somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গাওয়াল (উপন্যাস: পর্ব-দুই)

০৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কমলপুর গ্রামের শেষ মাথায় ঋষিপাড়া। নামেই ঋষিপাড়া, দলিলি নাম; আদতে এই পাড়ার মানুষ ব্যতিত অন্যপাড়ার মানুষের কাছে মুচিপাড়া নামে পরিচিত। এ পাড়ার নিরুপায় বাসিন্দারাও মেনে নিয়েছে এই নাম। গ্রামের অন্যসব পাড়ার তুলনায় ঋষিপাড়া হলো মন্দিরের প্রসাদ প্রার্থী মানুষের লম্বা লাইনের শেষ মানুষটির মতো, প্রাসাদ বিতরণ করতে করতে পাত্রের তলিতে কিছু লেগে থাকলে পেলো, না থাকলে অভুক্ত থাকলো। প্রকৃতি ঋষিদের ঠকিয়েছে গায়ের রঙটি কষ্টিপাথরের মতো কালো দিয়ে, আর উঁচু বর্ণের মানুষ আদিকাল থেকেই এদেরকে ঠকিয়ে আসছে, নানাভাবে প্রবঞ্চনা-লাঞ্ছনা করে চলেছে। কালে কালে উঁচু বর্ণের পতিত লালসার রঙ গোপনে গড়িয়ে মিশে গেছে কারো কারো শরীরের নিকষ কালো রঙে! তাতে কালো রঙের একই ধারায় বয়ে চলা স্রোতধারায় ভিন্ন ভিন্ন ধারা যোগ হওয়ায় কোনো কোনো হারান কি হাসির গায়ের রঙের হেরফের হলেও তাদের জীবনধারা একই আছে! শিক্ষায় তারা পিছিয়ে, অর্থ-সম্পদে তারা নিন্মতর নিন্মবিত্তের বৃত্তে বন্দী। রাজনীতি কী তা তারা বোঝে কেবল ভোটের সময়- যখন ভোট ভিক্ষুকেরা দলে দলে তাদের বাড়িতে এসে হাত ধরে ভোট ভিক্ষা মাগে, তাদের ঘর্মাক্ত দেহগুলো জড়িয়ে ধরে; তাদের জীবনযাত্রা বদলে দেবার স্বপ্ন দেখিয়ে যখন পরোক্ষভাবে কটাক্ষ করে। বছরের পর বছর ঋষিপাড়ার জীবনধারা একইভাবে বইছে। সেই একই রুক্ষ, কদর্য, নিষ্ঠুর ছাঁচে ঢালা জীবন। তবু ঋষিপাড়ার মানুষ ভোটের সময় তুলনামুলক ধলা কাপড় পরে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দল বেঁধে ভোট দিয়ে আসে। জবুথবু বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও ভোট দেয়, ভোট ভিক্ষুকদের সাগরেদরা সকাল সকাল ভ্যান পাঠিয়ে দেয় এইসব প্রায় অথর্ব ভোটারদের জন্য। তখন পাড়ার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ বিমলের শতবর্ষী ঠাকুমাও নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করে। নাতবউরা সদ্য ক্ষারে ধোয়া সাদা থান পরিয়ে ভ্যানে তুলে তাকে ধরে বসে থাকে। বুড়ি মোটা ফ্রেম-মোটা ফাটা গ্লাসের ভেতর দিয়ে কুঁচকে যাওয়া চামড়ার মধ্যিখানে থাকা ঘোলা চোখ দুটো পিট পিট করে বহুদিন পর বাইরের পৃথিবী দ্যাখে। শেষবার দেখেছিল হয়তো আগের বারের ভোটের সময়। ভোটকেন্দ্রের সামনের জটলায় বহুদিনের পুরনো পরিচিত কাউকে দেখতে পেলে তার হাত ধরে কুশল জানতে চায়, হাসে, আবার কাঁদেও। বুড়ির কয়েক ফোঁটা চোখের জল ভাগাভাগি করে নেয় অসংখ্য বলিরেখার খাঁড়িপুঞ্জ। ভোটের উৎসব ছুঁয়ে যায় সবাইকেই। তারপরও পাকা রাস্তাটি লেজ গুটিয়ে নেয় মধ্যপাড়ার শেষ মাথার কাছটায়, বাজারের দাপুটে ব্যবসায়ী ননীগোপাল সাহার বাড়ি পর্যন্ত এসে। যেখান থেকে মাঝারি গতিতে আরো মিনিট চারেক হাঁটার পর ঋষিপাড়ার শুরু। ঋষিপাড়ার মাধব কিংবা যাদব ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের কাছে এর কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে, কাজ করতে করতে বর্ষা চলে এসেছে। বর্ষা শেষ হলেই ঋষিপাড়ার রাস্তার শেষ মাথা পর্যন্ত পাকা হবে। আর হয়েছে! তারপর কতো বর্ষা গেল! এখনো ঋষিপাড়ার জোয়ান-বুড়োরা গ্রীষ্মের উত্তপ্ত বেয়াড়া ধুলোয় পায়ের পাতা ডুবিয়ে আর বর্ষায় কাদার সাগর পাড়ি দিয়ে পাকা রাস্তায় ওঠে। পাকা ধরে খানিকটা এগোনোর পর ভবেশদের পুকুর থেকে পা ধোয়, আর ভুলে গেলে ধুলো-কাদামাখা রোমশ পা নিয়েই যায় যেখানে যাবার!

ঋষিপাড়ার মানুষের শিক্ষা নেই, নীলু ব্যতিত আরও তিন-চারজন আছে স্বল্পশিক্ষিত। স্কুলেও ঋষিপাড়ার ছেলে-মেয়েরা নানান রকম বৈষম্যের শিকার হয়। সহপাঠীদের, এমনকি শিক্ষকদেরও। দু’একজন উদারমনা শিক্ষক ব্যতিত অধিকাংশ শিক্ষকই তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। তাদের গায়ে হাত দেয় না। এমনকি তারা পড়া না পারলে উচ্চ বর্ণের হিন্দু কিংবা মুসলমান ছেলেদের মতো বেত দিয়েও তাদেরকে মারে না কোনো কোনো শিক্ষক। বলে, ‘কেন যে তোরা স্কুলে আসিস! তোদের দিয়ে লেখাপড়া হবে না। তোরা বরং জুতো সেলাইয়ের কাজটা ভালমতো শিখলেই পারতি!’ আবার কেউ বলে, ‘তোদের গায়ে এতো ময়লা, এই তোরা চান করিস নে!’
সহপাঠীরা তাদের কাছে বসতে চায় না। তাদের জায়গা হয় পিছনের বেঞ্চে। যদিবা উচ্চ বর্ণের কারো গায়ের সাথে ধাক্কা লাগে, ওদের পাছার ওপর দমাদম লাথি পড়ে। ওদেরকে কেউ খেলতেও ডাকে না। ওদের ধারে কাছে বসে কেউ টিফিন করে না। এতো গেল স্কুলের চিত্র। সমাজের চিত্র আরো করুণ! সেখানে পরতে পরতে অপমান আর লাঞ্ছনা! নগদ টাকা দিলেও বাজারের কোনো ভাতের হোটেল কিংবা মিষ্টির দোকানে বসে ওরা খেতে পারে না। অর্থাৎ খেতে দেওয়া হয় না। ওদেরকে খেতে দিলে অন্য হিন্দু এবং মুসলমানরা সেই হোটেল কিংবা মিষ্টির দোকান বয়কট করবে বলে হুমকি দেয়। চায়ের দোকানে ওদের জন্য নির্দিষ্ট দুটো চায়ের কাপে লাল রঙের দাগ দেওয়া থাকে। ময়লা, কালচে দাগ পড়া কাপ। কিন্তু কাপ না ভাঙা পর্যন্ত কাপের বদল হয় না। অপমানের এখানেই শেষ নয়। এখানকার নাপিতরা ওদের চুল কাটতে চায় না, কোনো নাপিত ওদের চুল কাটলে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা তার সেলুনে বসতে চায় না। সুলতানপুর বাজারে গিয়ে তারা চুল কাটায়। জেলে, শীল, ধোপা, কামার ইত্যাদি নিন্মবর্ণের হিন্দুরাও তাদেরকে ঘৃণা করে। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়ে অন্য নিন্মবর্ণের মানুষের ভেতরে যে ক্ষোভ জন্মায়; সেই ক্ষোভের ঝাল ঝাড়ে ওরা ঋষিদের ওপর, ঋষিরা নিন্মতর নিন্মবর্ণ, ঋষিরা সবার কাছেই ব্রাত্য!

প্রকৃত শিক্ষার অভাবে প্রকৃত কোনো নেতা গড়ে ওঠেনি ঋষিদের মধ্যে। সঙ্গত কারণেই তারা তেমন সংঘবদ্ধ নয়। প্রতিবাদের শক্ত মেরুদণ্ডটা ওদের তৈরি হয়নি। সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময়ও ওদের নেই। সূর্যোদয় হয়ে দিনের প্রহর গড়িয়ে সূর্যাস্ত হলেও তাদের জীবনযুদ্ধ শেষ হতে চায় না। কেউ জুতা মেরামতের কাজ করে, কেউ করে ছাতা মেরামতের কাজ। বাড়ির মহিলারাও বসে থাকে না। বাঁশ ও বেত দিয়ে তারা নানান রকম গৃহসামগ্রী বানায়। বেতের ধামা, আধলা, সাঁজি বানায়। বানায় বাঁশের চালুনি-কুলা, ঝুঁড়ি-ডালা ইত্যাদি। পুরুষেরা কোনো একটি কাজ নিয়ে পড়ে থাকে না। এক কাজের ফাঁকে ফাঁকে অন্য কাজ করে। নইলে সংসার চলে না। কেউ কেউ বিভিন্ন পূজা-পার্বণে, নানান উৎসবে ঢাক বাজাতে যায়। দূর-দূরান্ত থেকে বায়না আসে। এপাড়ায় একটা বাদ্যকর দল আছে। ওরা নিজেরা বলে, ‘ব্যানপার্টি’। বিয়ে, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি অনুষ্ঠানে বাজাতে যায় তারা। বর্ষীয়ান কানাইলাল ব্যান্ডপার্টির সর্দার। খুব ভাল সানাই বাজায় কানাইলাল। ঢোল-খোলেও সমান পটু। তবে দলটা কানাইলালের শরীরের মতোই শীর্ণ। আধুনিক বাদ্যযন্ত্র তেমন নেই। পুরোনো সেকেলে বাদ্যযন্ত্রই ভরসা। ফলে ধনী পরিবারের সামাজিক বা ধর্মীয় উৎসবে তারা ব্রাত্য হয়ে পড়েছে। বোয়ালমারী, কানাইপুর, ফরিদপুরে এখন নতুন নতুন দল তৈরি হয়েছে। মানুষকে আকৃষ্ট করার মতো নানান রকম বাদ্যযন্ত্র তাদের আছে। কী তাদের বাহারি পোশাক! এবেলা তাদের গায়ে একধরনের ঝকঝকে পোশাক, তো ওবেলা আরেক ধরনের। এই দলগুলোর মালিক ঋষি সম্প্রদায়ের কেউ নয়, মুসলমান অথবা উচ্চ বর্ণের হিন্দু ব্যবসায়ীরা এইসব দলের মালিক। অন্যান্য ব্যবসার পাশাপাশি ব্যান্ডপার্টির দল গড়াটাও তাদের ব্যবসা। মোটা টাকা বিনিয়োগ করে তারা। চটকদারি ভাষায় যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় তারা বায়না নেয়। তাগড়া-জোয়ান, সুন্দর চেহারার বাজিয়েদের ভাল বেতনে দলে নেয় মালিকেরা। বাজানোটা ওখানে কেবলই চাকরি, নেশা নয়।

তাদের রেখে ধনী লোকেরা কমলপুরের এই জরাজীর্ণ ব্যান্ডপার্টির দলকে কেন ডাকবে? শুধু কী ধনী, মোটামুটি গৃহস্থরাও এখন তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। লোকে তাদের ব্যান্ডপার্টিকে বলে দুব্বলপার্টি। এই দুব্বলপার্টির রেট কম বলে এখন আর্থিক দিক দিয়ে অসচ্ছল লোকেরাই কেবল বায়না করে। নীলুর বাবা সুবোধ এই দলে ঝাঁঝ বাজায়। সুবোধ কখনো যেতে না পারলে নিখিল যায়। তাদের দলটা সাতজনের, অসুখ-বিসুখ কিংবা অন্য কোনো কারণে কেউ যেতে না পারলে ঠেকা কাজ চালানোর মতো লোকের অভাব নেই ঋষিপাড়ায়।

নীলুও কয়েকবার গিয়েছে। সে ভাল সানাই বাজাতে পারে। কানাইলালের কাছে শিখেছে। নীলুর কানাই জ্যাঠা। তার প্রথম গুরু। একবার জ্বরের কারণে কানাই জ্যাঠা যেতে না পারায় নীলু সানাই বাজিয়েছিল। আর কয়েকবার বাজিয়েছে ঝাঁঝ। কিন্তু বায়নায় যেতে ওর ভাল লাগে না। ব্যান্ডপার্টির দলকে কেউ সম্মান করে না। বরযাত্রী বোঝাই বাসের ছাদে তুলে দেয় তাদেরকে। কখনো-সখনো যদিবা ভেতরে জায়গা হয় তো একেবারে পিছনের সিটে। কোলের ওপর বাদ্যযন্ত্রগুলো নিয়ে ঠেসেঠুসে বসতে হয় তাদের, তা সে যতো দূরের যাত্রাই হোক না কেন! পিছনের সিটে বসে বাসের ঝাঁকুনিতে পেটের খাবার তো খাবার নাড়ি-ভুঁড়িও বেরিয়ে আসতে চায়! তার ওপর একটু ঝিমুনি এলে ঢাক কি ঢোলের সাথে কপাল ঠুকে যায়! আর মাঝে মাঝেই যে-সে হেঁকে ওঠে, ‘এ কী রে অজিত, মগা বাদ্দিকের আনছিস কহান তে! কী হলো রে ভাই, টাহা খরচ করে কী তুমাগের ঘুমানের জন্যে আনছে নাকি বিয়ের নেমন্তন্ন খাওয়ার জন্যে? বাজাও না-কী!’
আর কী, বাজাও! পিছনের সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বাজাও, বাসের ছাদে বসে জোরসে বাজাও! আর বিয়েবাড়ি পৌঁছার তিন-চার মাইল আগে থেকেই বাজাও, কনের বাড়িতে পৌঁছে বাজাতে বাজাতে শরীরের সব রস নিঙড়ে দাও, খালি বাজাও আর বাজাও, এ বাজানোর যেন শেষ নেই, যেন মানুষ নয় বাজনদাররা সব যন্ত্র! বিয়ের বাসে কিংবা বিয়েবাড়িতে বরকর্তা একজন হলেও বাজনদারদের হুকুম দেবার মাতব্বর সবাই!

বাজানো তো হলো, এবার খাওয়া-দাওয়া? না খেয়ে গ্যাসের ব্যথা উঠলেও খুব কম গৃহস্থ-ই আছে তাদের খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ নেয়। নিজেদেরকেই যেচে গিয়ে খাবার কথা বলতে হয়। সকলের সঙ্গে একই বৈঠকে নয়, আলাদাভাবে উঠোনের এক কোনার দিকে কলাপাতায় অনাদরে-অবহেলায় খেয়ে ওঠে তারা, নিজেদের কলাপাতা নিজেদেরকেই ফেলতে হয়। এজন্যই নীলু এইসব অনুষ্ঠানে বাজাতে যেতে চায় না। অস্বস্তি বোধ করে, তার আত্মসম্মানে ঘা লাগে।
এই গ্রামের ব্রাহ্মণ, কায়েত, মাহিষ্য, শীল, জেলে, বারুজীবি, সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে পতিত ঋষি সম্প্রদায়; আর এই ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত নীলু। ছোট্ট এই জীবনে কম অপমান-অবহেলা সহ্য করেনি সে, এখনও হজম করে যাচ্ছে নিরন্তর! হোক বাড়ির লোক, পাড়ার লোক কিংবা স্কুলের সহপাঠী; তার হৃদয়ের বেলাভূমিতে অপমানের যাতনাময় আঁচড় কেটেছে, কেটে চলেছে তারা। বেড়ে চলেছে তার হৃদয়ের চিহ্নহীন ক্ষত!
‘মাঠে নাই আমন
নীলে হলো বামন
বই নিয়ে বগলে
নীলে যায় স্কুলে
ওরে নীলে স্কুলে না
সঙ সেজে সার্কাসে যা।’

নীলু যখন স্কুলে যেতে শুরু করেছিল, তখন তাকে নিয়ে এই ছড়া বেঁধেছিল তাদের পাড়ার-ই কানারাম রুইদাস। কানারামের আসল নাম রামপ্রসাদ। এক চোখ কানা বলে সবাই তাকে কানারাম বলতো। কানারাম মুখে মুখে ছড়া বলতে পারতো। কোনো ঘটনা বা কাউকে নিয়ে তাৎক্ষণিক ছড়া বাঁধতো সে। নীলুর বাবার সাথে কানারামের ছিল দন্দ্ব। তাই কানারাম নীলুকে নিয়ে এই ছড়া বেঁধে শিখিয়ে দিয়েছিল গ্রামের দুষ্টু ছেলেদের। এরপর থেকে স্কুলে, পথে-ঘাটে, হাটে-মাঠে যেখানেই পেয়েছে, দুষ্টু ছেলেরা তাকে শুনিয়ে এই ছড়া বলেছে। প্রথম প্রথম বাড়িতে এসে বাবা-মা’র কাছে নালিশ করতো সে। সুবোধ অনেকবার দুষ্টু ছেলেদের বাড়িতে গিয়ে তাদের বাবা-মায়ের কাছে নালিশ করে এসেছে। কিন্তু তাতে বরং ফল হয়েছে বিপরীত!

শেষে একদিন তার ঠাকুমা এই ছড়ার পাল্টা ছড়া শিখিয়ে দিলো তাকে। তার আনন্দ দেখে কে! এতোদিনে সে একটা মোক্ষম জবাব পেয়েছে। ঠাকুমার শেখানো পাল্টা ছড়া ভালমতো মুখস্ত করলো। পরদিন যে-ই তাকে ছড়া বলে খ্যাপাবে, সে-ও তাকে পাল্টা ছড়া শুনিয়ে দেবে। এই ছড়া শোনার পর কেউ আর তাকে খ্যাপানোর জন্য ছড়া বলবে না। পরদিনের দৃশ্যটি কল্পনা করতে করতে মনের আনন্দে সে ঠাকুমার গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। পরদিন যখন ছড়াটা মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে স্কুলে রওনা হলো, তখন তাকে দেখে ছড়া বলতে শুরু করলো তারই সমবয়সী মধ্যপাড়ার পলাশ, সুকেশ আর গৌতম। সে-ও আর দেরি না করে ঠাকুমার শেখানো শব্দাস্ত্রের শরণাপন্ন হলো-
‘খ্যাপালি খ্যাপবো
কচু পাতায় হাগবো
দই বলে খাওয়াবো!’
ছড়াটা বলার সঙ্গে সঙ্গে যা হলো নীলুর কল্পনার কোথাও এই দৃশ্যের জায়গা ছিল না। তিনজন দৌড়ে এসে তিনদিক থেকে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। এলোপাথারি কিল, ঘুষি, লাথির বর্ষণ হলো তার ওপর। ছেলেগুলো তাকে হাত দিয়ে মারলো, পা দিয়ে মারলো, আবার মুখ দিয়েও মারলো! অকথ্য ভাষায় নীলুর চৌদ্দ গুষ্টির পিণ্ডি চটকালো!

সত্যিই তো! ওরা দেখতে বড়। ওদের শারীরিক গঠন স্বাভাবিক। ওরা নীলুকে নিয়ে ছড়া কাটবে, যা খুশি তাই করবে, যা খুশি তাই বলবে। কিন্তু নীলু বামন, কিঞ্চিৎ পা বেঁকে হাঁটে। সে ওদের গু খাওয়াতে গেলে ওরা সহ্য করবে কেন! ওরা তখন চড় মারবে, কিল-ঘুষি মারবে, লাথি মারবে, বাপ-ঠাকুরদার নামে গালিগালাজ করবে। সবল দুর্বল কে মারবে এই তো বর্তমান পৃথিবীর অলিখিত নিয়ম! নীলু কেন এই নিয়মের বাইরে থাকবে!

আরেকবার কাসের এক সহপাঠী তাকে জোকার বলেছিল। নীলু সেই সহপাঠীর বিরুদ্ধে নালিশ করেছিল বাংলা স্যার শিবুলাল দাসের কাছে। বাংলা স্যারের আড়ালে তাঁর শিবুলাল দাস নামটি হারিয়ে গিয়েছিল। সবাই তাঁকে বাংলা স্যার বলেই ডাকতো। বাংলা স্যার কাসের সবার সামনে সেই ছেলেকে শাস্তি দিয়েছিলেন। পরে তিনি নীলুকে একা ডেকে বলেছিলেন, ‘নীলু, তুমি বামন হয়ে জন্মেছ বলে মনে কষ্ট রেখো না। একজন ছয় ফুট মানুষও ছোট হয়ে যায় তার কর্মের জন্য। আবার তোমার মতো মানুষও বড় হতে পারে। সেও ঐ কর্ম দিয়েই। আজ একজন তোমাকে জোকার বলেছে বলে আমি তাকে শাস্তি দিয়েছি। কিন্তু এই সমাজে আরও অনেক মানুষ আছে। তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো তোমাকে জোকার বলবে। তাদেরকে কে শাস্তি দেবে বলো? যারা তোমাকে জোকার বলে তারা হয়তো অনেক লম্বা-চওড়া মানুষ। কিন্তু ওরা তোমাকে জোকার বলে নিজেকেই ছোট করে। তুমি তোমার মনের বড়ত্ব দিয়ে ওদেরকে ক্ষমা করে দিও। উচ্চতা দিয়ে মানুষকে পরিমাপ করা যায় না নীলু। মানুষকে পরিমাপ করতে হয় তার কর্ম দিয়ে, আচার-আচরণ দিয়ে।’

সেদিন বাংলা স্যারের কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিল নীলু। কেঁদে ফেলেছিল সে। বাংলা স্যার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। বাংলা স্যার আজ বেঁচে নেই। কিন্তু বাংলা স্যারের বুকের উষ্ণতা আজো সে অনুভব করে। জীবনে এই একজন মাত্র শিক্ষকের নিবিড় স্নেহের স্পর্শ সে পেয়েছে। বাংলা স্যারের কথাগুলো আজও তার হৃদয়ে গেঁথে আছে। ঐ কথাগুলোই তাকে বড় হবার স্বপ্ন দেখায়। সেই কানারামও মরে গেছে বেশ কয়েক বছর হলো। কিন্তু তার ছড়াটা এখনো বেঁচে আছে। সু-বিদ্যার যেমন পরম্পরা আছে, তেমনি কু-বিদ্যারও আছে। এখনো তাকে দেখলে অনেকেই ছড়া বলতে শুরু করে। সে কিছুই বলে না তাদেরকে। শুধু বিষন্ন চোখে তাদের দিকে তাকায়। বাংলা স্যারের কথা মতো তার মনের বড়ত্ব দিয়ে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৮ দুপুর ১২:৫১
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×