মুর নামে তাঁর নাম।
ম্যাডাম বইটা হাতে নিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়েছিলেন। যে ম্যাডাম বই পড়তে দেখে আমাকে মেরেছিলেন, সেই ম্যাডামই আমাকে আমারই বই হাতে আশির্বাদ করে দিয়েছেন।

'আম্মু জানে না, এখন সেবার সেই ছোট ছোট বইয়ে আমার লেখা থাকে । জানলে খুশি হতো কিনা বুঝতে পারছি না।

'কিন্তু আমি প্রচন্ড উচ্ছ্বসিত। আমার লেখা গল্প কেউ পড়ার গাইডের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়বে- ভাবতেই আবেগে আপ্লুত হচ্ছি। হয়তো মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে ছেলেমেয়েদের বইপ্রীতি কমে গেছে। কিন্তু আমি ভাবতে চাই, ওরা এখনো লুকোছাপা করে বই পড়ে, গাইডের মধ্যে লুকিয়ে আমার বইটাও পড়বে। এটা ভেবে উচ্ছ্বাসটা ধরে রাখতে চাই। আর সেই সাথে একটু কাঁদতে চাই।"


বলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন লেখিকা। বহুদিন পর দুফোঁটা জল সাবিহা'র মরা নদীটাকে ভিজিয়ে দিলো।

পুনশ্চ

ওইদিন ফেরার সময় রিপোর্টার নিনিতা রহমানকে তার একটা বই অটোগ্রাফ সহ গিফট করেছিলেন সাবিহা তানভী।

পরদিন, দেশের প্রধান দৈনিককাগজ "বাংলাদেশ সময়" এর প্রথম পাতায় সাবিহা তানভী'র ছবিসহ বিশাল আর্টিকেল ছাপা হল।

উৎসর্গ - সেসব কিশোর কিশোরীদের, যারা পয়সা জমিয়ে বই কিনে পড়ে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১:১৯
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×