তো আমাদের পুরো প্ল্যানের একটা জায়গাতেই ভুল ছিল। সেটা হলো মহষেখালী সফরটা নিয়ে। এটার টাইমিংটা ছিল ভুল। যার জন্য আমাদের অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয় জোয়ার-ভাটার টাইমিংটা ভুলে যাবার জন্য।
আমরা রওনা দিয়েছিলাম কক্সবাজার থেকে দুটি স্পিড বোটে মহেষখালীর উদ্দেশ্যে। তখন বাজে প্রায় বেলা বারোটা। ওখানে পৌঁছে আমরা আবার একটা সাম্পান নৌকাতে করে একটা কিছুক্ষণ ঘুরলাম। সেখানে আমরা প্রথমে একটা মন্দিরে গিয়েছিলাম। বেশ কারুকাজ করা একটা মন্দির। অনেক উচুতে পাহাড়ের উপর। ওখানে পৌছেই ডাব আর মহেষখালীর বিখ্যাত মিষ্টি পান খেলাম।
এরপর গেলাম গোরকঘাটা বাজারের একটি হোটেলে লাঞ্চ করতে। এখানে এসে কক্সবাজারের চেয়ে মজা করে ভাত খেতে পারলাম। একটা জিনিস খেয়াল করলাম, ওখানকার রিক্সাওয়ালারা জোড় করে তাদের রিক্সায় তুলতে চাইছে এবং তারা বেশ আন্তরিক। আরো দেখলাম লবনের ক্ষেত। শুটকীর মাঁচা। অদ্ভুত সব দৃশ্য। চমৎকার একটা জায়গা।
লাঞ্চ করে গেলাম বেশ কিছু দুরে একটা বৌদ্ধ মন্দিরে গেলাম। সেখানে গেটে সবাইকে জুতা খুলে জমা দিয়ে যেতে হয়। বেশ কিছুক্ষন সেখানে ঘুরলাম, ছবি তুললাম। বের হয়ে ঢুকলাম একটা তাঁতী বাড়ীতে। বাড়ীগুলো চমৎকার। উঠোনে দোকান আর একটা ঘরের মধ্যে চলছে খট খট শব্দে তাঁত। সেখানে বসে সে বাড়ী মহিলা তাঁত বুনছেন।
এরপর রওনা দিলাম ঘাটের দিকে উদ্দেশ্য আবারো কক্সবাজারে ফেরা। ততক্ষন প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। পথে পড়ল শুটকীর বাজার। সেখানে নেমে আবারো সবার শুটকী কেনা। তারপর হেলেদুলে ঘাটে পৌঁছালাম। আমাদের তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে কারণ আমাদের ঢাকা আসার বাস রাত ১১টায় ছাড়বে।
কিন্তু ঘাটে পৌঁছে যা দেখলাম তা দেখে আমাদের অবস্থা খারাপ। ঘাটে কোন নৌকা বা স্পিডবোট নেই। আর ঘাট থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দুরে অস্থায়ী ঘাট করা হয়েছে ভাটার কারণে। চারিদিকে সব ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূল বেরিয়ে পড়েছে। ঘাটটি একটি বড় সাম্পানের উপরে। সেখানে আধা ঘন্টা পর পর এসে ভিড়ছে ছোট ছোট শ্যালো নৌকা। কিন্তু কোন স্পিড বোট আসেছে না। কারণ পানি বলে কম। তাতে স্পিডবোটের পাখা নীচে বেঁধে যেতে পারে। ঘাট থেকে সেই সাম্পানে উঠতে হবে ছোট ছোট ডিঙ্গির উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে। সেই ডিঙ্গি কোনটা উপরে কোনটা নিচে। কোলে ঘুমন্ত বাচ্চা নিয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে সেগুলো পার হয়ে আসাটা কি কষ্টকর সেটা প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া কেউ বুঝবে না।
অনেক মারামারি, অনেক কষ্ট করে লাষ্টে সেই বড় নৌকায় এসে পৌঁছালাম। আমার এককোলে আমার দেড় বছর বয়সী ঘুমন্ত ছেলে আর আরেক হাত দিয়ে স্ত্রীর হাত ধরে আছি। প্রতিটা লোকজনের চোখে মুখে একটা ভীতি কাজ করছে। যেতে পারবে কি পারবে না। অনেক মহিলা আর বাচ্চারা কাঁদছে। আবার একটা নির্দিষ্ট সময় পর নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ সেখানে এত লোক গিয়েছিল যে অন্যদিন এত লোক দেখা যায় না (সেখানের লোকের মুখে শোনা)। কারণটা ছিল, ঐ কয়েকদিন ছুটির মধ্যে এযাবৎ কালে সর্বোচ্চ চার লাখ লোক সমাগম হয়েছিল কক্সবাজারে (সেখানকার জেলা প্রশাসকের পরিসংখ্যান মতে)। এদিকে নৌকার উপরে অতিরিক্ত লোকের ভীড়ের জন্য একজন পড়ে গেল পানিতে। তাকে নাকি দড়ি দিয়ে তোলা হলো। সেই সাম্পানের পাটাতন পানি থেকে কমপক্ষে প্রায় ২০/২২ ফিট উপরে।
পরিশেষে আমাদের একজন অনেক কষ্ট করে সেখানকার এক মাতব্বর টাইপের লোক ধরে একটি স্পিডবোট জোগাড় করল। তাতেই আমরা সবাই (যাদের বাচ্চ ছিল) উঠলাম। স্পিডবোট ছাড়লো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর পর নীচের বালুতে আটকে যায়। সেকি ভয়াবহ অবস্থা। এভাবে অনেক কষ্ট করে প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর কক্সবাজার ঘাটে এসে পৌঁছালাম।
সেদিনকার মত এত ভয়াবহ উৎকন্ঠা আমি কোনদিনও দেখিনি কারো মধ্যে। তখন আমার শুধু টাইটানিকের সেই সিন মনে পড়ছিল। যখন টাইটানিক ডুবে যাচ্ছিল আর ওটার যাত্রীরা প্রাণপণে চেষ্টা করছিল বোটে উঠার জন্য। একদম সেই সিনটার কপি দেখেছিলাম সেদিন।
যারা মহেষখালী যাবেন, তারা কক্সবাজার থেকে রওনা দেবার আগে জোয়ার ভাটার টাইম জেনে তারপর রওনা দেবেন। মহেষখালী থেকে ভাটা হওয়ার আগেই রওনা দিতে হবে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে।
ছবি:
১। ভাটার সময়ের ম্যানগ্রোভ।
২। জোয়ারের সময়ের ম্যানগ্রোভ।
৩। নৌকার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ের একটি ছবি
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০০৮ দুপুর ২:১৬