somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি নাতিদীর্ঘ ভ্রমণের দীর্ঘ কাহিনী

০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বৃহঃস্পতিবার রাতে প্রিয় ইন্টার্ণী ডাঃ রাহাদ ফোন দিল, ‘ভাই, যাবেন নাকি ট্যুরে?’
বিগত এক মাস যাবত ট্যুরে যাবার জন্য আমার মনটা আকুপাকু করছে, তাই বসা থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
উত্তরে সে বললো, ‘আজ রাত একটায় আমরা কুমিল্লা থেকে কক্সবাজার রওয়ানা হব, কাল ভোর সাতটা-আটটায় কক্সবাজার পৌঁছে যাবো। তারপর সারাদিন ঘুরাঘুরি করে সন্ধ্যায় সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে রাত বারটা-একটা নাগাদ কুমিল্লায়।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘বাবা রাহাদ, তুই আগে কক্সবাজার গেছিস?’
- ‘কেন ভাই?’
- ‘তোর মাথাটাও তোর শরীরের মতই এত মোটা হয়ে গেছে, বুঝতে পারিনাই।’
রাহাদ কিঞ্চিত গাঁইগুঁই করে নিজের প্রস্তাব ডিফেন্ড করার চেষ্টা করলো। আমি অতঃপর বললাম, আমার কোথাও যেতে আপত্তি নাই। তোরা আগে ভালমত ভেবেচিন্তে আমাকে জানা। এরপর রাত ১১ টায় ডাঃ সাবরিনার ফোন, ‘ভাইয়া, আপনি যাচ্ছেন তো?’
আমি এবার সতর্ক ভাবে বললাম, ‘কোথায়, কক্সবাজার?’
সে বললো, ‘না ভাই, ওইটা মোটুর মোটা বুদ্ধি। আমরা কাল সকালে খৈয়াছড়া যাচ্ছি’।
নামটা পরিচিত মনে হলনা। তাই তাকে জিজ্ঞাসা করে বিস্তারিত যা জানলাম তা হল, ‘খৈয়াছড়া একটি জলপ্রপাত, যেটা চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলায় অবস্থিত। ঢাকা চট্টগ্রাম যাবার পথে কুমিল্লা পার হলে ফেনী জেলা, তারপরেই চট্টগ্রাম জেলার শুরু। যে উপজেলা দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা শুরু হল, সেটাই মিরসরাই। মিরসরাই বাজার পার হয়ে ১ কিমি রাস্তা গেলে বিশ্বরোডের উপরেই মিরসরাই বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের ঠিক উল্টোদিক দিয়ে খৈয়াছড়া যাবার রাস্তা।‘
কুমিল্লা থেকে এত কাছাকাছি বিধায় আমি নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে গেলাম।
পরের দিন শুক্রবার সকাল ৬ টায় রওয়ানা দেয়ার কথা। ঘুম থেকে ঊঠে দেখি পাঁচটা পঞ্চাশ বাজে। আমার দৈনন্দিন দুই-একটি ভাল কাজের মধ্যে একটি হল ঘুম থেকে উঠেই আমি বাথরুমে আধঘন্টা সময় কাটাই, এর মধ্যে ছোট, বড়, মাঝারি সব কার্জ সম্পাদিত হয়। সেদিন এসবের সময় নাই দেখে দাঁত ব্রাশ করতে করতে কাপড় চেঞ্জ করতে শুরু করলাম। প্যান্টটা সবে পড়েছি, এমন সময় এল ডাক। না না, ট্যুর এর ডাক নয়, এ ডাক প্রকৃতির ডাক। বুঝলাম, আমি একদিনের জন্য প্রকৃতিকে ছাড়তে চাইলেও প্রকৃতি আমাকে ছাড়বেনা। ভাল অভ্যাস যে মাঝে মধ্যে বিরাট বিপদের কারণ হয়, আরেকবার বুঝলাম। সেই আধঘন্টা আমাকে কাটাতেই হল... যা হোক, ডাক্তার প্রজাতির মধ্যে সময় জ্ঞানের কিঞ্চিত ঘাটতি থাকায় আমার সমস্যা হলনা। আমি রেডি হয়ে চা খেয়ে বিরক্ত হয়ে দ্বিতীয়বার ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন সেই রাহাদের ফোন এল, ‘ভাই আমরা পাঁচ মিনিটের (!) মধ্যে বেরুচ্ছি’। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘ও আচ্ছা’।
আমাদের যাত্রা শুরু হল সকাল সাড়ে সাতটায়। গাড়ি আমাকে নিতে বাসার কাছাকাছি এসেছিল, গাড়িতে উঠে দেখি মোট এগার জন। ছেলে ছয়, মেয়ে পাঁচ। মূলতঃ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারী ইউনিট ওয়ানের প্রোগ্রাম, তবে বহিরাগত দুজন, একজন আমি, আরেকজন গাইনীর ইন্টার্ণী ডাঃ জারিন। সার্জারী ইউনিট ওয়ানের সহকারি রেজিস্ট্রার ডাঃ তাপস দাদা হল আমাদের লীডার। ডাঃ রাহাদ (মোটু), ডাঃ অন্তু (চাইনিজ), ডাঃ মইন (মালখোর), ডাঃ রাসেল (হাইপো) ডাঃ সাবরিনা, ডাঃ সুতৃপ্তা, ডাঃ সাজিয়া, ডাঃ শিখা এরা সবাই সেই ইউনিটের ইন্টার্ণ। এখানে মেয়েদের নাকিকান্নার ভয়ে শুধু ছেলেদের ডাকনামগুলো ব্রাকেটে উল্লেখ করা হল। রাহাদ দেখি লাল রঙের পাঞ্জাবী পড়ে আছে। মেয়েরা দেখি একেকজন বাহারী থ্রি পিস পড়া, সাবরিনা আবার আলখাল্লা টাইপের অদ্ভুত কিছু একটা পড়ে এসেছে। আমরা পাহাড়ে ট্রেকিং করে ঝরণা দেখতে যাচ্ছি, নাকি বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি, ওদের দেখে সে ব্যাপারে কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লাম। রাহাদ আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেই বলে উঠলো, ‘ভাই, থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর গ্যাঞ্জি ব্যাগে আছে।’ সেটা শুরুতেই পড়ে নিতে কি সমস্যা, সেটা বুঝা গেলনা। মেয়েরাও একই বুদ্ধি নিয়ে এসেছে কি না, সেটাও তখন বুঝতে পারলাম না। পরে অবশ্য দেখলাম তারা ওই থ্রি পিস আর আলখাল্লা পড়েই পাহাড়ে চড়তে আগ্রহী। এরা সবাই আমারও ইন্টার্ণ ছিল, আমি ক্যাজুয়ালটি বিভাগের সহকারি রেজিস্ট্রার পদ থেকে কিছুদিন পূর্বেই বদলী হয়ে উপজেলা লেভেলে চলে গেছি, তাই সবার সাথে খুব আন্তরিক সম্পর্ক। এছাড়া এরা সবাই আমার খুব প্রিয় ইন্টার্ণ, একেবারে নয়নের মণি টাইপের ব্যাপার। যা হোক, যাত্রার শুরুতেই মাইক্রোবাসে গ্যাস নেয়ার বিরতি। সেটার পর চৌদ্দগ্রাম বাজার পার হয়ে কিছুদুর যাবার পর চা খাবার জন্য জগন্নাথ দীঘির উপরে ‘তৃপ্তি হোটেলে’ থামলাম। ছাপড়া টাইপের হোটেলের চা খাবার জন্য রাজসিক ব্যাবস্থা, ঠিক দীঘির পাড়ে একটা বাগান টাইপের ব্যাপার, সেখানে বড় গাছের গুড়ির ক্রস সেকশান দিয়ে টেবিল আর ছোট গাছের গুড়ির ক্রস সেকশান দিয়ে চেয়ার বানানো। আমরা ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের কাপে সেই কর্তিত বৃক্ষের উপর বসে চা খেলাম, আমাদের সাথের আহ্লাদী ললনারা এই সুযোগে ছোটখাট একটা ফটোসেশান করে ফেললো। আমাদের ফটোগ্রাফার হল অন্তু। সে চায়না থেকে ৩ লাখ টাকায় কেনা জাপানি ক্যানন ডিএসএলআর ক্যামেরায় ১৮-১৪০ মিমি লেন্স ফিট করে মেয়েদের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগলো, সেটা শুধুই ছবি তোলার আশায় নাকি অন্য কোন ব্যাপার, সেটা বুঝা গেলনা। ইদানিং মেয়েদের নতুন কিছু পোজ বেরিয়েছে, জারিন কে দেখলাম সুতৃপ্তার গালের সাথে গাল লাগিয়ে অন্য গালে চায়ের কাপ ঠেকিয়ে ছবি তুলতে পোজ দিচ্ছে... যাক এই বিষয়ে আর বেশি কিছু না বলি...
দীর্ঘ চা বিরতির পর আমরা আবার রওয়ানা হলাম। এবার একটানে মিরসরাই। বাজার পার হয়ে কিছুদুর গিয়ে মিরসরাই স্কুল পেলাম, তার ঠিক উল্টোদিকেই বিশ্বরোডের উপর সবুজ সাইনবোর্ড টাঙ্গানো, ‘ খৈয়াছড়া ঝরণা/ KHOIACHORA WATERFALL 4.2 km’। সরু রাস্তা ধরে গাড়ি ঢুকে গেল, একটি কালভার্টে প্রায় আটকা পড়তে পড়তেও পার হয়ে গেল। তবে বেশিক্ষণ সুখ সইলোনা, আধ কিলোমিটার যাবার পর গাড়ির রাস্তা শেষ, ঢাকা চট্টগ্রাম রেললাইনের পাশে, সেখানে কিছু দোকান হয়েছে ট্যুরিস্ট ধরার উদ্দেশ্যে। সেই দোকান থেকে চিপস আর পানি কিনে আমরা যাত্রা শুরু করতে যাবো, এমন সময় কে একজন বলে উঠলো, ‘রাহাদ আর মইন ভাই কই?’ তাপস দা বিরক্তি সহকারে বলে উঠলেন, ‘বেয়াদ্দপ গুলা গাড়িতে বসে কাপড় পাল্টাইতেসে’ বলেই তিনি তার স্মার্টফোন খানা গাড়ির উইন্ডশীল্ডে লাগিয়ে তাদের কিছু আনসেন্সরড ছবি তুলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু টিনটেড সাইড গ্লাসের কারণে গাড়ির ভেতরটা অন্ধকার হওয়ায় সুবিধা করা গেলনা। একটু পর দিগ্বিজয়ের হাসি নিয়ে থ্রি কোয়ার্টার পড়ে গাড়ি থেকে নামলো রাহাদ আর মইন। আমরা রওয়ানা হতে গেলাম, তখন মেয়েদের দুজন গাড়িতে ঢুকলো। তাহারা যে কি কারণে ঢুকলো, সেই কারণ অনুসন্ধানে আমরা কেউ আর আগ্রহী হলাম না, শুধু আমি এই ফাঁকে রেললাইনের উপর কালো সানগ্লাস পড়ে হেব্বি একটা পোজ দিয়ে অন্তুর ডি এস এল আরে ছবি তুলে ফেললাম। একটু পর সব মেয়েরা দেখি তাদের ভ্যানিটি ব্যাগ (আমি জানিনা কোন বুদ্ধিতে তারা ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে পাহাড়ে উঠতে এসেছিল) অসহায় মইনের ব্যাগপ্যাকে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। জারিনের টা সেখানে জায়গা না হওয়ায় সে আমার ব্যাগপ্যাকে ঢুকিয়ে দিল। অনুমতির বালাই নাই, যেন নিজের ব্যাগ! পোলাপান সিনিয়ার জুনিয়ার কিচ্ছু মানেনা!
এতকিছুর পর আমাদের পদযাত্রা শুরু হল। প্রথমে সমতল রাস্তায় প্রায় আধ কিলোর মত হাঁটার পর একটা বাঁশের সাঁকো, সেটা পার হতে আমাদের ললনা গ্রুপের বারোটা বেজে গেল। এমন ভাব যে তাদের না জানিয়ে এমন কঠিন রাস্তায় নিয়ে আসা হয়েছে, এখন তারা কিভাবে এই বাঁশের সাঁকো পার হবে! একেকজন কে হাত ধরে, পা ধরে সাঁকো পার করতে হল। আহা, সামনে কি আছে, তখন যদি তারা জানতো!
জানতাম না আমরাও। সাঁকো পেরিয়ে আবার সমতল রাস্তা, তবে এবার কাদাযুক্ত আর পিচ্ছিল। আগের রাতে বেশ বৃষ্টি হওয়ায় জায়গায় জায়গায় পিচ্ছিল কাদা জমে আছে। আর আমরা হাঁটছি উঁচু রাস্তায়, একপাশে ঝরণার পানির দ্বারা সৃষ্টি হওয়া বেশ গভীর নালা, আরেক পাশে বেশ নীচু ক্ষেত। অতঃএব পা পিছলে পড়ে গেলে বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা। মেয়েদের মধ্যে সন্দেহাতীতভাবে সবচেয়ে ঢঙ্গী জারিন, প্রতিবার কাদার সামনে এসেই সে বলে উঠে, ‘হায় আল্লাহ! আমি পার হব কিভাবে!’ অতঃপর ছেলেদের একজন দয়াপরবশ (!!) হয়ে তাকে প্রায় আলগিয়ে কাদা পার করে দেয়। প্রথম কিছুক্ষণ এই গুরুদায়িত্ব পালন করলো মইন, তারপর দেখলাম সুযোগসন্ধানী রাহাদকে, শেষ অংশে ট্যাগ হয়ে গেল রাসেল। আমি আবার ঠোঁটকাটা টাইপের, শেষে জারিনকে বলেই ফেললাম, ‘এত ঘনঘন পার্টনার চেঞ্জ করছিস কেন? একদিনে সবার হাত ধরতে হবে?!!’
এর মধ্যে জারিনের হাইহিল (অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি সে হাইহিল পড়েই পাহাড়ে চড়তে চেয়েছিল) নালায় পড়ে গেল। অন্তু দেখি তার ক্যামেরা আমার হাতে দিয়ে তীব্র গতিতে নালায় প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো। হিন্দি ছবি হলে এইখানেই এক প্রেমকাহিনী রচিত হয়ে যেত। কিন্তু বাস্তবে বেচারা সুবিধা করতে পারলোনা, জুতা ফেরত পেয়ে জারিন পুনরায় রাহাদের কাছে ফিরে গেল।
কিছুদূর গিয়ে যখন কাদা ছাড়া আর কিছু দেখা যায়না, তখন সিদ্ধান্ত হল সবাই স্যান্ডেল-জুতা রেখে যাবে। একটি দোকান পেয়ে সেখানে সবার জুতা রাখা হল, কিন্তু আমি জন্মগতভাবেই একটু পন্ডিত, আমি জুতা পড়ে হেঁটে চলার নীতিতে অটল থাকলাম। কিছুক্ষণ পড়েই অবশ্য অটল নীতি টলে গেল, ততক্ষণে জুতার নীচে কেজি পাঁচেক কাদা আটকে গেছে, আর বার দশেক আমি পিছলা খেতে খেতে বেঁচে গেছি। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে শুনেছি, আমার দেখলাম দোকান পেরুলে বুদ্ধি বেড়েছে। জুতা খুললাম, কিন্তু রাখার তো জায়গা নাই... কিছুদূর হাতে করে নিলাম। কিন্তু সেটা অতি দুরূহ কাজ, দুই হাতকেই ব্যাস্ত রাখতে হয় ব্যালেন্স রাখতে। অবশেষে তীব্র বুদ্ধির নিদারুণ ঝলক দেখিয়ে জুতাগুলো ফিতা দিয়ে ব্যাগপ্যাকের পিছনে বেঁধে আমার জুতামুক্তি ঘটলো। এর মধ্যে আমরা সমতল ভূমি পেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় প্রবেশ করেছি। ঝোরাপথের পাশ দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে চলে গেছে অত্যন্ত পিচ্ছিল রাস্তা, উঁচুতে উঠার সময় খুব সাবধানে পাহাড়ের গা ধরে ধরে কোনমতে উঠছি, নামার সময় ব্যালেন্স রাখা আরো কঠিন, রাহাদ এর মধ্যে তার হস্তিসম শরীর নিয়ে গোটাকয়েক আছাড় খেয়েছে, এটা দেখেই বোধহয় জারিন রাহাদ কে পরিত্যাগ করে রাসেলের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। এভাবেই কোনমতে আমরা ঝরণার প্রথম ধাপে পৌঁছালাম। এটা মূল ঝরণা নয়, পানি জমে ডোবার মত হয়ে আছে এমন একটি জায়গা, কিছু উপর থেকে তীব্র গতিতে পানি ডোবার মধ্যে পড়ছে। এখানে এসে ডোবার কাছাকাছি জায়গায় নালা পেরিয়ে উল্টোদিকে যেতে হয়। নালার মধ্যে কিছু পাথর বেরিয়ে আছে, সেটা দিয়ে নালা পার হয়ে আমরা ডোবার পাশের পাথরের উপড় এসে দাঁড়ালাম। পাথরে শেওলা জমে খুব পিচ্ছিল হয়ে আছে। আমরা বিশ্রাম নেয়ার জন্যে উঁচু পাথরে বসলাম, এর মধ্যে মইন লাফ দিয়ে ডোবায় নেমে পড়লো। আমাদের মধ্যে সে সবচেয়ে ভালো সাঁতার পারে। একটু পর রাহাদ মইনকে কিছু বলার জন্য ডোবার পাশে এসে দাঁড়ালো, সাথে সাথে আমরা ধপাস করে একটা শব্দ শুনলাম। তাকিয়ে দেখি রাহাদ নেই। পিছল খেয়ে সে ডোবায় গিয়ে পড়েছে। ডোবাটা বেশ গভীর, ঠাঁই পাওয়া যায়না, তার উপর সে সাঁতার জানেনা। জীবন বাঁচাবার তাড়নায় তার মুখ দিয়ে ‘আঁ আঁ’ জাতীয় শব্দ বের হতে লাগল। আমি তাকে উদ্ধারের বদলে সেই শব্দ মোবাইলে রেকর্ড করে রাখা যায় কিনা সেই চিন্তা শুরু করে দিলাম। মইন এসে হাতিকে কোনমতে ঠেলেঠুলে ডোবার কিনারায় নিয়ে এল। এর মধ্যে তাপস দা বোধহয় রাহাদকে কোন উপদেশ বাণী দিতে এসেছিলেন, ধুম করে তিনিও পাথরের উপর পড়লেন, অতঃপর ডোবায়। তিনি অবশ্য জীবনের চেয়ে মোবাইল বাঁচাতে বেশি ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন, তার পকেটে নিজের টা সহ মোট তিনজনের মোবাইল ছিল। অন্তু আবারো মহামানব রূপে আবির্ভূত হতে চেষ্টা করলো, আমার হাতে ক্যামেরা দিয়ে ছুঁটে গেল। তাপস দার জায়গায় মেয়েদের কেউ হলে হয়তো ঝাঁপিয়েই পড়তো, তাপস দা বলে হাতের লাঠি বাড়িয়েই দায় সারলো। তিনজন ডোবার পানিতে, নিজেকে আমি ধরে রাখতে পারলাম না। ব্যাগপ্যাক টা সাবরিনার হাতে দিয়ে একে একে মোবাইল মানিব্যাগ ওটাতে ঢোকালাম। এরপর সাধের চামড়ার বেল্টটা খুলে যখন তার হাতে দিলাম, দেখি সে ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বিব্রত হাসি দিয়ে ‘ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখ’ বলে ঝাঁপ দিলাম ডোবায়। এর পরের আধ ঘন্টা আমরা সবাই ইচ্ছে মত ভিজলাম। ছেলেরা ডোবায় নেমে পড়লো, মেয়েরা ভিজলো ঝরণার মধ্যে। ফটোসেশান হল, শুয়ে, বসে, একজন আরেকজনের উপর পড়ে, যে যেভাবে পারে।
আমাদের কারো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় কেউ কেউ ভেবেছিলাম, এটাই বোধহয় খৈয়াছড়া ঝরণা। কিন্তু একটু পরেই দেখলাম আরো দূর থেকে লোকজন আসছে, তাদের থেকে জানলাম এটা প্রথম ধাপ। মূল ঝরণায় যেতে আরো দুটো ধাপ পার হতে হবে। মূল ঝরণার নাকি আবার বেশ কয়েকটি ধাপ। যা হোক, ডুবাডুবি শেষ করে আমরা আবার যাত্রা করলাম। এবারের পথ আরো কঠিন। এর মধ্যে ফিরতি পথের একজন দর্শনার্থী আমাকে তার লাঠি ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘এটা নিয়ে যান, বিরাট উপকার পাবেন’। দেখলাম কথা সত্য, লাঠি ছাড়া প্রতি পদে পদে আছাড় খেতে হত। রাহাদের অবশ্য এইসব ছোটখাট লাঠিতে কাজ হয় না, সে বিরাট এক গাছের ডাল হাতে নিয়ে লিটল জনের মত হাঁটতে হাঁটতে আরো গোটাকয়েক আছাড় খেল। জারিন ততক্ষণে রাসেলের সাথে পার্মানেন্টলি ট্যাগ হয়ে গেছে। রাসেলও দেখলাম বড় আপাকে সাহায্য করতে প্রায় জান দিয়ে দিচ্ছে। সুতৃপ্তা এতক্ষণ ভালই ছিল, জারিনের প্রভাবেই কিনা কে জানে, সে দেখি মইনের সাথে ট্যাগ হয়েছে। সাজিয়া আর শিখা মেয়ে দুটা পুরাপুরি পাহাড়ি। তারা একটু পরপর অনেক দূর এগিয়ে যায়, তারপর আমাদের ডাকাডাকিতে দাঁড়ায়। এরা থ্রি পিস পড়ে যে গতিতে পাহাড় বাইলো, প্রোপার ট্রেকিং ড্রেসে তারা বিশ্ববিখ্যাত ট্রেকার দেরকেও হার মানাবে। সাবরিনাও আলখাল্লা পড়ে ভালই খেল দেখাল। আমিও মোটামুটি পাহাড়ি টাইপের, সমতলে কিছুদূর হাঁটলেই আমি ক্লান্ত হয়ে যাই, কিন্তু পাহাড় যেন আমার এনার্জি বাড়িয়ে দেয়। সবাই যখন আর হাঁটতে পারছেনা, তখন আমার সবে জোশ এসেছে টাইপের ব্যাপার। সবার পেছনে রাহাদ, তারপর জারিন আর রাসেল, তাদের সামনে তাপস দা, মইন সুতৃপ্তা কে নিয়েও ভালই হাঁটছে, আমি, শিখা, সাবরিনা আর সাজিয়া সামনে চলে এসেছি, দুই গ্রুপের মাঝামাঝি অন্তু। এভাবে দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছুলাম।
এখানে আর বিরতি দিলাম না, কারণ মূল ঝরণা দেখতে হবে। দ্বিতীয় ধাপের পরপরেই সবচেয়ে কঠিন পথ, বেশ খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে। আরো কঠিন হয়ে গেছে পিচ্ছিল কাদার কারণে। শিখা এবার ভাল বুদ্ধি বের করলো। মূল পথটা মানুষের চলাচলের কারণে খুব বেশি পিচ্ছিল হয়ে আছে, তাই সে ঘাস ভরা পাহাড়ের গা বেয়ে উঠা শুরু করলো। দেখলাম ব্যাপারটা বেশ কার্যকর, সবাই তাই করলাম। এর মধ্যে জারিন আবার ভ্যানভ্যান শুরু করেছে, সে এই পথে উঠতে পারবেনা। তাপস দা ভাল বুদ্ধি বের করেছেন, তিনি সবার পেছনে চলে গেছেন, যে পিছিয়ে পড়ছে, তাকেই মাথাই লাঠি দিয়ে গুঁতো দিচ্ছেন। রাসেলের নিঃসার্থ ভালবাসার কারণে হোক, আর দাদার লাঠির গুঁতোর কারণেই হোক, জারিনও সবচেয়ে শক্ত পথটা পার হয়ে গেল। আর কিছুদূর গিয়ে এরপরের পথ নালা বেয়ে। তীব্র স্রোতের চেয়ে বড় বাঁধা হল, যেখানে সেখানে পানির গভীরতা হঠাত বেড়ে গেছে। লাঠি থাকায় বিরাট সুবিধা হল। আমি ন্সামনে গিয়ে লাঠি দিয়ে গভীরতা মেপে মেপে এগুচ্ছি, পেছনে বাকিরা। এভাবে আমরা মূল ঝরণার আগের শেষ ধাপে এসে পৌঁছালাম। সেখানে পাথরের উপর বসে আবার ফটোসেশান। সবাই ক্লান্তিতে নুয়ে পড়েছে। রাহাদ কে দেখলাম বোয়াল মাছের মত হা করে শ্বাস নিচ্ছে। ফিরতি পথের কয়েকজন যাত্রীর কথায় শক্তি ফিরে পেলাম। তারা বললো, ‘ভাই, মূল ঝরণা দেখলে সব ভুলে যাবেন’। আমরা আবার উঠে দাঁড়ালাম। আরো প্রায় ১৫-২০ মিনিট হাঁটার পর এল সেই বাঁক। আমি সবার আগে, বাঁক পেরিয়ে বিস্ময়ে থমকে দাঁড়ালাম। এ কি দেখছি আমি! এমন সৌন্দর্যের কথা কল্পনাতেও ভাবিনি। ভেবেছিলাম নাম না জানা ঝরণা, কি আর এমন হবে! কিন্তু এ কি! পত্রিকায় পড়ে খাগড়াছড়ির তৈদুঝোরায় গিয়ে পুরোপুরি প্রতারিত হয়েছি, টেপের পানির মত একটা জিনিস, তার নাম নাকি ঝরণা, মাধবকুন্ডে গিয়েও এত পানি আমি দেখিনি! কি সেই ঝরণার শব্দ, কি তার প্রতাপ! আমি আনন্দে চিতকার করে উঠলাম! বাঁক পেরিয়ে সবাই অভিভূত। প্রবল গর্জনে আনুমানিক ১০০ ফিট উপর থেকে অনাবিল পানির ধারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাথরের উপর! অ-বি-স্ম-র-ণী-য়! এর পরের কাহিনী আর কি বলবো! ব্যাগপ্যাক ছুঁড়ে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম পানিতে। মাধবকুন্ডের মত এখানে ঝরণার পাদদেশে পানির গভীরতা এত বেশি নয়, একেবারে ঝরণার নীচে যেতেও তাই বাঁধা নেই। প্রথমে ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়লো। অনেক লোকের মাঝে মেয়েরা কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিল, ছেলেরা তাদের টেনে নামালো পানিতে। তারপর কিসের কি, সবাই আমরা হারিয়ে গেলাম... ঝরনার এক অদ্ভুত ব্যাপার, যত সময় যায়, ততই এর প্রতি টান বাড়তে থাকে, আমরা টানা ৪ ঘন্টা যা ইচ্ছা তাই করলাম। ডুবালাম, সাঁতার দিলাম, একে অন্যকে চুবালাম, রাহাদের টার্গেট ছিল তার জারিন আপু, ওকে সে গোটা দশেক বার পানিতে চুবালো, তার পরেও দেখি জারিনের মন ভরেনা, আরো চুবা খেতে চায়। এর মধ্যে সুতৃপ্তার কিছুটা হাইড্রোফোবিয়ার মত আছে, প্রথমে সে কিছুতেই ভয়ে পানিতে নামবেনা, কিন্তু এই ঝরণার তীব্র আকর্ষণ ক্ষমতার কাছে হার মানলো সব ভয়, সেও পানিতে নামলো, অবশ্য কিছুক্ষণ পরপরেই বিকট চিতকার করে সবার দৃষ্টি আকর্ষন করছিল। এর মধ্যে অন্তু মেয়েদের সামনে তার বডি প্রদর্শন করতে গিয়ে গ্যাঞ্জি খুলে ফেললো। বিশাল চর্বিওয়ালা বডি মেয়েদের দেখানোর কি আছে বুঝলাম না। এই বডি দেখলে মেয়েরাই লজ্জা পাবে। তো তার সেই গ্যাঞ্জি শাস্তিস্বরূপ তাপস দা ঝরনার দেয়ালে ছুঁড়ে মারলেন, আনুমানিক ৫০ ফুট উপরে সেটা আটকে গেল। বেচারার কান্নাকাটি করার মত অবস্থা, পরে আমি লাঠি ছুঁড়ে সেটা নামিয়ে আনলাম। কিছু পরে হঠাত সাজিয়ার কাফ মাসলে পুল হল, তারপর কিছু বিরতি দিয়ে হতেই থাকলো। কতজনের কত ম্যাসেজ, কিছুতেই তার পুল ভাল হয়না, একটু কমলেই সে পানিতে দুইটা ডুব দেয়, আবার পুল হয়, আবার কান্নাকাটি শুরু করে... সে এক দেখার মত দৃশ্য। চিকিতসার অংশ হিসেবে দাদা সাজেশান দিলেন, চিপসের মধ্যে লবন আছে, লবন মানেই সোডিয়াম, পটাসিয়াম, সো ওকে বেশি করে চিপস খাওয়ানো হোক। দাদার চিকিতসায় কাজ হলোনা, সাজিয়ার ক্র্যাম্প হতেই থাকলো। অতঃপর ডাক্তারি শাস্ত্র বাদ দিয়ে ডাক্তারেরা দৈবিক চিকিতসায় মনোনিবেশ করলেন। সাজিয়াকে সূর্য দেবতার কাছে সমর্পন করা হল, আই মিন, রোদের মধ্যে এনে বসানো হল, তার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ক্রাম্প, পুল সব গায়েব। এর মধ্যে অতি উৎসাহী মইন দেখি শিখা আর সাবরিনাকে নিয়ে মূল ঝরণার উপরের ধাপে উঠতে শুরু করেছে। খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে বেশ অনেকটা উঁচুতে উঠতে হয়, অনেক ডাকাডাকি করে তাদের নামানো হল। আলখাল্লা পড়ে সাবরিনা এত সাহসী কিভাবে হল বুঝলাম না... তবে ছেলেদের মধ্যে চুক্তি হল এর পরের বার ন্যাকা ন্যাকা মেয়েগুলাকে ছাড়া আসবো, যাতে করে একেবারে যেখান থেকে ঝর্ণা শুরু হয়েছে, সেখানে যেতে পারি। এর পর শুরু হল ফটোসেশান। কে কত ভঙ্গিতে ছবি তুলতে পারে, তার প্রতিযোগিতা পড়ে গেল। এখানে বলে রাখি, অন্তুর ক্যামেরাটা বাই টার্ণ একেকজনের হাতে ছিল, বাকিরা যখন পানিতে যা ইচ্ছে তাই করে বেরাচ্ছিল, সেইসব ছবি ক্যামেরাম্যান যে যখন ছিল, তুলে যাচ্ছিল। যা হোক, একসময় আমাদের মেয়েদের দীর্ঘ ফটোসেশান শেষ হল। বিদায় নেবার আগে আরেকবার আমরা সবাই মিলে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ঝরণার তীব্র ধারার নীচে মাথা পেতে দিলাম। পানির তীব্রতায় মাথায় ব্যাথা হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল যেন মাথায় কেউ চাবুক দিয়ে পেটাচ্ছে। তবুও আমরা আবার আবার বারবার মাথা পেতে দিলাম... হয়তো এটা প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা জানাতেই, হয়তো বুকের ভেতরে ওই ঝরণাটাকে আজীবন ধারণ করতে কিংবা হয়তো এই প্রার্থনায়, যেন মনের সব পাপ এই ঝরনার ধারার সাথে মুছে যায়, থাকে শুধু বিশুদ্ধ সত্ত্বাটুকু...
এবার ফেরার পালা, এটা মনে রাখতে হবে, পাহাড়ে উঠার চেয়ে নামা দ্বিগুণ কঠিন কাজ। তার উপরে পিচ্ছিল পথ। একেকজন সারাদিনের ধকল সয়ে নুয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র মনের জোরে আমরা সেই খাড়া পাহাড় থেকে নেমে আসলাম। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা এখন সুতৃপ্তার। বেচারির দম যায় যায় অবস্থা। আর আমি... হৃদয় যেখানে আনন্দে পরিপূর্ণ, এইসব শারীরিক ব্যথা, বেদনা, কষ্ট আমার কাছে তখন খুব তুচ্ছ ব্যাপার। আমি তখন ঝরণার কাছ থেকে নব যৌবনপ্রাপ্ত, সবার আগে নেমে চলে এলাম। তারপর বাকিদের জন্য থামতে হল। সবাই একসাথে সমতল জায়গায় একটা বাড়ির কাছে পৌঁছে বিশ্রাম নিতে বসলাম। দেখি আরো দুজন বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, এর মধ্যে একজন আরেকজনকে বলছে, উরিব্বাবা, কি পথ, আমি আর যেতে পারবোনা। বুঝলাম, তারা ঝরণা দেখতে যাচ্ছে সবেমাত্র। সমতল জায়গাতেই তাদের এহেন অবস্থা দেখে হাসি চেপে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়লো। সামনে কি আছে যদি তারা জানতো! যা হোক, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে, তাই আমরা দ্রুত পা চালালাম। মোটামুটি দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে গেছি আমরা। সামনের গ্রুপে আমার নেতৃত্বে শিখা, সাবরিনা, জারিন, রাহাদ, রাসেল, পেছনের গ্রুপে তাপস দার নেতৃত্বে অন্তু, মইন, সুতৃপ্তা, সাজিয়া। কিছুদূর এসে পেছনে ফিরে দেখি ওরা নেই। দশ মিনিটের মত দাঁড়িয়ে রইলাম, পাত্তা নেই। কি ব্যাপার দেখতে আমি আবার পেছনের দিকে হাঁটা ধরলাম। বাঁক পেরুতে দেখি সুতৃপ্তা আর সাজিয়া ধানক্ষেতে ফটোসেশানে ব্যস্ত। একেকজন পারলে ধানগাছ জড়িয়ে শুয়ে পড়ে এমন অবস্থা! ফটোগ্রাফার আমাদের তাপস দা। বহু রিকোয়েস্ট করে উনাদের ফটোসেশান বন্ধ করা গেল। আবার যাত্রা। কিছুদূর গিয়ে আবার দেখি এক গ্রুপ নাই। আবার ফটোসেশান, এবার চিচিঙ্গা গাছের মাচা ধরে! জারিন এবার মূল মডেল, আগের ফটোসেশান মিস করায় এবার সে পুষিয়ে দিতে বদ্ধ পরিকর। বিরক্তিকর অবস্থা। ওদেরকে প্রায় গরু খেদানোর মত খেদিয়ে যখন গাড়ির কাছে পৌঁছালাম, তখন মাগরেবের আজান দিচ্ছে। গাড়ির কাছে এসে আমাদের একজন নারী অভিযাত্রী যুগান্তকারী ডায়লগ দিল, ‘ আর কোন দিন বেল্ট ছাড়া প্যান্ট পড়বোনা... উফফফ!!!’ আমি টিপ্পনি কেটে বললাম, ‘রাস্তা থেকে একপিস দড়ি নিয়ে বেঁধে নিতি...’ বেচারি না বুঝেই উত্তর দিল, ‘পেলাম না তো’।
সারাদিন কিছু খাইনি, পেট খিদায় চোঁ চোঁ করছে। ঠিক হল ফেনীর কাছাকাছি গিয়ে খাবো। এবার গাড়িতে গান শুরু হল। হিন্দি বেবি ডল গানের সাথে হাত পা ছুঁড়ে আমি গাড়ির ভেতর হাসির খোরাক যোগালাম। একসময় ফেনী পার হয়ে এলাম। সুবিধামত খাবারের দোকান খুঁজছি। অবশেষে সকালের সেই চা খাওয়া ছাপড়ায় এসে থামলো গাড়ি। সবাই তখন ক্ষুধার চোটে রাক্ষসে পরিণত হয়েছে। ওই এলাকার মানুষ এমনিতেই খারাপ বলে জানি, আরেকবার প্রমাণ পেলাম। জামাই আদর করে আমাদের ওরা বিভিন্ন আইটেম খাওয়ালো, তারপর গলাটা কেটে বিল নিল। আমার টেবিলে আমরা চারজন মিলেই খেলাম ১২০০ টাকা। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, প্রতিটা আইটেমের রান্না ছিল অসাধারণ! মুরগি, গরু, গরুর মগজ, গরুর ভুড়ি, মাছের ডিম, একেকটার চেয়ে একেকটা মজার। আমি তো মনে মনে পণ করে ফেলেছি, ঢাকা চট্টগ্রাম রোডের কোথাও রাতের খাবার খেলে সেটা এই তৃপ্তি হোটেলেই খাবো। ওরা নাকি ৫২ টা আইটেম রান্না করে, যার মধ্যে কোয়েল পাখি, বালিহাস ইত্যাদিও আছে।
যা হোক, অবশেষে রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ আমরা কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাসে এসে গাড়ি থেকে নামলাম। মেয়েদের বিদায় দিয়ে বাইরের দিকে হাটতে হাঁটতে তাপস দা বললো, ‘ছবি যা তোলা হইসে, সেইগুলা সব ছাড়া হইলে তো... না থাক, কি বললেন, সেটা আমি নাইবা বললাম, কিছু টেকনিক্যাল প্রবলেম আছে...
তো, এই হল আমাদের খৈয়াছড়ার কাহিনী। এক কথায় বলতে গেলে বলা লাগে, ‘অ-বি-স্ম-র-ণী-য়’।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×