জাহাজে চাকরি করার সুবাদে অনেকেই জাহাজ সম্পর্কে জানতে চায়। কিন্তু আমার জাহাজে অভিজ্ঞতা জুম্মা জুম্মায় কয়েকদিন মাত্র। তার পরও দেশের অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে জাহাজের অগ্নি নির্বাপন ব্যাবস্থা নিয়ে কিছু লেখার সাহস করলাম।
বিভিন্ন কারনেই জাহাজে অগ্নি নির্বাপন ব্যাবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সহজ কথায় বলা যেতে পারে জাহাজ চালানোর জন্য জাহাজে বিপুল পরিমান দাহ্য তেল বহন করা হয়। এছাড়া বৈদ্যুতিক সংযোগ থাকে এর নিজস্ব জেনারেটর এর মাধ্যমে। বেশ জটিল তারের সজ্যা থাকে জাহাজ জুরে, সেখান থেকেও বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট হতে পারে। এছাড়া বয়লার , ইনসিনারেটর থেকেও আগুন লাগার সম্ভাবনা থাকে। জাহাজ এর ওয়ার্কশপ ছাড়াও ডেক বা ইঞ্জিন রুমের বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজন অনুসারে যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষ এর অনুমতি সাপেক্ষে ওয়েল্ডিং , চিপিং , গ্রাইন্ডিং , গ্যাস কাটিং , সহ নানা হট ওয়ার্ক করা হয়। গ্যাস ক্যারিয়ার বা তেলে বাহি ট্যাঙ্কারে সুনির্দিষ্ট ভাবে এসব কাজের গাইড লাইন দেয়া থাকে। কাজের স্থানে পানি , প্রয়োজন অনুসারে অগ্নি নির্বাপক জিনিস পত্র প্রস্তুত রাখা সহ অতিরিক্ত লোক নিয়োগ করা হয় যেন কোন ধরনের দূর্ঘটনা মোকাবেলা করা যায়। রান্নার স্থানের হটপ্লেট বা টোস্টার থেকেও অনেক সময়ই আগুন লাগার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।
এসব কারন ছাড়াও অসাবধানতা বসত সিগারেট এর আগুন থেকে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে আর তাই সব জাহাজে নির্দিষ্ট স্মোকিং রুম থাকে। সাধারনত মেস রুম , ব্রিজ , কার্গো কন্ট্রোল রুম , ইঞ্জিন কন্ট্রোল রুমে সিগারেট খাওয়ার পার্মিট থাকে।
এখন আসুন যেনে নেয়া যাক আগুন কি? আগুন একটি রাসয়নিক বিক্রিয়া যা যা অক্সিজেন এর উপস্থিতিতে তাপ বেড়ে গিয়ে কোন বস্তুর দহন। আবার একবার আগুন ধরে গেলে সেখানে আপনাতেই উত্তাপ বাড়তে থাকবে। একটি ত্রিভুজ চিন্তা করলে এর এর এক একটি কোনায় আমরা রাখতে পারি
১. অক্সিজেন
২. তাপ
৩. ফুয়েল বা দাহ্য বস্তু।
যদি আগুন থেকে আমরা এর যে কোন একটি সরিয়ে ফেলি তাহলে আগুন নিভে যাবে। এখানে যেনে রাখা প্রয়োজন যে বাতাসের অক্সিজেনের পরিমান সর্বনিম্ন ১৪% থাকলে তা আগুন জ্বলতে সাহায্য করে। এর কম হলে জ্বলবে না।
আগুনের প্রকারভেদ
আন্তর্জাতিক ভাবে আগুন কে কয়েক টি ক্লাস এ ভাগ করা থাকে। আমি সে আলোচনায় না গিয়ে সহজ করে লিখছি।
১. সলিড আগুন
২. তরল আগুন
৩. গ্যাস আগুন
৪. বৈদ্যুতিক আগুন।
সলিড আগুন বলতে বুঝায় কোন কঠিন পদার্থের আগুন কে। যেমন , কাঠ , কাগজ , লোহা ইত্যাদি র আগুন কে আমরা সলিড আগুন বলতে পারি।
তরল আগুন বলতে বুঝায় কোন তরলে র আগুন কে। যেমন, পেট্রল বা ডিজেল বা কোন তরল রাসয়নিক দ্রব্যের আগুন কে।
গ্যাস আগুন বলতে আমরা গ্যাসে ধরা আগুন কে বুঝি। যেমন , অক্সিএসিটিলন এ বা বাড়ির গ্যাস সিলিন্ডারের আগুন।
বৈদ্যুতিক আগুন বলতে ইলেক্ট্রিক শর্টসার্কিট বা কোন ইলেক্ট্রিক লাইনের আগুন কে বুঝি।
এখন আসুন দেখি জাহাজে অগ্নি নির্বাপনে কি কি ব্যাবস্থা থাকে?
ফায়ার ডিটেক্টর:
ফায়ার ডিটেক্টরে হল কিছু ইলেক্ট্রিক ডিভাইস যা তাপ , ধোঁয়া , শিখার উপস্থিতি বুঝতে পারে। এগুলো জাহাজের বিভিন্ন যায়গায় লাগানো থাকে একটি কন্ট্রোল সিস্টেম এর আওতায়। এদের প্রত্যেকটি র নির্দিষ্ট কোড থাকে। এই সিস্টেমে একটি ফায়ার এলার্ম রিপিটার থাকে যেখানে কোন ডিটেক্টর আগুন সেন্স করলে তার নম্বর দেখায় আর চার্ট এ ঐ নম্বর এর অবস্থান দেখে আমরা আগুনের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি। সেই সাথে এটি ফায়ার এলার্ম ও বাজাতে থাকে যাতে সবাই বুঝতে পারে।
অগ্নি নির্বাপক পানি :
সমস্ত জাহাজ জুড়ে একটি বা একের অধিক পাম্প থেকে একটি ফায়ার পাইপ লাইন থাকে। যার বিভিন্ন স্থানে ফায়ার হোস লাগানোর ব্যাবস্থা থাকে আর এর পাশেই ফায়ার হোস ও এটি লাগানোর সরঞ্জাম থাকে। ফায়ার পাম্প ছাড়াও একটি ইমার্জেন্সি ফায়ার পাম্প থাকে যেটিকে আমরা ব্রিজ বা অন্য কোন নির্দিষ্ট স্থান থেকে চালু করতে পারি। আর এ পাম্প গুলো সাগরের পানি ব্যাবহার করে। সাধারনত এ পাইপ লাইন লাল রং করা থাকে।
অগ্নি নির্বাপক পোশাক :
কিছু নির্দিষ্ট যায়গায় অগ্নি নির্বাপক পোশাক থাকে যেগুলো ফায়ার ফাইটার কে আগুন থেকে বাচিয়ে কিছু নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আগুনের খুব কাছাকাছি থেকে অগ্নি নির্বাপনে সাহায্য করে। এর সাথে কম্প্রেসড ফ্রেস এয়ার একটি সিলিন্ডার ও ব্যাবহার এর জন্য মাস্ক থাকে , লাইফ লাইন বলে দড়ি থাকে, একটি কুঠার থাকে যাতে ফায়ার ফাইটার তাতখনিক ভাবে কোন প্রতিবন্ধকতা দুর করতে পারে। একটি সিলিন্ডারে মোটামুটি ৩০ মিনিট ব্যাবহার উপযোগী বাতাস ভরা থাকে।
ফোম সিস্টেম:
ট্যাঙ্কার জাহাজে অবস্যম্ভাবি ভাবে একটি ফোম সিস্টেম থাকে। ফোম সিস্টেম হোল রাসয়নিক ভাবে ফেনা উতপাদন কারী ব্যাবস্থা যা পাইপ লাইনের মাধ্যমে তেল রাখার ট্যাঙ্ক এ দেয়ার ব্যাবস্থা থাকে ও ফোম থ্রোয়ার এর মাধ্যমে থ্রো করারও ব্যাবস্থা থাকে। উপরে আলোচ্য তরল আগুনের ক্ষেত্রে এটি ব্যাবহৃত হয়। তরল আগুন পানি দিয়ে নেভানো সম্ভব না। কারন তেল পানির থেকে হালকা বলে পানিতে ভাসে আর আগুন জ্বলতেই থাকে। কিন্তু কোন তরল আগুনে ফোম বা ফেনা দিলে তা ঐ তরলের উপর একটি আবরন তৈরি করে যা দাহ্য পদার্থ কে অক্সিজেন এর সংস্পর্শ থেকে সরিয়ে নেয় আর আগুন নিভে যায়। তবে তরল আগুনে সরাসরি ফোম থ্রো করা যাবে না। যে পাত্রে বা ট্যাঙ্ক এ তরল আছে তার দেয়ালে সাবধানে ফোম থ্রো করলে ফোম আসতে আসতে তরলের উপর আস্তর তৈরি করবে। আর সরাসরি দিলে তরল ছিটকে গিয়ে আগুন কে আরো ছড়িয়ে দেবে।
CO2 কার্বন ডাই অক্সাইড সিস্টেম :
আমরা জানি কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাসের থেকে ভারি। যদি কোন বদ্ধ্য ঘরে আগুন লাগে আর সেখানে আমরা যদি কার্বন ডাই অক্সাইড স্প্রে করি তাহলে এক সময় তা অক্সিজেন কে সরিয়ে যায়গা দখল করে নেবে এবং আগুন কে নিভিয়ে দেবে। জাহাজে বড় আগুন নির্বাপনে এ ব্যাবস্থা কার্যকরী। সাধরণত ইঞ্জিন রুম ও ট্যাঙ্কার এর কার্গো পাম্প রুমে এ ব্যাবস্থা থাকে। একটি নির্দিষ্ট রুমে প্রয়োজন অনুসারে কার্বন ডাই অক্সাইড এর সিলিন্ডার থাকে। যেগুলো একটি পাইপ লাইনের সাথে যুক্ত এবং পাইপ লাইনের শেষে স্প্রে নজল থাকে। তবে এটি স্প্রে করার আগে একটি নির্দিষ্ট এলার্ম বাজানো হয়। যেটি শোনা মাত্র সবাই যেখানেই থাকুক মাস্টার স্টেশনে জড় হবে। জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা ক্রু লিস্ট অনুসারে হেড কাউন্ট করে নিশ্চিত হবেন যে ঐ নির্দিষ্ট যায়গায় কেউ নেই। তার পর ক্যাপ্টেন এর অনুমতি সাপেক্ষে সেই স্থানে কার্বন ডাই অক্সাইড স্প্রে করা হবে। আর তার আগে সে সে স্থানের সব ভেন্টিলেশন, রানিং মেশিনারিজ বন্ধ করতে হবে। তবে এ ব্যাবস্থা এমন ভাবে থাকে যে কার্বন ডাই অক্সাইড প্রি ডিসচার্জ এলার্ম এর সাথে সাথেই নির্দিষ্ট কিছু মেশিনারিজ অটো বন্ধ হবে। আর কার্বন ডাই অক্সাইড চার্য এর পর নির্দিষ্ট কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষে একজন ফায়ার ম্যান আউট ফিট পরে সেই স্থানে গিয়ে নিশ্চিত হবেন যে সেখানে আর আগুন নেই আর তার পর ভেন্টিলেশন খুলে যথাযথ ভাবে বাতাস পরিবহন করে এবং গ্যাস ডিটেক্টরের সাহায্যে নিশ্চিত হতে হবে যে সেখানে কার্বন ডাই অক্সাইড নেই আর তার পরই সে স্থানে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যাবে।
পোর্টেবল ফায়ার এক্সটিংগুইসার:
ফায়ার এক্সটিংগুইসার হল সহজে বহন যোগ্য অগ্নি নির্বাপন অস্ত্র বা ইকুইপমেন্ট। আমরা সাধারনত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ লাল রং এর সিলিন্ডার দেখি যার সাথে একটি নল লাগানো থাকে। এগুলিকেই পোর্টেবল ফায়ার এক্সটিংগুইসার বলে। কয়েক ধরনের ফায়ার এক্সটিংগুইসার আছে যা আগুনের প্রকৃতি ভেদে ব্যাবহার হয়। যেমন , ফোম ফায়ার এক্সটিংগুইসার ব্যাবহার হয় তরল আগুনের জন্য। কার্বন ডাই অক্সাইড এক্সটিংগুইসার ব্যাবহার হয় কঠিন আগুন বা বৈদ্যুতিক আগুনের জন্য। মনে রাখা জরুরী যে বৈদ্যুতিক আগুনে পানি বা ফোম কোন ভাবেই ব্যাবহার করা যাবে না। কার্বন ডাই অক্সাইড এক্সটিংগুইসার ব্যাবহার এ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। যে এক্সটিংগুইসার এর নজল টা প্লাস্টিকের তৈরি এবং নজল দেখতে চওড়া আর এর সাথে ধরার একটি হ্যান্ডেল আছে সেটি কার্বন ডাই অক্সাইড এক্সটিংগুইসার্। সিলিন্ডারের গায়েও দেখে নিতে পারেন। এটি ধরার সময় অবশ্যই ঐ নজল এ হাত না রেখে হ্যান্ডেল এ হাত রাখতে হবে কারন কার্বন ডাই অক্সাইড রিলিজ হয়ার সময় তাপ মাত্রা হারিয়ে প্রায় -৭০ ডিগ্রি তে চলে যায়। যদি শরীর এর সংশপর্শে আসে তাহলে ফ্রস্ট বাইট হবে। আর কোন ভাবেই কারো শরীর এ সরাসরি এটি ছোড়া যাবে না তাতে তার মৃত্যু হতে পারে।
এর পর আছে ড্রাই পাউডার এক্সটিংগুইসার্। এর সিলিন্ডারে থাকে রাসয়নিক পাউডার যা ছোড়া হলে সেই বস্তুর উপর সুক্ষ্ম আবরণ তৈরি করে ফলে অক্সিজেন এর অভাবে আগুন নিভে যায়। বৈদ্যুতিক এবং গ্যাস এর আগুনে এটি খুবই কার্যকরী।
এ ছাড়াও আরো কিছু ব্যাবস্থা থাকে তবে এগুলোই প্রধান। জাহাজে প্রতি মাসে বিভিন্ন সিচুয়েশন এ ক্রু দের কে ফায়ার ড্রিল করানো হয় যাতে বিপদের সময় তারা প্যানিক না হয়ে সঠিক কাজ টি করতে পারে। আর একটি মাস্টার লিস্ট এ সবার দায়িত্ব ভাগ করা থাকে যাতে কম সময় এর মাঝে সুশ্রিঙ্খল ভাবে বিপদের মোকাবেলা করা যায়।
আমরা নাবিক রা প্রতি মাসে এমন অগ্নি নির্বাপন ড্রিল করে নিজেদের প্রস্তুত করি কিন্তু যখন দেখি আমাদের দেশের মানুষ আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। বাংলাদেশে অনেক মেরিন অফিসার আছেন যারা এ কাজে দক্ষ। অনেকেই দেশে থাকেন বছর এর কোন না কোন সময়। আবার অনেক অভিজ্ঞ অফিসার আছেন যারা হয়ত আর জাহাজে আসেন না। দেশেই থিতু হয়েছেন তাদের কে যদি কাজে লাগানো যায় এসব আগুনের ঝুকি পূর্ন প্রতিষ্ঠান এর কর্মী দের প্রশিক্ষন বা সেসব স্থানের অগ্নি নির্বাপন ব্যাবস্থা সাজানোর তাহলে আশা করি আমাদের এ অবস্থার উন্নতি হবে। অথবা তাদের দিয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রিতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক ভাবে অগ্নি নির্বাপন ব্যাবস্থা পড়ানোর ব্যাবস্থা করা যায় তাহলে খুব সহজেই আমরা অনেক গুলো প্রশিক্ষিত হাত পেয়ে যাব।
সাধারন খেটে খাওয়া মানুষের পোড়া শরীর আর হয়ত দেখতে হবে না। নষ্ট হবেনা কোটি কোটি টাকার সম্পদ।