গতপর্বের পরে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
জামার্নী, ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পোল্যান্ডকে আক্রমনের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে। এতে সেইসময়কার পরাশক্তিগুলোর মধ্যে একটা বিভাজন শুরু হয়। এর ফলে জার্মানীর পক্ষে চলে আসে ইতালি, যুগোস্লাভিয়া, রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া এবং ভৌগলিক দিক থেকে অনেক দুরে থাকা জাপানও। এদের এই গ্রুপটাকে বলা হয় অক্ষশক্তি। আর ঠিক এদের বিপরীতে মিত্র বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠে ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, আমেরিকা সহ প্রভৃতি দেশ। এই বিশ্বযুদ্ধ ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সালে। পুরো ইউরোপ, প্রশান্ত মহাসাগর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ভূমধ্যসাগর এবং আফ্রিকা জুড়ে চলে তান্ডব। আর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এই ডামাডোলে বিজয়ী হয় মিত্রবাহিনী। এবং ঠিক এই যুদ্ধ দিয়েই পৃথিবীতে বৃহৎ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া। এই ভয়াবহ যুদ্ধে আনুমানিক ৬ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ মারা যায় যার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল রাশিয়ার নাগরিক। নিহতের এই সুবিশাল সংখ্যার মূল কারণ ছিল কিছু গণহত্যামূলক অভিযান। [প্রসংগ ক্রমে এই "দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস" প্যারাটি লিখতে হলো, যেহেতু মূল পোষ্টের সাথে সম্পর্কযুক্ত]
যুদ্ধে নিহত মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের সমাধি তথা ওয়ার সিমেট্রীঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের যুদ্ধে নিহত মিত্রবাহিনীর সেনাদের স্মৃতি সংরক্ষণে ভারতে ১০টি, মিয়ানমারে (বর্মা) ৩টি, পাকিসত্মানে ২টি, সিঙ্গাপুরে ১টি, মালয়েশিয়ায় ১টি, জাপানে ১টি, থাইল্যান্ডে ২টি, বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ১টি, কুমিলস্নার ময়নামতিতে ১টি (যদিও হিসাব মতে ৩টি) সহ ৮টি দেশের ২২টি সমাধি ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। যাকে ওয়ার সিমেট্রী বলে। কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহের সংগঠন কমনওয়েলথ গ্রেভস কমিশনের তত্ত্বাবধানে এ সব সমাধিক্ষেত্র পরিচালিত হয়।
কমনওয়েলথ গ্রেভস কমিশনের সূত্র মতে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত এই সৈন্যদের কবর মোট ১৫০টি দেশে রয়েছে। এদের সবগুলোই কনওয়েলথভুক্ত দেশসূমহের সংগঠন কমনওয়েলথ গ্রেভস কমিশন দেখাশোনা করে। বাংলাদেশে মোট ১৪৪৭ জনের কবর আছে। তার মধ্যে যুদ্ধে নিহত বেসামরিক লোকের ৫টি, ২৭টি অজানা লোকের এবং বাদবাকী ১৪১৫ জনের যাদের নাম পাওয়া গেছে। প্রতিটি স্মৃতিফলকে মৃত সৈন্যের নাম, জাতীয়তা, বয়স, র্যাংক লেখা আছে। মিত্র বাহিনীর যেসব দেশের সৈন্যদের কবর দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রিটিশ-ভারত। তবে বাংলাদেশে দেয়া কবরের সংখ্যার ব্যাপারে কমনওয়েলথ গ্রেভস কমিশনের দেয়া তথ্যের সাথে ইন্টারনেটে পাওয়া বিভিন্ন তথ্যে অল্প কিছু গড়মিল পাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রীঃ
চট্টগ্রামের মেহেদিবাগে বাদশা মিয়া রোডে প্রায় সাড়ে সাত একর জমিতে গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রী। এখানে যে মেমোরিয়াল বুক আছে সেই হিসেবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাণিজ্যিক নৌবহরের যে ৬ হাজার ৫০০ নাবিক মৃত্যুবরণ করেন, তাদের নাম ও পদবি লেখা আছে এবং আরেকটি রেজিস্টারে ৭৫৫ জন সৈনিকের নাম ও পদবিসহ সংক্ষিপ্ত পরিচিতি মুদ্রিত রয়েছে সুবিন্যস্তভাবে যাদেরকে এখানে সমাহিত করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রী
প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী সৈনিককে নিজ নিজ ধর্মীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় এবং ফলকে ধর্মীয় প্রতীক খোদাই করা আছে। মুসলমানদের জন্য কলেমাখচিত, খ্রিস্টানদের জন্য ক্রুশ। সৈনিকদের মধ্যে ১৪৯ জন মুসলিম, পাঁচজন হিন্দু, একজন ইহুদি, ১৯ জন বৌদ্ধ, ৫৭৭ জন খ্রিস্টান এবং চারজন অজ্ঞাত ধর্মাবলম্বী। নামের ইংরেজি আদ্যক্ষর দিয়ে কবরের সারি সাজানো। দেশভেদে ব্রিটেনের ৩৭৮ জন, কানাডার ২৫ জন, অস্ট্রেলিয়ার ৯ জন, নিউজিল্যান্ডের দুজন, অবিভক্ত ভারতের ২১৪ জন (বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান মিলে), পশ্চিম আফ্রিকার ৯০ জন, পূর্ব আফ্রিকার ১১ জন, বার্মার দুজন, নেদারল্যান্ডের একজন, জাপানের ১৯ জন ও অন্যান্য চারজনসহ ৭৩৭ জন জানা আর বাকি ১৮ জন অজানা সৈনিক।
কুমিল্লা ওয়ার সিমেট্রীঃ
কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে ব্রিটেনের ৩৫৭ জন, কানাডার ১২, অস্ট্রেলিয়ার ১২, নিউজিল্যান্ডের ৪, দক্ষিণ আফ্রিকার ১, ভারতীয় উপমহাদেশের ১৭৮, রোডেশিয়ার ৩, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬, মিয়ানমারের ১, বেলজিয়ামের ১, পোল্যান্ডের ১ ও জাপানের ২৪জন যুদ্ধবন্দীসহ ৭৩৭ জনকে এখানে সমাধিস্থ করা হয়।
কুমিল্লা ওয়ার সিমেট্রী
১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত সৈনিক ও সেনা কর্মকর্তাদের সমাধি তখন থেকে শহীদদের সমাধিস্থল ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করে।
এইসব ওয়ার সিমেট্রীতে প্রতিবছরের ৫ নভেম্বর কমনওয়েলথভুক্ত দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা এই সিমেট্রিতে উপস্থিত হয়ে নিজ নিজ দেশের পক্ষে স্মৃতিফলকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন।
আজাদ হিন্দ ফৌজের কিছু সৈনিক
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নিহত মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের কবরের ব্যবস্থা হলেও ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে নিহত তথা আজাদ হিন্দ ফৌজের কোন সৈন্যের কবর আছে কিনা তা জানা যায় নি। বা থাকলেও সেটা নিয়ে গড়ে উঠেনি কোন বিশেষ ব্যবস্থা, ঠিক যেমনটা মিত্রবাহিনীর মৃত সৈনিকদের জন্য ওয়ার সিমেট্রী করা হয়েছে। তাদের স্বরণে নেই কোন সৃত্মিসৌধ। প্রকৃতপক্ষে ঐসব আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যরা ছিল মুক্তিযোদ্ধা। তারা দেশ বা তাদের ভুখন্ড বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছে। তারাই বীর সৈনিক। তাদের নাম, সমাধি বা সর্বশেষ অবস্থা সম্মন্ধে গবেষণার প্রয়োজন আছে।
আমরা সেইসব আজাদ হিন্দ ফৌজের নিহত ও যুদ্ধাহত সেনাদের স্যালুট জানাই। তারাই আমাদের আপন। তারাই মুক্তিকামী জনতা। তারা তাদের জীবন দান করে গেছে আমাদের দেশের (তখনকার ভারতবর্ষ) জন্য। এই জাতিকে মুক্তি দিতে চেয়েছে ব্রিটিশের শোষন থেকে। তাই এখন ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্থান সম্বিলিত অথবা একক ভাবে এইসব বীরযোদ্ধদের সনাক্ত করে এবং তাদের সমাধি চিহ্নিত করে যথাযথ শ্রদ্ধা দেখানো উচিত। আবারো আমার স্যালুট জানাই আজাদ হিন্দ ফৌজের ঐসব বীর সৈনিকদের যারা দেশের জন্য জীবন দিয়ে গেছেন।
সমাপ্ত
গত পর্ব
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১১ সকাল ১১:৫৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





