গতবছরের শেষের দিকে সুন্দরবন ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেটার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখার পরিকল্পনা আমার আগে থেকেই ছিল। ঘুরে আসার পর সেটা নিয়ে লিখতে বসা যেত, কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে সময় পাওয়া যায় না, আর লিখতে বসলেও অনেক কিছু মনে পড়ে না। তাই ওখানে থাকার সময়ই ডায়েরি আকারে পুরো অভিজ্ঞতাটা লিখে ফেলেছিলাম। আশা করি ভাল লাগবে।
৮ ডিসেম্বর ২০১৭
অবশেষে অনেক জল্পনা কল্পনার শেষে আমরা সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। গতরাতে কুয়েটে ছিলাম। মনে রাখার মত একটা রাত ছিল সেটা। সাজেদ আর ফায়েদের সাথে আমি আর দেবব্রত প্রায় সারা রাতই জেগে ছিলাম। ঘুরে বেড়িয়েছি কুয়েটের এমাথা ওমাথা, যখন বোরিং লেগেছে তখন পকেট গেট দিয়ে বাইরে গিয়ে চা খেয়ে এসেছি। যখন আর কিছুই করার ছিল না, তখন ফায়েদের রুমে গিয়ে কার্ড খেলতে বসেছি। কার্ড খেলতে খেলতে কখন যে রাত শেষ হয়ে গেছে সেটা আর দেখা হয়নি। আমার পুরোনো দিনের আইইউটি-র কথা মনে পড়ে গেল। একটা সময় ছিল যখন প্রতিবার ছুটিতে আসলেই আমি এক রাত হলেও আইইউটি-তে থাকতাম। সেই রাতগুলোও এই রাতের মত স্মরণীয় ছিল।
সব শেষ হতে হতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। এরপর আর ঘুমাতে যাওয়ার মানে হয় না। আমি জেগেই ছিলাম। ঐ সময় ঘুমাতে গেলে আর ওঠা লাগত না। তারপর ওখান থেকে সরাসরি চলে এলাম রূপসা ঘাটে। কুয়েটের বাইরেই মাহেন্দ্র নামে একটা হাফ সিএনজি হাফ টেম্পু দাঁড়িয়ে ছিল। ওটাতেই করে চলে গেলাম রূপসা ঘাট। সেখানে গিয়ে চা খেলাম। খানিকক্ষণ পর আমাদের গাইড এখানে এসে পৌছাল। তার সাথে করে একটা ছোট নৌকা নিয়ে আমরা লঞ্চ পর্যন্ত এসে পৌছালাম।
লঞ্চে ওঠার পর সকালে নাস্তা করে এসে কোন কথাবার্তা ছাড়াই কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে নিলাম। এর মধ্যে আশেপাশে রূপসা নদী ছাড়া দেখার মত কিছু ছিল না, কাজেই খুব বেশি একটা ক্ষতি হয়েছে তা বলব না। ঘুম থেকে উঠে পুরো লঞ্চটা খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। ছবি তুললাম বেশ কিছু। মজার ব্যাপার হচ্ছে সকালে এবং দুপুরে খাবার সময় দুবেলাই খেয়াল করলাম ভয়ংকর খিদে পেয়েছে। কোথায় যেন শুনেছিলাম সাগরের বাতাস পেলে খাবারের রুচি নাকি বেড়ে যায়। সেটা যদি সত্যি হয়, তবে আমার জন্য তো বেশ ভালই হয়েছে। যদিও এটা সাগর হয়, রূপসা নদীতেই আছি আমরা এখনো। তবে সাগর খুব দূরেও নয়। দুপুরের খাবার পর আমরা এসে পৌছালাম হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম সেন্টারে। এটা মূলত সুন্দরবনেরই মাঝে একটা জায়গা। জায়গাটাকে সাজিয়ে এবং পুরো এলাকাটার মাঝে একটা কাঠের ব্রিজ করে দিয়ে বনের মধ্যে দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে আসা যায় আর কি। আমরা যখন পৌছেছি, তখনো ভাটা শুরু হয়নি, কিন্তু বনের মধ্যে থেকে জোয়ারের পানি নেমে গেছে। ভরা জোয়ারের সময় যে এখানে পানি উঠে যায় সেটা বুঝতে পারলাম মাটির অবস্থা দেখে। মাটি পুরোটাই কাদা কাদা হয়ে আছে। এখানে এসে তেমন কোন বন্যপ্রাণী দেখতে পারব সে আশা ছিল না। তবে প্রচুর পাখির ডাক শুনেছি আর ফিরে আসার সময় একটা বানর এসে ভেংচি কেটে চলে গেছে। দেখিয়ে দিয়ে গেছে যে আসলে এখানে কিছু না কিছু হলেও আছে!
দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে এখানে আজকে সারাদিন ধরেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টির জন্যই ডেকে গিয়ে বসা যাচ্ছে না। তাও আমি আর দেবব্রত কিছুক্ষণের জন্য গিয়ে বসেছিলাম ডেকে। ছবি তুললাম বেশ অনেকগুলো। সত্যি কথা হচ্ছে, আজকে সারাদিনে যত ছবি তুলেছ, গত ১৫ দিনে এর ১০% ছবিও তুলিনি আমি শিওর!
হাড়বাড়িয়া থেকে রওনা দেবার পর আসলে করার মত কিছু ছিল না। দুপাশে বিস্তর বনভূমি, খুব কাছে না, আবার খুব দূরেও না। দেখতে দেখতে কিছুটা একঘেয়ে লেগে যায়। তাই আমি আর দেবব্রত মিলে একটা মুভি দেখতে বসলাম। মুভি দেখতে দেখতেই দেবব্রত আবার ঘুম! আচ্ছা বেচারা ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। আমি একাই দেখলাম মুভি।
মুভি দেখা শেষ করার পর ভাবলাম ডেক থেকে একটু ঘিরে আসা যাক। পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেলেও কোথায় কেন আবছা একটু আলো রয়ে গেছে। সেই আলোতে আশেপাশে পরিষ্কার না দেখা গেলেও মোটামুটি ঠাহর করা যাচ্ছে আশেপাশে কি কি আছে। ডেকে নোনা বাতাসের মৃদু গন্ধ, আর তার সাথে হাল্কা বৃষ্টির ছটা পরিবেশটাকে কেমন যেন স্বর্গীয় করে রেখেছে। বাকি সহযাত্রীরা প্রায় সবাই-ই যার যার রুমের ভেতর স্বেচ্ছাবন্দি। শুধু আমি একাই দাঁড়িয়ে আছি ডেকের উপর। লঞ্চের সামনে নদীর পানি ভেঙ্গে সাদা ফেনা হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। এই আবছা আলোতে সেটা কেমন যেন জ্বলজ্বল করছে। সাথে লঞ্চের ইঞ্জিন চলার মৃদু শব্দ, পায়ের নিচে লঞ্চের মৃদু দুলুনি, সব মিলিয়ে কি অসাধারণ একটা পরিবেশ! দুপুরের পর থেকেই আমরা নেটওয়ার্কের বাইরে চলে গেছি। এই অনুভূতির সাথে অবশ্য আমার পরিচয় আছে, তাও কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। আসলে পরিবেশটাই কেমন যেন অদ্ভুত। বনের ধারে গাছগুলো বাতাসে হালকা হালকা নড়ছে। মনে হচ্ছে ওপাশ থেকে বনের বাসিন্দারা যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এরকম শব্দ করে পানির বুক চিরে চলে যাওয়া আজব জলযানটাকে দেখার জন্য ওরা সবাই জড় হয়েছে। মাঝে মাঝে বনের মধ্যে হালকা হালকা আলো দেখা যাচ্ছে, জোনাকির আলো হবে হয়ত, অথবা মৌয়ালদের নৌকার আলোও হতে পারে। মধু নেবার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে এই বিজন বনের মধ্যে। আমিও যদি মৌয়াল হয়ে জন্মগ্রহণ করতাম! আমিও এরকম বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যাবেলায় নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম বনের গভীর থেকে গভীরে।
৯ ডিসেম্বর, ২০১৭
আজকে সকাল সকাল উঠলাম। ওঠার কথা ছিল ৫ টার সময়। পরিকল্পনা ছিল ৫ টার সময় ঊঠবো, এরপর আমরা কটকা সী-বিচ ঘুরতে যাব, এরপর জামতলা টাইগার পয়েন্টে। গতকালকে রাতে অনেক চেষ্টা করলাম তাড়াতাড়ি ঘুমানোর জন্য। তাড়াতাড়ি মানে ১ টার দিকে আর কি। কিন্তু আমার শরীরের ঘুমের সাইকেলের গোলমাল হয়ে গেছে পুরো। গত কয়েকদিন ধরে রাত জাগা হচ্ছে, প্রতিদিনই প্রায় ৪ টার পর ঘুমানো হচ্ছে, আর সকালে উঠতে উঠতে দুপুর ১২ টা। যাই হোক, সকালে দেবব্রতের ধাক্কাধাক্কিতে অনেক কষ্টে ছয়টার দিকে উঠলাম। উঠেই তাড়াহুড়া করে ফ্রেশ হয়ে ট্রলারে গিয়ে উঠলাম, উদ্দেশ্য কটকা বিচ।
রাতের বেলা বলে খেয়াল করিনি, আমরা রাতে কটকা বিচের এখানেই এসে নোঙর করে ছিলাম। গত রাত সারারাতই টানা বৃষ্টি হয়েছে, এক মুহূর্তেরও বিরাম নেই। আজকে সকালে দেখলাম আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার ছিল। যদিও নদী কিছুটা অশান্ত ছিল। ট্রলারে করে কটকা বিচে গেলাম। কটকা বিচ খুবই সুন্দর একটা জায়গা। যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেখান থেকে আমরা প্রায় অনেক দূর চলে এসেছি। ডাঙায় পা দেবার পর সেটা বুঝতে পারলাম। পরিচিত কোন ডাঙার সাথে এর কোন মিল নেই। বন আর সী-বিচের এক অপূর্ব মিশ্রণ কটকা বিচ। যদিও বিচটা বেশ ছোট। অবশ্য বিচ বড় হবে একরম আশাও করিনি। তবে আমার আশার চেয়ে বড়ই ছিল বলতে হবে। ওখানে নামার পর হাঁটতে হাঁটতে আমরা ভিতরে গেলাম। কিছুদূর যাবার পর দূর থেকে বেশ কিছু হরিণ দেখতে পেলাম।
আমাদের সাথে যে গাইড ছিল দেবু’দা, সে এই লঞ্চের আরেকজন স্টাফকে সাথে নিয়ে এগিয়ে গেল ওদিকে। যাবার আগে আমাদের বলে গেল আমরা যেন শব্দ না করি আর সামনে না যাই, তাতে হরিণগুলো ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতে পারে। এরপর ওনার সাথের ছেলেটা একটা গাছে উঠে পাতাসহ ডাল ভেঙে ভেঙে নিচে ফেলতে থাকল। এভাবে বেশ কিছু ডাল ভেঙে ফেলার পর দুজনে সরে এসে দূরে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে এসে দাঁড়িয়ে গেল। দূর থেকে হরিণগুলো পায়ে পায়ে কিছুটা এগিয়ে এল যেখানে ডালগুলো ফেলা হয়েছিল সেদিকে। একটু সামনে আসার পর আবার একটু পিছিয়ে যায়, ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছে না দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আজব প্রাণীগুলোকে। প্রথমে একটা হরিণ সাহস করে এগিয়ে এল, ওটাকে দেখেই মনে হল এই পালের সেই সর্দার। বেশ বড়বড় শিং, আর গায়ের ফুটকিগুলোও অন্যরকম। এর পিছে পিছে আস্তে আস্তে বাকিগুলোও আসা শুরু করল। আমাদের মধ্যে থেকেও একজন একজন করে সামনে আগানো শুরু করল। ব্যাপারটা কেমন যেন আদিম যুগের চুক্তি করার মত। দুপক্ষের সর্দার আগে এগিয়ে যাবে, যদি সমঝোতা হয়, তাহলে দলের বাকি লোকজনও আসবে। হরিণগুলো এসে পাতা খেতে শুরু করল। আমরাও আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে গেলাম, গিয়ে ছবি তোলা শুরু করলাম। এর আগে বহুবার চিড়িয়াখানায় হরিণ দেখেছি। বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে ছোট একটা চিড়িয়াখানা আছে, সেখানে বেশ কয়েকটা হরিণ আছে। প্রতিদিন দৌড়ানোর সময় সেটার পাশ দিয়েই যাই, প্রতিদিনই হরিণ দেখা হয় প্রায়। কিন্তু এভাবে খোলা বনের মধ্যে হরিণ দেখার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। ওদের অনেক বেশি সুন্দর, অনেক বেশি জীবন্ত মনে হয়।
আরো খানিকক্ষণ ওখানে ঘোরাঘুরি করার পর আমরা আবার ট্রলারে ফিরে আসলাম। এর মধ্যে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। কটকা বেশ অনেক বড় জায়গা। আমাদের গাইডের কাছ থেকে শুনলাম পুরো কটকা যদি ঘুরে দেখতে চাই, তাহলে মিনিমাম ১০ দিনের মত সময় প্রয়োজন। সেটা তো আর এরকম ট্রিপে সম্ভব না। মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম যে হয়তো আবার কোন দিন ঘুরতে আসব এখানে। সেবার অনেক সময় নিয়ে পুরোটা ঘুরে দেখব। আস্তে আস্তে বৃষ্টির বেগ বাড়ছিল। এই শীতের মধ্যে এরকম টানা বৃষ্টি চলতে থাকবে সেটা কে বুঝেছিল, আগে বুঝলে সাথে করে ছোট একটা ছাতা নিয়ে আসতাম। যাই হোক, বগুড়া থেকে প্যারাস্যুট কাপড়ের যে জ্যাকেটটা কিনেছিলাম, সেটা অনেক সাপোর্ট দিচ্ছিল। মোটামুটি রেইনকোটের মতই বৃষ্টি থেকে বাঁচাচ্ছিল। আমাদের পরিকল্পনা ছিল কটকা থেকে আমরা সরাসরি জামতলার উদ্দেশ্যে রওনা দেব। কিন্তু বৃষ্টি বাড়ার সাথে সাথে আমাদের সহযাত্রী কয়েকজনের যাবার ইচ্ছে উবে গেল। পরে তাদেরকে আমরা লঞ্চে গিয়ে নামিয়ে দিলাম। এরপর আমরা রওনা দিলাম জামতলার দিকে।
আমরা নদীর যেপাশে ছিলাম জামতলা মোটামুটি তার উল্টোদিকেই। কটকা বিচ থেকে উল্টোদিকে বনের মধ্যে একটা ছোট খাল ঢুকে গেছে। ঐ খালটা ধরে খানিকক্ষণ গেলেই জামতলার দেখা পাওয়া যাবে। জামতলা মূলত পরিচিত টাইগার পয়েন্ট আর বিচের জন্য। নৌকা থেকে নামার পরই টাইগার পয়েন্ট। ঐ জায়গাটা পার হবার সময় মানুষজন যেমন সতর্ক হয়ে পার হচ্ছে মনে হচ্ছিল বাঘমামা আশেপাশেই ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। অবশ্য আমরা পার হবার সময় ঐ এলাকার আশেপাশের ১০ মাইলের মধ্যে কোন বাঘ আছে বলে মনে হল না। কোন এক সালের কোন একদিন হয়তো একটা বাঘ দেখা গিয়েছিল ঐ এলাকায়, সেটার জন্য এলাকার নাম হয়ে গেছে টাইগার পয়েন্ট। যাই হোক, টাইগার পয়েন্ট পার করে আমরা এগুতে থাকলাম জামতলা সী-বিচের দিকে। যাবার রাস্তাটা বেশ কয়েক কিলোমিটার হবে। হাঁটতে ভালই লাগত, কিন্তু গত ২ দিনের বৃষ্টিতে এলাকা পুরো কাদা কাদা হয়ে ছিল। আমার তলা সমান হওয়া কনভার্স কয়েকবার পিছলে গেল। তবে ব্যালেন্স রাখতে তেমন কোন সমস্যা হয়নি। যাবার পথে মোটামুটি মাঝারি সাইজের যতগুলো গাছ পাওয়া গেল, সবগুলো গাছের পাতাগুলো কে যেন সমান করে কেটে রেখেছে। গাইডকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল এগুলো হরিণের কাজ। হরিণ গাছের গায়ে পা ঠেকিয়ে যতখানি নাগাল পেয়েছে, সেটুকু পাতা খেয়ে সমান করে রেখেছে। আরো বেশ খানিকটা হাঁটার পর আমরা বনের মধ্যে এসে পড়লাম। এই ট্রিপের এই প্রথম বেশ ঘন বনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া। ভালই লেগেছে। আমি দেবব্রতের সাথে গল্প করতে করতে যাচ্ছিলাম। আমাদের সাথে আমাদের সহযাত্রীরাও ছিল, কিন্তু তাদের সাথে আসলে ওভাবে কথা বলা হয়নি। এরকমই ভাল লাগে আমার, একা একা ভাল লাগে না, আবার মানুষের সাথেও ততটা ভাল লাগে না। এর চেয়ে এরকম ভিড়ের মধ্যে একা একা থাকার অনুভূতিটাই সবচেয়ে ভাল লাগে।
বনের পথ ধরে বেশ খানিকটা হাঁটার পর আমরা জামতলা বিচে এসে পৌছালাম। এখন পর্যন্ত এই ট্রিপে যতগুলো জায়গায় গিয়েছি, এর মধ্যে জামতলা বিচটাই সবচেয়ে ভাল লেগেছে আমার কাছে। বিচের মত পুরোটা বালি, এর মধ্যে বড় বড় গাছ। গাছের গোড়ায় সাদা বালি জমে আছে এই দৃশ্য খুব একটা দেখা যায়না, কিছুটা অস্বাভাবিক লাগার কথা, কিন্তু মনে হচ্ছিল এটাই যেন স্বাভাবিক। বরঞ্চ গাছের গোড়ায় কাদা থাকলে সেটাই যেন বেমানান দেখাতো। গাছের সারি শেষ হবার পর সামনে খোলা বিচ। বিচের মাঝখানেও শ্বাসমূলের সারি। পাশেই সাইনবোর্ড লাগানো রয়েছে এখানে নামা বিপদজনক। গাইডের কাছ থেকে শুনলাম কবে একবার ভার্সিটির কিছু ছেলে এখানে এসে মারা গিয়েছিল। পুরো বিচের জায়গায় জায়গায় চোরাবালি লুকিয়ে আছে। নামা আসলেই একটু বিপদজনক। কাজেই দূর থেকে দেখেই খুশি থাকতে হল জামতলা বিচ। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন ভাটা চলছিল। পানিও অনেক দূরে ছিল। আর আমরা ততক্ষণে বৃষ্টিতে ভিজে একশা হয়ে গিয়েছি, পানিতে নামার ইচ্ছেও ছিল না। ওখানে খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম, ছবি তুললাম। এরপর আবার ফিরতি পথ ধরে চলে আসলাম ট্রলারে। সেখান থেকে আবার লঞ্চে। লঞ্চে ফিরে আসতে আসতে প্রায় সবাই-ই মোটামুটি পুরোটা ভিজে গেছে। আমার গায়ে প্যারাস্যুট কাপড়ের হুডিটা ছিল বলে ভরসা। উপরের ভাগটুকু শুকনাই ছিল বলা চলে।
এখান থেকে আমাদের দুবলার চরের উদ্দেশ্যে রওনা দেবার কথা। কিন্তু আবহাওয়া প্রতি মুহূর্তে খারাপের দিকেই যাচ্ছিল। এর মাঝে কোস্ট গার্ডের সাথে কথা বলে জানা গেল ওদিকে না যাওয়াই ভাল হবে। সাগর কিছুটা উত্তাল আছে। উত্তাল সাগরের কথা শুনে আমার ওদিকে যেতেই ইচ্ছে করছিল, কিন্তু এখানে এই লঞ্চ নিয়ে তো আর সেটা সম্ভব না। পরে ঠিক করা হল আমরা দুবলার চরের দিকে না গিয়ে কোকিলমুনির দিকে যাব। দুপুর ২ টার দিকে লঞ্চ আবার চলা শুরু করল। গন্তব্য কোকিলমুনি।
আমি আর দেবব্রত দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। খাবারের পর রুমে এসে একটা মুভি দেখা শুরু করেছি, এমন সময় আবার খবর আসল আবার বের হব আমরা। এবারে কোকিলমুনি। কোকিলমুনি দেখে কিছুটা আশাভঙ্গই হল। এখানে আসলে দেখার মত একটা পদ্মপুকুর ছাড়া আর কিছু নেই। আর যখন বের হয়ে কেবল ট্রলারে উঠেছি, তখনই ঝেপে আসল বৃষ্টিটা। সকালে ঘোরাঘুরি শেষে প্যান্টটা ভিজে আর কাদা লেগে এমনই হয়ে গিয়েছিল যে সেটা আর পরার মত ছিল না। তাই আর একটা যে প্যান্ট ছিল সেটা পরেই রওনা হয়েছিলাম। এখন তো পড়লাম বিপদে। আর এদিকে আমার কথা শুনে দেবব্রতও তার নতুন প্যান্টটা পরে গেছে, আর খানিকক্ষণ পর পর আমার চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করছিল আর কি! যাই হোক, কোকিলমুনি পৌছানোর পর পাশেই একটা গোলঘর মত ছিল, সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিলাম আমরা। খানিকক্ষণ পর বৃষ্টি কমে গেল, আমরা বের হলাম। খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আর দেখার মত কিছু পেলাম না। তবে এখানে দেখার মত একজনকে পেলাম, আমার মত একটা ক্যাডেট হুডি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। উনি অবশ্য অন্য একটা ট্রাভেল এজিন্সির সাথে এসেছেন। দেখা করে পরিচয় দেব কি দেব না সে চিন্তা করতে করতে উনি চলে গেলেন। অবশ্য উনি নিজেই এসে আমাদের সাথে কথা বলতে পারতেন। তবে সিনিয়র মানুষ কিনা, মাইন্ড করেছেন কিনা কে জানে!
ওখান থেকে বের হয়ে ট্রলারে উঠলাম আবার। ততক্ষণে লঞ্চ চলে গেছে তিনকোণা আইল্যান্ডের ওখানে। ট্রলারে করে আমরা রওনা দিলাম সেদিকে। তিনকোণা আইল্যান্ডে যাবার পথটায় পানির দুধারে বন অনেক সুন্দর ছিল। কিছুক্ষণ পরপরই হরিণ দেখা যাচ্ছিল। দূর থেকে আমাদের ট্রলার দেখে কৌতূহলী হয়ে উঁকি দিচ্ছিল, কিন্তু ট্রলার কাছাকাছি আসতেই ট্রলারের শব্দে পালিয়ে যাচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল এখানে আসতে হলে আসলে ডিঙি নৌকা নিয়েই আসা উচিত ছিল। হরিণগুলোর আরো অনেক কাছাকাছি যাওয়া যেত। এভাবে কখন যে পথটা শেষ হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। পথে তিনকোণা আইল্যান্ড চোখে পড়ল। খুব বেশি একটা যে বড় তাও না। ট্রলারে করে আমরা একটা চক্কর দিলাম আইল্যান্ডের চারপাশে। ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সন্ধ্যার অদ্ভুত আলোতে অনেক রহস্যময় লাগছিল দ্বীপটাকে। মনে হচ্ছিল এখন যদি একবার যাওয়া যেত ওখানে! এসব বসে বসে ভাবছি, এমন সময় আমাদের সহযাত্রীদের মাঝে থেকে কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠলেন, বাঘ! বাঘ!! ঐ যে বাঘ দেখা যাচ্ছে!! সাথে সাথে পুরো ট্রলারে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। তারা এমনই চিল্লাপাল্লা শুরু করল যে সাথে সাথে ট্রলারের মুখ ঘুরিয়ে আবার ওদিকে যাওয়া শুরু করলাম। কাছাকাছি গিয়ে তেমন কিছু দেখা গেল না। একে তো সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে, এর মধ্যে ঘন জঙ্গল। ওখানে কোত্থেকে কে যে কি দেখেছে সেটা খোদা মালুম। তবে পরের বার যাবার পরও কেউ কেউ গায়েবি বাঘ দেখতে পাচ্ছিল। ঐ যে দাঁড়িয়ে আছে, ঐ যে হেঁটে চলে যাচ্ছে, এরকম নানান কথা বার্তা শোনা যাচ্ছিল। আমি বা দেবু কেউ কিছু দেখতে পাইনি। আদৌ ওখানে ঐ সময় বাঘ ছিল নাকি সেটা নিয়েই সন্দেহ আছে। তবে যদি বাঘ থেকেও থাকে, আমাদের নৌকার লোকজনের চিল্লাপাল্লাতে আর এই এলাকায় থাকার কথাও না।
বাঘ বাঘ ডাক শুনেছি, তবে বাঘ দেখতে পারিনি বলে যে অনেক আফসোস রয়ে গেছে তা না। বরং আমাদের এই অমূল্য সম্পদগুলো মানুষের চোখের আড়াল থাক সেটাই প্রার্থনা করি। যেভাবে বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা কমে গেছে, আর দিন দিন আরো কমছে, তাতে কয়েক বছর পরে আমাদের জাতীয় পশুর আর অস্তিত্ব থাকবে নাকি সেটা নিয়েই সংশয় রয়েছে। বেচারা হয়তো ওখানে দাঁড়িয়ে আমাদের চলে যাওয়া দেখছিল, হয়তো ভালই লাগছিল তার, কিন্তু ঘরে তার আপনজনেরা অপেক্ষা করে আছে, তাই আর দাঁড়াতে পারেনি। এবার না হোক, হয়তো সামনের বার, আবার যখন আসা হবে সুন্দরবনে, দেখা হবে তোমার সাথে বাঘ মামা, ততদিন সগৌরবে বেঁচে থাক, নিশ্চিহ্ন হয়ে যেও না, তাহলেই চলবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১৮ বিকাল ৪:২১