somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাসূলের (সা.) ভূমিকাসমূহ – ৩

২৯ শে জুন, ২০১০ দুপুর ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[এই পোস্টটা, যারা seriously ইসলাম সম্বন্ধে জানতে চান, তাদের জন্য। আমরা যখন প্রায় "নাস্তিক" একটা মস্তিষ্ক নিয়ে বড় হচ্ছিলাম, তখন চাইলেও ইসলাম সম্বন্ধে জানার তেমন সুযোগ ছিল না - বলা যায়: আজকের মত সহজলভ্য source বা resource কোনটাই তখন ছিল না। আজ তাই যারা "searching souls" - তাদের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছে দিতে বড় ইচ্ছা করে।]

এই সিরিজের আগের লেখাটা রয়েছে এখানে:
www.somewhereinblog.net/blog/mariner77/29183267
www.somewhereinblog.net/blog/mariner77/29183982

আমরা ইনশাল্লাহ্ রাসূল (সা.)-এঁর ৪টি প্রধান ভূমিকা সামনে রেখে আলোচনা করবো :

১)কুর’আনের ব্যাখ্যাকারী
২)স্বনির্ভর আইনপ্রণেতা
৩)নিখুঁত উদাহরণ

এবং
৪)যার আনুগত্য করতে হবে এমন ব্যক্তি।

(১)
কুর’আন ব্যাখ্যাকারী হিসেবে নবী মুহাম্মদ (সা.)

(দ্বিতীয় পর্বের ধারাবাহিকতায়, পরবর্তী অংশ)
…….

(ছছ) নবী (সা.) এমন বক্তব্য রেখেছেন যেগুলোর অর্থ কুর’আনের আয়াতসমূহের মতই – যেগুলো কুর’আনের বক্তব্যকে জোরদার করে এবং আরো পরিষ্কার করে দেয়

আল্লাহর রাসূল (সা.) তাঁর নিজের বক্তব্য দ্বারা কুর’আনের বহু আয়াতের অর্থের উপর আরো জোর দিয়েছেন এবং গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অর্থাৎ তাঁর বক্তব্যের অনেকগুলোই এমন, যেগুলোর অর্থ কুর’আনের কিছু আয়াতের সাথে অভিন্ন। এবং সেগুলো হয় কোন আয়াতের অর্থকে কেবল জোরদার করেছে অথবা অতিরিক্ত ব্যাখ্যা করেছে। এটা এক ধরণের তাফসীর বা ব্যাখ্যা। কেননা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা অথবা গুরুত্ব আরোপ করে বলাতে একটা সত্য আরো সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এবং যখন একই বক্তব্য ভিন্ন শব্দাবলীতে প্রকাশ করা হয় তখন তা আরো পরিস্কার হয়। উদাহরণস্বরূপ আল্লাহ কুর’আনে বলেন:

“আখিরাতের তুলনায় এই জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নগন্য।” (সূরা তাওবা, ৯:৩৮)

এই আয়াতের ভাবার্থ আরো গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে যখন নবী (সা.) বলেন, “আল্লাহর শপথ, আখিরাতের তুলনায় এই পৃথিবীর তুলনা হচ্ছে, তোমাদের কেউ এই আঙ্গুল – এবং ইয়াহিয়া (বর্ণনাকারী) তাঁর তর্জনী দেখালেন – এক সমুদ্রে ঢুকালো এবং তার পরে উঠিয়ে নিয়ে দেখলো তার সাথে কতটুকু উঠে এসেছে। (সেটুকুর সাথে সমুদ্রে যা রয়ে গেল সেটুকুর যে তুলনা তেমন)।” (মুসলিম)

আরেকটি আয়াতে আল্লাহ বলেন:

“অবশেষে যখন তারা জাহান্নামের কাছে পৌঁছবে তখন তাদের কান, চোখ, ত্বক তাদের কৃতকর্ম সম্মন্ধে তাদের বিরুদ্ধে স্যা দেবে।” (সূরা ফুসসিলাত, ৪১:২০)

সে সময় ঠিক কি ঘটবে, তা সহীহ মুসলিমের নিম্নলিখিত হাদীসটি থেকে পরিস্কারভাবে বোঝা যায়:
আনাস ইবন মালিকের (রা.) বর্ণনা থেকে এসেছে যে, “আমরা আল্লাহর রাসূলের (সা.) সাথে ছিলাম এবং তিনি হেসে উঠলেন। তিনি বললেন, ‘তোমরা কি জান আমার হাসি পেল কেন?’ আমরা বললাম, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সবচেয়ে ভাল জানেন।’ ‘মানুষ তার প্রভুকে কি বলবে সেটা মনে করে (আমি হাসলাম)। সে বলবে, ‘হে আমার প্রভু, আপনি কি কথা দেননি যে কোন অবিচার করবেন না?’ তিনি বলবেন, ‘নিশ্চয়ই’। সে তখন বলবে, ‘আমি কেবল আমার মধ্য থেকে ছাড়া আর কোন সাীর আমার বিরুদ্ধে স্যাদানে সন্তুষ্ট হবো না’। তিনি বলবেন, ‘আজ তোমার বিরুদ্ধে তোমার নিজের নাফসই সাী হিসাবে যথেষ্ট হবে, ঠিক যেমন নাম লিপিবদ্ধকারী মহান সাীগণ।’ তিনি তখন বলবেন, ‘এর মুখ বন্ধ করে দাও।’ তারপর তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বলা হবে, ‘কথা বলো।’ তখন সেগুলো তার কর্মকান্ড সম্মন্ধে বলতে শুরু করবে। তখন ঐ ব্যক্তিকে আবার কথা বলতে দেওয়া হবে এবং সে তার নিজের হাত-পাকে বলবে, ‘দূর হয়ে যাও। তোমাদের উপর আল্লাহর লা’নত পড়–ক। তোমাদের প হয়ে আমি ফরিয়াদ করছিলাম।’ ” (মুসলিম)

(জজ)নবী (সা.) এমন সব ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করে গেছেন যেগুলোর কুর’আনে উল্লেখ নেই

বহু ক্ষেত্রেই কুর’আনে উল্লেখ রয়েছে এমন ব্যাপারে নবী (সা.) আরো বেশী পরিমাণ তথ্য সরবরাহ করে গেছেন। উদাহরণস্বরূপ কিয়ামতের দিন কি ঘটবে, জাহান্নামের আগুন কেমন হবে ইত্যাদি বিষয়ে নবী (সা.) অতিরিক্ত বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে গেছন, কিন্তু এমন দুটি উদাহরণ রয়েছে যা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবী রাখে।

সূরা কাহাফের ৬০ থেকে ৮২ নং আয়াতে আল্লাহ খিজির (আ.) এবং মূসা (আ.)-এঁর কাহিনীর বর্ণনা দেন। নবীও (সা.) এই ঘটনা নিয়ে আলাপ করেন। কিন্তু নবীর (সা.) বর্ণনায় এমন অনেক বিস্তারিত খুঁটিনাটি রয়েছে, যেসব কুর’আনে পাওয়া যাবে না। উদাহরণস্বরূপ নবীর (সা.) বর্ণনার শুরু হয় এইভাবে:
“মূসা ইসরাইলী গোত্রের সামনে একটা বক্তৃতা দিতে দাঁড়ান এবং তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘মানুষের মাঝে সবচেয়ে জ্ঞানী কে?’ মূসা উত্তর দিলেন, ‘আমি।’ জ্ঞানের জন্য [তথ্যের জন্য] কেবল আল্লাহর উপর নির্ভর না করার জন্য আল্লাহ তাঁকে তিরস্কার করলেন। তাই আল্লাহ তাঁর কাছে ওহী নাযিল করলেন: ‘দুইটি সাগরের সন্ধিস্থলে আমাদের এক বান্দা রয়েছে, যে তোমার চেয়ে জ্ঞানী।’ মূসা বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমি কিভাবে তাঁর সাক্ষাৎ পেতে পারি?’ আল্লাহ বললেন, ‘একটা মাছ নাও এবং সেটাকে একটা ঝুড়িতে ভর আর তারপর যাত্রা শুরু কর…..।”

এখানে আল্লাহর রাসূল (সা.) ব্যাখ্যা করেছেন যে, কেন মূসা খিজির (আ.)-এঁর খোঁজে বেরিয়েছিলেন এবং কুর’আনের এই সূরায় উল্লিখিত মাছের মাহাত্যই বা কি? এই ভূমিকার মতোই, কুর’আনে বর্ণিত এই ঘটনার সাথে নবী (সা.) বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী তথ্য সরবরাহ করেছেন। এই কাহিনীর উপর মন্তব্য করতে গিয়ে মুহাম্মাদ আল সিদ বলেন,
“এই হাদীস এবং আরেকটি হাদীস যেখানে নবী (সা.) বলেন, ‘আমকে কিতাবখানি এবং যা তার সদৃশ তা দান করা হয়েছে’ – প্রতীয়মান করে যে কুর’আনের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে তাঁকে বিস্তর জ্ঞান দান করা হয়েছিল। এর ফলে কেবল তাঁকে কুর’আনের বিস্তারিত ব্যাখ্যার ব্যাপারে একটা একক কর্তৃত্ব দান করা হয়েছিল - কুর’আনে উল্লেখ করা হয়নি এমন সত্য খুঁটিনাটি যোগ করার মাধ্যমে। তাঁর তাফসীরের (বর্ণনার) তাই একটা অদ্বিতীয় মর্যাদা রয়েছে…..।”
এ ধরনের আরেকটি চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে সূরা বুরুজের ঘটনাবলী এবং সে সম্বন্ধে নবীর (সা.) বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহীহ মুসলিমে লিপিবদ্ধ রয়েছে, যেখানে আল্লাহয় বিশ্বাস করার জন্য একদল মানুষকে একটা গর্তে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এ ছাড়াও আল্লাহর রাসূল (সা.) এমন অনেক অভিব্যক্তির অর্থ ব্যাখ্যা করে গেছেন যেগুলো কুর’আন থেকে স্পষ্ট হয়না। উদাহরণস্বরূপ সূরা ফাতিহার ব্যাপারে আল্লাহর রাসূলের (সা.) ব্যাখ্যা করে গেছেন যে, যাদের উপর আল্লাহর ক্রোধ পতিত হয়, তারা হচ্ছে ইহুদী সম্প্রদায় এবং যারা বিপথগামী হয়েছে তারা হচ্ছে খৃষ্টান সম্প্রদায়।
এই কথাগুলো কেবল সূরা ফাতিহার সংশ্লিষ্ট আয়াত পড়ে কিছুতেই জানা যায় না। কিন্তু যেহেতু নবী (সা.) তা ব্যাখ্যা করে গেছেন, তারপরে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, ঐ আয়াতে তাদের কথাই বলা হয়েছে।

(ঝঝ)কুর’আন বুঝতে গিয়ে নবীর (সা.) জীবন বৃত্তান্তের শরণাপন্ন হওয়া

আরো একটা বিবেচ্য বিষয় রয়েছে, যা আমাদের দেখিয়ে দেয় যে, সঠিকভাবে কুর’আন বুঝতে হলে আমাদের নবীর (সা.) জীবনবৃত্তান্ত ও সুন্নাহর শরণাপন্ন হতে হবে। আরেকভাবে বলতে গেলে, যে কুর’আন বুঝতে চাইবে – তার জন্য আল্লাহ, নবীর (সা.) সুন্নাহ ও তাঁর জীবনবৃত্তান্ত সম্বন্ধে একটা ভাল জ্ঞান অর্জনকে অপরিহার্য করে দিয়েছেন। কেননা তা করতে না পারলে, কুর’আনের বহু আয়াতের অর্থ অবোধ্য রয়ে যাবে। এ সম্মন্ধে বলতে গিয়ে হাবিবুর রহমান আজামী বলেন:

“কুর’আন ছাড়া যদি আর কোন নিশ্চিত জ্ঞানের উৎস না থেকে থাকে এবং নবীর (সা.) কাছ থেকে আসা বর্ণনাগুলো যদি অনির্ভরযোগ্য বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়, তবে কুর’আনের বহু আয়াতের অর্থ ও গুরুত্ব অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ কুর’আন বলে, ‘আর যায়েদ যখন তার কাছ থেকে তালাকের প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতাগুলো সম্পন্ন করলো, আমরা তখন তাকে তোমার কাছে বিয়ে দিলাম।’ (আল-আহযাব, ৩৩,৩৭)। সুন্নাহ বা হাদীসের শরণাপন্ন না হয়ে এবং সেসবের উপর আস্থা স্থাপন না করে এই আয়াতের পূর্ণ গুরুত্ব কি কখনো অনুধাবন করা যাবে? অথবা কেবল কুর’আন থেকে কি এটা কখনোই জানা সম্ভব যে যায়েদ কে ছিলেন, তাঁর স্ত্রী কে ছিলেন এবং সত্যি সত্যি কি ঘটেছিল…..।
একইভাবে হাদীসের গোটা ভান্ডারকে যদি অপ্রয়োজনীয় ও অনির্ভরযোগ্য বলে বাতিল করে দেয়া হয় তবে আহযাব, হুনায়েন ইত্যাদি যুদ্ধ সম্বন্ধে কুর’আনে যেসব ঘটনা উল্লিখিত রয়েছে সেগুলোর বিস্তারিত জানার কি আর কোন উপায় থাকবে? আবারও আমরা কুর’আনে পড়ি: ‘এবং আল্লাহ তোমাদের কাছে দুইটি বাহিনীর একটি যে তোমাদের হবে [অর্থাৎ তোমাদের নিকট পরাজিত হবে] সে সম্বন্ধেও অঙ্গীকার করেছিলেন (আন-আনফাল, ৮:৭)। কেউ কি কেবল কুর’আন থেকে বলতে পারবেন যে ঐ দুটি বাহিনী কি কি ছিল? এই অঙ্গীকার ঠিক কি ছিল কুর’আনের কোথাও কি বর্ণিত হয়েছে ? কুর’আনে যদি তা না থেকে থাকে তাহলে নবীর (সা.) কাছে আরেক ধরণের ওহী প্রেরীত হওয়াটা কি আবশ্যিক নয় ?
(এ ধরণের বেশ কিছু উদাহরণ দেওয়ার পর আজামী উপসংহারে বলেন): এগুলো হচ্ছে কতিপয় উদাহরণ এবং এ ধরণের আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যেতো। আমরা এখানে দেখাতে চেয়েছি যে, কুর’আনের বহু আয়াতের অর্থ বোঝা বা ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতো যদি হাদীসসমূহকে, অপ্রয়োজনীয় ও অনির্ভরযোগ্য বলে আমরা অস্বীকার করতাম।”

(ঞঞ)কুর’আনের ব্যাখ্যাকারী হিসাবে নবীর (সা.) ভূমিকার ব্যাপারে উপসংহার

কুর’আনের ব্যাপারে নবীর (সা.) কর্মকান্ডকে নিম্নলিখিত পয়েন্টগুলো দ্বারা সংক্ষেপে প্রকাশ করা যায়:

১) কুর’আনের সাধারণ এবং সুনির্দিষ্ট আদেশসমূহকে ব্যাখা করা। বহু সাধারণ বক্তব্যকে এবং অনির্দিষ্ট আদেশকে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া।
২) কুর’আনের আদেশ-নিষেধের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা এবং প্রয়োগ বুঝিয়ে দেয়া।
৩) এমন কিছু বাক্যাংশের সঠিক অর্থ প্রদান করা যেগুলোর অর্থগুলো জটিল ছিল অথবা যেগুলোর বহু সম্ভাব্য অর্থ ছিল, সেই সাথে কুর’আনের আয়াতসমূহের ব্যাপারে বিদ্যমান ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে সেগুলোকে শুদ্ধ করে দেয়া।
৪) অতিরিক্ত অনুশাসন এবং আইন-কানুন প্রদান করা যেগুলো কুর’আনে পাওয়া যায় না, কিন্তু যেগুলো দ্বীন ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ।
৫) কোন আয়াতগুলো মানসুখ [বাতিল] হয়ে গেছে এবং কোনগুলো হয়নি সেটা ঠিক করে দেয়া।
৬) তাঁর নিজের বক্তব্য দ্বারা কুর’আনের বহু আয়াতের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা এবং জোর দেয়া। কুর’আনে উল্লেখ করা ঘটনাবলীর বিস্তারিত খুঁটিনাটি বর্ণনা করা।

এছাড়াও নবীর (সা.) জীবনের বহু ঘটনা ও দিকের কথা কুর’আনে যেভাবে উল্লিখিত হয়েছে, সে সম্মন্ধে কোন সত্যিকার ধারণা লাভ করতে হলে যে কাউকেই নবীর (সা.) জীবনবৃত্তান্ত ও সুন্নাহর একটা ন্যূনতম জ্ঞান লাভ করতে হবে।
সত্যিকার অর্থে কুর’আন অনুযায়ী কিভাবে জীবন যাপন করতে হবে, তা জানতে চাইলে মুসলিমদের যে অবশ্যই তাঁর সুন্নাহর ভিতর তা খোঁজ করতে হবে, তার প্রমাণ স্বরূপ কুর’আনে আরো একটি নিদর্শন রয়েছে। এ ব্যাপারে কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই যে, কুর’আনে আল্লাহ যে জীবন-পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন, সেটাই হচ্ছে সিরাতুল মুস্তাকীম – আল্লাহর সন্তুষ্টি বয়ে আনবে এমন একটি জীবন পদ্ধতি। কিন্তু একই সময় আল্লাহ বলেন:
“যে আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহকে বেশী বেশী আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহর রাসূলের (সা.) মাঝে নিশ্চয়ই তার জন্য এক চমৎকার উদাহরণ রয়েছে।” (সূরা আহযাব, ৩৩:২১)

যখন আল্লাহ ঘোষণা করেন যে, আল্লাহর রাসূল (সা.) হচ্ছেন মুসলিমদের অনুসরণ করার যোগ্য শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, তখন সেটা আল্লাহর তরফ থেকে এমন একটা ঘোষণা যে, আল্লাহর রাসূল (সা.) আসলে সিরাতুল মুস্তাকীমে রয়েছেন – যে পথটার ব্যাপারে রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। অথবা অন্য কথায় এর অর্থ হচ্ছে এরকম যে, আল্লাহর রাসূলের (সা.) জীবন পদ্ধতি বা সুন্নাহই হচ্ছে কুর’আনের শিক্ষা অনুযায়ী এক জীবন পদ্ধতি। মূলত আল্লাহ এখানে বিশ্বাসীদের বলছেন, “তোমরা যদি দেখতে চাও যে কিভাবে শুদ্ধভাবে ও সর্বোত্তম উপায়ে কুর’আন প্রয়োগ করতে হয়, তবে আল্লাহর রাসূলের (সা.) উদাহরণের দিকে তাকিয়ে দেখ।” আমরা যেমন আগে আলোচনা করেছি, এই একই কথা নবীর (সা.) স্ত্রী আয়েশার (রা.) কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছে, নবীর (সা.) চরিত্র সম্মন্ধে জিজ্ঞাসা করা হলে যখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “তাঁর চরিত্র হচ্ছে কুর’আন।”
সারকথা হচ্ছে নবী (সা.) ছিলেন কুর’আনের বাস্তব প্রয়োগ, ‘এক চলমান কুর’আন’- যেমনটা বলে কেউ কেউ তাঁকে সম্বোধন করতেন। আল্লাহ আরো বলেন:

“এবং নিশ্চয়ই তুমি (হে মুহাম্মাদ, মানুষকে) সঠিক পথের দিক নির্দেশনা দাও। সেই আল্লাহর পথ, আকাশমন্ডলীতে যা কিছু আছে এবং পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার সবকিছুই যাঁর। আল্লাহর কাছেই কিভাবে সব বিষয় পৌঁছে সেটা ল্য কর।” (সূরা শূরা, ৪২:৫২~৫৩)
এবং আল্লাহ বলেন:

“যেমন আমি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য একজন রাসূল পাঠিয়েছি, যিনি তোমাদের কাছে আমাদের বাণীসমূহ পাঠ করবেন এবং তোমাদের পবিত্র করবেন এবং তোমাদের শিা দেবেন কিতাব ও প্রজ্ঞা, এবং শিা দেবেন এমন বিষয় যা তোমরা জানতে না।” (সূরা আল-বাক্বারা, ২:১৫১)

উপরে আমরা সূরা শূরার (৪২:৫২-৫৩) যে আয়াতগুলো উদ্ধৃত করেছি সেখানে আল্লাহ বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) সরল পথের দিক নির্দেশনা দেন। পবিত্র কুর’আনে বলা হয়েছে যে, কুর’আন নিজেই যে পথের বর্ণনা দেয় সেটাই হচ্ছে সিরাতুল মুস্তাকীম বা সরল পথ। সুতরাং আল্লাহর রাসূল (সা.) এবং কুর’আন উভয়ে মুসলিমদের এক ও অভিন্ন সরল পথ দেখাচ্ছেন ও দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন, যা যে কাউকে আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে নিয়ে যায়। আর তাই তাদের একে অপরের সাথে সহাবস্থান করতে হবে এবং যে কাউকে তাদের উভয়কেই একত্রে পথ নির্দেশক হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।
উপরের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত যে, নবীর (সা.) শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া এবং তিনি যেভাবে কুর’আন প্রয়োগ করেছিলেন সেটা জানা ছাড়া, কুর’আনকে শুদ্ধভাবে বোঝা সম্ভব নয়। সেজন্যেই কুর’আনের তাফসীরের সকল বিশেষজ্ঞগণ এ ব্যাপারে একমত যে, কুর’আনের আয়াতসমূহের অর্থ বের করার জন্য প্রথম উৎস হচ্ছে খোদ কুর’আনের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহ। আর দ্বিতীয় উৎসই হচ্ছে নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূলের (সা.) বক্তব্য ও কর্মকান্ডসমূহ, কেননা, নিশ্চিতই, তাঁর মুখ্য ভূমিকার একটি ছিল এই যে তিনি কুর’আন ব্যাখ্যা করবেন এবং সেটাকে এমনভাবে বাস্তব জীবনে প্রায়োগিক রূপ দেবেন, যেমনভাবে জীবনে অনুশীলন করার জন্য তা নাযিল করা হয়েছিল। সাঈদ বিন যুবায়ের যখন রাসূল (সা.) এঁর একটি হাদীস উদ্ধৃত করছিলেন তখন এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এলো এবং বললো, “আল্লাহর কিতাবে এমন কিছু রয়েছে যা তুমি যা কিছু বললে তার চেয়ে ভিন্ন।” সাঈদ তখন উত্তরে বাস্তবিক সত্যই বলেছিলেন, “আল্লাহর রাসূল (সা.), আল্লাহর কিতাব তোমার চেয়ে ভাল জানেন।”

আসলে এই সৃষ্টিতে যে কারো চেয়ে আল্লাহর রাসূল (সা.) আল্লাহর কিতাব ভাল জানেন এবং কেউ যদি দাবী করে যে সে নবীর (সা.) চেয়ে এ ব্যাপারে বেশী জানে বা বোঝে, তবে সে আসলে একজন মুরতাদ। এই আলোচনায় তাফসীরের দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস প্রতিষ্ঠিত হলো: পবিত্র কুর’আন এবং নবীর (সা.) সুন্নাহ। কোন একটি আয়াতের এমন ব্যাখ্যা অনুমোদিত নয় যা এই দুটি উৎসের যে কোনটির সাথে বিরোধপূর্ণ হয়। এটা সত্য, কেননা এই দুটো উৎসই আসলে সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে আসে। এবং কেউই আল্লাহর কিতাবকে, যিনি তা নাযিল করেছন তাঁর চেয়ে ভাল জানেন না। এই দুটো হচ্ছে তাফসীরের নিশ্চিত দুটো উৎস যেগুলোকে ব্যক্তিগত যুক্তিতর্ক বা ইজতিহাদ দ্বারা বিরোধিতা করা উচিত নয়। এ ব্যাপারে আব্দুর রহিম সঠিকভাবেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যখন তিনি বলেন:
“এটা প্রতিষ্ঠিত যে কুর’আনের তাফসীর ও ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নবী (সা.) যা কিছু বলেছেন তা ছিল ওহী এবং যা আল্লাহ তাঁর অন্তরে মুদ্রণ করে দিয়েছিলেন ও জ্ঞান ও বিদ্যার যা কিছু বিশেষভাবে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল তার উপর ভিত্তিশীল। আসলে আল্লাহ তাঁর উপর কুর’আন ব্যাখ্যা এবং তাঁর বাণীর অর্থসমূহ ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন …..। সুতরাং যে কেউ, যিনি কুর’আনের তাফসীর করবেন, তার জন্য এটা অবশ্যকরণীয় যে তার তফসীর যেন রাসূল (সা.) এঁর কৃত তাফসীরের উপর ভিত্তি করে করা হয় এবং তা থেকে তিনি যেন বিচ্যুত না হন – তার পরিবর্তে কেবল আরবী বাক্যের দিকে নজর দিয়ে এর অর্থ বের করতে গিয়ে যেন ইজতিহাদ এবং ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধির শরণাপন্ন না হন। ”

[Page#116~127, The Authority and Importance of Sunnah - Jamaal al-Din M. Zarabozo থেকে অনুদিত।]
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১০ দুপুর ২:০৮
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×