নাটক, বাস্তবতা!!!
জঙ্গলের এত গহীনে কেউ কোন দিন আসেনি, মধ্যবয়স্ক লোকটা ঠিক এই মুহূর্তে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে।
অনেক দিন থেকে পরিকল্পনা করে, খোঁজে খোঁজে এসেছে সে বনের এই গহীনে।
সে চিৎকার করে কাঁদতে চায়, চিৎকার করে কিছু বলতে চায়, চিৎকার করে কিছু মানুষকে গালি দিতে চায় আর চিৎকার করে কিছু মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে চায়।
লোকালয়ে এমন করলে লোকে পাগল ভাববে, জেনে যাবে তার জীবনের অনেক না বলা গল্প।
চুলদাড়ি প্রায় সব পেকে একাকার; যতোনা বয়সের ভারে তার চাইতে জীবনের অনিশ্চয়তা আর ঝড়ঝাপটায়।
চিৎকার শুরু করেছে সে, শুরু করেছে কান্নাও। চোখে অশ্রু নেই, কান্নার শব্দটাও কেমন অদ্ভুত। এই দৃশ্যে গ্লিসারিন দিয়ে চোখে জল আনা হলোনা কেন নাকি অশ্রুহীন কান্নার ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলার জন্য।
যাই হোক ফ্ল্যাশব্যাক থেকে যা জানা গেলো: লোকটার জীবনে তিনবার প্রেম চিত্রায়িত হয়েছিলো। প্রথম প্রেমটাকে প্রেম না বললেও চলে, যদিও সে প্রেমই জীবনের অনেক হিসেব নিকেশ লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিলো । যাকে সে কোনদিন বলতেই পারেনি, "তোমাকে ভালোলাগে , ভালোবাসি।" বছরের পর বছর গোপনে ভালোবাসতে বাসতে যেদিন বলার জন্য প্রায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো ঠিক সেদিন জানলো, খুব বেশী না হয়তো মুহূর্ত কয়েক আগেই ভালোবাসার মানুষটিকে আরেকজন দখল করে ফেলেছে!! এরপর অনেকবার শৈশবের সে যন্ত্রণাময় দিনগুলিতে ভালোবাসার মানুষটিকে অন্যের বাহুডোরে দেখেছে আর নিভৃতে কেঁদেছে। গল্প শেষ না এখনো প্রথম প্রেমের। ভালোবাসার মানুষটি একটা অসময়ে ধরা দিয়েছিলো স্বপ্নের মতো আরো পরে। তারপর একেবারেই চলে গিয়েছিলো সুখের অসুখ দিয়ে।
দ্বিতীয় প্রেমটা হুট করে এসেছিলো, মেয়েটা ভালোবাসতো প্রথম প্রথম খুব। নিজে থেকেই এসে হাত বাড়িয়েছিলো সে। আজকের মধ্যবয়স্ক লোকটা তখন সবে বছর কুড়ি কিংবা বাইসের হবে। দীর্ঘদিন চললো সে প্রেম। চললো মান অভিমান, ঝগড়াবিবাদ, প্রথম ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে হলো বিরাট ঝামেলা। একসময় সমাধান হলো সবকিছুর কিন্তু আরো অনেক দিন পর মনে হলো আসলে সে মানুষটা আর আগের মানুষ নেই। যেখানে ছিলো ভালোবাসা সেখানে জমতে লাগলো মিথ্যা, ছলনা, অপ্রেম, প্রতারণা। অনেকগুলো দিন, মাস, বছর পার করে লোকটা দেখলো সম্পর্কটা একটা মিথ্যার দুর্ভেদ্য দুর্গ। ফলাফল বুকের ভেতর পাথর চাপা দিয়ে বাঁধন ছিন্ন করা।
তৃতীয় জন জীবনে এসেছিলো অনেকটা দেবীর মতো। অবিশ্বাস্য ভাবে সে এসেছিলো জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে প্রদীপের আলো হয়ে। পরম মমতা, ভালোবাসা আর নির্ভরতা দিয়ে সে যেনো জীবনটাকেই পালটে দিতে এসেছে মনে হয়েছিলো। মধ্যবস্ক লোকটাকে সে দেবী তখন এতো ভালোবেসেছিলো নিঃস্বার্থ ভাবে যে, লোকটা জীবনের ফেলে আসা বিভীষিকাময় ঘটনাগুলি ভুলতে বসেছিলো প্রায়। ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলো সে, এমন একজন মানুষকে তার জীবনে পাঠানোর জন্য কিন্তু লোকটার সে সুখ আর শান্তি বেশিদিন থাকলোনা। পুর্বজনমের কোনো পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে মনে হয় লোকটার জন্ম হয়েছিলো। এমন মনে হবার কারান তৃতীয় মানুষটা এতোটাই ভালোবাসতে শুরু করলো যে তা ভয়াবহ ভালোবাসায় রূপ নিলো। এমন ভালোবাসা, কিংবা মমতা কোন পিতামাতা তার সন্তানকে করেন কি না সন্দেহ। বিপদ আপদ সবকিছুতে মানুষটা দেবদূতের মতো হাজির হতো, ছায়ার মতো পাশে থাকতো। সে মেয়ে আজকের গহীন জঙ্গলের লোকটাকে শুধু পারেনি গিলে খেয়ে নিজের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখতে। প্রতিটা মুহূর্ত চাইতো পাশে পাশে থাকার, সারাক্ষণ চাইতো ওর সঙ্গ, চোখের আড়াল হলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়তো মায়াবতী, মমতাময়ী আর সুন্দর মেয়েটি। এই ভালোবাসাই একসময় শাস্তি মনে হতে লাগলো, মায়াবতীকে বুঝানো গেলোনা কিছুতেই এ যে ভালোবাসা নয় এ অত্যাচার। মধ্যবয়স্ক এই লোকটাকে মায়াবতী ভালোবাসতে বাসতে প্রায় মানসিক ভাবে অসুস্থ করে তুললো। ফলাফল এত ঘটনা,দুর্ঘটনায়ও যে জীবনে নেশা স্পর্শ করেনি সে নিজেকে গিনিপিগ ভাবতে শুরু করলো, ভালোবাসার অত্যাচারে, ভালোবাসার অপরিমেয়তায় পরিণত হলো নেশাখোরে। পতন শুরু তখন, যে পতন আটকাতে পারেনি কেউ। লোকটা উপলব্দি করেছিলো, ভালোবাসাহীনতা কিংবা মিথ্যা, প্রতারণা ইত্যাদিই শুধু মানুষকে কষ্ট দেয়না, অতিরিক্ত ভালোবাসাও কষ্ট দেয়।
নির্জন জঙ্গল আজ লোকটার চিৎকারে প্রকম্পিত। বিধাতাকে সে প্রশ্ন করছে, হে বিধাতা, জীবনে যতো অপরাধ করেছি তার জন্য তো কোনদিন শাস্তি দাওনি আমাকে কিন্তু বিনাদোষে এত অসহ্য যন্ত্রণা কেন সইতে হলো জীবনভর? এ তোমার কেমন বিচার? আমি তো কোনদিন পথের একটা কুকুরকেও ঢিল ছুড়ে মারিনি সে কষ্ট পাবে ভেবে তবে আমাকে কেন অসহ্য কষ্টের অসংখ্য ঢিলের আঘাত সইতে হলো!!
লোকটার চোখে এখনো পানি নেই, কিন্তু বাকি সবাই অশ্রুসিক্ত ঠায় বসে আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ৩:২০