somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"বরিশাল ক্যাডেট কলেজ, বরিশাল-৮২১৬" :পর্ব-০২

৩১ শে মে, ২০০৮ বিকাল ৩:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই পর্বটি পড়ার আগে প্রথম পর্ব থেকে শুরু করতে পারেন ... ...
পর্ব ০: প্রারম্ভিকা: আমার লেখার কারন ও আপনার অংশগ্রহণ
পর্ব-০১
-------------------------পর্ব ০২-------------------------------------

ছোট্ট সরু একটা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছি আমরা... হাতের বাম পাশে খুব সুন্দর একটা মসজিদ, ডানপাশে একটা দোতলা লম্বা বিল্ডিং। আমরা গিয়ে পৌছলাম রাস্তার একেবারে শেষপ্রান্তে একটা তিনতলা বিল্ডিংয়ের সামনে, সেখানে লাগানো বিশাল তিনটি ফলক:
শরীয়তউল্লাহ হাউজ, শেরেবাংলা হাউজ এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাউজ।

বরিশাল ক্যাডেট কলেজের খ্যাতনামা শিক্ষক মোল্লা স্যারের ছেলে ইমন ভাই ছিলেন আমার গাইড। তিনি নিয়ে গেলেন আমার নতুন ঠিকানায়: রুম নং ১২৭, শরীয়তউল্লাহ হাউজ... গিয়ে দেখি আমার রুমমেট আমার অতি পরিচিত বন্ধু রাজিব, দুজন একত্রে কোচিং করতাম জিলা স্কুলের এনামুল হক স্যারের কাছে । দুই গ্রুপের বাবা-মাই বেশ খুশি, মিলেমিশে থাকবা তোমরা, ভালই হইছে দুজন একই রুমে পরেছ। ভর্তি পরীক্ষায় আমার ইনডেক্স নম্বর ছিলো ১২০৮৫, রাজিবের ১২০৮৪। এখানে এসে আমার ক্যাডেট নম্বর হল ১১৮২, ওর ১১৮১। ইমন ভাই আমার বিভিন্ন জিনিসপত্র আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, তারপর আমার সাদা শার্টটার ডানপাশে লাগিয়ে দিলেন কালো একটা নেমপ্লেট, যেখানে লেখা রয়েছে "তারিক"; আমার অতি প্রিয় "মিঠু" নামটা যে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে সেটা তখনো বুঝতে পারিনি, সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম আরও প্রায় ১৫/২০ দিন পরে। এরপর নাস্তা, শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচয় পর্ব ইত্যাদির পরে বাবা মায়ের বিদায়ের পালা।
আমার কেন যেন সেদিন বাবা-মায়ের জন্যে ততটা কষ্ট লাগেনি, কিন্তু শুধু ছোটবোনটার জন্যে... আম্মুর জন্যে একটু কষ্ট লাগছিল, কারন আম্মু অনেক সখ করে নিয়ে আসা কাঁথাটা আমাকে দিয়ে যেতে পারেননি, তবে কষ্টটা আম্মুর জন্যে লেগেছিল নাকি কাঁথাটার জন্যে- সেটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, কারন আমি আবার কাথা ছাড়া ঘুমাতে পারতাম না। তবে আব্বু-আম্মুকে ছেড়ে যখন হাউজের দিকে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম, সে এক করুন দৃশ্য... আমার অধিকাংশ হবু বন্ধুই কাঁদছে, কাঁদছেন স্নেহময়ী মায়েরা... আড়ালে চোখের পানি মুছছেন বাবারা... সৌরভের ছয় বোনের সে কি কান্না... কারন ও ছিল ছয় বোনের আদরের ছোট ভাই...
সবার কান্নাকাটি দেখে আমি একবার পিছন ফিরে তাকালাম আমার বাবা-মায়ের অবস্থা দেখার জন্যে। মায়ের মুখটা মলিন, চোখে পানি আছে কিনা সেটা দূর থেকে বুঝতে পারিনি... তবে বাবা যে হাত দিয়ে চোখের কোণাটা মুছছেন- সেটা দেখতে পেলাম স্পষ্ট। বাবার সেই কান্নার অর্থ সেদিন বুঝিনি, কিন্তু আজ বুঝতে পারি... ওটা কষ্টের কান্না ছিলো না, ওটা ছিলো আনন্দের... কিসের আনন্দ? চলুন ঘুরে আসি ১৯৭১... যখন বাবা ছিলেন সদ্য ক্লাস সেভেন...

আমার বাবার বয়স মাত্র ১২/১৩, সবে ক্লাস সিক্সে পড়েন। যতটুকু জানি, বেশ ভাল ছাত্র ছিলেন আমার বাবা। দাদার স্বপ্ন ছিল, ছেলে বড় অফিসার হবে। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস, ৭১-এর শুরুতেই পাক দস্যুদের হাতে নিহত হলেন আমার দাদা... এরপর শুরু হল আমার বাবার জীবন যুদ্ধ... সৎ মায়ের সংসার, আমার দাদু একটু বোকাসোকা ছিলেন, তাই সংসার চালাতেন আমার ছোট দাদু। চাচা- চাচীদের অবহেলা, অত্যাচার এসবের মাঝে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের সহযোগীতায় কোন রকমে HSC পাস করেন তিনি... দিনের বেলা চাকরি করেছেন, রাতে পড়েছেন নাইট কলেজে- এমনই কেটেছে সময়... দাদার সহায়সম্পত্তির মোটেই কমতি ছিল না, কিন্তু শুধুমাত্র একজন বুদ্ধিমতি মায়ের অভাবে সেগুলো সেসময় ভোগ করার সুযোগ হয়নি আমার বাবার ... অনেকদিনই পেটপুড়ে খেতে পারেননি... পড়াশুনাতো অনেক পরের কথা... সেই বাবার ছেলে আজ ক্যাডেট কলেজের মত একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে যাচ্ছে এটা ছিল তাঁর কাছে স্বপ্নের মত... কল্পনারও অতীত... তাই হয়ত বাবা চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি...
আসলে "সুশিক্ষিত মানুষ মাত্রই স্বশিক্ষিত" - এই বাক্যটির এক স্বার্থক প্রমাণ আমার বাবা, ক্লাসের বই কিনে পড়তে পারতেন না... নতুন জামা-কাপড় হয়ত ছিল না, কিন্তু আমার বাবা ছিলেন জ্ঞান রাজ্যের এক নীরব প্রজা... বরিশাল পুরাতন পাবলিক লাইব্রেরি ছিল জ্ঞানের সেই রাজদরবার... বাবার অনেক লেখাও তখন প্রকাশিত হয়েছিল বিচিত্রাসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়...

সেই বাবার ছেলে আমি যাচ্ছি এক নতুন জগতে... পিছনে বাবা-মা, আদরের ছোটবোন... সামনে ক্যাডেট কলেজ... মাঝখানে হাটছি আমি এক কিশোর... কি ছিলো আমার সেদিনের অনুভূতি- সেটা সঠিক করে বলতে পারব না... তবে এতটুকু জানি, সেদিন বাবা-মায়ের জন্যে ততটা কষ্ট লাগেনি যতটা লেগেছিল পরবর্তী ক্যাডেট লাইফে, যতটা লাগে এখন... [চলবে]

------পরের পর্বগুলি------
পর্ব -০৩
পর্ব -০৪
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১১ রাত ৯:১১
১০টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতী এখন পুরোপুরিভাবে নেতৃত্বহীন ও বিশৃংখল।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩



শেরে বাংলার নিজস্ব দল ছিলো, কৃষক প্রজা পার্টি; তিনি সেই দলের নেতা ছিলেন। একই সময়ে, তিনি পুরো বাংগালী জাতির নেতা ছিলেন, সব দলের মানুষ উনাকে সন্মান করতেন। মওলানাও জাতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন বিপ্লবী নেতা হাদী

লিখেছেন আরোগ্য, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১৬



ওসমান হাদী অন্যতম জুলাই যোদ্ধা, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র, স্পষ্টবাদী কণ্ঠ, প্রতিবাদী চেতনা লালনকারী, ঢাকা ৮ নং আসনের নির্বাচন প্রার্থী আজ জুমুআর নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর গুলিবিদ্ধ হয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×