somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"বাবা"- একটি ছোটগল্প

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক
"ঘ্রোৎ ঘ্রোৎ" স্বরে মোবাইল ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো।
আসিফ বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে ফোন বের করতে হাত বাড়ালো। জিন্সের প্যান্টের পকেট, টাইট হয়ে থাকে। সহজে ফোন বেরোতে চায়না। ডিসপ্লেতে লেখা, "কলিং আব্বু।"
সে লাইনটা কেটে দিল। আগামীকাল ক্যুইজ। কস্ট একাউন্টিং। অত্যন্ত কঠিন সাবজেক্ট। পড়া হয়নি কিছুই। তাই সে বন্ধুদের মেসে এসেছে গ্রুপ স্টাডি করতে। সাফওয়ানও এসেছে মেসে। সাফওয়ানকে ওর বন্ধুরা "একাউন্টিংয়ের জনক" বলে থাকে। অতি জটিল জটিল থিওরীও সে অনায়াসে বুঝতে পারে। তারচেয়ে বড় কথা, ছেলেটা যা বোঝে, তা সহজে অন্যকেও বুঝাতে পারে। জুনায়েদ নামে ক্লাসের একটা হারামজাদা কিসিমের ছেলে আছে, সেও একাউন্টিং খুব ভাল বুঝে। কিন্তু কাউকে সাহায্য করতে চায়না। সাহায্য চাইতে গেলেই বলে, "আমি কি বুঝাবো? আমি নিজেওতো বুঝিনা।"
আসলে ফকিরনীর পুতের মন ভর্তি হিংসা। যদি কেউ তার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে যায়!
পড়ায় যাতে ডিস্টার্ব না হয়, সেজন্য সে ফোনটা ভাইব্রেশন মুডে সেট করে রেখেছে। এমনকি রীতুকেও বলে দিয়েছে আজকে তার সাথে বেশি কথা বলা হবেনা। রাতে ডিনার শেষে ঘুমাতে যাবার আগেই কেবল 'গুডনাইট' বলা হবে।
রীতু মানতে চায়নি প্রথমে। যখন প্রমিস করেছে যে ক্যুইজ উইক শেষে সে ক্ষতিপূরন হিসেবে প্রতিদিন ফোনে আধা ঘন্টা করে এক্সট্রা কথা বলবে, তখন গিয়ে তার মন নরম হয়েছে।
ভীষণ অভিমানী হয়েছে মেয়েটা। আসিফ অবশ্য কিছু মনে করেনা। তাকে ভালবাসে বলেইতো এত অভিমান করে।
আব্বু জানে সে এখন কোথায় আছে। তারপরও বারবার ফোন করে ডিস্টার্ব করছে কেন সেই জানে।
সাফওয়ান বলল, "কে ফোন করছেরে?"
আসিফ বেশ বিরক্ত গলায় বলল, "আব্বু।"
"ইমার্জেন্সি কিছু?"
"আরেনা, খাজুইরা আলাপ করতে ফোন করেছে শিওর। ‘কোথায় আছি, কেমন আছি, কখন বাসায় ফিরবো’ এইসব আর কি।"
"তুই জানিয়ে আসিসনি যে তুই এখানে?"
"আম্মাকে বলে এসেছি। তারপরেও আমাকে একদম বিশ্বাস করেনা।"
"আহা। বেচারা যখন এতবার ফোন করছেন, তখন একবার রিসিভ করে জানিয়েই দে না তুই কি করছিস। শুধু শুধু টেনশন বাড়িয়ে কি লাভ?" "করুক টেনশন। উনাকে টেনশন করতে কে বলেছে? এমন ভাব করেন আমি যেন এখনও স্কুলে পড়ি।"
ফোন আবারও "ঘ্রোৎ ঘ্রোৎ" স্বরে বেজে উঠে।
আসিফ আবারও বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দেয়।
সাফওয়ান বলে, "তুই ফোন ধর, কথা বলেনে, তারপর নাহয় আমরা সামনে এগোবো। আর তাছাড়া আমার মনে হয় একটা ব্রেক হলে খুব একটা মন্দ হয়না, কি বলিস তোরা?"
রাহাত একটু তোতলা স্বভাবের। সে বলে, "আআআরে নাহ! এখন স্ স্ স্ স্টাডি ব্রেক হলে কতক্ষণে শ্ শ্ শ্ শেষ করবো? একটানা পড়ে তারপর বববব্রেক নেয়া ভাল।"
মনির ধমক দিয়ে উঠলো, "এখনি ব্রেক দরকার! এককাপ চা না খেলে মাথায় প্যাচ খেয়ে যাবে সব! এইসব '....'ছাল থিওরী একসাথে মাথায় বেশি ঢুকবে না।"
রাহাত বলল, "এখন বববব্রেক নিলে কোন রাতে শ্ শ্ শ্ শেষ করবি? এখনিতো রাত এগারোটা ববববাজে।"
মনির রাহাতকে উড়িয়ে দিল।
"তুই কথা শুরু করিস না। তুই কথা কওয়া শুরু করলে কালকে সকালের আগেও শেষ করতে পারুম না। চুপচাপ চা খা, শইল স্ট্রেচ কর, তারপর ফ্রেশ মাইন্ডে আবার ইস্টার্ট কর!"
তর্কে বাঁধা দিতেই যেন আবারও আসিফের মোবাইল "ঘ্রোৎ ঘ্রোৎ" করে উঠলো। আসিফ বিরক্তভাবে তাকালো ডিসপ্লের দিকে।
"কলিং আব্বু।"
সাফওয়ান বলল, "তুই কথা সেড়ে নে। আমরা এখন দশ মিনিটের ব্রেক নিচ্ছি। কারও বিড়ি সিগারেট খাবার ইচ্ছা জাগলে খেয়ে আসতে পারে। প্লিজ এই ঘরে খাস না, বিড়ির গন্ধ আমার সহ্য হয়না।"
আসিফ একটু সাইডে সরে গিয়ে ফোন রিসিভ করলো।
ওপাশ থেকে বাবার কন্ঠ শোনা গেল, "হ্যালো বাবা! তুমি ঠিক আছোতো?"
আসিফ চাপা গলায় জবাব দিল, "হ্যা, ঠিক আছি। কেন ফোন দিচ্ছো?"
"এত রাত হয়ে গেল, তুমি বাইরে, তাই টেনশন হচ্ছিল খুব।"
"টেনশনের কি আছে? আমিতো বলেই এসেছি যে আমি বন্ধুদের মেসে রাতে থাকবো।"
"নিজের বাসা ফেলে অন্যের বাড়িতে এভাবে রাত কাঁটানো ভাল না বাবা।"
আসিফের খুবই বিরক্ত লাগলো।
"আমি কি আড্ডা দিতে এসেছি নাকি? আমি পড়তে এসেছি।"
"পড়া কখন শেষ হবে বাবা?"
আসিফের আর ধৈর্য্য হলো না।
"জানিনা কখন শেষ হবে। এখন রাখি। কালকে দেখা হবে। আল্লাহ হাফেজ।"
বাবাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে ফোন কেটে দিল। সাথে সাথেই একটা এসএমএস এলো ফোনে।
"বেবি.....আই মিস ইউ!"
রীতু পাঠিয়েছে। এসএমএস পড়েই মনটা ভাল হয়ে গেল। সে সাথে সাথে ফোন দিল।
"হ্যালো জাআআআন!"
"হাই বেবি! তুমি না আজকে ফোন করার কথা না? তাহলে ফোন দিলা যে?"
"আমার জানুর সাথে কথা বলার জন্য দুই মিনিট টাইম কি আমি বের করতে পারিনা?"
"অঅঅ, ইউ আর সো স্যুইট বেবি!"
"আই নো হানি!"
"ইউ নো?"
"অবশ্যই! সুইট না হলে কি তোমার বেবি হতাম?"


দুই

পরীক্ষার হলে গিয়ে আসিফ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। আরেকবার কোয়েশ্চেন পেপার ভাল করে চোখ বুলালো।
এসব কি এসেছে? কস্ট এস্টিমেশনের চ্যাপ্টারে সে খানিকটা দূর্বল ছিল। কাল সেটার উপর খুব জোর দিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু এখানে যে অংক এসেছে, সেটার সে মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না।
জব কস্টিং, প্রোসেস কস্টিং চ্যাপ্টারগুলো ছিল তার হাতের ময়লা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে কিছুই জানেনা।
প্ল্যানিং অ্যান্ড বাজেটিং থেকেও যা এসেছে সে মনে হয়না কিছু লিখতে পারবে।
তার মানে এই পরীক্ষায় সে নিশ্চিত শুন্য পাবে। নকল করা ছাড়া তার কোনই উপায় নাই।
তার সামনে কাউসার বসেছে। সে দেখা যাচ্ছে অনবরত লিখেই চলেছে। এই ছেলে কবে থেকে একাউন্টিং জিনিয়াস হয়ে গেল?
"এই, কাউসার!"
আসিফ ফিসফিস করে ডাকে।
কাউসার একবার দেখে নিল ইনভিজিলেটর শরীফ স্যারের অবস্থান। তিনি এদিকে দেখছেন না। সে সাবধানে তাকালো আসিফের দিকে। ভুরু তুলে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, "কী?"
"কি লিখছিস?"
কাউসার আঙ্গুলের ইশারায় দেখালো এক নম্বর প্রশ্নের উত্তর লিখছে।
কস্ট এস্টিমেশন! আসিফ উৎসাহী গলায় জানতে চাইলো, "পারিস?"
কাউসার এমনভাবে তাকালো, যেন বলছে ভিক্ষার চাল, কারা না আকারা! সহজ ভাষায়, ফকিরনি! তোকে যে দান করছি এই ঢের, তুই আবার ছেঁড়া নোট নিয়ে অভিযোগ করোস!
"দ্যাখা!"
কাউসার তার খাতা মেলে ধরলো। আসিফ উকি দিয়ে দেখতে লাগলো।
"এই, একটু স্পষ্ট করে লেখ না, কিছুইতো বুঝিনা।"
কাউসার কিছু বলল না। শুধু খাতাটা তার দিকে আরেকটু এগিয়ে দিল।
শরীফ স্যার তখনই লক্ষ্য করলেন। তিনি এগিয়ে এসে আসিফকে বললেন, "ইয়ং ম্যান, প্লিজ স্ট্যান্ড আপ!"
আসিফ ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ালো। পরীক্ষার সময়ে ছাত্রদের খাতা টেনে নেয়ার বদনাম শরীফ স্যারের আছে। তার খাতা নিয়ে গেলে সে যে শুন্য পাবে!
স্যার নিজের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, "ওখানে গিয়ে বসে পরীক্ষা দিন, প্লিজ!"
আসিফের হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো। স্যারের চেয়ারে বসে পরীক্ষা কিভাবে দিবে? সে যে কিছুই লিখতে পারবেনা।
"স্যার। প্লিজ! আর করবো না।"
শরীফ স্যার খুবই বিনীত স্বরে বললেন, "তাহলে ওখানে গিয়ে লিখতে সমস্যা কোথায়?"
"স্যার....."
স্যার এবার গলা পাল্টালেন। "Don't make me expel your paper!"
আসিফ আর কথা বাড়ালো না। মাথা নীচু করে স্যারের চেয়ার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।
কাউসারও খাতা ভাজ করে লিখতে শুরু করলো। খুব বাঁচা বেঁচে গেছে। শরীফ স্যার অপরাধকারী ও সাহায্যকারী দুটোরই খাতা বাতিল করতে কুখ্যাত।
আসিফ কিছুক্ষন বানিয়ে বানিয়ে লেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু এটিতো লিটারেচার না যে বানিয়ে বানিয়ে লিখলেও স্যার দয়া করে পাশ মার্কস দিয়ে দেবেন।
সে কেটে কিছুক্ষন ঝিম মেরে বসে রইলো।
টয়লেটে যেতে হবে। টেনশনের সময়ে নিম্ন চাপের সৃষ্টি হয়। এখনকার পরিস্থিতিতে টেনশন না করলে কবে করবে?
"স্যার! টয়লেটে যেতে পারি?"
স্যার ইশারায় অনুমতি দিলেন।
আসিফ ছুটে বেরিয়ে গেল। ক্লাস রুমে তার দমবন্ধ লাগছিল। মনে হচ্ছিল এখান থেকে বেরুতে না পারলে সে বুঝিবা মারাই যাবে।

টয়লেটে গিয়ে তার হাত থরথর করে কাঁপতে লাগলো। কমোডের ফ্ল্যাশের ট্যাংকির পেছনে কেউ কস্ট একাউন্টিং বইটা লুকিয়ে রেখেছে। তার হাতে এখন বই আছে। পরীক্ষায় কি কি প্রশ্ন এসেছে সে সব জানে! তারমানে তাকে আর ফেল করতে হবেনা!
ঝট করে বইটা হাতে তুলে নিয়ে সে চ্যাপ্টারগুলো বের করতে লাগলো। উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছে। কপাল ঘামে ভিজে উঠছে। উত্তর খুঁজে পেয়েছে, কিন্তু কিছুতেই মুখস্ত করতে পারছেনা। সময় তার হাতে নেই। বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে স্যার সন্দেহ করবেন। এ যেন কেউ যুদ্ধের ময়দানে তার হাতে বন্দুক তুলে দিয়েছে কিন্তু গুলি দিতে ভুলে গেছে!
তার হাতে এখন একটাই উপায় আছে। আসিফ কোন কিছু না ভাবে বইয়ের পৃষ্ঠা ছিড়তে শুরু করলো।



"স্যার। আপনাকে এইভাবে আমরাও ডেকে আনতে চাইনি। কিন্তু পরিস্থিতিই এমন....."
ডিন কথা শেষ করলেন না। করুন চোখে তাকালেন আসিফের দিকে। যেন তিনি বলার চেষ্টা করছেন, "এ তুই আমাকে কোন ঝামেলায় ফেললি!"
আসিফের বাবা সালাম সাহেব গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। তাঁকে দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি বজ্রাহত। তাঁর মুখ থমথম করছে।
"স্যার এক গ্লাস পানি খাবেন? অথবা ঠান্ডা ড্রিংকস?"
ডিনের কথায় তিনি চোখ তুলে তাকালেন। তাঁর দৃষ্টি শুন্য। যেন তিনি কিছু বুঝতে পারছেন না।
তিনি সারাজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর ছাত্ররা তাঁকে দেবতাজ্ঞান করে। এই যে তাঁর সামনে যে লোকটা বসে আছে, এই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ডিপার্টমেন্টের ডিন, সেও নাকি তাঁর ছাত্র ছিল। তাঁকে ঘরে ঢুকতে দেখেই উঠে এসে পায়ে ধরে সালাম করলো। তিনি অবশ্য চিনতে পারেননি। এখনও মনে করতে পারছেন না। বয়স হয়েছে না? কতজনকে তিনি মনে রাখবেন? কিন্তু তাঁর ছাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন হয়েছে, এতেই তিনি গর্বিত। ছাত্রের সফলতা মানেইতো তাঁর সফলতা।
"আমাদের ইউনিভার্সিটির ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন খুবই স্ট্রিক্ট। কোন কম্প্রমাইজ করা হয়না। তবুও আমি চেষ্টা করবো আমার পক্ষে যেটুকু সম্ভব করার।"
সালাম সাহেব তাঁর পাশে বসা পুত্রের দিকে তাকালেন। ছেলে মাথা নিচু করে বসে আছে। আসলে মাথা নিচু হয়েছেতো তাঁর নিজের। যেই তিনি সারাজীবন ছাত্রদের কেবল এই শিক্ষাই দিয়ে গেছেন যে সুশিক্ষার চেয়েও স্বশিক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ, সেই তাঁরই সন্তান কিনা পরীক্ষায় নকল করে পাশ করতে চেয়েছে?
ডিন একটি ফরম এগিয়ে দিলেন তাঁর দিকে, "স্যার, আপনাকে এখানে সাইন করতে হবে।"
তিনি কলম হাতে নিলেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন ডিনের দিকে। কিছু বললেন না। বলার শক্তি বা মানসিকতা তাঁর নেই।
ডিন বুঝতে পারলেন। তিনিই বললেন, "এখানে লেখা আছে যে আসিফ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করেছে। পরীক্ষায় নকল করেছে। এখন তদন্ত কমিটি যা সিদ্ধান্ত নিবে, তাই মেনে নিতে হবে।"
সালাম সাহেব আবারও পুত্রের দিকে তাকালেন। পুত্র মাথা নিচু করে আছে।
ফর্মে নিজের নাম সাইন করার সময়ে তাঁর হাত কাঁপতে লাগলো।
"স্যার, আমি আমার পক্ষে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো শাস্তি যেন কঠিন না হয় সেই ব্যপারটা নিশ্চিত করতে। আপনি শক্ত হন।"
সালাম সাহেব বলতে চাইছিলেন, "আমার ছেলে বলে তাকে আলাদা কোন সুবিধা দেয়ার প্রয়োজন নেই। তোমরা প্রচলিত পদ্ধতিতেই তার বিচার করো।"
তাঁর গলা ধরে এলো। মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোলো না।
ডিন নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে স্যারের হাত ধরলেন।
"স্যার মনকে শক্ত করুন। বাচ্চা ছেলে, ভুল করে ফেলেছে। আপনি কষ্ট পাবেননা।"
তিনি নিজের ছাত্রের দিকে তাকিয়ে কাষ্ঠ হাসি হাসলেন। ডিন তাঁকে দরজার বাইরেও এগিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। তিনিই ইশারায় বললেন তার দরকার হবেনা।
বাড়ি ফেরার পথে কিংবা বাড়ি ফেরার পরেও তিনি আসিফের সাথে কথা বললেন না। আসিফও গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। সেও বুঝতে পারছে না কিভাবে বাবার সাথে কথা বলা যায়।
দুপুরে তিনি ভাত খেলেন না। রাতেও তিনি বারান্দার ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে শুয়ে রইলেন। মাঝে মাঝে তাঁর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুধারা। আবার গালেই তারা শুকিয়ে গেল।



আজকে বহুদিন পর অফিসে বসে আসিফের সেই দিনটার ঘটনা মনে পরে গেল। কী অপমানের মধ্য দিয়েই না তার বাবাকে সেদিন যেতে হয়েছিল! সবই হয়েছিল তার সাময়িক বোকামিতে।
সেই এক ঘটনাই বাবার চরিত্র পাল্টে দিয়েছিল। তিনি একাকী থাকতে শুরু করেন। হৈহুল্লোড় আড্ডাবাজি একদম এড়িয়ে চলতেন। তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমনকি এক টেবিলে বসেও ভাত খেতেন না।
সে যখন তাঁর পা চেপে ধরে পাক্কা দুই ঘন্টা কেঁদেছিল, তিনি শুধু বলেছিলেন, "ঠিক আছে। এমন কাজ আর দ্বিতীয়বার করো না।"
তারপরেও তিনি স্বাভাবিক হতে পারেননি। একটি পাথর যেন তাঁকে চেপে ধরে রাখলো। তিনি ইচ্ছে করেই যেন সেই বোঝা সরাতে চাননি।
সেই এক ঘটনা তার কি নিজের জীবনকেও পাল্টে দেয়নি?
ইউনিভার্সিটি থেকে বহিষ্কার হবার পরে কত কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছিল আরেকটি ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার নতুন করে পড়ালেখা শুরু করতে। একসময়ে রীতু ছিল তার ক্লাস মেট। এখন হয়ে গেল তার সিনিয়র।
ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময়ে ওর যখন বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে যায়, তখন সে বারবার বলছিল তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে। ওর বাবা মারা গেলেও একটি স্টুডেন্টের সাথে বিয়ে দিবেন না।
তখন আসিফ কিছুই করেনি। একবার নকল করে বাবাকে যে কষ্ট দিয়েছে, এখন পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলে বাবা নির্ঘাত মারা যাবেন।
তীব্র অভিমানে রীতু কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, "কাপুরুষ!"
সে কাপুরুষ হতেও রাজি আছে, কিন্তু বাবার হত্যাকারী নয়। ইশ, রীতুকে যদি সে কথাটা বোঝাতে পারতো! কেমন আছে এখন মেয়েটা? যে গভীর ভালবাসায় মেয়েটি তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, একই ভালবাসা কি এখন তার স্বামীকেও সে দিতে পারে?
শুনেছে শান্তিনগরের দিকে কোন এক অ্যাপার্টমেন্টে সে সংসার পেতেছে। সে এখন পারতপক্ষে শান্তিনগরের দিকে যায় না। মেয়েটির মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস এখন আর তার নেই।

আজকে এইমাত্রই তার বস তাকে ইমেইলে জানালো সিনিয়ার ফাইন্যানসিয়াল অ্যানালিস্টের পজিশনের জন্য ম্যানেজমেন্ট তাকেই নির্বাচিত করেছে। সেই দুই সপ্তাহ আগে ইন্টারভিউ নেয়া হয়েছিল। ইন্টার্নাল এমপ্লয়ী ছাড়াও আরো অনেক বাইরের লোকেরও ইন্টারভিউ নেয়া হয়েছে। সে প্রায় আশাই করেনি এই পজিশনে সে নির্বাচিত হবে।
এখন চাকরিতে তার প্রমোশন হয়েই গেল! আজকে তার জন্য একটি বিরাট আনন্দের দিন। ঠিক এই সময়েই কেন হঠাৎ করে পুরনো ঘটনার স্মৃতি মনে ফিরে এলো?

আসিফ রিসিভার তুলে নম্বর ডায়াল করে বাসায় ফোন করে। তিন রিংয়ের মাথায় মা ফোন ধরেন।
"হ্যালো মা?"
"কিরে? তুই হঠাৎ এইসময়ে ফোন দিলি যে? কোন সমস্যা হয়েছে?"
"না মা। বাবা কি করছেন?"
"পত্রিকা পড়ছেন।"
"একটু ফোনটা দিবে?"
"কেন? খারাপ কিছু হয়েছে নাকি?"
"একটু দাও না।"
মা গিয়ে বাবাকে ডেকে আনলেন। আসিফ রিসিভার কানে ঠেকিয়ে বসে রইলো। বাবা এসে ভারী গলায় বললেন, "হ্যালো।"
"বাবা! আমার প্রমোশন হয়েছে বাবা! আজকে তোমার ছেলের প্রমোশন হয়েছে! আজকে থেকে আমি সিনিয়র ফাইন্যানসিয়াল অ্যানালিস্ট!"
কথাটা বলতে বলতে আসিফের গলা ধরে এলো। ওপাশে বাবার অনুভূতি সে বুঝতে পারছে না। তার নিজের গলা বারবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। আনন্দে বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে।
অফিসের অন্যান্য কলিগরা কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সবাই অবাক। হঠাৎ তাঁদের কলিগের কি হয়ে গেল।
সালাম সাহেবেরও বুকটা হঠাৎ করেই হালকা হয়ে গেল। বহুদিন ধরে চেপে থাকা পাথরটা যেন আজকে আপনাতেই নিচে নেমে গেল। তাঁর ছেলের কাজে পদোন্নতি হয়েছে। আজ যে তাঁর অনেক গর্বের দিন!
ছেলে বোধয় কাঁদছে। আরে বোকা ছেলেটা কাঁদছে কেন? আজকে কি কাঁদলে চলবে?
তিনি নিজের চোখ মুছতে মুছতে সেই বহুযুগ আগের মত উৎফুল্ল কন্ঠে বললেন, "বাসায় চলে আয় বাবা! আজকে বাপ ব্যাটা মিলে দুপুরে একসাথে ভাত খাই!"
https://www.facebook.com/groups/canvasbd/
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ২:২৫
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×