মহাখালীর জ্যামে গাড়িতে বসে দরদর করে ঘামছেন এনামুল হক। গাড়ির এসিটা নষ্ট হয়ে আছে অনেকদিন ধরেই। হেয়ালি করে ঠিক করানো হচ্ছে না। এবারের প্রজেক্টটা সফল হলে মোটা অংকের টাকা পাবেন উনি। তা দিয়ে চাইলে নতুন একটা গাড়িই কিনে ফেলতে পারবেন।
খুশি খুশি গলায় ড্রাইভারকে এফএমটা অন করতে বললেন। খবরটা শোনা যাক।
‘. . . পরিবেশবাদীদের সমালোচনার মুখে বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং ভারত-বাংলাদেশ বিদ্যুৎ সঞ্চালন উদ্বোধন করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়। গতকাল (শনিবার) বেলা সাড়ে ১১টায় কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার গোপিনাথপুর থেকে নয়াদিল্লিতে অবস্থানরত ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যৌথভাবে ভারতীয় বিদ্যুৎ আমদানির উদ্বোধন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। একই সময়ে বাগেরহাটের রামপালে প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তরের ফলকও প্রধানমন্ত্রী ভেড়ামারা থেকে উন্মোচন করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বাটন টিপে প্রথমে লাল কাপড় দিয়ে ঢাকা বাংলাদেশ-ভারত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন উদ্বোধন করেন। এরপর সুইচ টিপে রামপাল মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রকল্প এবং ভেড়ামারায় নির্মাণাধীন ৩৬০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন।’
এটুকু খবর শোনার পর বিজ্ঞাপন বিরতি শুরু হলো। মুচকি মুচকি হাসছেন এনামুল হক। বাংলাদেশ সরকারের বন প্রতিমন্ত্রী তিনি। আজকের দিনটা উনার জন্য দারুণ খুশির একটা দিন। প্রধানমন্ত্রী একটা কাজের কাজই করেছে। ভারতের সাথে চুক্তি করায় তাঁর মত মন্ত্রীদেরও পকেট ভরতে শুরু করেছে। বিজ্ঞাপন বিরতি শেষ হতেই পাঠিকা আবার খবর পাঠ করা শুরু করল।
এবারের খবরটা রামপাল প্রকল্পের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে। হাত বাড়িয়ে নব ঘুরিয়ে চ্যানেল পাল্টে দিলেন এনামুল হক। প্রত্যেকটা কাজ নিয়েই নেগেটিভ আলাপ আলোচনা হবে। ওসব শুনতে তাঁর মোটেও ভালো লাগে না।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই জ্যাম ছুটে গেল। ছয়জন ক্রিকেটারের মূর্তির পাশ দিয়ে অভিজাত এলাকার রাস্তায় গাড়ি ঢুকিয়ে দিল ড্রাইভার। মসজিদ রোডের সুনসান নীরব দোতলা ডুপ্লেক্স বাড়ির গ্যারেজে গিয়ে থামলো।
স্বতন্ত্র ভঙ্গীতে গাড়ি থেকে নেমে বাসায় ঢুকলেন এনামুল হক। তার বড় ছেলে তমাল ট্যাবলেট হাতে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। ছেলেটা সারাদিন এসব নিয়েই পড়ে থাকে। পড়াশোনা কখন করে, কে জানে!
'কী করছো?' একটা চেয়ার টেনে ছেলের সামনে বসলেন এনামুল হক।
'ফেইসবুকিং।' মুখ না তুলেই জবাব দিল তমাল।
'ফেইসবুকে কী করছো?' আবার জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ছেলের বেয়াদবিতে একাধারে বিরক্ত ও অবাক দুটোই হয়েছেন তিনি। যেন বাবার সাথে কথা বলার চেয়েও ফেইসবুকিং করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মুখ তুলে বাবার দিকে তাকালো তমাল। ঘৃণা আর নির্লিপ্ততা তার দৃষ্টিতে। ট্যাবলেটটা বাড়িয়ে ধরল বাবার দিকে।
ছেলের দৃষ্টি দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন বন প্রতিমন্ত্রী। ছেলে যে তাঁকে ঘৃণা করে, এটা-এতদিন তো জানতেন না। তাঁর প্রতি ছেলের কিসের এত ঘৃণা?
ছেলের হাত থেকে ট্যাবলেটটি নিয়ে চোখের সামনে ধরলেন তিনি। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন সম্পর্কিত একটি পোস্ট পড়ছিল তমাল। পড়তে শুরু করার আগে ছেলের দিকে একবার তাকালেন। গভীর মনোযোগ দিয়ে হাতের আঙ্গুলের নখ কামড়াচ্ছে সে। এনামুল হক ট্যাবলেটের স্ক্রিনে মনোযোগ দিলেন।
‘...সুন্দরবনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, অবৈধ নৌপথ ও কয়লার ডিপো নিয়ে জাতিসংঘের রামসার সচিবালয় উদ্বেগ জানিয়েছে।
রামসার ইরানের একটি শহর। জীববৈচিত্র্যপূর্ণ জলাভূমি রক্ষায় ১৯৭২ সালে এই শহরে যে চুক্তি সই হয়, তা রামসার চুক্তি নামে পরিচিত। এর মধ্যে বন বিভাগ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত হওয়া উত্তপ্ত পানি, উড়ন্ত ছাই ও দূষণের ব্যাপারে তাদের উদ্বেগ তুলে ধরেছে।
আইইউসিএন থেকে রামপাল প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বন বিভাগ উভয়ই অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনে এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছে তাদের প্রতিবেদনে।
গত ১২ জুন রামসার কর্তৃপক্ষ সরকারকে সুন্দরবন ও টাঙ্গুয়ার হাওর সম্পর্কে জানতে চেয়ে চিঠি পাঠায়। সুন্দরবনের পাশে রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, বনের আক্রাম পয়েন্টে ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প ডিপো স্থাপন এবং সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ ও কার্গো চলাচলের প্রভাব সুন্দরবনের ওপরে কীভাবে পড়ছে - এসব জানতে চায় তারা।
মনুষ্যসৃষ্ট কোনো কারণে বা সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডের ফলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হলে তা রামসার চুক্তির লঙ্ঘন হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের সুন্দরবন এবং টাঙ্গুয়ার হাওর রামসার এলাকা বা বিশ্বের
জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকার স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ওই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে, এমন প্রমাণ পাওয়া গেলে সুন্দরবন রামসার এলাকার সম্মান হারাবে। ১৯৭২ সালে রামসার শহরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই চুক্তিতে এমন শর্তই জুড়ে দেওয়া হয়েছিল।...’
স্ট্যাটাসের কমেন্টগুলো পড়তে শুরু করলেন তিনি। পাবলিক রিঅ্যাকশন কেমন, জানা যাবে।
‘...
চৌধুরী জাফর
তবুও আমাদের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের দরকার আছে। রামপালের চেয়ে ভাল জায়গা বাংলাদেশে আর কোথাও নাই।
পরিবেশবাদীরা বেশী বুঝলে দিক না বলে, অমুক জায়গায় করলে বেশী ভাল হবে, পরিবেশও বাঁচানো যাবে?'
বাহ। এই তো চমৎকার যুক্তি। কে বলে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম কেবল সরকারের বিরোধিতা করে? - ভাবলেন হক সাহেব। তৃপ্তির হাসি মুখে নিয়ে একবার ছেলের দিকে তাকালেন তিনি। সে এখনো নখ কামড়েই যাচ্ছে। যেন এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর কিচ্ছু নাই। একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করলেন প্রতিমন্ত্রী। তারপর আবার মন দিলেন ট্যাবলেটের স্ক্রিনে।
'মিঠু ইসলাম
সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র তো দূরে থাক, কোনো ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান
স্থাপন করতে দেওয়া হয় না। ভারতীয় স্বার্থ রক্ষা করার জন্য এই সরকারের সর্বশেষ প্রয়াস।"
'গাধা নাকি!' প্রায় ধমকে উঠলেন এনামুল হক। 'বাংলাদেশের সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব বুঝি ভারতের সুন্দরবনে পড়বে না?'
'পড়বে।' নখ কাটা বন্ধ করে বলল তমাল। 'তার আগে বাংলাদেশের পুরো সুন্দরবন নষ্ট হবে। এই ধ্বংসযজ্ঞ ভারতের সুন্দরবন পর্যন্ত পৌঁছাতে বাংলাদেশের সুন্দরী গাছ গুলিই পরিবহন হিসেবে ব্যবহৃত হবে!'
ছেলের গলায় ব্যঙ্গের তীব্রতা শুনে একটু যেন থমকে গেলেন বন প্রতিমন্ত্রী। তারপর আবার পড়তে শুরু করলেন …
'Shabbir Ahmad
বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে সবরকম কাজই করছে সরকার। কেউ কি নেই, যে সত্যিকারভাবে আমার প্রিয় বাংলাদেশটাকে ভালবাসে?'
'না! খালি আপনেই বাসেন!' বলতে চাইলেন এনামুল হক। শেষ মুহূর্তে সামলালেন নিজেকে। ছেলে আবার কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়, কে জানে! তবে কি ছেলেকে তিনি ভয় পাচ্ছেন?
পরের মন্তব্যগুলি একটানা পড়ে গেলেন তিনি। কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না।
'Hasan Abdullah
ভারতের কাছ থেকে আমাদের জনগন আর সরকার যদি একটু দেশপ্রেম শিখতে পারত!!! ভারত তার নিজ প্রয়োজনে যেটাই করুক, আমাদের সরকারের কাছে সেটিকেই দেশোদ্ধারের একমাত্র পথ মনে হয়। এগুলো নতজানু পররাষ্ট্র নীতির উদাহরণ হয় না বরং হয় পদলেহি পররাষ্ট্র নীতির বহিঃপ্রকাশ। ভারতের মত বন্ধু যার আছে তার আর শত্রুর দরকার হয় না। বাংলাদেশে যেন বন্যা না হয় তাই দয়া করে ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়েছে। টিপাইমুখ দিবে। তিস্তার পানি আসতে দিবে না। এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশকে সাহায্য করছে তারা। ভারত আমাদের মহান বন্ধু...'
nur abser jony
বাংলাদেশের ক্ষতি করে ভারতকে লাভবান করাই সরকারের এজেন্ডা?
Muhammad Alamgir Kabir
আশ্চর্যের ব্যপার হলো বিরোধীদলের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। গত পাঁচ বছরে বিরোধীদল শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থ ব্যতীত দেশের স্বার্থ রক্ষায় একটি আন্দোলনও করলো না!! যে দেশের সরকার দেশের কথা ভাবে না, যে দেশের বিরোধীদল দেশের কথা ভাবে না, নিজেদের যা আছে তা নিয়ে গর্ব অনুভব করে না, নিজেদের সৌন্দর্য, অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না - সেই দেশের সরকার আহাম্মক, বিরোধীদল মতলববাজ, আর জনগন অসহায়।
রফিক শিকদার
সাগরের তীর দরকার, ঠিক আছে। তাই বলে, সাগরের পাড় কি কেবল সুন্দরবনের পাশেই আছে? আর কোথাও নেই? কেন এই ধরনের হঠকারিতা করা হচ্ছে? সুন্দরবনকে শেষ করাই কি চক্রান্তকারীদের মেইন উদ্দেশ্য? আশাকরি, এধরনের আত্মঘাতি কাজ থেকে সরকার দূরে সরে আসবে।
জাহেদ রহমান
বিদ্যুৎও চাই সুন্দরবনও চাই। তবে সুন্দরবনের ক্ষতি করে নয়।
হাসান ইমাম
আমি গরীব, আমার অনেক অভাব, আমার খাবার দরকার। তাই আমার মায়ের রক্ত বেঁচে খাবো। এই কাজকে কি আপনারা সমর্থন করবেন? জানি কেউ সমর্থন করবে না, এমন কি যে সন্ত্রাসী দিন-রাত খুন করে বেড়ায় সেও পারবে না। এইবার আসি মূল কথায়। সুন্দরবনের পাশে রামপালে যে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানানো হচ্ছে। এতে কি আমাদের বিশাল লাভ হবে? মোটেই না। আমরা কি সিডর বা আইলার কথা ভুলে গিয়েছি। সুন্দরবন
না থাকলে কি অবস্থা হত দেশের? কোন দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার, আমার আছে কত ভাগ? আর এর মাঝে সুন্দরবনকে ধ্বংস করার জন্য মেতে উঠেছি? প্রকৃতির টোটাল ইকো-সিস্টেম নষ্ট হয়ে যাবে। কৃষিকাজের পরিবেশ নষ্ট হবে। বন্য পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে। এই রকম মনে হয় আরো শখানিক পয়েন্ট বলা যাবে। পরিশেষে একটা কথা বলি। আপনারা যারা নীতিনির্ধারক আছেন, তাদের মাথায় কিছুই নেই অথবা আমার মাথায় কিছুই নেই। খালি বলতে চাই আপনারা নতুন প্রজন্মের জন্য কেমন বাংলাদেশ রেখে যাচ্ছেন? নতুন প্রজন্ম আপনাদের কবর দেখিয়ে বলবে না তো ‘ওই দেখ বাংলার মীর-জাফরদের কবর!’
..."
এতক্ষণে তমালের ঘৃণা মিশ্রিত দৃষ্টির রহস্য উদঘাটিত হলো। বন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে এই প্রজেক্টে তাঁরও বিশাল একটা ভূমিকা আছে। এজন্যই ক্ষেপেছে তমাল।
এইসব ফেইসবুক টুইটার নামক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো এখনকার প্রজন্মকে একেবারে বিগড়ে দিচ্ছে! হুহ! রাগ দেখিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন তিনি।
মাসখানেক পর বন প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক, সুন্দরবনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছেন। বন পরিস্কার করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উপযোগী করার জন্য। কাজ কেমন এগোচ্ছে, দেখার জন্য তিনি নিজে যাচ্ছেন সেখানে। এখনকার লোকজন কাজে ফাঁকি দিতে ওস্তাদ। বিশ্বস্ত লোক দিয়ে পরিচালনা না করাতে পারলে বছরের পর বছর চলে যাবে, কিন্তু কাজ ঠিকই পড়ে থাকবে।
ড্রিমল্যান্ড এক্সপ্রেসের টিকিট কেটে রাখা হয়েছে। ইচ্ছা করলে গাড়ি নিয়েই যেতে পারতেন। কিন্তু যাবেন না। গাড়ি নিয়ে গিয়ে নিজের রেপুটেশনের বারোটা বাজানোর কোন ইচ্ছা নাই। ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বললেন তিনি। এগারোটার মধ্যে বাস টার্মিনালে পৌঁছুতে হবে।
শা শা করে ছুটছে রাতের বাস। নিজের সীটে বসে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন তিনি। কাল অনেক কাজ আছে।
বাস সুন্দরবন পৌঁছুলো সকাল এগারোটায়। ঠিক করে বলতে গেলে এগারোটা সাতে। টার্মিনালে ফরেস্টগার্ডদের প্রধান অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্য। গার্ডদের কোয়ার্টারগুলি রামপালের কাছাকাছি। ওখানে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে হালকা হলেন তিনি। নাস্তা করলেন। তারপর ধাতস্থ হয়ে বেরিয়ে পড়লেন কাজের অগ্রগতি দেখতে। যদিও শরীরটা একটু বিশ্রাম চাচ্ছিলো।
তোয়াক্কা করলেন না। এখানে বিশ্রাম নিতে আসেননি।
কাঠুরেরা গাছ কাটছে। এনামুল হক ঘুরে ঘুরে দেখছেন। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে বনের এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালেন। বসার মত কিছু একটা খুঁজছেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে পেয়েও গেলেন। করাত দিয়ে মসৃণ করে কাটা একটা গাছের গুড়ি। ঠিক যেন কাঠের একটা টুল। পা উঠিয়ে আরাম করে বসলেন গাছের গুড়িটায়।
নির্ঘুম রাত পার করার পর একটানা কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করায় তন্দ্রামত হলো উনার।
হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি খেয়ে তন্দ্রা টুটে গেল। খেয়াল করলেন, দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। উনার হাত দুটো উপরের দিকে উঠানো। আশ্চর্য! কেউ কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমুতে পারে? হাত দুটো নামানোর চেষ্টা করলেন। পারলেন না। যেন হাত দুটো ওভাবেই স্থির হয়ে আছে। পা বাড়িয়ে সামনের দিকে এগুতে চাইলেন। সেটাও পারলেন না। পা-দুটোতে শিকড় গজিয়ে গেছে। আক্ষরিক অর্থেই তার পায়ে শিকড় গজিয়ে গেছে!
মাথাটা প্রচন্ড ভারি মনে হচ্ছে এনামুল হকের। ঘাড়ও নাড়াতে পারছেন না তিনি। তাঁর সাথে কী হচ্ছে এসব? কেন হচ্ছে? আগামাথা কিছুই তো বুঝতে পারছেন না। মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তাঁর।
সহসা প্রবল আতঙ্ক চেপে ধরলো তাকে। হাত-পা-ঘাড়-মাথা কিছুই নাড়াতে পারছেন না। এর মানেটা কী! তিনি কি গাছ হয়ে গেছেন? এটা কী করে সম্ভব?
হঠাৎ-ই তিনি বিচিত্র কিছু শব্দ শুনতে পেলেন। কান পেতে ভাল করে শুনতেই বুঝলেন শব্দটা বিচিত্র অবশ্যই - তবে ভাষাটা বোধগম্যই মনে হচ্ছে উনার কাছে। গাছেদের কথা বলার শব্দ। আশ্চর্য! আশপাশের গাছেদের কথা বুঝতে পারছেন তিনি! তিনি কি পাগল হয়ে গেছেন?
স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে এখন দু হাতে মাথা চেপে বসতেন। কিচ্ছু শুনতে চান না তিনি! কিচ্ছু বুঝতে চান না!
শুনতে না চাইলেও গাছেদের কথা কানে আসছিল উনার। একগাছ আরেকগাছের সাথে কথা বলছে।
গাছ ১: মানুষেরা কী খারাপ জাতি গো! আমাদের কাছ থেকে এতো সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আমাদেরকেই কেটে ফেলছে!
গাছ ২: কী নিচ্ছে না আমাদের কাছ থেকে! খাবার-দাবার, অক্সিজেন থেকে শুরু করে সব কিছুতেই আমাদের উপর নির্ভরশীল। তবুও কেন আমাদের ধ্বংস করার ব্যবস্থা করছে?
গাছ ৩: জানিনা রে! কিছু কিছু গাছকে তৎক্ষনাৎ কেটে ফেলছে। আর কিছু কিছু গাছকে তো দূষিত ধোয়া দিয়ে অসুস্থ হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে! কোনটা করছি না ওদের জন্য? ঝড় তুফানে রক্ষা করছি। অতিরিক্ত গরম থেকে বাঁচাচ্ছি! তবুও কেন ……………!
থেমে গেল গাছ গুলো। কয়েকজন কাঠুরে এগিয়ে আসছে করাত নিয়ে। শঙ্কিত হয়ে পড়লো গাছেরা। কার কাছে আসছে এবার মরণ ছোবল?
কাঠুরেদের দেখে এনামুল হক চিৎকার করে চেচিঁয়ে উঠলেন, ‘আমাকে কেউ বাঁচাও!’
তাঁর কথা শুনলো না কেউ। একজন কাঠুরে করাত হাতে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালো। তিনি আবার বললেন, ‘আমাকে কেটো না! আমাকে কেটো না!’
কাঠুরে আরেক কাঠুরেকে নিয়ে করাত বসালো তার গোড়ালির উপর।
করাত লাগানোর সাথে সাথেই চিৎকার করে ঘুম ভেঙে উঠলেন এনামুল হক।
বাস এগোচ্ছে আপন গতিতে। ভোরের আলো ফুটছে সবে। বাসের জানালা দিয়ে সবুজ গাছপালার দিকে তাকালেন তিনি। ওগুলোও যেন অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তাকেই দেখছে। শরীরটা শিরশিরিয়ে উঠল এনামুল হকের।
বাসটা থামতেই চট করে ঘড়ির দিকে তাকালেন এনামুল হক। ঠিক এগারোটা সাত। শরীরটা বেতসলতার মত কাঁপতে শুরু করলো তাঁর। কাঁপতে কাঁপতেই বাস থেকে নামলেন। ফরেস্টগার্ডদের প্রধান দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। কেউ তাঁকে চিনিয়ে দেয়নি কিন্তু তিনি খুব সহজেই লোকটাকে চিনতে পেরেছেন। চিনতে পেরে তাঁর কাঁপুনি কমলো না মোটেও। কারণ এই লোকটাকে এই একই ভঙ্গীতে আগেও দেখেছেন এনামুল হক। স্বপ্নে!
খানিক বাদে উজ্জ্বল সূর্যালোকে ছুটে চলা জীপে বসে আপনমনে হেসে উঠলেন এনামুল হক। কী বাচ্চাদের মত ভাবছিলেন তিনি! স্বপ্ন তো স্বপ্নই। ওটা নিয়ে এত ভাবার কী আছে?
গন্তব্যে পৌঁছে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। রাত্রি জাগরণ আর ভ্রমণ ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে। বিকেলে না হয় যাবেন জায়গাটা দেখে আসতে। না গেলেও সমস্যা নেই। আগামীকাল সারাটা দিনই তো পড়ে আছে।
বিকেল পেরুবার আগেই বিছানা ছাড়লেন এনামুল হক। কেন যেন ঘুমটা ভালো হল না। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। বনে একবার ঢু মেরে আসাই মনস্থ করলেন তিনি।
সব কাজ ঠিকঠাক চলছে। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন প্রতিমন্ত্রী। অন্ধকার হয়ে আসায় খেয়াল করলেন না, তিনি যেখানে বসেছেন, সেটা তাঁর অতি পরিচিত। চেয়ারের মত দাঁড়িয়ে থাকা গাছের গুঁড়িটা গতরাতেই স্বপ্নে দেখেছিলেন।
পরিশিষ্ট ঃ বহু খুঁজে নিখোঁজ বন প্রতিমন্ত্রীকে পরদিন বেলা বারোটায় বনের ভিতরে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁর কোমরের নিচ থেকে কে যেন পা দুটো নিখুঁতভাবে কেটে নিয়েছে। কাটা পা দুটি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত তাঁর সাথে কী ঘটেছিল, জানা যাবে না।
অশিক্ষিত কাঠুরেরা এই ঘটনাকে ভৌতিক ব্যাপার ভেবে পালিয়েছে। সন্ধ্যে নাগাদ একজন মানুষকেও আর দেখা যায়নি রামপালের আশেপাশে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ তাই সাময়িকভাবে বন্ধ।
বিঃদ্রঃ ২০১৪র ডিসেম্বরে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষনা আসার পর প্রতিবাদস্বরূপ এই গল্প লিখেছিলাম। হয়তো, প্রতিবাদ হিসেবে গল্পটা যুৎসই হয়নি। আধিভৌতিক ব্যাপারটা এই টপিকের সাথে হয়তো যায় না। কিন্তু তখন কেন যেন এরকমটাই লিখতে ইচ্ছে করেছিল। তাই লিখেছিলাম। এরচেয়ে বেশিকিছু নয়।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ৮:১৩