ফ্রিল্যান্সার স্টাইলিস্ট হিসেবে বছর দেড়েক কাজ করার পর আমি এবং আমার বন্ধু মিলে একটি ছোট্ট প্রোডাকশন ইউনিট শুরু করলাম এই সপ্তাহে। উত্তরা ৩ নং সেক্টরের এই ছোট্ট ফ্যাক্টরিতে ৪ জন কর্মী আর কিছু মেশিন নিয়ে আমরা কাজ শুরু করছি। আমাদের এই প্রোডাকশন ইউনিট কে আমরা Design House বলছি, আমাদের কাজ হচ্ছে Personal styling (পোশাকের সাথে হেয়ার স্টাইল, গয়না, ব্যাগ, জুতা আর প্রেজেন্টেশনের পন্থা পর্যন্ত সমন্নয়করণ), Event designing, Bride counseling, Interior decoration - এর সাথে সম্পর্কিত যাবতীয় ‘প্রডাক্ট’ উৎপাদন করা। আমার ফ্রিল্যান্সার জীবন অত্যন্ত আনন্দবহুল ছিল, ফ্রিল্যান্সারের স্বাধীনতা ভোগ থেকে সরে এসে একটা কারখানার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার সাহস করতে আমার যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। কারণ কাজ, ক্যারিয়ার এবং আইডেন্টিটি - এর কোনটাই আমার কাছে কোন অর্থ বহন করে না। আমি একই ধরণের কাজে খুব দ্রুত বিরক্ত হয়ে যাই, তাই যতক্ষণ আনন্দ পাচ্ছি, ঠিক ততক্ষন কাজ, আর বাকি সময় পড়াশোনা, দৌড়-ঝাঁপ, আড্ডা, ঘুম, সিনেমা, দার্শনিক এবং অধিবিদ্যা সম্পর্কিত আলোচনা - এই সব করে জীবনকে মোটামুটি গোল্লায় নিয়ে যেতেই আমার ভালো লাগে। ভবিষ্যৎ নামক ‘idea’ নিয়ে আমার তেমন কোন মাথা-ব্যাথা নেই, আমি সব দিক থেকেই একজন বর্তমান কেন্দ্রিক মানুষ, তবে এপিকিউরিয়ান দর্শনের সাথে আমি অনেকখানি একমত হলেও নিজেকে এপিকিউরিয়ান গোত্রভুক্ত দাবী করতে পারি না, চার্বাক তো নয়-ই। এতোটা অস্থির চিত্ত নিয়ে একটা কারখানার দায়িত্ব আমি কখনই তুলে নিতে পারতাম না যদি এর সাথে একটি আদর্শ এবং স্বপ্ন নিয়ে আমাদের ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করার সামর্থ না থাকতো। ব্যবসায়িক কর্মকান্ডের ফলাফল হিসেবে আইডেন্টিটি বা অর্থের চেয়ে এই এক্সপেরিমেন্টের পরিণাম জানতে আমি অনেক বেশী আগ্রহী।
ব্যবসায়িক আদর্শঃ
একটি তালিকা দিচ্ছি ঠিকই, তবে এমন না যে এটা অপরিবর্ধনীয়। অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং যুক্তির আলোকে নতুন আদর্শ এখানে সংযোজিত হতে পারে। এ মুহূর্তে যে আদর্শবলী নিয়ে এ কারখানাটি শুরু করলাম, তার তালিকাটি এরকম-
১। সরকারকে ঠিকমত কর দেব, ১ টাকা কর ও ফাঁকি দেব না।
২। কোন ধরণের ব্যাংক লোন নেব না, টাকার প্রয়োজন হলে বিনা সুদে ধার করব এবং ঠিকমত ধার শোধ করব, সুদের বদলে উপকার, হৃদ্যতা এবং বন্ধুত্বের মাধ্যমে চির কৃতজ্ঞতা পালন করব।
৩। শুধুমাত্র বেতন যোগাতে অসমর্থ হলে কারখানার কর্মীকে ছাঁটাই করা হবে। কর্মীর অযোগ্যতা বা স্বভাবে দোষ থাকলে তাকে সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণ বা শাসন করা হবে, কিন্তু চাকরি থেকে বিদায় করে দেয়া হবে না।
৪। পৃথিবীর সকল ধর্মের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল, একইসাথে সকল প্রাণের প্রতিও আমরা সহানুভূতিশীল। এমন কোন উৎসব বা কাপড় যা অপর প্রাণীর বেঁচে থাকার অধিকার খর্ব করে, তা আমরা এড়িয়ে চলব। আমরা রেশমি কাপড় ও পশু চামড়া ব্যবহার করব না এবং কোরবানির ঈদ উপলক্ষে কোন কাজের অর্ডার নেয়া হবে না।
৫। সকল অবস্থায় কর্মী কে সহকর্মী হিসেবে নেব, বেতনভুক্ত শ্রমিক হিসেবে না। ‘Equal Work Respect’ – এর ভিত্তিতে কারখানা পরিচালিত হবে।
ব্যবসায়িক স্বপ্নঃ
আমাদের প্রথম স্বপ্ন কাজের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতার উৎকর্ষ সাধনের পাশাপাশি আমাদের সহকর্মীদের জীবন এবং পরিবারে গুণগুত পরিবর্তন আনায়ন। আমাদের Ornament and Crafts সেকশনটি পরিচালনা করা হবে আমাদের কর্মীদের পরিবারের মহিলাদের কাজ শেখানোর মাধ্যমে। এছাড়াও তাদের পরিবারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বাসস্থানের উন্নয়নে অনুদান এবং নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে অনুপ্রাণিত করা আমাদের অন্যতম স্বপ্ন।
আমার ফ্রিল্যান্সিং অভিজ্ঞতায় আমি জেনেছি, গ্রাহকের সন্তুষ্টি এবং মানসিক নির্ভরশীলতা কোন কাজের উৎকর্ষতা লাভে অন্তহীন অনুপ্রেরণার যোগান দেয়। আমাদের গ্রাহকের চাহিদাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করার প্রয়াসে আমরা যেন সৃষ্টিশীলতার পরিপূর্ণ আনন্দ ভোগ করতে পারি এবং নিজেদের ক্ষমতার সীমানাকেই পরিবর্ধিত করতে পারি, এটাই আমাদের লক্ষ্য এবং স্বপ্ন।
ব্যবসায়িক এক্সপেরিমেন্টের উদ্দেশ্যঃ
আমাদের ব্যবসায়িক রূপরেখার কোথাও আমরা অর্থের ওপর আলাদা জোর দিয়ে কিছু বলছিনা। যেহেতু আমরা ফ্রি সেবা দিচ্ছি না, কাজ করতে পারলে একটা পরিমাণের অর্থ আমরা উপার্জন করতেই পারব, আর গ্রাহকের চাহিদা এবং সামর্থের ভিত্তিতেই সেটা নিরূপিত হবে। কিন্তু conventional business concepts এ যেভাবে business scopes, prospects এবং ambitions কে মূল্যায়ন করা হয়, আমাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগে এগুলোর খুব একটা জায়গা নেই। আমাদের কাজের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি experiment, exploration এবং result এর ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। কাজের ভবিষ্যৎ আগেই ঠিক করে বসে থাকলে কাজের ক্ষেত্রে দ্রুত একঘেয়েমি চলে আসে, অথবা জাগতিক লাভের চিন্তা একসময় নেশায় পরিণত হয়। আমাদের এই এক্সপেরিমেন্টের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থের গুরুত্ব থেকে পুরোপুরি সরে গিয়ে মূল্যবোধ, কল্যাণ এবং প্রয়োজনে ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে কাজের আনন্দ পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করা। মুদ্রাবাজারের বিশ্বে মানসিক বৈষম্য এবং অর্থপার্জন-সর্বস্ব জীবনের তীব্র স্রোতের বিপরীতে জীবনবোধ-সর্বস্ব ভেলা নিয়ে কত ক্রোশ চলা যায় তা দেখার নির্ভেজাল আগ্রহ নিয়ে আমাদের এই ব্যবসায়িক উদ্যোগ বা এক্সপেরিমেন্টটি শুরু করলাম।
আপনাদের শুভকামনা প্রার্থী।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৩০