ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক
আব্দুল মান্নান মল্লিক
মাত্র পঁচিশ দিনের বাচ্চা রেখে মা পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। বাচ্চাটাকে দেখার মতো পৃথিবীতে তার আপন বলতে আর কেউ ছিলনা। কোথাও বসা মাচার তলে, নইত কোনো গাছতলে কখনো বা পথের ধারে কারও বারান্দায় শুয়ে রাত কাটাত।
তবুও তার এতটুকু শান্তি ছিলনা। চোখে পড়লেই সবাই তাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিতো।
সেদিন বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে-দিতে বাড়ি ফিরতে অন্ধকার হয়ে গেছে। বাড়ি ঢুকতেই বাচ্চাটা ছুটতে ছুটতে এসে আমার পা চাঁটতে লাগলো। কোথায় ছিল কে জানে? যতই আলতো পায়ে ঠেলে সরিয়ে দিই, তবুও আমাকে ছাড়তে চাইনা। যেন কতদিনের চেনা।
বারবার এমনভাবে দেখে আমারও মনটা খুব দুর্বল হয়ে গেল।
হেরে গেলাম এই অল্প বয়স্ক বাচ্ছাটার কাছে।
ওর উপর আমার খুব মায়া পড়ে গেল। ওকে বুকে তুলে চুমা দিতে-দিতে বাড়ি ঢুকতেই বাবা বলে, ওটা কি হবে?
আমি বললাম পুষব।
ঠিক আছে, তোর যখন এতই শখ, তো পুষনা। এই বলে বাবা হাসতে হাসতে বারান্দায় উঠে।
তখনই বোতলে দুধ ভরে ওকে খাওয়াইতে লাগলাম। খাওয়া দেখে মনে হল, যেন সাত সাগরের জল একাই খেয়ে ফেলবে। ক্রমে-ক্রমে দু'দিনের মধ্যেই সাভাবিক হয়ে গেল।
গায়ের রং ছিল সম্পূর্ণ সাদা, তাই আদর করে নাম রাখা হল ধবলা।
ধবলা দিনে-দিনে যত বড় হতে থাকে, মায়াও যেন বাড়তে থাকে। কোনো আত্মীয় পরিজনের সাথে কথা বললেও ওর খুব কষ্ট হয়। ও ঘেউঘেউ করে বুঝাতে চায় আমি যেন ওকে নিয়েই ব্যস্ত থাকি। আমার গায়ে কেউ হাত দিয়ে কথা বলুক, সেটাও কিছুতেই সহ্য করতে পারে না।
ধবলাকে ছেড়ে আমার বাইরে কোথাও যাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়লো। কোথাও গেলে, ওর আড়ালে আমাকে যেতে হয়।
সব সময় ধবলা যেন আমাকেই খুজে বেড়ায়।
একদণ্ড চোখের আড়াল হলেই বাড়িতে ঘেউঘেউ করে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে।
ও যেন ভাবে, পাছে আমার আপদ বিপদ না ঘটে, সঙ্গে থাকলে হয়ত ধবলা উদ্ধার করবে। বাড়ির সবার কাপড় ধরে টানাটানি করে, ওর ইচ্ছা, কেউ যেন ওকে আমার কাছে নিয়ে যায়।
যত দিন যায় ধবলা ও ধীরে-ধীরে আমার খুব প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠলো।
ধবলা এখন বড় হয়েছে। আমাদের সম্পর্কটা এমন ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলো, কুকুরের কথা ভুলেই গেছি। ও যেন আমার খুব প্রিয়জন।
এইভাবে চলতে চলতে একদিন হঠাৎ করে ভিন পাড়ার অন্য একটি কুকুর আমার বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। ধবলা তাকে কিছুতেই সহ্য করতে না পেরে, ঘেউঘেউ করে ছুটে গিয়ে মারামারি কামড়াকামড়ি আরম্ভ করে দিল। ভিন পাড়ার কুকুরটি পালাতে চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই ছাড়তে চায়না। আমি অনেক চেষ্টা করেও যখন ছাড়াতে পারছিনা রাগের মাথায় ধবলাকে মেরেছিলাম। তারপর ধবলা শান্ত হয়ে গেল। ভিন পাড়ার কুকুরটি ও চলে গেল।
ধবলাকে আমি কাছে ডাকতে আর কোনো সাড়া দেয়না। চুপ করে বসে রইলো। চক্ষু বেয়ে টসটস করে জল পড়তে লাগল। বুঝতে পেরেছি, যাকে আমি এতদিন শুধু আদর করেই এসেছি, আজ হঠাৎ আমার স্বভাবের এই পরিবর্তন দেখে, ধবলা খুব দুঃখ পেয়েছে।
ধবলা সারা বাড়িটা একবার ভালো করে দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বাড়ির বাইরে পা ফেলে। আমি তার গলা ধরে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে অনেক চেষ্টা করেও বিফল হলাম। অবশেষে আমি বাড়ি ফিরে বারান্দায় বসে গালে হাত দিয়ে ভাবছি, ওর দুঃখ ভাঙলে বাড়িতে আবার ফিরে আসবে।
বেশ কিছুক্ষণ পর দেখলাম আসছে না, বাইরে বেরিয়ে দেখি, তার জায়গায় সে আর নাই।
অনেক খুঁজাখুঁজি করেও তার কোনো সন্ধান পেলামনা।
আজ প্রায় তিন মাস কেটে গেল, তবুও বিশ্বাসে পথ চেয়ে বসে আছি ধবলা একদিন না একদিন ফিরে আসবে।