ইসলামের পর্দা প্রথা নিয়ে অনেক সময়েই অনেক আজগুবি কথাবার্তা শুনি। দুইপক্ষ থেকেই। এবং কিছু বলতে গেলে উল্টা শুনতে হবে, "আপনি কেন মনে করছেন আপনিই সব সঠিক জানেন? অথেন্টিক সোর্স থেকে আমিও পড়েছি।"
এরপরে আর তর্ক করার রুচি থাকেনা। তাছাড়া আমার স্বভাবও ঝগড়া করার না। আমার যা জানা আছে তার উপর ভিত্তি করে কিছু কথা বলবো। মানলে মানবা, না মানলে নাই। আমার কিছুই যায় আসেনা।
এতে অনেকেই মনে করে তর্কে হেরে গিয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছি।
ভাবতে পারেন। আমার তাতেও কিছুই যায় আসেনা। আপনার সাথে কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া ছাড়াও আমার জীবনে আরো অনেক জরুরি কাজ আছে।
তো যা বলছিলাম, ইসলামে মেয়েদের পর্দা নিয়ে অনেক কঠিন কঠিন কথাবার্তা শুনি। আজগুবি সেসব কথাবার্তার কয়েকটা উদাহরণ হচ্ছে, মেয়েদের ঘরের কোণে পরে থাকতে হবে। বের হওয়া নিষেধ। পর পুরুষের সাথে কথা বলা নিষেধ। বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার তাঁদের নেই। বাপ/ভাই যেই খুটায় দড়ি বেঁধে দিবে, চুপচাপ সেখানেই ঘাস খেতে হবে। ইত্যাদি।
তা আমি আবার নবী রাসূল এবং সাহাবাদের জীবনী থেকে উদাহরণ দিতে পছন্দ করি। আমার ধারণা, তাঁদের চেয়ে ইসলামিক জ্ঞান কেউই রাখেনা।
তা নবীজির (সঃ) জীবনী থেকে আমরা কী পাই? তিনি যতটা বিয়ে করেছেন, প্রত্যেকটাতে হবু স্ত্রীর সাথে সরাসরি কথা বলেছেন। সরাসরি তাঁদের মত নিয়েছেন। এবং তাঁরা রাজি হবার পরেই তাঁদের বিয়ে করেছেন।
উম্মে সালামার (রাঃ) উদাহরণ দেয়া যাক।
উম্মে সালামার স্বামী মারা যাবার সময়ে উম্মে সালামা শপথ নিলেন তিনি আর দ্বিতীয় বিয়ে করবেন না। তাঁর স্বামী মৃত্যুশয্যায় বললেন, "আমার শেষ অনুরোধ তুমি রাখবে?"
স্ত্রী বললেন, "অবশ্যই রাখবো।"
স্বামী বললেন, "তাহলে তুমি অবশ্যই কাউকে বিয়ে করবে।"
তাঁর মাথায় এই চিন্তাই ছিল, তিনি মারা গেলে স্ত্রীর দেখভাল করবে কে? তারপর তিনি দোয়া করলেন, "ইয়া আল্লাহ! তুমি তাঁকে আমার চেয়েও ভাল স্বামী দান করো। যে তাঁকে আমার চেয়েও সুখী রাখবে।"
উম্মে সালামা বললেন, "তোমার চেয়ে ভাল কেউ হবে না।"
তখনকার সমাজ কিন্তু আমাদের বাঙালি সমাজের মতন ছিল না। যেখানে বিধবা মেয়েদের কুফা বিবেচনা করা হয়। ডিভোর্সি মেয়েদের আর বিয়েই হয়না। যদি কোন মেয়ে একের অধিক বিয়ে করে, তখন আড়ালে কানাঘুষা শুরু হয়ে যায়, "বেটির এইটা তিন নাম্বার জামাই।"
সেই সমাজ যথেষ্টই মুক্তমনা ছিল। সিঙ্গেল থাকার কনসেপ্টই বরং ছিল রেয়ার ঘটনা। একজন নারীর স্বামী মারা গেছে, তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে আরও অনেক খানি সময়। এই সময়টায় তাঁর আরেকজন সঙ্গী নিলে দোষের কিছুই নেই।
কাজেই বিধবা উম্মে সালামার ইদ্দতকালীন সময় পার হবার পরে আবু বকর (রাঃ) নিজের জন্য তাঁর হাত চাইলেন। উম্মে সালামা (রাঃ) অতি ভদ্রতার সাথে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন।
তার অনেকদিন পরে নবীজি (সাঃ) নিজের জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন।
উম্মে সালামা বললেন, "আমার তিনটা শর্ত আছে।"
নবীজি (সঃ) বললেন, "শোনাও তাহলে তোমার শর্ত।"
তিনি বললেন, "আমি একজন নারী, এবং আমার ঈর্ষা রোগ আছে। আমি চিন্তিত এই নিয়ে যে আপনার অন্যান্য স্ত্রীদের প্রতি আমার ঈর্ষা আপনার অসন্তুষ্টির কারন হতে পারে।"
নবীজি (সঃ) বললেন, "আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করবো। তোমার ঈর্ষা রোগ যেন সেরে উঠে।"
"আমার বয়স বাড়ছে। দ্রুতই আমি বার্ধক্যে পতিত হবো।"
"আমিও তোমার মতন একই দুর্যোগে আক্রান্ত।" (তিনি লিটারেলি এই বাক্যটিই বলেছিলেন। তিনি মাঝেমাঝে রসিকতাও করতেন)
"তোমার তৃতীয় শর্ত বলো।"
"আমার পরিবার আছে। তাঁদেরও দায়িত্ব নিতে হবে আপনার।"
"তোমার পরিবার আজ থেকে আমারও পরিবার।"
এবং তারপর চতুর্থ হিজরী সনের কোন এক মাসে উম্মে সালামার সাথে নবীজির (সাঃ) বিয়ে হয়।
এই সেই উম্মে সালামা (রাঃ) যিনি হুদাইবিয়া সন্ধির সময়ে যখন সব ক'জন সাহাবী হতাশ মনে নবীজির নির্দেশ (মাথা কমানোর) পালন করলো না, এবং নবীজি (সঃ) বিষন্ন মনে নিজের তাঁবুতে ফিরে এলেন, তিনি বললেন, "এখন কারোর সাথে কথা বলার প্রয়োজন নেই। আপনি বরং নিজে মাথা কমিয়ে ফেলুন, দেখবেন সবাই আপনাকে অনুসরণ করবে।"
নবীজি (সঃ) স্ত্রীর পরামর্শ শুনলেন। এবং দেখা গেল, বাস্তবেও তাই হলো।
আরেকটা উদাহরণ। হাদীসটির রেফারেন্স দিতে পারবোনা, তবে ওমার সুলাইমানের মুখ থেকে নিজের কানে শোনা - অথেন্টিসিটির উপর ভরসা করা যায়।
একটি নারী নবীজির (সাঃ) কাছে এসে বলেছিলেন, "আমাকে আমার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দেয়া হয়েছে।"
নবীজির (সাঃ) উত্তরে সেই বিয়ে ভয়েড করে দিলেন। যেহেতু "ম্যারেজ কন্ট্রাক্টে" মেয়ের "অনুমতি/সম্মতি" ছিল না, কাজেই সেই কন্ট্রাক্ট নাল অ্যান্ড ভয়েড।
এই কারণেই অ্যামেরিকায় যত নিকাহ পড়ানো দেখি, প্রত্যেকটাতে কাজী মেয়েকে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে বারবার জিজ্ঞেস করেন, "তুমি নিশ্চিত তো যে তোমার উপর কেউ জোর খাটিয়ে এই বিয়ে করাচ্ছে না!"
মেয়ে নিশ্চিন্ত করলে তবেই কাবিন নামায় সই করা হয়।
আরেকটি অথেন্টিক উদাহরণ। বারিরা নামের এক সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত দাসী একবার মদিনার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তাঁর পেছনে তাঁর স্বামী বারবার অনুনয় বিনয় করছিল তাঁর সংসার না ভাঙতে। এবং বারিরা কোন কথাই কানে তুলছিলেন না।
রাস্তার লোকজন মজা দেখছিলেন।
নবীজি (সঃ) তাঁর সাহাবীদের বললেন, "কী অদ্ভুত ঘটনা! মেয়েটির স্বামী যতটা না তাঁকে ভালবাসে, মেয়েটি ততটাই বেচারাকে ঘৃণা করে।"
তারপর তিনি এগিয়ে গিয়ে মহিলাকে বললেন, "বেচারাকে একটা সুযোগ দিয়েই দেখোনা।"
মহিলা বললেন, "এটি কী রাসূলুল্লাহর আদেশ? নাকি উপদেশ?"
নবীজি (সঃ) বললেন, "শুধু পরামর্শ।"
মহিলা তখন রাসূলুল্লাহর (আল্লাহর দূত), মুসলিম বিশ্বের সম্রাট, ইসলামিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের দিকে তাকিয়ে সরাসরি বললেন, "তাহলে আমি আদবের সাথেই এই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করলাম।"
কোন সাহাবী এগিয়ে এসে বলেনি, "বেয়াদব মেয়ে মানুষ! আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) বিরোধিতা করিস! কাফির! নাস্তিক! মুরতাদ!"
এছাড়া হজরত মুসার (আঃ) জীবনীতেও আমরা সেটাই পাই। মাদইয়ানে গিয়ে দুই নারীকে পানি তোলায় সাহায্য করলে পরে দুই বোনের একজন মুসাকে ভালবেসে ফেলেন। বাবার মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান।
উমার (রাঃ) তখন খলিফা। আমিরুল মুমিনীন। তিনি বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন আবু বকরের কন্যা, হজরত আয়েশার বোনের কাছে। উমারকে (রাঃ) ফিরিয়ে দেয়া হলো। কন্যার পাত্র পছন্দ হয়নি।
আয়েশা (রাঃ) অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, "আমিরুল মুমিনীনকে তুমি ফিরিয়ে দিচ্ছ?"
বোন জবাব দিলেন, "উমার একটু বেশিই কট্টর। আমার এত কট্টরতা ভাল লাগেনা।"
তাহলে কী বুঝতে পারলাম?
সাহাবীদের সময়ে সমাজটা তেমন ছিল না যেমনটা আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়।
নারী সাহাবীরা পুরুষ সাহাবীদের সাথে পর্দা করেই মেলামেশা করেছেন। একই মসজিদে, একই কামরায় নামাজ পড়েছেন। হ্যা, গা ঘেষাঘেষি, হাতাহাতি, হাগাহাগি, কিসাকিসি ইসলামে কোন কালেই ছিল না। সেটা এখনও নেই। এছাড়া হজরত আবু বকর - উমারকেও ফিরিয়ে দেয়ার অধিকার/ক্ষমতা নারীদের ছিল।
কাজেই "মেয়েদের পুরুষদের সাথে মেলামেশা হারাম" "বিয়ের ব্যাপারে মেয়েদের নিজস্ব কোন মতবাদ নেই" বা "স্বামীকে কোন পরামর্শ দেয়ার অধিকার স্ত্রীরা রাখেনা" জাতীয় আজগুবি কথাবার্তা বলবার আগে দয়া করে একটু পড়াশোনা করে নিবেন।
এবং মুক্তিযুদ্ধের অথেন্টিক সোর্স হিসেবে যদি ইয়াহিয়া খানের জীবনীকে দাবি করেন, তাহলে আপনার মুখ না খোলাই ভাল। সেক্ষেত্রে আমি কোন তর্ক করবো না। আপনি ভাবতে পারেন আমি লেজ গুটিয়ে পালিয়েছি। বাস্তবে আমার কিছুই যায় আসেনা।
ধন্যবাদ।