নবনীতার ডায়েরি - ৩
হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম আজকাল আমি আর শ্রাবণ একে অপরের সাথে খুব কম কথা বলছি। সেই সকালে দুজনেই একসাথে বের হই অফিসের উদ্দেশ্যে, তারপর বাসায় ফেরা, রান্না খাওয়া আর টিভি দেখতে দেখতে ঘুমের প্রস্তুতি। তারপর ? আমি সেই তারপরের অবস্থাটা ভাবছি। কেন দুজনে চুপচাপ হয়ে গেছি বা যাচ্ছি? কাজ থেকে ফিরে ক্লান্তি ভর করে বলে? নাকি বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে আমাদের জীবনে না আমাদের বয়স একটু একটু করে বাড়ছে বলে! আমার মনে হয় শ্রাবণের সাথে এটা নিয়ে কথা বলা দরকার। ওর অভ্যাসই হলো বিছানায় শোবার কিছুক্ষণের মাঝে ঘুমিয়ে পড়া। আগে ভীষণ মেজাজ খারাপ হতো আমাকে রেখে ঘুমিয়ে যেতো বলে। মনও খারাপ লাগতো। এখনও খারাপ লাগে তবে ওকে কিছু বলি না। ও আমাকে আরো রাগাবার জন্য বলে -
শোনো আমি হলাম আল্লাহর নিরীহ বান্দা। শুলেই ঘুম চলে আসে। তুমি মাইন্ড সেট আপ করেই নিছ তোমার ঘুম আসবে না। তুমি ইনসমনিয়াক এটা ভুলতে পারলেই দেখবা তোমারও ঘুম আসছে। আর আমার সাথে থাকার পরেও তোমার ঘুম না আসলে আমি এখন কি করব বলো!
- কি আবার করবা ,আমার সাথে সাথে জেগে থাকো!
ও রাত বারোটার নিউজ দেখার জন্য বসে আছে। এদিক ওদিক চ্যানেল বারবার ঘোরাচ্ছে। আমার দিকে চোখে চোখ পড়তেই বললাম -
চা খাবা?
খাওয়ালে খাবো। নিমকি আছে ? থাকলে একটু নিয়ে এসো তো!
চা খেলে তোমার আবার ঘুম হাওয়া হয়ে যাবে না তো, দেইখো
আরে তোমাদের মত আমার এত নকশা নাই। চা আর ঘুম দুইটা আলাদা আলাদা ব্যাপার। চা খেলে ঘুমানো যায় না কে বলছে!
আর কিছু খাইলে বলো একবারে নিয়ে আসি। টিভি দেখতে দেখতে খাই তারপর একটা মুভি দেখি। চলো এক কাজ করি, আজকে সারা রাত জাগি।
কাল অফিস যাবে না?
নাহ্ , কাল অফিস বাদ। যাবো না। আমি আর কাল থেকে চাকরি বাকরি করবো না।সব বাদ! বলে আমি ওর কোলের উপর মাথা রেখে কিছুক্ষণ পড়ে থাকি। ও আমার চুলে হাত বুলায়। জিজ্ঞেস করে -
তুমি ঠিক আছো তো?
আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। বলি - আমি ঠিক নাই। দাঁড়াও চা নিয়ে আসি। খেতে খেতে কথা বলি।
আমি চা বানাবার জন্য রান্নাঘরে যাই ঠিকই কিন্তু রান্নাঘরে ঢোকার পরে মনে হয় আরেক পশলা ক্লান্তি চেপে ধরে। মনে হয় শ্রাবণকেই ডেকে বলি চা বানাতে। ডাকলে মানা করবে না কিন্তু সব শিখিয়ে দিতে হবে। ও বলেছিল একদিন নাকি আমাকে ডিম ভাজা আর ডাল ভুনা খাওয়াবে সাথে মাছের ফ্রাই। কবে ঐ দিন আসবে অপেক্ষায় আছি।
চা নিয়ে শোবার ঘরে গিয়ে দেখি ডিসকভারির কোনো প্রোগ্রামে মশগুল হয়ে আছে। ওর পাশে গিয়ে বসতেই জিজ্ঞেস করলো -
এইবার বলো কি নিয়ে তোমার মন খারাপ।
শ্রাবণ, তোমার কি মনে হয় না আজকাল আমরা একে অপরের সাথে কম কথা বলছি, রুটিন ওয়ার্ক করছি ?
না, আমার এমন মনে হয় না। সবই তো স্বাভাবিক লাগছে। টিভির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে।
আমি টেনে ওর মুখটা আমার দিকে ঘোরাই। এট লিস্ট এখন আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো প্লিজ, ওকে বলি।
কি ব্যাপার, তুমি এমন সিরিয়াস হয়ে আছো কেন নবনীতা? তুমি আসলে বেশি বেশি ভাবো তাই এমন লাগে। যে কোনো জিনিসের বেশি ডিপে তুমি ঢুকে যাও। আর তোমার কি এসব নিয়ে মন খারাপ ?
নাহ্। আজকে কেন যেন মনে হলো আমরা বাসায় ফেরার পর কেমন শব্দহীনতায় ভুগি। আমাদের বাসায় শব্দের অভাব। আচ্ছা, তোমার কি পুলকের কথা মনে আছে?
কোন পুলক? তোমার ফার্স্ট লাভ? বাহ্ বাহ্ রোম্যান্টিক নস্টালজিয়ায় ভুগছো নাকি আজকে?
আমি চুপ করে থাকি। চামচ দিয়ে অকারণেই চায়ের কাপে নাড়াতে থাকি। বলি - আজকে সন্ধ্যায় শুনলাম ও আজ বিকেলে মারা গেছে। বউ, বাচ্চাসহ গ্রামের বাড়ি থেকে ছুটি কাটিয়ে বাড়ি ফিরছিলো তারপর ত্রিশালে এসে বাসের সাথে ওদের প্রাইভেট কারের ধাক্কা লেগে পুলক, ওর মেয়েটা স্পট ডেড আর ওর বউ মারাত্মক ইঞ্জিউরড।
হায় হায় বলো কি! শ্রাবণ আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে রাখে।
আমার ভেতরের কি রকম একটা ফাঁকা অনুভূতি ফুলে ফেঁপে বড় হতে থাকে। আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। শ্রাবণ আমার চুলে হাত বুলাতে থাকে। বলে, তোমার কি পুলকের কথা আরো বলতে ইচ্ছে করছে? তাহলে বলো ওর কথা, শুনি।
ও আমাকে ঝিনুক নামে ডাকতো। চিঠিতেও লিখত এই নামে।
সামনাসামনি দেখা হলে চিঠি দিতে নাকি পোস্ট করতে? ধরা পরো নাই চিঠি নিয়ে কখনো ?
সামনাসামনিও চিঠি দিতাম, পোস্টেও। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি আমার এক আত্মীয়র সাথে ও আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলো। সময়টা দুপুর। আমি অংক করছিলাম। ও আমার খাতাটা টেনে নিয়ে বলেছিল -
দেখি তো কি অংক করছ! একটু পরে বললো - অংকের রেজাল্ট মিলেছে কিন্তু মাঝখানে তো গোঁজামিল দিয়েছ। আসো তোমাকে অংক শিখিয়ে দেই। ও তখন মেডিক্যাল ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট। ওর কথা শুনে তো আমার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেলো। আমি বললাম -
আপনি আমার সাথে আর কথা বলবেন না। আমি এখন টিচারের কাছে পড়তে যাবো। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যেন দেখি আপনি চলে গেছেন।
আমার কথা শুনে পুলক খুব হাসছিলো। আর আমি আরো রেগে যাচ্ছিলাম। এরপর তার কথা আর মনেই নাই। বাসার কাছাকাছি এসে সন্ধ্যায় মনে পড়লো তার কথা। এসে দেখি সে আর বাসায় নাই। কিছুক্ষণ পর আমার চাচীর ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখি ওখানে আমার আত্মীয়ের সাথে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো -
হোমওয়ার্ক এর গোঁজামিল অংক দেখে তোমার টিচার প্যাঁদানি দেয়নি ? বলেই সেই গা জ্বালানো হাসি হাসতে লাগলো ।
আমি তার কথা শুনে আচমকা কেঁদে ফেলে রেগেমেগে ওখান থেকে চলে আসি। আমি সেদিন সত্যিই টিচারের কাছে মার খেয়েছিলাম ভুল অংকের জন্য কিন্তু সেটা তো তাকে বলতে পারি না।
এরপর ?
যখন ক্লাস নাইনে উঠি তখন সে আমাকে প্রপোজ করে।
তারপর ?
তারপর আর কি! কিছু না। বাদ দাও।
তারপর?
ধুর এর পরের সব তো তুমি জানোই! মোট কথা আমাদের রিলেশনটা ক্লিক করে নাই। আমিও ছোট ছিলাম ও নিজেও স্টুডেন্ট, বাড়ি বিক্রি করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যাওয়া ইত্যাদি অনেক অনেক কারণের সাথে যারা আমাদের এই রিলেশনে হেল্প করতো তারাই পিঞ্চিং করে করে আরো দূরে সরাইয়া দিছিলো আমাদের। আমাকে ও চাইলে যেমন খুঁজে বের করতে পারতো আর আমার কাছে তো ওর নাম্বার ছিলই।
তাহলে যোগাযোগটা রাখলা না কেন!
কি জানি হয়ে ওঠে নাই। তবে অনেক বছর পর বেইলি রোডে একবার দেখা হইছিল,কয়েকদিন ফোনে যোগাযোগও ছিল। বলেছিল বিয়ের জন্য ওর বাসা থেকে মেয়ে দেখতেছে। আর এসব তো তোমাকে সব বলছিই আমি। কিন্তু খুব অপরাধী লাগতেছে নিজেকে, বুঝলা?
কেন? তুমি কেন অপরাধী হবা! শ্রাবণ টিভির সুইচ অফ করে এবার আমার দিকে পুরোপুরি মনোযোগ দেয়।
প্রায় বারো বছরেরও বেশি সময় ওর সাথে আমার যোগাযোগ নেই। আমাদের রিলেশন খারাপভাবে শেষও হয় নাই। আনুষ্ঠানিক বিদায়, মনোমালিন্য কিছুই হয় নাই জাস্ট সময়ের কাছ থেকে ছিটকে গেছিলাম। কিন্তু ও তো আমার আশেপাশেই ছিল। আমার অনেক পরিচিত মানুষদের সাথেও ওর ওঠাবসা ছিল, আমার কাছে ওর নাম্বার ছিল, আমার ফ্রেন্ডদের কলিগ ছিল অথচ আমি যোগাযোগ করি নাই। ফেসবুকে আইডি সার্চ দিলেই ওকে পেতাম!
একবার ভাবো তো নবনীতা, আমি যদি আমার প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে যোগাযোগ করি তোমার ভাল লাগবে? আমি তো চাইলেই ওদের বাসায় যেতে পারি। কিন্তু এইরকম হরদম বা মাঝে মাঝেও যদি যোগাযোগ করতাম তোমার কি ভালো লাগতো? নিশ্চয়ই লাগতো না। আমি বুঝতে পারছি তোমার কেন খারাপ লাগছে। আসলে মৃত্যু এমন একটা ব্যাপার যে একজন মানুষের গুরুত্ব, হিসাবনিকাশ সবকিছু সাথে সাথে বদলে যায়।
হুম এটাও ঠিক। আসলে আমি তোমাকে নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম আর আমাদের দুজনের লাইফের এতো ঘটনাবহুল পরিস্থিতি পার করে করে আজকের এই অবস্থায় আসছি আমার আসলে পুলকের ব্যাপারটা মাথা থেকে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু যে একটা সময় আমার আত্মার অংশ ছিল সে মানুষটা এখন মাটির নিচে শুয়ে আছে যেখান থেকে ফিরে আসার চান্স নেই!
খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। তুমি চাইলে আমরা ওর গ্রামের বাড়ি গিয়ে ওর কবর যিয়ারত করে আসতে পারি।
শ্রাবণের কথা শুনে আমার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বলি -
নাহ্ থাক। দরকার নাই।
লাইট অফ করে আমরা পাশাপাশি শুয়ে থাকি। আমার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে কিছুক্ষণের মাঝেই শ্রাবণ ঘুমিয়ে পড়ে। বুকের ভেতরে একটা ফাঁকা অনুভূতি নিয়ে আমিও ঘুমের কোলে ঢলে পড়ার অপেক্ষায় থাকি।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:২৫