ভারতবর্ষে ২০০ বছরের ইংরেজ শোষনের ইতিহাসঃ
একসময়ে পুরো বিশ্বের প্রায় অনেক দ্শেই শাসন করতো ইংল্যান্ড। মূলতঃ শাসন নয় শোষন। এই ভারতবর্ষও তার ব্যাতিক্রম ছিল না। সেটা নিয়ে আছে এক দুঃখ গাঁথা অধ্যায়। তার পরতে পরতে অনেক নির্যাতন আর অস্ফুট কান্না। যাক সে কথা।
সেই সময়কার দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতবর্ষ
মুলতঃ ইংরেজরা ১৬০৮-এ মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনকালে সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি পায়। আস্তে আস্তে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে তাদের বিচরণ শুরু হয়। ১৬৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে জেমস হার্ট ঢাকা প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ আগমন শুরু হয়। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধ হয় তাতে বাংলার নবাবের করুন মৃত্যু দিয়ে এই ভুখন্ডে অর্থাৎ ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সূচিত হয়।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা
এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় ইংরেজদের পক্ষ থেকে লর্ড ক্লাইভ। এবং তাকে সহায়তা করে নবাব সিরাজের পরিবারের কয়েকজন ও মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগত শেঠ সহ অন্যান্য বিশ্বাসঘাতক। বিশ্বাসঘাতকতার পুরষ্কার স্বরূপ মীরজাফর বাংলার নবাব হয় এবং লর্ড ক্লাইভ তৎকালীন ত্রিশ লক্ষ টাকা ও চব্বিশ পরগনার জায়গিরদারি লাভ করে। এর পরে লর্ড ক্লাইভ ইংল্যান্ড চলে যায় আবারো ফিরে আসে ১৭৬৫ সালের মে মাসে এবং ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন। একজন কেরানী থেকে সে গর্ভনর হয়।
সেই কুখ্যাত লর্ড ক্লাইভ
বাংলার সেই কুখ্যাত সন্তান, ষড়যন্ত্রকারীদের প্রধান মীর জাফর, এক পাপিষ্ঠের নাম
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে হত্যার পর এই পাঁচ পুতুল পর্যায়ক্রমে নবাব সিংহাসনে বসেছিল
১০০ বছর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক শোষনঃ
১৭৬৫ সালের ১লা অগাষ্ট লর্ড ক্লাইভ দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেন। বিহার-ওড়িশার প্রকৃত শাসন ক্ষমতা লাভ করে, নবাবের নামে মাত্র অস্তিত্ব থাকে। ফলে পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে যে শাসন-ব্যবস্থা চালু হয় তা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত। নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কোম্পানি। এতে বাংলার নবাব আসলে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে আর এই সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। মূলতঃ ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল এই প্রায় ১০০ বছর ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে ভারতবর্ষের শাসনভার থাকে।
৯০ বছরের ব্রিটিশ ভারত ঔপনিবেশিক শোষনঃ
এরপর ১৮৫৮ সালে ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির হাতে স্থানান্তরিত হন। রানি ভিক্টোরিয়া নিজ হাতে ভারতের শাসনভার তুলে নেন। এর সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাণী ভিক্টোরিয়া
১৮৭৬ সালে ভিক্টোরিয়া ভারত সম্রাজ্ঞী উপাধি গ্রহণ করেন। এই সময়কালকে বলা হয় ব্রিটিশ ভারত ঔপনিবেশিক শাসন বা ব্রিটিশ রাজ। এই ভুখন্ডে ছিল বর্তমানের ভারত, পাকিস্থান ও বাংলাদেশ। এই তিনটি ভুখন্ড মিলে বলা হতো ভারতীয় সাম্রাজ্য। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য ভারতীয় অধিরাজ্য ১৪ই অগাষ্ট (পরবর্তীকালে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র) ও পাকিস্তান অধিরাজ্য ১৫ই অগাষ্ট (পরবর্তীকালে পাকিস্তান) নামে দুটি অধিরাজ্যে বিভক্ত হলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। সেই সাথে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৮৫৮ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯০ বছর ব্রিটিশের প্রত্যক্ষ শাসনে থাকে এই ভারত সাম্রাজ্য।
ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঃ
প্রায় এই ১৯০ বছর এই ভারত ভুখন্ডের মানুষরা বিভিন্ন ভাবে প্রতিবাদ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। আর তাই ১৮৫৭ সালে ভারতে প্রথম স্বাধীনতার আন্দোলন হয়। কিন্তু বর্বর ইংরেজদের ভাষায় ওটা ছিল "সিপাহী বিদ্রোহ"।
ভারতে প্রথম স্বাধীনতার আন্দোলনের একটি কাল্পনিক চিত্র যাকে ইংরেজরা সিপাহী বিদ্রোহ বলে
প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের পরে সেকুন্দ্রাবাগের ছবি ইটালীর ফেলিস বিয়াতো নামক ফটোগ্রাফারের তোলা। (এখানে অনেক কংকাল ও মাথার খুলি পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে)
এখান থেকেই প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়
ইংরেজ সেনাবাহিনীর অন্তর্গত ভারতীয় সিপাহীরা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহে মূল ভূমিকা পালন করে। ইংরেজ সরকার এই বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করলেও এর মাধ্যমে ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়।
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অর্থাৎ ১৯৪৫ সালে ভারতবর্ষ জুড়ে "ইংরেজ খেদাও" আন্দোলন তীব্রতর হয়। কিন্তু মহাত্বা গান্ধী সহ সব বড় বড় নেতা তখন সরাসরি ইংরেজদের হটাও আন্দোলনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন।
মহাত্বা গান্ধীর সাথে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু
মহাত্বা গান্ধীর দিক থেকে তাঁর "অহিংসা মনোভাব" এর কারণে হয়ত আন্দোলন বেগবান হচ্ছিল না। গান্ধীজীর মতে "যখন আমি হতাশ হই , আমি স্মরণ করি সমগ্র ইতিহাসেই সত্য ও ভালবাসার জয় হয়েছে । দুঃশাসক ও হত্যাকারীদের কখনো অপরাজেয় মনে হলেও শেষ সবসময়ই তাদের পতন ঘটে মনে রাখবেন সর্বদাই।" অপরেকে নেতাজীর বক্তব্য ছিল,"তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব"।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু মহাত্বা গান্ধীর এই অহিংসা মনোভাব পছন্দ করতেন না। উনি চাইতেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এবং সেটা হবে সমর যুদ্ধ। তাই তিনি খুঁজছিলেন ঠিক সেই মুহুর্তে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোন পরাশক্তি আছে। সেই হিসেবে সে খুঁজে পায় জামার্নীকে আর ইংল্যান্ড তো তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনী। আর তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতবর্ষের অংশগ্রহনটা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ভালো ভাবে নেননি। তিনি হিটলারের কাছে গেলেন।
জার্মানীতে হিটলারের সাথে সুভাষ চন্দ্র বসু
কিন্তু সেই মুহুর্তে হিটলার প্রচন্ড ব্যাস্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে। তাই নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু অক্ষশক্তির আরেক শক্তিশালী রাষ্ট্র জাপানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। এসময় জার্মান তাকে একটি সাবমেরিনে করে জাপানে পৌছে দেয়। জাপান নেতাজীর পরিকল্পনা শুনে, এতে মত দেয়। এবং প্রয়োজনীয় অর্থ ও সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে।
জাপানে সুভাষ চন্দ্র বসু
রাসবিহারী বসুর কাছ থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব নিয়ে ভারত আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ মূলতঃ ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা গঠিত একটি সশস্ত্র সেনাবাহিনী। ১৯৪২ সালে এই বাহিনী গঠিত হয়। এর বাহিনী ভিতরে ভারতের স্বাধীনতাকামী মানুষ, ইংরেজ নির্যাতিত ভারতীয়, মুটে ও মজুর ছিল। আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অর্থের অভাব থাকলেও নেতাজী সুভাসের অসাধারণ নেতৃত্বের ফলে প্রায় ৬০ হাজার সৈন্যের একটি সুশৃঙ্খল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে।
আজাদ হিন্দ ফৌজের কুচকাওয়াজে সুভাষ চন্দ্র বসু
জাপানী সহায়তায় বলীয়ান হয়ে এই বাহিনী ভারতের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ভারতকে আক্রমন করে। [এখানে একটা বির্তক আছে যে কেন সে ভারতীয় হয়ে ভারতকে আক্রমন করলো? আসলে তার আক্রমন ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে]
জাপানের সহায়তায় আজাদ হিন্দ ফৌজ অতর্কিত আক্রমনে ভারতে ইংরেজরা কিছুটা হলেও নড়বড়ে হয়ে যায়। এক যুদ্ধের ভিতরে আরেক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ভারতের আরাকান, ইম্ফল, ময়রাং, বিষেণপুর প্রভৃতি স্থান সুভাষ চন্দ্র দখল করে নেন। এসব দখলকৃত জায়গা পুনরুদ্ধারের জন্য ব্রিটেনের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা যুদ্ধবিমান ও কামান নিয়ে আক্রমণ শুরু করে। ঠিক এই মুহুর্তে নেতাজীর দল একটু পিছপা হয়ে পড়ে। তখন তারা রেঙ্গুনে গিয়ে আবারো পুর্নগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। কয়েক মাস ব্যাপী এ যুদ্ধে মারা যায় উভয় পক্ষের অনেক সৈন্য। কিন্তু ঠিক এই মূহুর্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় পরাজিত হয় অক্ষ বাহিনী। তাই জাপানের আত্মসমাপর্নের ফলে বন্ধ হয়ে যায় আজাদ হিন্দ ফৌজের রসদ সরবরাহ। তারপর থেকে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু নিখোঁজ হন। কথিত আছে ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইওয়ানে একটি বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। (তবে তাঁর এই দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে বির্তক আছে)
চলবে.....
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১১ রাত ১০:৩৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



