নুহা
নুহা- ২
গরম কাপড় পরে বের হলেও একটা সূচালো ঠাণ্ডা বাতাস বাইরে বের হবার পর নাকের ডগা আর দু'গাল কেমন যেন অসাড় করে দিচ্ছিলো। খুব হালকা ভাবে বৃষ্টি হয়েছিলো কোনও এক ফাঁকে ভেজা ভেজা রাস্তা দেখে টের পাওয়া যাচ্ছে। আমার তাড়াহুড়া ছিলো না যদিও তারপরেও অবচেতনে মাথায় কাজ করছিলো মার্কনি যাবার বাসটা ধরতে হবে তাড়াতাড়ি গিয়ে। কখনো কখনো এমন হয় রাস্তায় সিগন্যাল পড়ার কারণে আমি দাঁড়িয়ে আছি এক প্রান্তে আর আমার চোখের সামনে দিয়ে হুস করে নীল রঙের বাসটা চলে গেলো। হেঁটে হেঁটেও আমি মার্কনি যেতে পারি কিন্তু সকাল দশটা পার হয়ে গেলে গরম গরম কর্নেত্তোটা পাওয়া যায় না আর। আজকেও চোখের সামনে দিয়ে বাসটা চলে গেলে আমার হাসি চলে এলো। একের পর এক গাড়ি যাচ্ছে তখন। এভাবে তিন মিনিট পর আমি যখন রাস্তা পেরিয়ে স্টপেজে গিয়ে দাঁড়ালাম ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। এখানে বৃষ্টির সাথে নাকি শীতকালে কাদাও ঝরে - এ কথাটা রেজার কাছে প্রথম শুনে আমি খুব বিস্মিত হয়ে বলেছিলাম - এহ , খালি চাপাবাজি ! এখানে নতুন আসছি তো , তাই যা ইচ্ছা তাই বলে মজা নাও , না ? বলে হাসতে হাসতে আমি যখন কথার প্রসঙ্গ ঘোরাচ্ছিলাম তখন রেজা আগের প্রসঙ্গে ফিরে বললো -
দাঁড়াও, কাল সকালেই তোমাকে নিয়ে যখন বের হবো তখন বুঝবা ।
আসলেই পরদিন সকালে বের হয়ে দেখেছিলাম রাস্তায় বিল্ডিং এর সাইডে সাইডে রাখা গাড়ির গায়ে কেমন কাদার ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে। তখন ও জিজ্ঞেস করলো -
কি বলেছিলাম না সত্যি কাদা বৃষ্টি হয় ! দেখলে তো !
- হুম , বলে আমি মিটিমিটি হেসেছিলাম । ব্যাপারটা আমার কাছে প্রথমত নতুন এবং অদ্ভুত লেগেছিলো।
এখানে তীব্র গরম বা শীতে ব্যাগে ছাতা রাখাটা জরুরী আমার মতো পায়ে হাঁটা মানুষের জন্য । রেজার একটা প্রাইভেট কার আছে ঠিকই কিন্তু সেটিতে ছুটির দিন ছাড়া তেমন একটা আমার ওঠা হয় না । আর প্রতি ছুটির দিনেও যে রেজা আমাকে নিয়ে বাইরে বের হয় তাও না। একটা বাঙালি এরিয়া আছে যেখানে বাংলাদেশ থেকে আগত শাক-সব্জি, মাছ ছাড়াও অনেক টুকিটাকি জিনিস কিনতে পাওয়া যায় , সেখানেই মাঝে মাঝে ছুটির দিনে গিয়ে সপ্তাহের বাজারটা সেরে রেজা তার দায়িত্ব পালন করে এবং এটাই ওর আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া। যাই হোক , এটা নিয়ে খুব বেশী একটা আক্ষেপ আমার নেইও অবশ্য। কারণ রেজার সঙ্গটা ভীষণ বোরিং লাগে আমার। সারাক্ষন খুঁতখুঁতানি , রাস্তায় যে এখানে বাংলাদেশের মতো খুব একটা ট্রাফিক পড়ে সেটা নয় তবুও মাঝে মাঝে ২/৫ মিনিটের জন্য রাস্তায় সিগন্যালে একটু দাঁড়াতে হলেই স্টিরিয়ারিং এ একটা ঘুসি মেরে বলবে -
- ধুসস শালা ! কিংবা এত্ত দূর যাবো , তেলের দাম শালার সরকার এত বাড়িয়েছে না !
- এক কাজ করো , গাড়িটা গ্যারাজেই রাখো বরং। চলো মেট্রো বা বাস দিয়ে যাই ।
আমার এ কথা শুনে রেজা প্রথম প্রথম আপত্তি করলেও এরপর দূরে গিয়ে বাজার করা কিংবা কোনও কিছু কেনার হলে আমি আর রেজার ছুটির দিনের জন্য অপেক্ষা করতাম না । কারণ ততদিনে আমার পথাঘাট চেনা হয়ে গিয়েছিলো মোটামুটি । আমার কাজগুলো আমি নিজেই সেরে নিতে পারতাম । আজব এক মানুষ এই রেজা ! সব কিছুতেই খুঁতখুঁতানি ওর ! তাই ওর সাথে গেলে আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি হতো । গাড়ি কিনে কেউ যে সত্যিই গ্যারাজে রাখতে পারে ওকে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না আমার। একমাত্র কাজে যাওয়া আর আসা এই ছিলো ওর গাড়ির ডিউটি। অবশ্য পরে একদিন ওর কলিগের কাছেই শুনেছিলাম যেদিন ওর দুই বেলা ডিউটি থাকে সেদিন লাঞ্চের পর শাওয়ার নিয়ে ও গাড়িতেই এসি ছেড়ে ঘুমায় । কারণটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম, বাসা যাওয়া আসাতে অনেকটা তেল খরচ হবে এই ভয়ে সে দুপুরে বাসাতেই খেতে আসতো না । অথচ এসি চললেও যে তেল পোড়ে সে হিসাব কি ওর মাথায় ধরতো না ,নাকি আমাকেই সে পছন্দ করতো না এটা নিয়ে আমি আগে চিন্তাভাবনা করলেও সেসব নিয়ে ভাবনা-চিন্তা বলা যায় ছেড়েই দিয়েছি এখন। কারণ জীবনকে এত জটিল করে দেখার মানে নাই আসলে । শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান একটা দাম্পত্য জীবনের জন্য প্রয়োজন বিগত তিন বছরে তাই মনে হয়েছে আমার।
আজকের বৃষ্টিটা তেমন জোরালো ছিলো না। কেমন থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এরকম প্যাচপ্যাচে ধরণের বৃষ্টির মধ্যে ফুটপাত ধরে এই মুহূর্তে হাঁটতে ভালো লাগছিলো না । এ অবস্থায় ছাতা বন্ধ করলেও ভিজে যেতে হয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে আবার ছাতা হাতে ধরে রাখতেও কেমন হাত ব্যথা হয়ে যায়। দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছি এক বিশাল আকৃতির এক কুকুর নিয়ে এক মধ্য বয়সী মহিলা হেঁটে আসছে। এই বৃষ্টির মাঝেও কুকুর নিয়ে না বের হলেই কি এদের হয় না ? এখানে মানুষের এত কুকুর আর বিড়াল প্রীতি দেখি যে কি বলবো !
জীবে দয়া করে যেই জন
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর
এই কথা যদিও আমি ভুলে যাইনি কিন্তু আমার কুকুরভীতি শৈশবের। আর এদেশের মানুষদের দেখি কি অবলীলায় বাচ্চা সাইজের কুকুর কোলে নিয়ে হাঁটে, চুমু খায়! একটা ঘটনা মনে পড়লো, একবার আমি লিফটে করে আমার বাসায় ঢুকবো অমন সময় আমাদের বিল্ডিঙেরই এক সুন্দরমতো তরুণী ছোট বাচ্চা সাইজের একটা কুকুর নিয়ে ঢুকলো । স্বাভাবিক সৌজন্যে তাকে হাই হ্যালো বললেও লিফটে থাকা ঐ বিশ পঁচিশ সেকেন্ড সময়টা আমি শক্ত হয়ে স্ট্যাচুর মতো নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়েছিলাম।
একটু একটু খিদে অনুভব করছিলাম ঠিকই কিন্তু বুঝে উঠতে পারছিলাম এই প্রায় সকাল সাড়ে এগারোটায় আমি কি দুপুরের খাবারটাই খেয়ে নেবো নাকি শুধু এক কাপ কফি খেয়েই কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে কোনও পিৎজার দোকানে ঢুকবো ! আর সকালে উঠে আমি কেন যেন খেতেই পারি না , খাবার কথা মনে হলেই বমি বমি পায়। ঢুকবো না ঢুকবো না করেও দানিয়েলের দোকানেই ঢুকলাম। একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে আজ ওর দোকানের ভেতরে বসতেই ও হাসতে হাসতে জানালো -
ওহ ডিয়ার আজ দেরী করে ফেলেছ যে ! শরীর ঠিক আছে তো নাকি রাতে ভালো ঘুম হয়নি বলে চোখ টিপে ও হাসলো। ওর দোকানের কর্মচারীদের দেখলাম কিছু টেবিলে রিজার্ভ লেখা কার্ড লাগিয়ে রাখতে। আমি সচরাচর ভেতরে বসি না বলেই বুঝতে পারিনি এই টেবিলগুলো কোনো রেগুলার কাস্টমারের জন্য বুক করা হয় লাঞ্চের কিছু সময় আগের মুহূর্তটায়। আশেপাশেই বেশ কিছু সরকারী অফিস আছে এখানে।
আমাকে ভদ্রতা করে দানিয়েল এখানের বুক করা টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে বলতে পারেনি এটা বুঝতে পেরে আমি উঠে দাঁড়ালাম।
- হেই নুহা, তুমি খাবারটা শেষ করো । এখনো লাঞ্চের সময় হয়নি বলে হাসলো ও ।
আমি সাথে একটা কফিও নিলাম। ওর দোকানের কফিটা আমার বেশ লাগে।
নুহা এর মাঝে কয়েকদিন তোমাকে দেখিনি যে ! আমার দোকানের খাবার বোধ হয় এখন আর ভালো লাগে না ,তাই না বলে ও একটু দুষ্টুমির হাসি হাসে ।
- কেন , আমাকে মিস করছিলে নাকি ?
- আমি মিস না করলেও আর কেউ যে মিস করেনি সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারি না বলে দানিয়েল সেই মারিয়ানো নামের ছেলেটার দিকে ইঙ্গিত করে, যে দোকানের বাইরের কাস্টমারদের সাথে ব্যস্ত ছিলো। পরে দানিয়েলের কাছেই শুনলাম ছেলেটা রোমানিয়ার। তবে ওরা নাকি ইউরোপে বেশির ভাগই অবৈধ পথে আসে। দানিয়েল ওকে বেশীদিন রাখবে না এখানে কারণ পুলিশি ঝামেলা হয় যারা অবৈধ ভাবে এ দেশে আসে আর যে মালিকেরা ওদের কাজ দেয় তাদেরও। কিন্তু কি করবো বলো , এরকম ইয়াং ছেলে-মেয়েরা বেকার অবস্থায় ঘুরে, ড্রাগস নেয় , মেট্রো স্টেশনে ঘুমায়, মাঝে মাঝে হাতে টাকা না থাকলে ওরা দল বেঁধে নির্জন রাস্তায় ছিনতাইও করে। শুনলে অবাক হবে পুলিশও ওদের ভয় পায়। এসব বলতে বলতেই দানিয়েল আরও দুইজন কাস্টমার বিদেয় করে।
- কি বলো, পুলিশ এদের ভয় পাবে কেন ? এমন তো না ওরা আর্মস নিয়ে ঘোরে ! বলে আমি সত্যিই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি দানিয়েলের দিকে।
- তুমি পত্রিকা পড়তে পারো এখানকার , তাহলে দেখবে গত সপ্তাহেই ভিয়া আপ্পিয়া নামের একটা জায়গায় দুইজন রোমানিয়ান ছেলে এক পুলিশকে স্ট্যাব করেছে ধারালো চাকু দিয়ে । ওরা মাতাল ছিলো । পুলিশের মানিব্যাগ ছিনতাই করে তাকে মুখে স্কচ টেপ আটকে স্টেশনের টয়লেটে রেখে ওরা চলে যায়। পরে অবশ্য ধরা পড়েছে সে ছেলে দুজন।
মারিয়ানো ছেলেটা ভালো । দেখি ওর এখানে থাকার জন্য একটা স্টে পারমিশনের ব্যবস্থা করে দিব। তবে এতে টাকাপয়সা খরচ হবে, সময়েরও ব্যাপার।
দানিয়েলের কথা শুনে আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিঃসন্তান এই দানিয়েল আর তার বৌ এলিজা মিলে এই বারটা চালায়। দেশের বাইরের মানুষের মাঝে কোনও মানবতা নেই, শালীনতা নেই এই ধরণের যে ছোট ছোট ভুল ধারণাটা আমার মাঝে ছিলো সেটা দানিয়েলের সাথে পরিচয়ের পর থেকে একটু একটু করে কেটে গিয়েছিলো । দানিয়েল যেমন মিশুক, আন্তরিক তার বৌ এলিজা তার বিপরীত। সারাক্ষন গম্ভীর হয়ে থাকা এই মহিলাটা যন্ত্রের মতোই কাজ করে এখানে। কদাচিৎ আসা যাওয়ার পথে ওর মুখোমুখি হলে একটা হাসি বিনিময় করে সে তাও অতি কষ্টে। যদিও দানিয়েলের ভাষায় -
এলিজার মতো মেয়েই হয় না । বাচ্চা-কাচ্চা নেই তো তাই বোধ হয় একটু কম কথা বলে ও । মন খারাপ থাকে কিনা , তাই !
দানিয়েলের এ কথা শুনেও এলিজার চেহারার অভিব্যক্তিতে খুব একটা পরিবর্তন ধরা পড়ে না। আমি বিদায় নিয়ে ওর দোকান থেকে বেরিয়ে আসার সময় মারিয়ানোর সাথে হাই হ্যালো বলতেই হয় ওর সাথে চোখাচোখি হয়ে যাওয়াতে।
( চলবে )
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ২:২২