
আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু জীবনের পরতে পরতে যা প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে এই 'স্বাধীনতা' নিয়ে প্রশ্ন জাগে?
জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের প্রতি সরকারের বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, সীমাহীন দুর্নীতি, এবং অর্থ-পাচার—এগুলো কি পূর্বের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগ বা পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণেরই একটি চলমান ও তিক্ত ধারাবাহিকতা নয়? আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, আজকের বাংলাদেশ কেবল নামেই স্বাধীন। কিন্তু এই জাতি কখনো প্রকৃত স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বাদ অর্জন করতে পারেনি। আসলে, সময়ের পালাবদলে স্বাধীন বাংলা ছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলতে থাকা মনস্তাত্ত্বিক স্নায়ুযুদ্ধের এক অবাধ বিচরণ ভূমি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এদেশের সরকার ও প্রায় ৫২ বছর ধরে এই দুই দেশের কাছে নিজেদের স্বাধীনতা বন্ধক রেখে কার্যক্রম চালিয়েছে। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, মানব উন্নয়ন, কিংবা উদ্ভাবন—গর্ব করার মতো এমন কোনো ভিত্তি আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছিল আকস্মিকভাবে। গোটা জাতি বা দেশের মানুষ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। আর এই অপ্রস্তুত থাকার কারণেই এর সূচনালগ্ন থেকে এদেশের গণতন্ত্র তথা রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল সবসময় অস্থির। পাশাপাশি এই অস্থিরতার মূল কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ গঠনের সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলো অনেকেই সু-শিক্ষিত ও আধুনিক মনস্ক ছিলেন না।
উদাহরণস্বরূপ, আমাদের একজন ব্লগার "চাঁদগাজীর" কথাই ধরা যাক। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু সুশিক্ষিত আধুনিক মানুষ নন। উনি গ্রামে গরু চরিয়েছেন, ছাগলকে ঘাস খাইয়েছেন, ফসল উঠার সময় ধান কেটেছেন, গভীর রাতে যাত্রাপালা দেখে ঘরে ফিরেছেন। হুট করে সংঘটিত ৯ মাসের একটি সশস্ত্র সংগ্রামের পর একটি স্বাধীন দেশের পলিসি মেকারে বনে গেছেন। অর্থনীতি, কূটনীতি, বৈশ্বিক রাজনীতি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্ব-ব্যবস্থা, এবং জটিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার ফলে হার্ভার্ড পড়া কিসিঞ্জারের সাথে কূটনীতিতে তার পেড়ে ওঠার কথা নয়। ফলাফল একাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্ভিক্ষ, বাকশাল এবং শেষ পর্যন্ত শেখের মৃত্যুর মতো ট্র্যাজেডি। অথচ দেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী এই চরম সংকটকালে দেশ পরিচালনার ভার নেওয়া উচিত ছিল সুশিক্ষিত, আধুনিক চেতা এবং দূরদর্শী লোকজন যেমন ব্লগার খায়রুল আহসান, ডঃ আলী, শ্রাবণধারার এবং পরবর্তীতে তাদের উওরসুরী জুল ভার্ন ও ভুয়া মফিজদ্বয়। ২৪-এর 'টোকাইয়ের' মতো ৭১-এ ও দেশ পড়েছিল চাঁদগাজীদের মতো 'রাখালদের' হাতে। টোকাই-রাখাল মিলে অভ্যুত্থান আর স্বাধীনতা লাড্ডু খেয়ে শেষ করে ফেলেছে।
এই পেরা সম্পন্ন ব্যক্তিগত মতামত। শত চড়াই-উৎরাই পার করে দেশ স্বাধীনের পর শেখের উচিত ছিল ভারতীয় বাহিনীকে দেশে আরো কয়েক বছরের জন্য কোনো চুক্তির মাধ্যমে রেখে দেওয়া।দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত না করে, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা না ভেবে, একটি ধর্ম-নিরপেক্ষ সংবিধানের ভিত শক্ত না করে, এবং দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা তৈরি না করেই ভারতীয় সেনাবাহিনীকে এভাবে দ্রুত ফিরিয়ে দেওয়াটা একদমই উচিত হয়নি। সিঙ্গাপুরের স্থপতি 'লি' স্বাধীনতার পরও ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন, যাতে ব্রিটিশ বাহিনী আরও কিছুদিন সিঙ্গাপুরে অবস্থান করে। কারণ 'লি' জানতেন, বিশ্ব তখন পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের এক শীতল যুদ্ধে লিপ্ত। এই প্রেক্ষাপটে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য স্থিতিশীলতা ছিল প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য।
বাংলাদেশ সেই দূরদর্শিতা দেখাতে পারেনি। ফলস্বরূপ, স্বাধীনতার ফসল ঘরে তোলার আগেই আমরা এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়েছিলাম, যার ধারাবাহিকতা আজও চলমান। প্রকৃত স্বাধীনতা তাই এই জাতির কাছে আজও এক অধরা স্বপ্ন।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


