দশম প্রয়ান দিবস। কবি শামসুর রাহমান। বিনম্র শ্রদ্ধা আপনাকে।
বাংলাদেশে শামসুর রাহমানের প্রয়ানের পর আর কোন প্রধান কবি আমরা পাইনি। এর জন্য সম্ভবত একটি রাজনৈতিক ঘোষণা প্রয়োজন হয়। সেটি যেহেতু হয় নি, শামসুর রাহমান এখনো আমাদের প্রধান কবি। সৈয়দ সামসুল হক চাতুর্য্যের জাল বিস্তার করে রেখেছেন, কিন্তু রাজদন্ড নড়ছে না। এই দৌঁড়ে আরো কয়েকজন রয়েছেন। আল মাহমুদ-এর ভাগ্যে এই যাত্রায় তা আর হবে না। তাই আমাদের শেষ প্রধান কবি শামসুর রাহমান। এই মোলায়েম কবিতার কারিগর দশ বছর নেই, কিন্তু তাঁর কাব্যবিশ্ব আছে। সম্ভবত কবি শামসুর রাহমান মাঝে মাঝে মৃত্যুহীন অবিনশ্বর হতে চাইতেন। আবার কখনো কখনো মৃত্যুচিন্তা তাঁকে গভীর মগ্নতায় সন্ত্রস্ত করতো।
'ঘোর কেটে গেলে দূরে দৃষ্টি মেলে বলি মনে-মনে-
“এখনও যে বেঁচে আছ এমন ভুবনে,
কী বলবে একে? পরম আশ্চর্য সুনিশ্চয়।
এখনও সকালবেলা শয্যা ছেড়ে উঠে পড়ো মাঝে-মাঝে,
দুঃস্বপ্ন হামলা করে সত্যি, তবু ঘুম এসে পড়ে।“
অতিদূর সময়ের এক অতিশয় চেনা পাখি
ধূসর গাছের ডালে ব’সে বারবার
আমাকে ডাকছে ব’লে মনে হ’ল। ওর বড় বেশি
মধুর, আকর্ষণীয় ডাক এসে আমার বালক-বয়সকে
মৃত্যময় করে তোলে। তার সঙ্গে নেচে ওঠে বৃদ্ধের হৃদয়।'(একটি দু:স্বপ্নের ছায়া)
২০০৬ সালে প্রকাশিত 'না বাস্তব না দু:স্বপ্ন' কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা এটি। জীবনের অন্তে এমনি অজস্র কবিতা রচনা করেছেন প্রধান কবি শামসুর রাহমান। অন্য অনেকের মতই শামসুর রাহমানকে আমি পাঠ করতে শুরু করি 'স্বাধীনতা তুমি' কিংবা 'তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা' মধ্য দিয়ে। পরে, প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৬০), রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩), বিধ্বস্ত নিলীমা (১৯৬৭),ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাটা (১৯৭৪), বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে (১৯৭৭), ইকারুসের আকাশ (১৯৮২), উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ (১৯৮৩), যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে (১৯৮৪), টেবিলে আপেলগুলো হেসে উঠে (১৯৮৬), বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় (১৯৮৮)সহ বেশি ক'টি কাব্যপাঠে আমার সুযোগ হয়েছে। শামসুর রাহমানের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সম্ভবত পঁয়ষট্টি টি। তাঁর শেষ দিকে প্রকাশিত কোন কাব্যগ্রন্থই পুরো পাঠ করা হয় নি, কিংবা বলা চলে পাঠে মনোযোগি হতে পারি নি। এর প্রধানতম কারণ আমার প্রত্যাশা।
'চৈতন্যের আলো পড়ে ঘুম-পাওয়া সত্তার পাপড়িতে,
সূর্যের চুমোয় লাল পাণ্ডু গাল। টেবিলের দুটি
তরুণ কমলালেবু চেয়ে আছে দূরের আকাশে,
চিকন সোনালি রুলি ম্রিয়মাণ শঙ্খশাদা হাতে
যেন বেদনায় স্থির-মনে হল-সেই দুটি হাত
মায়াবী নদীর ভেজা সোনালি বালিতে আছে প’ড়ে!(তার শয্যার পাশে/প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে)
এই কবিতা পাঠের পর, মার্গীয় পাঠাভ্যাস যখন নেমে আসে এই কবিতায়-
'কে তুমি? কে তুমি আমাকে ব্যাকুল ডাকছ এই দারুণ
অবেলায়? তুমি কোনও বিজ্ঞানী নও নিশ্চয়ই,
তোমাকে তোমার দুরূহ গবেষণার কোনও কাজে
এতটুকু সাহায্য করার যোগ্যতা আমার নেই।'(প্রকৃতির দীপ্র স্নিগ্ধ উৎসব/হৃদপদ্মে জ্যোৎস্না দোলে)।
আবশ্যই এখানে আকাঙ্খার পাঠতৃষ্ণা নিবারন সম্ভব নয়। এই কারণেই অামি শামসুর রাহমানের অন্তের কবিতাগুলোর মনোযোগি পাঠক নই। তাছাড়া শেষ বেলায় অজস্রবার তাঁর মৃত্যুচিন্তা কাব্যের সৌন্দর্য হানি ঘটিয়েছে। বার বার ফিরে এসেছে পুরনো চিন্তা। সেই চিন্তাগুলো আগের মত সুবিন্যস্ত এবং কাব্যগুন সমৃদ্ধ নয়। তাই কেবলই মনে হতো, শামসুর রাহমান, এখন কবিতা থেকে ছুটি নিলেই পারেন। তিনি তা করেন নি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেছেন। শেষ পর্যন্ত কবিতা রচনার তৃষ্ণা জেগে থাকায় তিনি ৮৭ বছরেরও বেশি সময় বেঁচে ছিলেন। বাংলাদেশে একজন কবিকে নিয়ে একটি বিশাল গবেষণাগ্রন্থ রচিত হয়। 'শামসুর রাহমান, নি:সঙ্গ শেরপা'। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। রচয়িতা বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় হুমায়ুন আজাদ। আগ্রহ নিয়েই বইটি পাঠ করি। গ্রন্থটি পাঠের পর শামসুর রাহমান পাঠে আরো উপগত হই। এ নিয়ে প্রসঙ্গক্রমে হুমায়ূন আজাদের সাথে আমার কথাও হয়। আমার নেয়া দীর্ঘ এক স্বাক্ষাৎকারেও হুমায়ূন আজাদ গ্রন্থটি রচনার পটভূমি ব্যাখ্যা করেন(স্বাক্ষাৎকারটি হুমাযূন আজাদের 'ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ' গ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত আছে)। কথা শুনার পরে মনে হলো গ্রন্থটি রচনা করে তিনি ভুলই করেছেন। বললেন,'ওই গ্রন্থটি রচনা করাটা আমার ভুল ছিলো। শামসুর রাহমান এতো বেশি প্রসংশার যোগ্য নন। এখন হলে আমি ঠিক তার বিপরীত গ্রন্থ রচনায় উপনীত হতাম। শামসুর রাহমান জানেন না কার সাথে বিছানায় যেতে হয়, আর কার সাথে যেতে হয় না।' হুমাযূন আজাদের বিশালকায় গ্রন্থটি পাঠের পর শামসুর রাহমানকে নিয়ে আমার যে আগ্রহ তৈরী হয়েছিলো তার কিছুটা মাত্রা বিভ্রম হলো এই মন্তব্য শুনার পর। আমি হুমায়ূন আজাদের সাথে পুরোপুরি একমত না হলেও শামসুর রাহমানের শেষের দিকে কবিতাগুলো নিয়ে আমার মত বহু পাঠকের বিতৃষ্ণা রয়েছে বলে মনে করি।
শামসুর রাহমান তাঁর কবিতার মতই শান্ত। বিভিন্ন সময় এদিক সেদিক তাঁর সাথে দেখা হয়েছে আমার। একবার বেশি সময় সাথে থাকার সুযোগ হয়েছিলো। লেলিন আজাদের একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় উত্তরায় সাবেক আমলা ও কলামিস্ট মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায়। এটা ২০০২/০৩ সালের কথা। অনুষ্ঠানে শামসুর রাহমান ছাড়াও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ, নির্মলেন্দু গুণসহ আরো বেশ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। সবাই পানীয় হাতে গলা ভিজাচ্ছিলেন। আমরা চাইলেও বড়দের মাঝে পান করতে পারি না। পাশে বসে থাকি। এক পর্যায়ে শামসুর রাহমান বললেন,'তোমরা কিছু পান করছো না?' সাথে সাথে মহিউদ্দিন আহমেদ সুযোগ পেয়ে তাঁর ভাগিনাকে(আমার বন্ধু) বললেন ফ্রিজে রাখা বিয়ারগুলো আমাদের হাতে দিতে। আর তর সইলো না। বিয়ারের ক্যান হাতে নিয়ে গল্পে মগ্ন হই নির্মলেন্দু গুণের সাথে। গুণ দা প্রসঙ্গক্রমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারের বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং কেমন ছিলো সেই সময় তা নিয়ে কথা বলছিলেন। এক পর্যায়ে বললেন,'বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পুরো ঢাকা শহরে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো। কেনো এই হত্যাকান্ড ঘটেছিলো তা জানার জন্য চেষ্টা করছিলাম। তখন টেলিভিশন সবার বাসায় ছিলো না। গেলাম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী'র বাসায়। তিনি প্রথমে দরজা খুললেন না। পরে পীড়াপীড়ির পর খুললেও, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিষয়ে জানতে টেলিভিশন দেখতে এসেছি বললে, তিনি কোন মন্তব্য না করে আমাদের চলে যেতে বলেন।' গুণ দা'র গল্পে ছেদ পড়ে শামসুর রাহমানের কথায়। তিনি প্রকাশনা অনুষ্ঠানে কথা বলতে শুরু করেন। লেলিন আজাদের বই নিয়ে কথা বললেন। দেখলাম কত বিনম্র তাঁর আলোচনার ভাষা। বুঝলাম শামসুর রাহমান একজন কবি নন কেবল তিনি একজন ভালো মানুষও। অনুষ্ঠান শেষে গুণ দা'র কথার বিরোধিতা করি। কেননা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্ভব বাংলাদেশে একমাত্র বুদ্ধিজীবি যিনি কোন রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি করেন না। তিনি প্রান্তিক মানুষ এবং সময়ের কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যদি চুপ থাকেন, তার পিছনের কারন তিনিই বলতে পারেন। নির্মলেন্দু গুণ গল্প তৈরী করতে পারেন। একবার লন্ডনে এসে অনেক গল্পের জন্ম দিয়ে গেছেন। অন্য এক সময় সে বিষয়ে লেখার ইচ্ছে আছে। সম-সাময়িক কবিদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণ সম্ভবত কম পাড়াশুনা জানা কবি। তাঁর কবিতা নিয়েও বিস্তর বলার আছে। তাঁর রাজনৈতিক কবিতাগুলো জনপ্রিয় হয়েছে, কারণ সেগুলো স্লোগানধর্মী। সেগুলোকে অনেক সময় আমার রাজনৈতিক স্লোগান মনে হয়েছে। সেই তুলনায় শামসুর রহমানের কবিতাগুলো শিল্প-সৌকর্যে, রূপকল্পে ঈর্ষনীয় মাত্রায় কবিতা হয়ে উঠেছে।
'স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।'(স্বাধীনতা তুমি/শামসুর রাহমান)
এই যে রূপকল্প, যার মধ্যে দিয়ে কবিতার শরীরে চালান করা হয়েছে যাবতীয় রসদ। এটিই আধুনিক কবিতার চরিত্রকে সুসংহত করে। বিপরীতে যখন নির্মলেন্দু গুণকে দেখি-
'একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে কখন আসবে কবি?(স্বাধীনতা - এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো/নির্মলেন্দু গুণ)'
কোন কাব্যিক অনুরনন নেই। সরাসরি একটি বক্তব্য। বঙ্গবন্ধুর মঞ্চে আসার ঘোষণা দিচ্ছেন একজন উপস্থাপক। মানুষের মধ্যে আবেগ জাগানোর জন্য কবিতাটির আবেদন চিরকালীন সেটি অবশ্যই স্বীকার্য, তবে কাব্যমূল্যের বিচারে তা গৌণ। নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের কবিতাগুলোও বেশ জনপ্রিয়। তাঁর এই শ্রেনীর কবিতাগুলো'তোমার চোখ এতো লাল কেনো'র মতোই। সুড়সুড়ি ঘরনার। প্রেমের কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও তিনি তার বন্ধু কবি আবুল হাসানকে এখনো উতরে যেতে পারেন নি। ধরুন--
'এ ভ্রমণ আর কিছু নয় কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো;তোমার পায়ের নীচে পাহাড় আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই স্নান কর
পাথর সরিয়ে আমি ঝর্ণার প্রথম জলে স্নান করবো!(তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না/আবুল হাসান)
এই মাপের কোন প্রেমের কবিতা নির্মলেন্দু গুণের নেই। শামসুর রাহমান বেঁচে থাকলে কখনো এই কথা বলতেন কিনা জানি না। তবে উত্তরার ওই অনুষ্ঠানের কথা ফাকে আমাকে এই ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন।
,
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ১০:১৮