somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাজাকারের ফাঁসী!

২০ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
জীবনে প্রথম যেদিন ঢাকা চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম সেদিন অজগরের খাচার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভিতরে একটা সাদা খরগোশ ছেড়ে দেয়া হয়েছিল, সাপের লাঞ্চ আইটেম। বিশাল অজগর জিভ লকলকিয়ে হিস হিস করছে, কিন্তু খরগোশ বেচারা সেই তুলনায় একদমই ছটফট করছেনা। প্রথম দিকে করুন দৃষ্টিতে খাচার বাইরের দর্শকদের দিকে তাকাচ্ছিল। তারপর হয়তো যা বুঝার তা বুঝে নিয়তি মেনে নিয়েছে।
আমার বয়স তখন খুবই কম। ক্লাস থ্রিতে পড়ি। এই বয়সী শিশুরা ভয়াবহ আবেগী হয়। খরগোশটার জন্য মায়ায় বুক ভরে গেল। কী সুন্দর সাদা ধবধবে দেহ, তুলার বালিশের মতন নরম শরীর। ইচ্ছা করছিল খাচার দরজা ভেঙ্গে অজগরের ফণা থেকে তাকে উদ্ধার করি।
মানুষ খুব আগ্রহ নিয়ে খাদ্যগ্রহন দৃশ্য দেখার অপেক্ষা করছে। অজগর ধীরে ধীরে এগিয়ে খুব কাছাকাছি এসে মুখ হা করলো।
আমি খাচার সামনে থেকে সরে গেলাম।
২.
যুথীকে যেদিন মিলিটারী ক্যাম্পে পাঠানোর জন্য তাঁর বাড়ি থেকে তুলে আনা হলো, সে পাড়ার শান্তি কমিটির সদস্য মনিরুজ্জামানের পায়ে ঝাপিয়ে পড়ে বলেছিল, "চাচা, আমি শেফালির বান্ধবী চাচা!"
শেফালী হচ্ছে মনিরুজ্জামানের বড় মেয়ে। "আমি আপনার বাড়িতে খেলেধুলে বড় হয়েছি। আপনার স্ত্রী আমাকে তাঁর আরেক মেয়ে ডাকেন। আপনি নিজেও আমাকে "মা" ডাকেন! আমার উপর দয়া করেন চাচা! আমাকে ওদের হাতে তুলে দেবেন না।"
মনিরুজ্জামান নির্বিকারভাবে যুথীর বুক বরাবর লাথি মেরে তাঁর হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে। তারপর অতি বিরক্ত স্বরে নিজের লোকেদের তিরস্কার করে, "এই জব্বার! সকালে ভাত খাস নাই? একটা মাইয়ারে সামলাইতে পারোস না, কিয়ের মর্দ তুই?"
জব্বার এসে যুথীকে জাপ্টে ধরে। উপস্থিত মিলিটারী জোয়ানেরা খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। ক্যাপ্টেন সাহেবের ইস্তেমালের পর এই মালতো তারাও ব্যবহার করতে পারবে। সেই খুশিতেই ঠোটের ফাঁক দিয়ে দাঁত ঝিলিক দিয়ে উঠে।
আশেপাশে বেশ কিছু পাড়াপ্রতিবেশী নিজনিজ অবস্থান থেকে এই দৃশ্য দেখলেন। কেউ কেউ বিষন্ন হলেন, কেউ রাগ চেপে রাখলেন, কেউ বা হলেন আমোদিত।
যুথী চিড়িয়াখানার ঐ খরগোশটার মতন হাল ছেড়ে দিল। অজগর তাঁরও সামনে এসে হা করলো।
৩.
পত্রিকায় খবর ছেপেছে, "গত রবিবার রাতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন অংশে একদিক্রমে কয়েকটি সফল অভিযান চালিয়ে বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে। এ ব্যপারে কয়েক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দেশপ্রেমিক নাগরিকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই অভিযানগুলো চালানো হয়।"
একাত্তুরের সেই অভিশপ্ত ২৯-৩০ অগাস্ট। বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শহীদ আলতাফ মাহমুদ, শহীদ বদি, শহীদ রুমি, শহীদ জুয়েল, শহীদ আজাদসহ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। ফিরে আসেনি তাঁরা। এই সমস্ত দেশপ্রেমিক নাগরিকরাই গভীর রাতে মিলিটারী ক্যাম্পে গিয়ে নিজ হাতে ওদের খুন করেছিল। জানোয়ারেরা লাশগুলোকে পর্যন্ত স্বজনদের হাতে তুলে দেয়নি। এক মা জানতেনই না কোথায় তাঁর সন্তানের কবর হয়েছে। তাই তিনি বাকি জীবন স্যান্ডেল পরেননি। সন্তানের কবরকে জুতা দিয়ে মাড়ানোর মতন নিষ্ঠুর তিনি হতে পারেননা।
পত্রিকা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মন থেকে অভিশাপ দিলেন শহীদ রুমির মা, "হে আল্লাহ! এই সমস্ত দেশপ্রেমিক নাগরিকদের জন্য তোমার ভয়াবহ, নিকৃষ্টতম হাবিয়া দোজখও যেন যথেষ্ট না হয়!"
শহীদ আজাদের মা ভাত খাওয়াই ছেড়ে দিলেন। ছেলের জন্য ভাত নিয়ে গিয়ে আর ছেলের দেখা পাননি। জীবনের শেষ চৌদ্দটা বছর সেই মা শক্ত মেঝেতে ঘুমিয়েছেন, কারন ছেলে অন্তিম মুহূর্তে বিছানা পায়নি। এই দুই মায়ের কথা আমরা জানি কারন বইয়ে পড়েছি। বাকিদের কী হয়েছিল?
হয়তো সেই চিড়িয়াখানার খরগোশের মতন অজগরের হা করা মুখের সামনে তাঁরাও হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন।
৪.
ষোলই ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে চারটা থেকে লাখ লাখ স্বজন অপেক্ষা করেছেন তাঁদের প্রিয়জনেরা ফিরে আসবেন। কেউ ফিরেছেন, বেশিরভাগই ফেরেননি। অশ্রুসিক্ত নয়নকে পাথর করে তাঁদের দেখতে হয়েছে তাঁদেরই স্বজনদের খুনিদের আমরা রাজ গদিতে বসিয়েছি, জননেতা বানিয়েছি, কোটিপতি বানিয়ে সমাজের মাথায় তুলে কড়জোরে জ্বী হুজুরি করেছি।
চল্লিশটা বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁরা শুধু দর্শক হিসেবে দেখেছেন। কেউ চোখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, কেউ খাচা থেকেই দূরে সরে গেছেন। আবার কেউ বা এই সময়ে দাঁত ক্যালিয়ে অজগরের ফুলে ওঠা পেশী দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।
এখন যখন কলংকের দাগ মুছতে শুরু করেছে - আফসোস হয় এই দেখে যে খাচার বাইরে দাঁত ক্যালানো দর্শকের সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। দেশের সবচেয়ে বড় শত্রুর যখন বিচারের রায় ঘোষণা করা হয়, তখন দেশে বিক্ষোভ ও নাশকতার আশংকা করা হয়! দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল অফিসিয়াল বিবৃতি দেয় "আমরা ন্যায় বিচার পাইনি - আমরা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার!"
এবং তারচেয়েও বড় আফসোস, দলকানারা চোখ বন্ধ করে এই দাবির সমর্থন করে। তারা বলে, যা হবার তা হয়েছে, এখন শুধু শুধু এতদিন পর এ নিয়ে টানা হ্যাচরা কেন?
আমি অবাক হই, নিজের পিতা বা সন্তানের খুনিদের ব্যপারে কী এই কথা বলতে পারতো? বা নিজের মায়ের ধর্ষককে ক্ষমা করতে পারতো?
রাজাকারের বিচার চাইতে হলে আপনাকে আওয়ামী দালাল হতে হবেনা। রাজাকারের বিচার চাইতে হলে আপনাকে শেখ হাসিনার সমর্থক হতে হবেনা। বরং এই জানোয়ারদের বিচার চাইতে হলে কেবল বাংলাদেশী হওয়াটাই যথেষ্ট। দেশটাতো আপনার-আমার তাই না? এখনওতো কোন দলের কাছে বেঁচে দেইনি।
আপনি যদি বাংলাদেশী হয়ে থাকেন, আপনি যদি বাংলায় কথা বলে থাকেন, এবং আপনি যদি দেশদ্রোহী না হন, তবে অবশ্যই আপনার উচিৎ এই সমস্ত অজগরদের ফাঁসির দাবিতে মিছিল করা।
নাহলে সবুজ পাসপোর্টটা ফেলে দিয়ে অন্য কোথাও শিফট হবার চেষ্টা নিন। তখনই বুঝতে পারবেন, প্যায়ারা মূলকের সরকার আপনার মতন আবর্জনাকে নিজের দেশে নিতে কতটা আন্তরিক!
আমার দেশের একটা বিরাট জনগোষ্ঠির প্রতি আফসোস, কবে যে আমরা এই সাধারণ ব্যপারটা উপলব্ধি করবো!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৪১
৩৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×