‘বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও’- প্রবচনটি হাওর এলাকাখ্যাত ভাটি বাংলার চিরায়ত প্রাকৃতিক চিত্ররূপের বহিঃপ্রকাশ। বর্ষায় যেখানে নৌকা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। চারদিকে পানি আর পানি। দূরে আবছা আবছা গ্রাম, বাড়িঘর ও পাহাড়ের দৃশ্যমান অবস্থা মিলে মনোরম প্রাকৃতিক লীলাকেন্দ্র হাওর। আর শুকনায় পায়ে হাঁটাই একমাত্র উপায়। দূরের পথ। সবুজ ঘাসে ভরা চট্টন (খোলা মাঠ)। কাছেই নিচু জায়গায় সবুজ ধানের ক্ষেত। দূরদৃষ্টি সীমানায় সবুজ আর সবুজের প্রান্ত। প্রকৃতির অসামান্য চারণভূমি এই হাওর। অথচ আমরা এই হাওরের সম্ভাবনার কথা মোটেই জানি না। জানলেও আমলে নেই না। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ ৬৪টি থানা নিয়ে হাওর অঞ্চল গঠিত। হাওর অঞ্চলের মোট আয়তন ৫ হাজার বর্গমাইল। এক তথ্যে জানা যায়, হাওর অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি। বর্ষায় হাওর এলাকা ৮-১০ ফুট পানিতে ভরপুর থাকে। হাওর অঞ্চলের অধিবাসীদের ৯০ ভাগই কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল। বাকিরা মৎস্য আহরণ, মৎস্য চাষ, ব্যবসা, চাকরি ও অন্যান্য পেশায় জড়িত। এখানে রয়েছে শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব। আর্থিক দুরবস্থা, স্থায়ী কর্মসংস্থানের অভাব, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা আর বিদ্যুৎহীনতার মতো বহুমুখী জটিল সমস্যা।
ছোট ছোট নদী, খাল-নালা, ডোবা আর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিল মিলিয়ে এই হাওর অঞ্চল ভাটি বাংলাকে যেন পরম মমতায় প্রকৃতির রূপে সাজিয়েছে। শুধু রূপ নয়- তার গুণ আর সম্পদ সম্ভাবনা অসীম। এখানে রয়েছে ধান উৎপাদনের বিশাল ক্ষেত্র। মৎস্য চাষ আর কৃষিভিত্তিক প্রকল্প গড়ে তোলার অপার দিগন্ত এই হাওরে। হাওর অঞ্চলে ৬/৭ মাস থাকে পানি। বাকি সময় শুকনো। এ কারণে শুকনার ৬ মাস শুধুমাত্র ফসল উৎপাদন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন হাওরবাসীরা। এই একটি ফসলের আয় দিয়েই চলতে হয় সারা বছর। কোনো কারণে ফসল মার গেলে সর্বনাশ। বছরের বাকি সময় অলস কাটে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর। হাওর অঞ্চল যখন শুকিয়ে যায় তখন এর নিম্নাঞ্চলে পানি জমা থাকে। এই নিম্নাঞ্চলকে বলা হয় বিল। পুরো বর্ষায় বেড়ে ওঠা বাহারি প্রজাতির দেশীয় মাছ সব গিয়ে বিলে জমা হয়। তখন বিল টইটম্বুর মাছে মাছে। বিল মানেই মাছ আর মাছ। প্রাকৃতিক জলাভূমি বিল। যার অন্তত অংশ বিশেষ স্থায়ীভাবে জলমগ্ন থাকে। ছোট ছোট বিল শীতে সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়, তখন সেখানে চাষাবাদ চলে। বাংলাদেশে বিলের সংখ্যা প্রায় ৪৫০০। যার মোট আয়তন প্রায় ১১,৪১,১৬১ হেক্টর। বিলে সাধারণত নদীর তুলনায় বেশি মাছ থাকে। এসব বিল দেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের মাছের প্রায় ৬.৮৮% যোগান দেয়।
রংপুর, বগুড়া, পাবনা, নাটোর, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, মধুপুর, নেত্রকোনা এলাকায় ছোট-বড় বিল রয়েছে। বিলে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মাছ পাওয়া যায়। যেমন- কৈ, সরপুঁটি, পুঁটি, খইলা, তিতপুঁটি, কাতলা, মাগুর, খৈলসা, বাঁশপাতা, আইড়, টেংরা, বাইম, চিতল, ভেদা, পাবদা, গজার, শোল, চাপিলা, বোয়াল, মৃগেল, রুই, কালবাউস প্রভৃতি। পরিকল্পিত উপায়ে বিলগুলোর সংরক্ষণ ও সুব্যবস্থাপনা করলে এই খাত থেকে অধিক অর্থ উপার্জন সম্ভব।
টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশাল এই হাওরটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। অনেকেই এ হাওরকে সম্পদ ও সৌন্দর্যের রাণী হিসেবে অভিহিত করেছেন। বলা হয়ে থাকে- একবার যে টাঙ্গুয়ার হাওর দেখেছে তার মানসপট থেকে সে দৃশ্য মুছে যাবে না কোনোদিন। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত একেক ঋতুতে এ হাওরের একেক রূপ। শীতকালে নীরব-নিস্তব্ধ বিশাল হাওরে পাখির কলকাকলী আর মাছের বুঁদবুদে হাওরের নীরবতা ভঙ্গ হয়। আর বর্ষায় তলিয়ে যায় বিশাল হাওরের তীর ও তীরের জনপদ। হিজল-করচ ও নলখাগড়ার বুক অবধি হাওরের পানি ঢেউ খেলে। এখানে বর্ষায় আরেক বিচিত্র রূপ পরিস্ফুটিত হয়। মাছ ও পাখির অভয়ারণ্য টাঙ্গুয়ার হাওর এখন এক অপার সম্ভাবনার নাম। দেশের অন্যান্য হাওরের সঙ্গে টাঙ্গুয়ার ভিন্নতা হলো এর সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য আর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ছোট-বড় ৫১টি বিলের সমন্বয়ে গঠিত এই হাওর। পরিবেশবাদীদের গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে বিপন্ন প্রায় বিরল প্রজাতির ২ শতাধিক পাখির অভয়াশ্রম এই টাঙ্গুয়ার হাওর। বিপন্ন ১৫০ প্রজাতির মাছের সমাগম এখানে।
ভারতের খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় থেকে নেমে আসা ২০ হাজার একরের ভূমি নিয়ে অন্যতম মিঠা পানির জলাভূমি এই টাঙ্গুয়া। হাওর অববাহিকার সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক জলাভূমি হেমন্তে পানি শুকিয়ে এর আয়তন দাঁড়ায় ৬ হাজার ৯ শত ১২ দশমিক ২০ একর। শুকনো মৌসুমে এখানকার সাড়ে ১৫ হাজার একর জমিতে বোরো ধান উৎপন্ন হয়। বিগত বছরে ১ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ে পরিবেশবিষয়ক এনজিও সিএনআরএস নামক সংস্থা সুইজারল্যান্ড সরকারের উন্নয়ন সংস্থা এসডিসির অর্থায়নে একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের ফলে টাঙ্গুয়ার পার্শ¦বর্তী গুরমার হাওরে ৯ শত একর জমিতে প্রায় ৮ কোটি টাকা মূল্যের ফসল উৎপন্ন হয়েছে। সিএনআরএস-হাওরবাসীদের উন্নয়নে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
টাঙ্গুয়ার পরিচিত এতকাল সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর-ধর্মপাশার বাইরে ছিল না। সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শুকনো মৌসুমে স্পিডবোটে সেখানে যেতে সময় লাগে ৩/৪ ঘণ্টা। আর হেমন্তকালে মোটর সাইকেলে ৫/৬ ঘণ্টা। তবে বর্ষায় হাওর পথে স্পিডবোটে সেখানে যেতে সময় লাগে দু’আড়াই ঘণ্টা। মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থার অনগ্রসরতার কারণে লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায় বিশাল সম্ভাবনার এ অঞ্চলটি।
টাঙ্গুয়ায় রয়েছে স্তন্যপায়ী দুর্লভ জলজ প্রাণী গাঙ্গেয় ডলফিন (শুশুক), খেঁকশিয়াল, উঁদ, বনরুই, গন্ধগোকুল, জংলি বিড়াল, মেছো বাঘ। গাছগাছরার মধ্যে রয়েছে-নলখাগড়া, হিজল, করচ, বরুণ, রেইনট্রি, পদ্ম, বুনো গোলাপসহ ২০০ প্রজাতিরও বেশি গাছ-গাছড়া। যা থেকে জ্বালানি কাঠ, আসবাবপত্রসহ গৃহসামগ্রী ও শৌখিন শোপিস তৈরির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় হয়।
এই দর্শনীয় পর্যটন স্পট টাঙ্গুয়ার হাওরের নিকটবর্তী স্থানে যেমন-তাহিরপুর, টেকেরহাট, বারেকটিল এবং আশপাশে সুবিধাজনক এলাকায় হোটেল, মোটেল স্থাপন করা যেতে পারে। পর্যটকদের থাকা-খাওয়া ও ভ্রমণের সুব্যবস্থা থাকলে দেশি-বিদেশি মানুষের ভিড় বাড়বে এখানে। আয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা। বাড়বে সরকারের রাজস্ব আয়। সৃষ্টি হবে স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র। হাওর অঞ্চলে একটিমাত্র ফসল উৎপাদন হয়-বোরো। বছরে ২ লাখ ১৫ হাজার ৬৭০ মেট্রিক টন। এ অঞ্চলের অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ হচ্ছে মাছ। দেশের আহরিত মৎস্যের শতকরা ২৫ ভাগ মৎস্য হাওর অঞ্চল থেকে আহরণ করা হয়ে থাকে। আর নেত্রকোনার এ অঞ্চল থেকে প্রায় ১২ শতাংশ মৎস্য আহরণ করা হয়। বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার মাছ পাওয়া যায়। হাওরে প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম উপাদান হচ্ছে মৎস্য সম্পদ। এক সময় জেলার মদন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী ও কলমাকান্দা। উপজেলার হাওর অঞ্চল থেকে ব্যাপক মাছ সংগ্রহ করা হতো। অনেকের ধারণা এখনো পাল্টে যায়নি। বিগত ৮-১০ বছর আগেও হাওর অঞ্চলে বিপুল পরিমাণে মাছ ধরা পড়ত। যা দেশের ২৫ শতাংশ মৎস্য চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। নেত্রকোনার ৪টি হাওর উপজেলায় মোট ৬৭টি বিল রয়েছে। যার বিস্তৃতি ৭ হাজার ৯১০ একর। এর মধ্যে ২০ একরের ওপরে সরকারি ইজারাভুক্ত বিলের মধ্যে কলমাকান্দায় রয়েছে ৭টি, মোহনগঞ্জে ৮টি, মদনে ১৪টি ও খালিয়াজুরীতে ২৮টি। এ ছাড়াও হাওর অঞ্চলে রয়েছে সরকারি ইজারাভুক্ত অসংখ্য বিল-ডোবা-নদীনালার শত শত ফিশারিজ।
প্রায় ৫০ বছর ধরে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা, তাহেরপুর, জামালগঞ্জ, টেকেরঘাট, খালিয়াজুরী ও মোহনগঞ্জ উপজেলার হাওর, বিল ও নদীর মাছ সেখানে বিক্রি করা হতো। আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত একাধারে মাছ শিকার ও বিক্রি চলত। সুতরাং হাওরের এই অসীম সম্ভাবনাকে কাজে লাগাবার কথা ভাবতে হবে এখনই। হাওরের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাইলে এখনই দীর্ঘমেয়াদি দূরদর্শী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে দ্রুত বাড়ছে জনসংখ্যা, কিন্তু বাড়ছে না সম্পদ। দেখা দিয়েছে খাদ্য ঘাটতি। এসব সমস্যা সমাধানে হাওর এলাকা বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।