আগের লিঙ্ক
আজকে অফিস থেকে বের হয়ে অনন্যায় গিয়েছিলাম ঘরের টুকিটাকি জিনিস কিনতে। এইসব ওয়ান স্টপ মলের দোকানগুলোতে সমস্যা একটাই যে যা কেনা দরকার তার সাথে পড়ে কিনলেও চলবে এরকম আরও পাঁচ/ সাতটা আইটেম কিনে বাড়ি ফেরা। আমার আরও বড় সমস্যা, যা দেখি পছন্দ হলে সবই কিনতে ইচ্ছে করে। কেনাকাটা শেষ করে অনন্যা থেকে বের হয়ে রিকশা খুঁজছিলাম, হঠাৎ করে টের পেলাম পিঠের মাঝে কিল মেরেছে কেউ। তাকিয়ে দেখি আমার খুব কাছের এক ফ্রেন্ড ( যার সাথে বছরে দুই একবার দেখা হয় !) বিপাশা। দাঁত বের করে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে -
কি রে কিলটা মনে হয় জোরে হয়ে গেছে, না ?
আমার এত্তো মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো কি বলবো। মেজাজ খারাপের চেয়েও বড় কথা হলো আচমকা এমন হওয়াতে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ওকে বলি -
তোরে থাপড়াইতে ইচ্ছা করতাছে। কোনো কাজ কি তুই স্বাভাবিকভাবে করতে পারিস না ?
আরে দোস্তো কতদিন পর দেখা হইলো! তাই একটু সেলিব্রেট করলাম। তা এদিকে কি মনে কইরা?
হইছে আর আল্লাদ দেখান লাগবো না। সারাবছর খোঁজ রাখস না, ফোন দিলে ধরস না আর দেখা হইলে প্রেম ভালোবাসা উথলাইয়া পড়ে। তুই এইখানে কি করস - ওকে জিজ্ঞেস করি।
আমার অফিস এইখানে। এই বায়িং অফিসে জয়েন করছি সাত মাস হইলো। খিদা লাগছিলো তাই একটু খাইতে আসছিলাম।
এখন বাজে সন্ধ্যা ছয়টা। অফিস ছুটির টাইম আর তুই আইছস খাইতে! আর এতবার চাকরি বদলাস ক্যান! বারবার সিভিতে জব চেঞ্জ দেখাচ্ছিস তোর প্রব্লেম হয় না? ইমেজ তো খারাপ হইয়া যাওয়ার কথা ইন্টারভিউ বোর্ডে!
আরে বাদ দে ব্যাটাগুলি যে শয়তান! কোনো জায়গায় কাম কইরা জুইত পাই না। আজকে ইউকের এক বায়ার আসার কথা। অফিস থেকে বের হইতে দেরি হইব। আয় পাঁচ নাম্বার রোডে যাই হাঁটতে হাঁটতে সিএসডির সামনে। পুকুর পাড়ে বইসা কথা বলি চল। তোর সাথে জরুরী কথা আছে, আয়।
আমি বলি -
ইস,। ঢঙের চোটে বাঁচস না। দেখা হইয়া গেছে ঝড়ে বকে, এখন আইছস কেরামতি দেখাইতে। তুই আমার বাসায় আয় শুক্রবারে। এখন আমার যাইতে হইব, গুলশানে শ্রাবণ অপেক্ষাইতাছে।
ধুর এত জামাই জামাই করিস না তো। তোর জামাইরে বল বারিধারা আইয়া তোরে নিয়া যাইতে। তোর লগে আমার কথা আছে, আয়। বলে বিপাশা আমার হাত ধরে রাখে শক্ত করে।
ওর এই দস্যিপনা, জবরদস্তি আমার সবসময়ই ভালো লাগে। ওকে দেখলে আমার ভেতরে অনেক সাহসের জন্ম হয়। ও অনেকটা ঝড়ের মতো, হুরমুড়িয়ে এসে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে যায়। ওকে বলি, অনেকদিন পর তোর সাথে দেখা, তাই না রে ! তোর ছেলেটা কেমন আছে? খালাম্মা ? খালু ?
আরে সবাই ভালো আছে। আমিও ভালো আছি। বলে ও হে হে হে করে হাসতে থাকে।
ওকে জিজ্ঞেস করি - আর তোর ফাজিল জামাই তুর্যের কি খবর ?
আছে ভালোই। একটা মিনমিনা শয়তান হারামজাদাটা। দিছি বাড়ির থিক্যা বাইর কইরা। কিন্তু এই বদেরে শিক্ষা দিতে যাইয়া আমি তো নিজেই কট হইয়া যাইতে নিছিলাম। শোন, কি হইছে। হেভি ইন্টারেস্টিং ঘটনা।
আমার বাপ-মা তো তুর্যের লিগ্যা পারলে জান দিয়া ফালায়। হেগো ভাবখানা এমন যে তুর্য হেগো আপন পেটের পোলা আর আমি হইলাম পোলার বউ। বিয়ার পর থিক্যা বাপের বাড়ি ভাড়া থাইক্যা আসলে বিপদে পড়ছি। আর হারামিটা বাসায় মাইয়া আইন্যা ফুর্তি করছে এইটা হাতে নাতে ধরণের পরেও আমার বাপ-মায়ের এক কথা ব্যাটা মানুষ, একটু আধটু এমন করতেই পারে।
ধুর পুরান প্যাঁচাল বাদ দে। ইন্টারেস্টিং ঘটনা কি এইটা বল।
আরে নতুন কাহিনী কইতে গেলে তো পুরান ইতিহাস একটু রিভিউ কইরা বলন লাগে। যাই হোক, হামারিটারে বাড়ি থিক্যা বাইর কইরা দিছি। সেপারেশনে আছি। আগের অফিসের ম্যানেজারের আলুর দোষ তো আছিলই আর তুর্য যাইয়া আমার কয়েক কলিগের কাছে কাইন্দা কাইট্যা পড়ছে। আমার ইজ্জতের ফালুদা বানাইছে। আর ঘরের কাহিনী যেইখানে অফিসের মানুষ জাইন্যা গেছে সেইখানে তো আর চাকরি করন যায় না, কি কস তুই ? এই লিগ্যাই আগের অফিসের চাকরি ছাইড়া দিছি।
আমি বলি - হুমম। ঠিকই তো। তারপর ?
কয়দিন আগে অফিস থেইক্যা বের হইয়া সোহেল ভাই আর ফয়সালের লগে বনানী আর গুলশানের যে ব্রিজটা আছে না, ওইদিকে গেছিলাম ঘুরতে। লগে এক প্যাকেট পিজ্জা। তখন রাইত প্রায় নয়টা বাজে।
সোহেল ভাইটা আবার কে ?
কে আবার! তোরে কই নাই? আমার দোস্তো ফয়সালের কথা মনে আছে তো তোর? সোহেল ভাই হইলো ফয়সালের বন্ধু, আমার ধর্ম ভাই বানাইছি তারে । ওইদিন তাগো লগে দেখা কইরা পরামর্শ নিতাছিলাম। সময়টাও আমার খারাপ যাইতাছিল। সোহেল ভাই তো ব্র্যাকে কাজ করে, তার লগে কথা কইতাছিলাম যদি তাদের অইখানে কোনো কাজ পাওন যায়। ফয়সালরেও বলছি ওর পরিচিত কোনো বায়িং অফিসে যদি আমার কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। যাই হোক, আমরা পিজ্জা পুজ্জা খাইয়া প্যাকেট লেকের কাছে ফালাইয়া দিছি। আমি আর ফয়সাল গাড়িতে হেলান দিয়া খাড়াইয়া কথা কইতাছিলাম আর সোহেল ভাই একটু দূরে খাড়াইয়া বিড়ি খাইতাছিল। অমন সময় আইছে পুলিশ। আইয়া তো নানান ধরণের প্যাঁচাল। আমাগো একে অপরের লগে সম্পর্ক কি, এইখানে কি করি, এত রাইতে বাইরে ক্যান!
রাত নয়টা আবার এত রাত হইলো ক্যাম্নে ?
আরে আমিও তো তাই কই। কিন্তু কপালডাই খারাপ। হেইদিন রাস্তায় কোনো মানুষজন নাই। গাড়িটাড়িও তেমন চলতাছিল না।
তারপর ?
তারপর আর কি, পুলিশ আমার দিকে তাকাইয়া জিগায় - কি ম্যাডাম কি করতাছিলেন সত্যি কথা বলেন। আমি কইলাম - পিজ্জা খাইতাছিলাম। তারা কয় - প্যাকেট কই ? এইটুকু বলে বিপাশার বিখ্যাত ননস্টপ হাসি শুরু হলো। হাসতে হাসতে ও আর কথাই বলতে পারে না। বারবার একই কথার রিপিট করে আর হাসে - সোহেল ভাই কইতাছিল , ফয়সাল ... এইটুকু বলে ওর আবার হাসি শুরু।
ধুর এরপরের কথা বল ।
সোহেল ভাই কইতাছিল, ফয়সাল পিজ্জার প্যাকেটটা ফালাইস না। প্যাকেটটা সুন্দর। ফয়সাল বলছে - বালের প্যাঁচাল পারস , পিজ্জার প্যাকেট ধুইয়া কি পানি খামু ? বইলা ফয়সাল প্যাকেটটা ছুইড়া লেকের পানিতে ফালায় দিছে। পুলিশ টর্চ জ্বালাইয়া তো এদিক সেদিক পিজ্জার প্যাকেট খুঁজে আর কয় - কই আপনাদের প্যাকেট? ফয়সালরে জিগায় - এই ভদ্রমহিলা আপনার কে হয় ? তারপর তার সেন্ট্রিদের দিয়া গাড়ি চেক করাইছে। গাড়ির মধ্যে আমার দুই ব্যাগ কাপড় চোপড় পাইয়া কয় - কি ভাগতাছেন নাকি ? ফয়সালও ধাপকি মাইরা কয় - আমারে দেখলে কি কলেজের পোলাপাইন মনে হয় ? দুই বাচ্চার বাপ। আমার দিকে আঙুল তুইল্যা কয় - ও আমার বউ। আর সোহেল ভাইরে দেখাইয়া কয় - এইটা আমার বন্ধু। ফয়সালের বাপ আর্মি অফিসার ,পরিচয় পাইয়াও পুলিশ তো ধানাপানাই করতাছিল।
তারপর ?
আমারে আলাদা কইরা ডাইক্যা নিয়া জিগায় ঐ লোক কি সত্যিই আপনার হাসব্যান্ড? আমিও কইলাম - দেইখ্যা কি মনে হইতাছে না ?
তারপর ?
তারপরের কাহিনী আরও মজার। সোহেল ভাই আইসা ঐ এসআইরে হ্যান্ডশেক করার ভঙ্গীতে কয় - তাহলে ভাই ঠিক আছে। আমরা এখন যাই ? সে পারলে গাড়ি স্টার্ট দেওনের ভঙ্গী করবো এমন ভাব লইয়া কইতাছিল। তারপর পুলিশ ছাইড়া দিলো। আমার খালি ভয় লাগতাছিল যদি আমার বাসায় ফোনে কারো লগে কথা কইতে চাইতো, তাইলেই গেছিলাম। আমার বাপ-মা আর তুর্য মিল্যা কইত আমিই খারাপ, বন্ধুবান্ধব লইয়া ঘুরি রাইত কইরা, চরিত্র খারাপ! জানসইতো দোস্তো, মাইয়াগো চরিত্রের অনেক দাম! বলে ও আবার হে হে হে করে হাসে। সোহেল ভাই তো সারা রাস্তা ফয়সালরে গালি দিতে দিতে ফিরসে। এখন পিজ্জার দোকান দেখলেই আমার হাসি পায়।
আমি ওকে বলি - তোর অনেক সাহস। কপাল ভালো যে তোরা কেউ নার্ভাস হস নাই পুলিশের সামনে আর স্মার্টলি হ্যান্ডেল করতে পারছস । তোর জায়গায় আমি হইলে কাইন্দা কাইট্যা একাকার হইয়া যাইতাম। আর তুই দাঁত কেলাইয়া হাসতাছস !
আর ডরাইলেই ডর। যদি ডরাইয়া ডরাইয়া থাকতাম তাইলে তুর্যের মাইর খাইতাম ঘরে বইসা আর আমার বেড রুমে থাকতো বাইরের মাইয়া। শিক্ষিত হইলেই মানুষের ভিত্রে শিক্ষার আলো ছড়ায় না, এইটা মানস তো!
যাই হোক, তুই যে ঘরে না বইসা থাইকা কাজ করতাছস, আশা করি তোর সময় ভালো কাটতাছে।
নাহ্ রে দোস্তো, আমার ভিতরের সুরটা কাইট্যা গেছে। সারাদিন ব্যস্ততায় ভালোই থাকি কিন্তু যখন বিছানায় শুইতে যাই খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তুর্যের লিগ্যা না । নিজের লিগ্যা। আমার জীবনে প্রাপ্তি বলতে কিছুই নাই ঝুলি হাতড়াইয়া দেখলাম। হে হে হে
আবার হাসতাছস ক্যান?
তাইলে কি কান্দুম? নতুন একটা গান মোবাইলে নিলাম। শুনবি ? তোর ব্লু টুথ নাইলে শেয়ার ইট অন কর, তোরে দিয়া দেই -
এই বরফপাত, এই কঠিন রাত,
তোমার পুরনো অজুহাত,
এই আলোর নিচে কাঁপতে থাকা
ছায়ার শিকড় ছিঁড়তে চাই ।
এই উল্কাপাত, এই বিশ্রী রাত,
আচমকা এই গোপন আঁতাত,
সব ধ্বংস হওয়ার আগেই আমি
তোমার চোখে ভিজতে চাই ।
শ্রাবণের ফোন আসে। বিপাশাকে বলি - চল আমার জামাইয়ের সাথে দেখা করবি। ও পার্কিং লটে অপেক্ষা করতেছে।
ও বলে - নাহ্ যামু না। আরেকদিন। তোগো সংসারি মানুষগো দেখলে আমার অনেক রাগ ওঠে। যা আমার সামনে থেইক্যা।
আমি ওর হাত ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকি। আমারও বিপাশার সাথে সাথে চোখ ভেজাতে ইচ্ছে করে বিপাশার জন্য।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:০৯