পর্ব ২ পর্ব ১
লাগেজ পেয়েছি । একটা ছোট মাইক্রোবাসে আমরা। আমি , একজন চাইনিজ , এক মিডল ইস্টের পরিবার আর আফ্রিকান একজন । দেশের নামটা ঠিক মনে নেই ।
আমরা অনেক অনেক মাঠ পেরুচ্ছি । ব্রুকিংস পৌঁছে গেলাম, আমাকে সাজ্জাদ এর বাসার সামনে নামিয়ে দেওয়া হল । সাজ্জাদের সাথে এর আগে কখনও কথা হয়নি । ছিপছিপে গড়নের হাল্কা পাতলা , চটপটে একটা ছেলে । ও আমাকে রায়হান ভাই এর বাসায় নিয়ে গেল । রায়হান ভাই এর ওয়াইফ আমাদের ক্যাম্পাসের । ওনাদের বাড়িতেই আমার জন্য রান্না হয়েছে । ওনাদের ফোন থেকে আব্বুকে ফোন দিলাম , পৌঁছে গেছি ।
খাওয়া দাওয়ার পর রায়হান ভাই আর সাজ্জাদ আমাকে নিয়ে বের হল। উদ্দেশ্য , ওয়ালমার্ট থেকে বিছানা –বালিশ আর প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা। রাত দুইটা বাজে । বেশ বড় সড় সুপার স্টোর । পুরাটা খোলা । লোকজন কেনাকাটা করছে । অনেক কাউন্টারে কেউ নেই । সেলফ চেক আউট করছে ।
আমরা অনেক কিছু কিনলাম ।
আমাকে আমার বাসায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছে । ব্রুকিংসের মেডারি এভিনিউ এর ৬২০ নং বাসা আমার । বেশ বড় বাসা । সাজ্জাদ আর ভাইয়া আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখাল । লিভিং রুমে কোন লাইট নেই । সাজ্জাদ বলল , “ আমেরিকানরা লিভিং রুমে লাইট রাখে না “। সব রুমে হলুদ আলো , কোথাও সাদা আলো নেই । কট কটা হলুদ আলো আমেরিকানদের খুব পছন্দ ।
দেশ থেকে একটা ফোন এনেছিলাম । সাজ্জাদ বলল ফোনটি এখানে কাজ করবে না । তবুও চার্জ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। চার্জার ঢুকলনা । পোর্ট গুলো অন্যরকম , চারকোনা । দেশের মত গোল না ।
আমাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে ভাইয়ারা চলে গেল ।
আমি একটা রুমে একা বসে আছি । ভয়ে ঘর থেকে বেরুতে পারছিনা । ঘুম ও আসছিলনা । সারা রাত জেগে কাটালাম । ভোরের দিকে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই । যখন ঘুম ভাঙল দেখি দরজায় শব্দ হচ্ছে ।
সাজ্জাদ দাঁড়িয়ে আছে । দুপুর বারোটার বেশি বাজে তখন । আমি ফ্রেশ হলাম। সাজ্জাদ আমাকে ক্যাম্পাস ঘোরাতে নিয়ে গেল । ঐ বলল,” তোমাকে সকাল থেকে অন্তত পাঁচ –ছজন বাঙালী এসে ডাকাডাকি করেছে । সাড়া নেই । নাসির ভাই এসে আমাকে বলল যে মেয়েটি গতকাল এসেছে ও তো হারিয়ে গেছে । তাই শেষমেশ আমাকে পাঠাল তোমাকে খুঁজতে” ।
সাজ্জাদ আমাকে কোথায় ওরিয়েন্টেসন, লাইব্রেরী , ডিপার্টমেন্ট সব ঘুরে দেখাল । ডিপার্টমেন্ট থেকে বাসা পাঁচ মিনিটের রাস্তা সেটাও দেখাল । আর জানাল আজ ঢাকা ভার্সিটির এক আপু আসবে , আমাদের সাথে থাকবে ।
বাসায় এসে রান্না করলাম । আপু আসল সন্ধ্যায় । আমি আর আপু পিছন দিকের বড় রুমটায় থাকব ঠিক করলাম ।আমার লিভিং রুমে থাকার কথা ছিল । আপুই বলল , তুমি আমার সাথে থাক ।
আপুর নাম ছিল শায়লা । আমি আর শায়লা আপু পরদিন ক্যাম্পাস গেলাম । ওরিয়েন্টেসন হল । অনেক বাঙ্গালীর সাথে দেখা হল ।
বিদেশী ছাত্র দেখলাম অনেক ।একান্নটি দেশের ও বিভিন্ন স্টেটের ছেলে মেয়েরা এসেছে পড়তে । এসব দেশের নাম আগে বইতে পড়েছিলাম। তবুও আমার খানিকটা সন্দেহ হত , পৃথিবী কি গোল ? পৃথিবী ঘোরে ? সত্যিই কি পৃথিবীতে এত এত দেশ আছে ? নাকি এমনিতেই সব লিখে রাখা হয়েছে ।
বিজ্ঞানীদের অনেক কথায় আমার মিথ্যে মনে হত , বেশ সন্দেহ হত ।আমেরিকা আসার পর সন্দেহ অনেকটা দূর হল । আমি নিশ্চিত হলাম পৃথিবী ঘোরে , সূর্যের চারদিকেই ঘোরে । তাই সূর্য আমার আর মায়ের কাছে একসময়ে আসতে পারে না । আমি আর মা পৃথিবীর দুটো বিপরীত পিঠে আছি ।
আমি পিঠে হেলান দিয়ে সবাইকে দেখছিলাম । কারো রেশমি সোনালী চুল , কারো ভেড়ার মত বিনুনি করা চুল , কারো উজ্জ্বল গায়ের রঙ আবার কারো কারো রঙ দেখে আমার কেবল অন্ধকারের কথা মনে হচ্ছিল ।
আমি শুধু দেখছিলাম আর দেখছিলাম । ওরিয়েন্টেসন এর কিছুই আমার মাথায় ঢুকছিল না । ওদের ইংরেজি বুঝতে ও খুব কষ্ট হচ্ছিল । সাউথ আমেরিকান একটি মেয়েকে দেখলাম জুতা পায়ে টেবিলের উপর পা তুলে দিয়েছে । আমাদের সবার পরিচিতি নেওয়া হচ্ছিল । মেয়েটি পা তোলা অবস্থায় পরিচিতি দিল ।
অনেক বোরখা পরা মুসলিম মেয়ে দেখলাম । ওদের আচরণ খুব সাবলীল ছিল । অন্যরাও ওদের সাথে সুন্দর করে কথা বলছিল । কেউ ওদেরকে টেররিস্ট ভাবছিল না ।
একজন আমাকে জিগ্যেস করল কেমন লাগছে ? কেমন লাগছে খুব একটা বুঝতে পারছিলাম না , শুধু মনে হল পুরো পৃথিবীটা দেখতে পাচ্ছি । ছোট ভাই এর সাথে গল্পের নতুন প্লট পেয়েছি । ওরিয়েন্টেসন এর এক ফাঁকে আমি সেটা সাজিয়েও নিলাম ।
একটা পাকিস্তানি ছেলের সাথে পরিচয় হল । শায়লা আপু পরিচয় করিয়ে দিল । ছেলেটা তার জীবনের গল্প বলল ; সে কিভাবে ফার্মার থেকে ফার্মাসিস্ট হল । আমি এতখন শুনছিলাম । তার অনুমুতি নিয়ে ও ক্ষমা চেয়ে একটি প্রশ্ন করলাম । ভেবেছিলাম রেগে যাবে , রাগল না । তাকে বললাম , “তুমি তো জান , একাত্তরে তোমাদের আর আমাদের একটা যুদ্ধ হয়েছিল । তোমরা আমাদের উপর ভীষণ অন্যায় অত্যাচার করেছিলে , আমার জানতে ইচ্ছে করছে এ অংশটা তোমাদের ইতিহাস বইয়ে কিভাবে লেখা আছে । “
ছেলেটি বলল, “তেমন কিছু লেখা নেই , শুধু আছে , এটা আমাদের ভুল ছিল । “
ওরিয়েন্টেসন এ আমাদেরকে সকালের নাস্তা , দুপুরের খাবার দেওয়া হল । আমি সব খাবার প্লেটে নিলাম। একজন বলল গোলাপিটা পোর্ক । সাথে সাথে সরিয়ে ফেললাম । হঠাৎ খুব বাথরুম পেল আমার । তবু চেপে রাখলাম । আমেরিকার পাবলিক বাথরুম গুলো ভীষণ ঝকঝকে । টিস্যু , স্যানিটারি ন্যাপকিন , সাবান , ভেজা হাত শুকানোর ব্যাবস্থাও আছে । হাত ধোয়ার পর কেউ পেপার ন্যাপকিন ইউজ করতে পারে । অথবা ড্রায়ার । একটা জায়গায় হাত রাখলে গরম বাতাস বের হয়ে হাত শুকিয়ে দেয় । তার উপরে লেখা ,” সেভ ট্রিজ” ।
ওদের বেসিনের কল গুলোও বেশ । কলের সামনে হাত রাখলেই পানি পড়ে । হাত সরিয়ে নিলে পানি বন্ধ হয়ে যায় ।তবে শৌচ কাজের জন্য বাথরুমের ভিতরে পানি থাকে না । ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত লাগল আমার কাছে । বাথরুমে পানি না থাকার বিষয়টি মানতে কষ্ট হল ।
ফিলিপিন আর কম্বোডিয়ার দুইটি মেয়ের সাথে এ ব্যাপারে কথা বললাম । ওরা বলল ওদের বাথরুমেও পানি থাকে না । বাথরুমে পানি থাকা অপ্রয়োজনীয় । বিষয়টা নিয়ে অনেক ভাবলাম । শায়লা আপুকে জিগ্যেস করলাম । আপু বলল , বাথরুমে পানি থাকা প্রয়োজনীয় ।
ডিনার দেওয়া হল বিকাল পাঁচটায় । বাইরে তখন ভীষণ রোদ । সূর্য ডুবতে অনেক দেরী । এখানে সূর্য ডোবে নয়টায় । আমরা রোদের মাঝে ডিনার সারলাম ।আমেরিকানরা পাঁচটায় ডিনার করে । আমাদেরকে আমেরিকান রীতি অনুসরণ করতে হল ।
আমরা ডিনার সেরেছি । ডিপ্লমেট এর সাথে ক্যাম্পাস ঘুরেছি । তবুও সন্ধ্যা নামেনি । বিকেলটা ভীষণ লম্বা মনে হল ।
বাসার পথে রওনা দিয়েছি আমরা । পাঁচ মিনিটের পথ , দু ঘণ্টা পার হয়ে গেছে । বাড়ি খুঁজে পাচ্ছিনা না । সব বাসা একি রকম মনে হচ্ছে । আমাদের দুজনের কারো ফোন কেনা হয়নি । কাউকে জানাতে পারলাম না , আমরা হারিয়ে গেছি ।
আপু খুব চিন্তায় পড়ে গেল । এক আমেরিকান দম্পতি আমাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দিল ।
পরদিন আমাদের আর এক রুমমেট যোগ হল , নাসরিন । ও আমার ক্যাম্পাসের, আমার ব্যাচের ।
কয়েকদিন পার হয়ে গেল ।
এ কদিনে আমরা কেউই পুরো বাসাটা ঘুরে দেখিনি । বাসাটা বেশ পুরনো । নিচ তালায় বেসমেন্ট , তারপর মূল বাসাটা । উপরে কার্নিশ । কার্নিশ যাবার সিঁড়ী আমাদের রুম দিয়ে । মাঝখানে দুইটা বাথরুম । ও পাশে নাসরিন এর রুম । আর সামনের দিকে লিভিং রুম , ডাইনিং রুম আর হল ঘরের মত একটা কিচেন । বেসমেন্টে এ যাবার দরজা কিচেন এর সাথে ।
পুরা বাসাটা কাঠের । মেঝেও কাঠের । হাঁটলে ভিসন আওয়াজ হত । রাতে আমার ঘুম আসত না । আমি হাঁটতাম , নামাজ পড়তাম আর ঠকঠক আওয়াজ করতাম । আস্তে আস্তে আমার আওয়াজে রুমমেটরা অভ্যস্ত হয়ে গেল ।
সেদিন রাত দুটার মত বাজে । আমি ঘরে শুয়ে আছি । আমার রুমে আপু ঘুমাচ্ছে । ঐ রুমে নাসরিন ।
আমি মেঝেতে হাঁটার ঠক ঠক আওয়াজ পেলাম ।কেউ একজন হাঁটছে । নাসরিন ভাবছে আমি হাঁটছি । আমি জানি আমি হাঁটছি না ।
আওয়াজটা আমার রুমের দিকে আসছে আস্তে আস্তে । বুঝতে পারছিলাম , কিছু একটা হতে যাচ্ছে । কেউ একজন দরজার লকটা ঘোরাচ্ছে । আমার হৃদপিণ্ড ধক করে উঠল ।
রুমের দরজা খুলে গেছে ।
আমার রুমের মাঝে ২৪-২৫ বছরের এক সুদর্শন আমেরিকান দাঁড়িয়ে , কোঁকড়া চুল । গায়ে গ্রিন সোয়েটার ।
পর্ব ৪
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ ভোর ৪:০৭