somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওরিয়ানা ফালাচির নেয়া শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার

২৭ শে এপ্রিল, ২০০৮ দুপুর ১২:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(ব্লগে ওরিয়ানা ফালাচির নেয়া শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার নিয়া অনেক কথা হইছে। অনেক নিন্দা করা হইছে তাকে। কিন্তু আমার ধারণা খুব কম ব্লগারই সাক্ষাৎকারটি পড়েছেন। আমি ও ব্রাত্য রাইসু যখন যায়যায়দিন পত্রিকায় কাজ করতাম তখন ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৬ তারিখে ওরিয়ানা ফালাচির ওপর একটি সংখ্যা প্রকাশ করছিলাম। সেই সংখ্যায় ফালাচির নেওয়া মুজিবের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হইছিল। সাক্ষাৎকারটি পুরাটা স্থান অভাবে প্রকাশ করা যায় নাই। সাক্ষাৎকারটির যায়যায়দিনে প্রকাশিত অংশের সফট কপি আমার কাছে আছিল। সেইটা এইখানে পোস্ট করলাম। ওরিয়ানা ফালাচি ২০০৬ এর ১৫ সেপ্টেম্বর মারা গেছেন। সাক্ষাৎকারটি নেয়া হইছিল আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর অনুবাদ করা ইন্টারভিউ উইথ হিস্টরি বই থেকে। ফালাচি সাক্ষাৎকার নিছিলেন ১৯৭২ সালে ফেব্রুয়ারিতে।)

রবিবার সন্ধ্যা : আমি কলকাতা হয়ে ঢাকার পথে যাত্রা করেছি। সত্যি বলতে কি, ১৮ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী তাদের বেয়নেট দিয়ে যে যজ্ঞ চালিয়েছে তা প্রত্যক্ষ করার পর পৃথিবীতে আমার অন্তিম ইচ্ছা এটাই ছিল যে, এই ঘৃণ্য নগরীতে আমি আর পা ফেলবো না। এ রকম সিদ্ধান্ত আমি নিয়েই ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার সম্পাদকের ইচ্ছা যে, আমি মুজিবের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। ভুট্টো তাকে মুক্তি দেয়ার পর আমার সম্পাদকের এই সিদ্ধান্ত যথার্থ ছিল। তিনি কি ধরনের মানুষ? আমার সহকর্মীরা স্বীকৃতি দিল, তিনি মহান ব্যক্তি, সুপারম্যান। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি দেশকে সমস্যামুক্ত করে গণতন্ত্রের পথে পরিচালিত করতে পারেন।
আমার স্মরণ হলো, ১৮ ডিসেম্বর আমি যখন ঢাকায় ছিলাম, তখন লোকজন বলছিল, ‘মুজিব থাকলে সেই নির্মম, ভয়ঙ্কর ঘটনা কখনোই ঘটতো না। মুজিব প্রত্যাবর্তন করলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না’। কিন্তু গতকাল মুক্তিবাহিনী কেন আরো ৫০ জন নিরীহ বিহারিকে হত্যা করেছে? ‘টাইম’ ম্যাগাজিন কেন তাকে নিয়ে বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে হেডলাইন করেছে? আমি বিস্মিত হয়েছি, এই ব্যক্তিটি ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে সাংবাদিক অ্যালডো শানতিনিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার দেশে আমি সবচেয়ে সাহসী এবং নির্ভীক মানুষ, আমি বাংলার বাঘ, দিকপাল ... এখানে যুক্তির কোনো স্থান নেই ...।’ আমি বুঝে উঠতে পারিনি, আমার কি ভাবা উচিত।
সোমবার বিকাল : আমি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এবং আমার দ্বিধাদ্বন্দ্ব দ্বিগুণের অধিক। ঘটনাটা হলো, আমি মুজিবকে দেখেছি। যদিও মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। সাক্ষাৎকার নেয়ার আগে তাকে একনজর দেখার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু এই কয়েকটা মুহূর্তই আমার চিত্তকে দ্বিধা ও সংশয়ে পূর্ণ করতে যথেষ্ট ছিল। যখন ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করি, কার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল? তিনি আর কেউ নন, মি. সরকার। আমার শেষবার ঢাকা অবস্থানকালে এই বাঙালি ভদ্রলোক আমার দোভাষী ছিলেন। তাকে দেখলাম রানওয়ের মাঝখানে। আমি ভাবিনি, কেন? সম্ভবত এরচেয়ে ভালো কিছু তার করার ছিল না। আমাকে দেখামাত্র জানতে চাইলেন, আমার জন্য তিনি কিছু করতে পারেন কি না? তাকে জানালাম, তিনি আমাকে মুজিবের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন। তিনি সোজা আমাকে নিয়ে রওনা হলেন এবং পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা একটা গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম। গেটে মেশিনগানধারী মুক্তিবাহিনীর কড়া প্রহরা। আমরা রান্নাঘরে প্রবেশ করে দেখলাম, মুজিবের স্ত্রী খাচ্ছেন। সঙ্গে খাচ্ছে তার ভাগনে ও মামাতো ভাইবোনেরা। একটা গামলায় ভাত-তরকারি মাখিয়ে আঙ্গুল দিয়ে মুখে পুরে দিচ্ছে সবাই। এ দেশে খাওয়ার পদ্ধতি এ রকমই। মুজিবের স্ত্রী আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন।
ঠিক তখনই মুজিব এলেন। সহসা রান্নাঘরের মুখে তার আবির্ভাব হলো। তার পরনে এক ধরনের সাদা পোশাক, যাতে আমার কাছে তাকে মনে হয়েছিল একজন প্রাচীন রোমান হিসেবে। পোশাকের কারণে তাকে দীর্ঘ ও ঋজু মনে হচ্ছিল। তার বয়স একান্ন হলেও তিনি সুপুরুষ। ককেশীয় ধরনের সুন্দর চেহারা। চশমা ও গোফে সে চেহারা হয়েছে আরো বুদ্ধিদীপ্ত। যে কারো মনে হবে, তিনি বিপুল জনতাকে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি স্বাস্থ্যের অধিকারী।
আমি সোজা তার কাছে গিয়ে পরিচয় পেশ করলাম এবং আমার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলাম। মি. সরকার ভূমিতে পতিত হয়ে মুজিবের পদচুম্বন করলেন। আমি মুজিবের হাতটা আমার হাতে নিয়ে বললাম, ‘এই নগরীতে আপনি ফিরে এসেছেন দেখে আমি আনন্দিত, যে নগরী আশঙ্কা করছিল যে আপনি আর কোনোদিন এখানে ফিরবেন না।’ তিনি আমার দিকে তাকালেন একটু উষ্মার সঙ্গে। একটু অবজ্ঞার হাসি হেসে বললেন, ‘আমার সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলো।’
আমার দ্বিধা ও সন্দেহের কারণ উপলব্ধি করা সহজ। মুজিবকে আমি জেনে এসেছি একজন গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রী হিসেবে। যখন আমি দম নিচ্ছিলাম, একজন যুবক আমার কাছে এসে বললো, সে ভাইস সেক্রেটারি। বিনয়ের সঙ্গে সে প্রতিশ্রুতি দিল, বিকাল চারটার সময় আমি ‘সরকারি বাসভবনে’ হাজির থাকতে পারলে আমাকে দশ মিনিট সময় দেয়া হবে। তার সঙ্গে যারা সাক্ষাৎ করতে চায় তাদের সঙ্গে সেখানেই তিনি কথা বলেন। বিকাল সাড়ে তিনটায় নগরী কান্ত, নিস্তব্ধ, ঘুমন্ত মধ্যাহ্নের বিশ্রাম নিচ্ছে। রাস্তায় কাধে রাইফেল ঝুলানো মুক্তিবাহিনী টহল দিচ্ছে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে এক মাসেরও বেশি সময় আগে। কিন্তু এখনো তাদের হাতে অস্ত্র আছে। তারা রাত-দিন টহল দেয়। এলোপাতাড়ি বাতাসে গুলি ছোড়ে এবং মানুষ হত্যা করে। হত্যা না করলে দোকানপাট লুট করে। কেউ তাদের থামাতে পারে না, এমনকি মুজিবও না। সম্ভবত তিনি তাদের থামাতে সক্ষম নন। তিনি সন্তুষ্ট এজন্য যে, নগরীর প্রাচীর তার পোস্টার সাইজের ছবিতে একাকার। মুজিবকে আমি আগে যেভাবে জেনেছিলাম, তার সঙ্গে আমার দেখা মুজিবকে মেলাতে পারছি না।
সোমবার সন্ধ্যা : আমি যে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছি এটা ছিল একটা দুর্বিপাক। তার মানসিক যোগ্যতা সম্পর্কে আমার সন্দেহ ছিল। এমনকি হতে পারে যে, কারাগার এবং মৃত্যু সম্পর্কে ভীতি তার মস্তিষ্ককে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছে? তার ভারসাম্যহীনতাকে আমি আর কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারি না। একই সময়ে আমি বলতে চাচ্ছি, কারাগার এবং মৃত্যুর ভয় ইত্যাদি... সম্পর্কে কাহিনীগুলো... আমার কাছে এখনো খুব স্পষ্ট নয়। এটা কি করে হতে পারে যে, তাকে যে রাতে গ্রেফতার করা হলো, সে রাতে সব পর্যায়ের লোককে হত্যা করা হলো? কি করে কি করে এটা হতে পারে যে, তাকে কারাগারের একটি প্রকোষ্ঠ থেকে পলায়ন করতে দেয়া হলো, যেটি তার সমাধিসৌধ হতো? তিনি কি গোপনে ভুট্টোর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছিলেন? আমি যতো তাকে পর্যবেক্ষণ করেছি, ততো মনে হয়েছে, তিনি কিছু একটা লুকাচ্ছেন। এমনকি তার মধ্যে যে সার্বক্ষণিক আক্রমণাত্মক ভাব, সেটাকে আমার মনে হয়েছে আত্মরক্ষার কৌশল বলে।
ঠিক চারটায় আমি সেখানে ছিলাম। ভাইস সেক্রেটারি আমাকে করিডোরে বসতে বললেন, যেখানে কমপক্ষে পঞ্চাশজন লোকে ঠাসাঠাসি ছিল। তিনি অফিসে প্রবেশ করে মুজিবকে আমার উপস্থিতি সম্পর্কে জানালেন। আমি একটা ভয়ঙ্কর গর্জন শুনলাম এবং নিরীহ লোকটি কম্পিতভাবে আবার আবির্ভূত হয়ে আমাকে প্রতীক্ষা করতে বললেন। আমি প্রতীক্ষা করলাম, এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা, চার ঘণ্টা; রাত আটটা যখন বাজলো, তখনো আমি সেই অপরিসর করিডোরে অপেক্ষমাণ। রাত সাড়ে আটটায় আমাকে প্রবেশ করতে বলা হলো। আমি বিশাল এক কক্ষে প্রবেশ করলাম। একটি সোফা ও দুটো চেয়ার সে কক্ষে। মুজিব সোফার পুরোটায় নিজেকে বিস্তার করেছেন এবং দুজন মোটা মন্ত্রী চেয়ার দুটো দখল করে বসে আছেন। কেউ দাড়ালো না। কেউ আমাকে অভ্যর্থনা জানালো না। কেউ আমার উপস্থিতিকে গ্রাহ্য করলো না। মুজিব আমাকে বসতে বলার সৌজন্য প্রদর্শন না করা পর্যন্ত সুদীর্ঘক্ষণ নীরবতা বিরাজ করছিল। আমি সোফার ক্ষুদ্র প্রান্তে বসে টেপ রেকর্ডার খুলে প্রথম প্রশ্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু আমার সে সময়ও ছিল না। মুজিব চিৎকার শুরু করলেন, ‘হারি আপ, কুইক, আন্ডারস্ট্যান্ড? নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। ইজ দ্যাট কিয়ার?... পাকিস্তানিরা ত্রিশ লক্ষ লোক হত্যা করেছে, ইজ দ্যাট কিয়ারÑ আমি বললাম, ‘মি. প্রাইম মিনিস্টার...।’ মুজিব আবার চিৎকার শুরু করলেন, ‘ওরা আমার নারীদেরকে তাদের স্বামী ও সন্তানদের সামনে হত্যা করেছে। স্বামীদের হত্যা করেছে তাদের ছেলে ও স্ত্রীর সামনে। মা-বাপের সামনে ছেলেকে, ভাইবোনের সামনে ভাইবোনকে ... ‘মি. প্রাইম মিনিস্টার... আমি বলতে চাই...’
‘তোমার কোনো কিছু চাওয়ার অধিকার নেই, ইজ দ্যাট রাইট?’
‘আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া হলো। কিন্তু একটা বিষয় সম্পর্কে আমি আরো কিছু জানতে চাই।’ বিষয়টা আমি বুঝতে পারছিলাম না। ‘মি. প্রাইম মিনিস্টার, গ্রেফতারের সময় কি আপনার ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল।’
‘নো, ম্যাডাম নো। তারা জানতো, ওতে কিছু হবে না। তারা আমার বৈশিষ্ট্য, আমার শক্তি, আমার সম্মান, আমার মূল্য, বীরত্ব সম্পর্কে জানতো, আন্ডারস্ট্যান্ড?’
‘তা বুঝলাম। কিন্তু আপনি কি করে বুঝলেন যে তারা আপনাকে ফাসিতে ঝোলাবে? ফাসিতে ঝুলিয়ে কি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়?’
‘নো, নো ডেথ সেনটেন্স।’
এই পর্যায়ে তাকে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হলো এবং তিনি গল্প বলতে শুরু করলেন, ‘আমি এটা জানতাম। কারণ ১৫ ডিসেম্বর ওরা আমাকে কবর দেয়ার জন্য একটা গর্ত খনন করে।’
‘কোথায় খনন করা হয়েছিল সেটা?’
‘আমার সেলের ভেতরে।’
‘আমাকে কি বুঝে নিতে হবে যে গর্তটা ছিল আপনার সেলের ভেতরে?’
‘ইউ মিস আন্ডারস্ট্যান্ড।’
‘আপনার প্রতি কেমন আচরণ করা হয়েছে মি. প্রাইম মিনিস্টার?’
‘আমাকে একটা নির্জন প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছিল। এমনকি আমাকে সাক্ষাৎকারের অনুমতি দেয়া হতো না, সংবাদপত্র পাঠ করতে বা চিঠিপত্রও দেয়া হতো না, আন্ডারস্ট্যান্ড?’’
‘তাহলে আপনি কি করেছেন?’
‘আমি অনেক চিন্তা করেছি, পড়াশোনা করেছি।’
‘আপনি কি পড়েছেন?’
‘বই এবং অন্যান্য জিনিস।’
‘তাহলে আপনি কিছু পড়েছেন।’
‘হ্যা, কিছু পড়েছি’।
‘কিন্তু আমার ধারণা হয়েছিল, আপনাকে কোনো কিছুই পড়তে দেয়া হয়নি।’
‘ইউ মিস আন্ডারস্টুড।’
‘তা বটে মি. প্রাইম মিনিস্টার। কিন্তু এটা কি করে হলো যে, শেষ পর্যন্ত ওরা আপনাকে ফাসিতে ঝোলালো না।’
‘জেলার আমাকে সেল থেকে পালাতে সহায়তা করেছেন এবং তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন।’
‘কেন, তিনি কি কোনো নির্দেশ পেয়েছিলেন?’
‘আমি জানি না। এ ব্যাপারে তার সঙ্গে আমি কোনো কথা বলিনি এবং তিনিও আমার সঙ্গে কিছু বলেননি।’
‘নীরবতা সত্ত্বেও কি আপনারা বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন?’
‘হ্যা, আমাদের মধ্যে বহু আলোচনা হয়েছে এবং তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আমাকে সাহায্য করতে চান।’
‘তাহলে আপনি তার সঙ্গে কথা বলেছেন?’
‘হ্যা, আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি।’
‘আমি ভেবেছিলাম, আপনি কারো সঙ্গেই কথা বলেননি।’
‘ইউ মিস আন্ডারস্টুড।’
‘তা হবে মি. প্রাইম মিনিস্টার। যে লোকটি আপনার জীবন রক্ষা করলো আপনি কি তার প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন না?’
‘এটা ছিল ভাগ্য। আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি।’
এরপর তিনি ভুট্টো সম্পর্কে কথা বললেন। এ সময় তার কথায় কোনো স্ববিরোধিতা ছিল না। বেশ সতর্কতার সঙ্গেই বললেন তার সম্পর্কে। আমাকে মুজিব জানালেন, ২৬ ডিসেম্বর ভুট্টো তাকে খুজতে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য তাকে রাওয়ালপিন্ডিতে নেয়া। তার ভাষায়, ‘ভুট্টো একজন ভদ্রলোকের মতোই ব্যবহার করলেন। তিনি সত্যিই ভদ্রলোক।’ ভুট্টো তাকে বলেছিলেন, একটা যুদ্ধ হয়ে গেছে। অবশ্য মুজিব ব্লাকআউট ও যুদ্ধ বিমানের গর্জন থেকে বরাবরই যুদ্ধ সম্পর্কে আচ করেছেন। ভুট্টো তার কাছে আরো ব্যাখ্যা করলেন যে, এখন তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং তার কাছে কিছু প্রস্তাব পেশ করতে চান।
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘কি প্রস্তাব মি. প্রাইম মিস্টার?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘হোয়াই শুড আই টেল ইউ? এটা একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। প্রাইভেট অ্যাফেয়ার।’
‘আমার কাছে বলার প্রয়োজন নেই মি. প্রাইম মিনিস্টার, আপনি বলবেন ইতিহাসের কাছে।’
মুজিব বললেন, ‘আমিই ইতিহাস। আমি ভুট্টোকে থামিয়ে বললাম, যদি আমাকে মুক্তি দেয়া না হয়, তাহলে আমি আলাপ করবো না। ভুট্টো অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উত্তর দিলেন, আপনি মুক্ত, যদিও আপনাকে শিগগির ছেড়ে দিচ্ছি না। আমাকে আরো দুই বা তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে। এরপর ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সম্পর্কে তার পরিকল্পনা তৈরি করতে শুরু করলেন। কিন্তু আমি অহঙ্কারের সঙ্গেই জানালাম, দেশবাসীর সঙ্গে আলোচনা না করে আমি কোনো পরিকল্পনা করতে পারি না।’ এই পর্যায়ে তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘তাহলে তো কেউ বলতেই পারে যে, আপনাদের আলোচনা খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে হয়েছিল।’

‘তা তো বটেই। আমরা পরস্পরকে ভালোভাবে জানি। খুব বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা ছিল। কিন্তু তা হয়েছিল আমার জানার আগে যে, পাকিস্তানিরা আমার জনগণের বিরুদ্ধে বর্বরোচিত নিপীড়ন করেছে। আমি জানতাম না, তারা বর্বরোচিতভাবে আমার মা-বোনকে হত্যা করেছে।
আমি তাকে থামিয়ে বললাম, ‘আমি জানি মি. প্রাইম মিনিস্টার, আমি জানি।’ তিনি গর্জে উঠলেন, ‘তুমি কিছুই জানো না; আমি তখন জানতাম না যে, তারা আমার স্থপতি, আইনবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, আমার চাকরকে হত্যা করেছে এবং আমার বাড়ি, জমি, সম্পত্তি ধ্বংস করেছে, আমার...।’

তিনি যখন তার সম্পত্তির অংশে পৌছলেন, তার মধ্যে এমন একটা ভাব দেখা গেল, যা থেকে তাকে এ প্রশ্নটা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলাম যে, তিনি সত্যিই সমাজতন্ত্রী কি না? তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যা...’। তার কণ্ঠে দ্বিধা। তাকে আবার বললাম, সমাজতন্ত্র বলতে তিনি কি বোঝেন? তিনি উত্তর দিলেন, ‘সমাজতন্ত্র’। তাতে আমার মনে হলো, সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার যথার্থ ধারণা নেই।
এরপর ১৮ ডিসেম্বর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি রাগে ফেটে পড়লেন। নিচের অংশটুকু আমার টেপ থেকে নেয়া:
‘ম্যাসাকার? হোয়াট ম্যাসাকার?’
‘ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত ঘটনাটি।’
‘ঢাকা স্টেডিয়ামে কোনো ম্যাসাকার হয়নি। তুমি মিথ্যে বলছো।’
‘মি. প্রাইম মিনিস্টার, আমি মিথ্যেবাদী নই। সেখানে আরো সাংবাদিক ও পনেরো হাজার লোকের সঙ্গে আমি হত্যাকা- প্রত্যক্ষ করেছি। আপনি চাইলে আমি আপনাকে তার ছবিও দেখাবো। আমার পত্রিকায় সে ছবি প্রকাশিত হয়েছে।’
‘মিথ্যেবাদী, ওরা মুক্তিবাহিনী নয়।’
“মি. প্রাইম মিনিস্টার, দয়া করে ‘মিথ্যেবাদী’ শব্দটি আর উচ্চারণ করবেন না। তারা মুক্তিবাহিনী। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল আবদুল কাদের সিদ্দিকী এবং তারা ইউনিফর্ম পরা ছিল।”
‘তাহলে হয়তো ওরা রাজাকার ছিল যারা প্রতিরোধের বিরোধিতা করেছিল এবং কাদের সিদ্দিকী তাদের নির্মূল করতে বাধ্য হয়েছে।’
‘মি. প্রাইম মিনিস্টার, কেউ প্রমাণ করেনি যে, লোকগুলো রাজাকার ছিল এবং কেউই প্রতিরোধের বিরোধিতা করেনি। তারা ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। হাত-পা বাধা থাকায় তারা নড়াচড়াও করতে পারছিল না।’
‘মিথ্যেবাদী।’
“শেষবারের মতো বলছি, আমাকে ‘মিথ্যেবাদী’ বলার অনুমতি আপনাকে দেবো না।”
‘আচ্ছা সে অবস্থায় তুমি কি করতে?’
‘আমি নিশ্চিত হতাম যে, ওরা রাজাকার ও অপরাধী। ফায়ারিং স্কোয়াডে দিতাম এবং এভাবেই এই ঘৃণ্য হত্যাকা- এড়াতাম।’
‘ওরা ওভাবে করেনি। হয়তো আমার লোকদের কাছে বুলেট ছিল না।’
‘হ্যা তাদের কাছে বুলেট ছিল। প্রচুর বুলেট ছিল। এখনো তাদের কাছে প্রচুর বুলেট রয়েছে। তা দিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গুলি ছোড়ে। ওরা গাছে, মেঘে, আকাশে, মানুষের প্রতি গুলি ছোড়ে শুধু আনন্দ করার জন্য।
এরপর কি ঘটলো : যে দুই মোটা মন্ত্রী ঘুমুচ্ছিলেন গোটা সাক্ষাৎকারের সময়টায়, সহসা তারা জেগে উঠলেন। আমি বুঝতে পারলাম না মুজিব কি বলে চিৎকার করছেন। কারণ কথাগুলো ছিল বাংলায়।
সোমবার রাত : গোটা ঢাকা নগরী জেনে গেছে, মুজিব ও আমার মধ্যে কি ঘটেছে। শমশের ওয়াদুদ নামে একজন লোক ছাড়া আমার পক্ষে আর কেউ নেই। লোকটি মুজিবের বড় বোনের ছেলে। এই যুবক নিউ ইয়র্ক থেকে এসেছে তার মামার কাছে। তার মতে মুজিব ক্ষমতালোভী এবং নিজের সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণাসম্পন্ন অহঙ্কারী ব্যক্তি। তার মামা খুব মেধাসম্পন্ন নয়। বাইশ বছর বয়সে মুজিব হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ করেছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতির সচিব হিসেবে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এছাড়া আর কিছু করেননি তিনি। কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে, মুজিব একদিন প্রধানমন্ত্রী হবেন। ওয়াদুদের মতে, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কারণ এটা নয়। আসলে একমাত্র ওয়াদুদের মাকেই মুজিব ভয় করেন। এই দুঃখজনক আচরণের জন্য তিনি পারিবারিকভাবে প্রতিবাদ জানাবেন। সে আরো জানালো, আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়েছে তা সে তার মাকে জানাবে, যাতে তিনি এ ব্যাপারে মুজিবের সঙ্গে কথা বলেন। সে আমাকে আরো বললো, সরকারি দফতরে গিয়ে এ ব্যাপারে আমার প্রতিবাদ করা উচিত এবং প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলা উচিত। কারণ প্রেসিডেন্ট খাটি ভদ্রলোক।
মুজিব সম্পর্কে সংগৃহীত তথ্যাবলী তার জন্য বিপর্যয়কর। ১৯৭১ এর মার্চে পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকা-ের কিছুদিন আগে ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো ঢাকায় এসেছিলেন। ইয়াহিয়া খান যথাশিগগির ফিরে যান। কিন্তু ভুট্টো ঢাকায় রয়ে যান। তাকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রাখা হয়। তার অ্যাপার্টমেন্ট ছিল ৯১১-৯১৩।
ইন্টারকন্টিনেন্টালের সর্বোচ্চ তলায় তখন ভুট্টোর ভূমিকা ছিল নিরোর মতো। নগরী যখন জ্বলছিল এবং এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ চলছিল, ভুট্টো তখন মদপান করছিলেন আর হাসছিলেন। পরদিন সকাল ৭টায় তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। আমি দেখেছি, যারা এক সময় পাকিস্তানিদের ভয়ে ভীত ছিল, তারা এখন মুজিবকেই ভয় করে। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রচুর কথাবার্তা চলে এ দেশে। কিন্তু সবসময়ই তা বলা হয় ফিসফিসিয়ে, ভয়ের সঙ্গে। লোকজন বলাবলি করে যে, এই সংঘাতে মুজিব খুব সামান্যই হারিয়েছেন। তিনি ধনী ব্যক্তি। অত্যন্ত ধনবান। তার প্রত্যাবর্তনের পরদিন তিনি সাংবাদিকদের হেলিকপ্টার দিয়েছিলেন। কেউ কি জানে কেন? যাতে তারা নিজেরা গিয়ে মুজিবের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি অবলোকন করে আসতে পারে। এখনো তিনি সমাজতন্ত্রের কথা বলেন, জাতীয়তাবাদের কথা বলেন। তিনি কি তার জমিজমা, বাড়ি, বিলাসবহুল ভিলা, মার্সিডিজ গাড়ি জাতীয়করণ করবেন?
ভুট্টোর সঙ্গে মুজিবের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯৬৫ সালে, যখন তিনি ভারতের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তকে অরক্ষিত রাখার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেন। একজন নেতা হিসেবে তার মূল্য ছিল খুবই কম। তার একমাত্র মেধা ছিল মূর্খ লোকদের উত্তেজিত করে তোলার ক্ষেত্রে। তিনি ছিলেন কথামালার জাদুকর ও মিথ্যার জাদুকর; কিছুদিন আগে এক জনসভায় বক্তৃতাকালে তিনি বলেছিলেন, করাচির রাস্তাগুলো সোনা দিয়ে মোড়া। তা দিয়ে হাটলে চোখ ধাধিয়ে যায়। অর্থনীতির কিছুই বুঝতেন না তিনি। কৃষি ছিল তার কাছে রহস্যের মতো। রাজনীতি ছিল প্রস্তুতিবিহীন। কেউ কি জানে ১৯৭০ এর নির্বাচনে তিনি কেন বিজয়ী হয়েছিলেন? কারণ সব মাওবাদী তাকে ভোট দিয়েছিল। সাইকোনে মাওবাদীদের অফিস বিধ্বস্ত হয়েছিল এবং তাদের নেতা ভাসানী আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জনগণকে যদি আবার ভোট দিতে বলা হয়, তাহলে মুজিবের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্নতর হবে, যদি তিনি বন্দুকের সাহায্যে তার ইচ্ছাকে চাপিয়ে দিতে না চান। সেজন্যই তিনি মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্রসমর্পণের নির্দেশ দিচ্ছেন না এবং আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, রক্তপিপাসু কসাই, যে ঢাকা স্টেডিয়ামে হত্যাযজ্ঞ করেছিল, সেই আবদুল কাদের সিদ্দিকী তার ব্যক্তিগত উপদেষ্টা। ইনডিয়ানরা তাকে গ্রেফতার করেছিল; কিন্তু মুজিব তাকে মুক্ত করেন।
এখন আমরা গণতন্ত্রের কথায় আসতে পারি। একজন মানুষ কি গণতন্ত্রী হতে পারে, যদি সে বিরোধিতা সহ্য করতে না পারে? কেউ যদি তার সঙ্গে একমত না হয়, তিনি তাকে ‘রাজাকার’ বলেন। বিরোধিতার ফল হতে পারে ভিন্নমত পোষণকারীকে কারাগারে প্রেরণ। তার চরিত্র একজন একনায়কের, অসহায় বাঙালিরা উত্তপ্ত পাত্র থেকে গনগনে অগ্নিকু-ে পতিত হয়েছে। বাঙালি রমণীদের প্রতি সম্মান জানিয়েই বলছি, তাদের সম্পর্কে কথা না বলাই উত্তম। তিনি নারীদের পাত্তাই দেন না...।
বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আমাকে আবার মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে বললেন। সব ব্যবস্থা পাকা।
প্রেসিডেন্ট যে প্রচেষ্টা করেছিলেন তা খুব একটা সফল হয়নি। তিনি দুজন কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছিলেন, যাতে তার নির্দেশ পালন করা হয়। মুজিবের কাছে একটা হুঙ্কার ছাড়া তারা আর কিছু পায়নি। তবে এবার একটা করিডোরের বদলে একটা কক্ষে অপেক্ষা করার অনুমতি পেলাম। আমি বিকাল চারটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। একজন বয় আমার চায়ের কাপ পূর্ণ করে দিচ্ছিল এবং এভাবে আমি আঠারো কাপ চা নিঃশেষ করলাম। উনিশ কাপের সময় আমি চা ফোরে ছুড়ে ফেলে হেটে বেরিয়ে এলাম। আমাকে অনুসরণ করে হোটেলে এলো মুজিবের সেক্রেটারি ও ভাইস সেক্রেটারি। তারা বললো, মুজিব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং আগামীকাল সকাল সাড়ে সাতটায় আমার সঙ্গে দেখা করতে চান।
পরদিন সকালে ঠিক সাতটায় আমি হাজির হলাম এবং সকাল সাড়ে নয়টায় মার্সিডিজযোগে মুজিবের আগমন পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হলো। একটা কথাও না বলে তিনি অফিসে প্রবেশ করলেন। আমিও অফিসে ঢুকলাম। আমার দিকে ফিরে তিনি উচ্চারণ করলেন, ‘গেট আউট’। আমি কক্ষ ত্যাগ করতে উদ্যত। তিনি বললেন, ‘গেট ইন হিয়ার।’ আমি ফিরলাম এবং তখনই তিনজন লোক পোস্টার আকৃতির একটি ছবি নিয়ে এলো। দেখে তিনি বললেন, ‘চমৎকার’। এরপর তিনি বললেন, এই মহিলা সাংবাদিককে দেখাও। আমি ‘চমৎকার’ শব্দটি উচ্চারণ করলাম। এ ছিল এক মারাত্মক ভুল। তিনি বজ্রের মতো ফেটে পড়লেন। তিনি ক্ষিপ্ত। ছবিটি ফোরে ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা চমৎকার নয়’। আমি কিছু না বুঝে নিশ্চুপ থাকলাম।
আমি তার উত্তেজনা হ্রাস করতে সক্ষম হলাম। যেহেতু আমি ভুট্টোর সঙ্গে তার সত্যিকার সম্পর্কটা খুজে পেতে চাই, সে জন্য ভুট্টো সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। নামটা বলার মুহূর্তেই তিনি জ্বলে উঠলেন এবং বললেন, তিনি শুধু বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর দিতে চান। আমি প্রশ্ন করলাম, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গকে যুক্ত করার সম্ভাবনা আছে কি না?’ খানিকটা দ্বিধান্বিত হয়ে তিনি বললেন, ‘এ সময়ে, আমার আর কোনো আগ্রহ নেই।’ এই বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধীকেও বিস্মিত হতে হবে যে, মুজিব কলকাতা করায়ত্ত করতে চায়। আমি বললাম, তার মানে আপনি বলতে চান, অতীতে আপনার আগ্রহ ছিল এবং ভবিষ্যতে পুনর্বিবেচনা করার সম্ভাবনা আছে।’ ধীরে ধীরে তিনি উপলব্ধি করলেন, আমি তাকে একটা ফাদে ফেলতে চাচ্ছি। নিজের ভুল সংশোধন করার বদলে তিনি টেবিলে মুষ্টাঘাত করে বলতে শুরু করলেন, আমি সাংবাদিক নই বরং সরকারি মন্ত্রী। আমি তাকে প্রশ্ন করছি না, দোষারোপ করছি। আমাকে এখনই বের হয়ে যেতে হবে এবং আবার আমি যেন এ দেশে পা না দিই।
এই পর্যায়ে আমি নিজের ওপর সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম এবং আমার মাঝে উত্তেজনার যে স্তূপ গড়ে উঠেছিল তা বিস্ফোরিত হলো। আমি বললাম, তার সবকিছু মেকি, ভুয়া। তার পরিণতি হবে খুবই শোচনীয়। যখন তিনি মুখ ব্যাদান করে দাড়ালেন, আমি দৌড়ে বেরিয়ে এলাম এবং রাস্তায় প্রথম রিকশাটায় চাপলাম। হোটেলে গিয়ে বিল পরিশোধ করলাম। স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে যখন বেরুতে যাচ্ছি, তখন দেখলাম মুক্তিবাহিনী নিচে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা এ কথা বলতে বলতে আমার কাছে এলো যে, আমি দেশের পিতাকে অপমান করেছি এবং সেজন্য আমাকে চরম মূল্য দিতে হবে। তাদের এ গোলযোগের মধ্যে পাচজন অস্ট্রেলিয়ানের সাহায্যে পালাতে সক্ষম হলাম। তারা এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে প্রবেশ করছিল। এয়ারপোর্টে দুজন ইনডিয়ান কর্মকর্তা আমাকে বিমানে উঠিয়ে নিলেন এবং আমি নিরাপদ হলাম।
(২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২)
ইন্টারভিউ উইথ হিস্টরী থেকে
অনুবাদ : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০০৮ দুপুর ১২:২৯
৩১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×