somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এন্টি গল্প > সেই ডানকানা মাছটি আর ফিরে আসেনি >

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দোআঁশ এলেবেলে মাটি কেটে কেটে খুব ধীরে এগুনো নদীর স্রোত যেখানে এসে প্রথম গোত্তা খেল সেই অপেক্ষাকৃত শক্ত উঁচুমতন মাটির পাড়ে ঘোড়ার খুরের মত একটা গোলমতন বাঁক নিয়েছিল। ওইখানটিতে জল সমানে দক্ষিণে যেতে যেতে কি ভেবে যেন একেবারে তীরের কাছে উত্তরেও যেত। এই উত্তরে যাওয়াকে বলে রায়ভাটা। প্রবাহমান স্রোতের বিপরীতমুখি যাত্রার মতই বিপরীত চিন্তার সপ্রতিভ এক মেয়ে রোজ সকাল-সন্ধ্যেয় থালা-বাসন নিয়ে নদীতে নামলেই রায়ভাটায় একটি ডানকানার বাচ্চা দেখতো। রোজ দেখত বলে তার মনে হতো সেই একটাই ডানকানা বুঝি রোজ রোজ আসে! হতে পারে অন্য কোন ডানকানাও আসে, কিন্তু মেয়েটি জানে সেই ডানকানাটিই আসে। আর তাতে করে তার মনে হয় সে বুঝি তাকে দেখেই আসে। মেয়েটির এই অদ্ভুত ভাবনার আর এক সাথী ছিল- একটি নুয়ে প্রায় জল ছোঁয়া হিজল। কালচে সবুজ পাতা নিয়ে পরম সখ্যতায় জল ছুঁই ছুঁই অবস্থায় কোনও মতে টিকে থাকা হিজলটি অকাতরে শেঁকড় বিছিয়ে মেয়েটির দাঁড়াবার জায়গা করে দিয়েছিল।

থালা-বাসন ধুয়ে ওই শেঁকড়ের উপর রেখে একাকী নিরবে কথা বলে যেত মেয়েটি। তারপর একেবারে নেয়ে ভেজা কাপড়ে বাড়ি ফিরত। রোজকার নিয়ম। রোজকার বাড়ি ফেরা। অনেকগুলো রোজ যোগ হয়ে এক একটি বছর হয়ে যায়, জীবন আরো একটু ডাঙ্গর হয়ে ওঠে, শরীরের এখানে সেখানে অযাচিত নতুন নতুন উপকরণ আর রেখাচিত্র ফুটে ওঠে, শরীরের ভাঁজগুলো আরো প্রকট হয়ে ওঠে, সেই ভাজেঁ ভাঁজে ভেজা কাপড় লেপ্টে কি যেন এক মহান শিল্প গড়ে তোলে তা কিছুতেই মেয়েটির জানবার কথা নয়, জানেওনি। কিন্তু যাদের জানবার কথা, যাদের চোখে এই বঙ্কিম রেখা ফুটে উঠে তাদেরও শরীরের কিছু অংশে রক্ত সঞ্চালন হঠাৎ বাড়িয়ে দেবার কথা তারা ঠিকই জেনে নেয়, ঠিকই একদিন কামার্ত চোখ অনিমার বাঁকে আটকে গিয়ে গলার কাছেও কি যেন আটকে দেয় সলেমানের। সলেমান বার কয়েক ঢোক গেলে। চোখ সেঁটে থাকে অনিমার বেঢপ ফুলে ওঠা পেছনটাতে, সেখান থেকে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়া জলের একটা রেখা থেকে যায় ধুলোওড়া পথে। অনিমা বড় হয়ে ওঠে।

ভবেশ ঠাকুরের কোন জমি জিরেত ছিলনা। বাপ ঠার্কুদার আমলের বেহারাগিরিই আয়ের উৎস। পাল্কির একদিকে নিজে অন্য দিকে বড় ছেলে নিতেশ। আশপাশের চার-পাঁচ গ্রামে এই ভবেশেরই পাল্কি টিকে ছিল। নদীর পাড়ে একটা দোচালা ঘর আর সেই ঘরের উঠোনে ঠাঁয় নিশ্চুপ বসে থাকা একটা পাল্কি। এই ছিল ভবেশের সম্পদ। ঘাড়ে কড়া পড়ে যাওয়া নিতেশ কিছুদিন আইগুঁই করে একদিন বাড়ি থেকে পালাল। কোথায় চলে গেল কেউ জানেনা। ভবেশ অগত্যা আরো দুজন বেহারা ঠিক করে রাখল ঠিকই কিন্তু ইদানিং আর বিয়ে-শাদি আসছিল না। ভবেশ এই গ্রামে জন্মে থেকে আর কিছু শেখেনি। জমিতে কাজ করে কত মানুষ পেটের ভাত করে। ভবেশ তাও পারেনা। কিন্তু বিয়োনোর বেলায় ভবেশের বউ ভবেশের ওই না-পারায় থেমে থাকেনি। গুণে গুণে সাতটি সন্তান বিইয়েছে। অনিমা তাদেরই একটি। বাকিগুলো পর পর সিঁড়ির মত, বড় থেকে ছোট।

বেমক্কা আর সব গ্রামের মত এই গ্রামেও দিন বদলের ঝোড়ো হাওয়া বয়ে গেছিল। আগের মত এখন আর চোখের জলে ভাসতে ভাসতে কোন বাড়ির ছোট্ট বউটি পাল্কিতে ঠেসেঠুসে উঠে বসেনা। রিকসা ভ্যানে পা দুলিয়ে হাওয়া খেতে খেতে শশুরবাড়ি যায়। চিকন একপায়ে চলা পথগুলো শরীর বিছিয়ে চওড়া হয়ে গেল। সেই চওড়া পথে নিঃশব্দে ভ্যান চলে। অনায়াসে চারজনে বসা যায়। বর-বউ সেই সাথে দুই তিন শালা-শালী! এমন যুতের পেল্লাই কারবার চালু হয়ে ভবেশের পাল্কিকে উঠোনেই বসিয়ে রাখল। পাল্কি নড়েনা, ভবেশের ঘরে চালও আসেনা, হাড়িও চড়েনা, কিন্তু থালা-বাসন হাতে অনিমা হিজল শিঁকড়ে বসে জলে পা ডুবিয়ে ডানকানার সাথে কথা কয়ে চলে।

বরুণদেব রুষ্ঠ হলেন কিনা বোঝা গেলনা, কিন্তু নদীর জলের কেপ্পনতা ক্রমেই বাড়তে থাকল। এবারের শুকনো কালে জল নেমে গেল অনেকটা দূরে। হিজলের শেঁকড় ছাড়িয়ে আরো দূরে। ডাকানার বাচ্চাটি তবুও আসে। অনিমা আরো একটু এগিয়ে বসে। ওপারের খৈ-বাবরা গাছগুলো ন্যাংটো দাঁড়িয়ে থাকে। তাতে থোকায় থোকায় ধরে থাকা জিলিপির মত বাবরা পেঁকে গোলাপিলাল হয়ে থাকে। রাজ্যের কাকেরা আসত আগে। এখন কমে গেছে, তবুও আসে। বাবরার ভেতরে দুধসাদা শাঁস ঠোঁটে নিয়ে উড়াল দেয়। বৈশাখের শুরুতেই নদীটা তিরতিরিয়ে বইতেও যেন কত কষ্ট! অনিমা বোঝে না, কিন্তু জল কমে যাওয়া নিয়ে সারা গ্রামের কারোই যেন কোন কিছু করবার নেই। ওরই বা কি করবার আছে? প্রায় খালের চেহারা নদীর পাড় এখন অনেক উঁচু, সেই উঁচু পাড়ে উঠে অনিমা একটু যেন হাঁপিয়ে ওঠে। আগেকার নিয়মেই তার ভেজা এক প্যাঁচের শাড়ি থেকে জল চুইয়ে পড়ে। একটা ঝোঁপমত জায়গায় এসে জল যেন একটু বেশি পড়ে। সেইখানে একটা শক্ত হাত ওর মুখে চেপে বসে। বাড়ির পথটা বদলে যায়। শ্যাওড়া, জারুল আর ঘন আঁশশ্যাওড়া ঝোঁপের ভেতর খানিকটা ধস্তাধস্তি। ঠেলে আসা চিৎকারটা বেরুতে পারেনা হাত চাপায়। শরীরের ভেতর আর একটা মাংশল শরীর ঢুকে পড়ে। দিনে দুপুরে অনিমা ঘুমিয়ে পড়ে। শাড়িতে তখনো জল থাকায় টক টকে লাল রক্ত একটু পানসে দেখায়। সলেমান একা বেরিয়ে বীরদর্পে হেঁটে চলে যায়। তারপর সেই চিরচেনা নাটুকে সংলাপঃ

-হতভাগী ত’রে কিডা এই কাম করলো?
-নিরবতা।
-কইস না ক্যান, কিডা করলো?
-নিরবতা।
-অ পোড়ামুখি, কতা কইস না ক্যান, অ ভগবান আমার এই সব্বোনাশ কিডা করলো গো......
-নিরবতা এবং অনিমার প্রস্থান।

আরো একটি বছর কি ভাবে যেন ভবেশরা পার করে দেয়, অথবা এভাবেই এক একটা বছর পার হয়েই যায়। বছর পার হতে কোন মাঝি-মাল্লা লাগেনা, নৌকা লাগেনা, সাঁকো লাগেনা, বছররা এভাবেই পার হয়ে যায়। ভবেশ পাল্কিটা বেঁচতে চায়, কে কিনবে? একদিন ভবেশের বউ পাল্কিটা ভেঙ্গে চুলো জ্বালায়। ভবেশ সারা বেলা উঠোনে মাথায় হাত রেখে বসে থাকে। এ পাড়ায় আর মাত্র একঘর হিঁদু, সেই নরেন খুড়ো পরামর্শ দেয়-‘অ ভবেশ সব তো গেল, ইবার এট্টা গাই গরু আছে সেইডে বেইচে আবাল কেন, তারপর ঘানি বসা। গাইডা যে আইধ সের দুদ দেয় তা দি কি হবে’? ভবেশ ভাবে। আইধ সের দুধ! তারচে’ তো ঘানি বানানোই ভাল। বাপের আমলের মোটা গাব গাছটা কেটে কিছুদিনের মধ্যেই ভবেশের বাড়ির পেছনে একটা ঘানি কল বসে। বড় বড় পাথর ঘানির উপর বসিয়ে চোখ বাঁধা বলদ গরুটা ঘানি টানে। কখনো কখনো অনিমা আর তার ছোট ভাই-বোনরাও ঘানিতে চড়ে বসে। আগে গ্রামের মানুষ তিন মাইল দূরে সাহা বাড়িতে যেত সর্ষে, তিল আর ফালি ফালি করে কাটা নারকেল নিয়ে। এখন নিজের গ্রামেই ভবেশ বেহারার ঘানিতে ভাঙ্গায়। তিন বেলার আহার দুই বেলা বা একবেলায় পৌঁছানো ভবেশের বাড়িতে আবার তিন বেলাতেই হাড়ি চড়ে। অনিমা সেই শরীরে আর একটা শরীর ঢুকে যাওয়া দিনটির কথা আর মনে করেনা। ওদের আর কোন সমস্যা নেই।

কিন্তু প্রযুক্তি নামক এক অদ্ভুত ব্যাপার আছে দুনিয়ায়, যার খবর ভবেশদের মত মানুষরা রাখে না। যে রিকশা ভ্যান ভবেশের পাল্কিকে বেকার বানিয়ে চুলোয় ঢুকিয়েছিল, সেই ভ্যানই ভবেশের ঘানিকে সতিন বানিয়ে দিল!সর্দার বাড়ির বেকার ছেলেটা একটা সেকেন্ডহ্যান্ড হলার আর একটা শ্যালো কিনে মোটা শক্ত কাঠের ওপর স্ক্রু এঁটে ভ্যানের উপর বসাল। ব্যাস, হয়ে গেল চলমান মাড়াই কল। গ্রামশুদ্ধ লোক দেখতে এলো তার এই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। ভ্যান চালিয়ে একেবারে বাড়ির উঠেনে এসে সর্দারের পো হাঁক ছাড়ে- ‘অ কাকি, ভাঙ্গাবা নাকি’? কাকিরা বলেন ‘বয় এট্টু বয়, তিল আছে চাইড্ডে, ভাঙ্গায়ে দে’। ভবেশের ঘানির ক্যাঁচোর ক্যাঁচোর কমতে কমতে একেবারেই কমে গেল। ভবেশ বাধ্য হয়ে যে দামে আগে ভাঙ্গাতো তার অর্ধেকে নামিয়ে আনল। ওতে যা আসে তা দিয়ে বলদটারও খাবার হয়না। নদীর জল কমে সেই ডানকানাটিরও আর দেখা নেই। সেও কি খাবারের আশায় অন্য পথ নিয়েছে? অনিমা এখনো খুঁজে ফেরে। তিরতিরে জলে কখনো কখনো আসে সেই মাছটা।

ভবেশের তোবড়ানো গালে আরো কিছু নতুন ভাঁজ ফেলে সময় আরো একবার ঘুরে এলো এই বৈশাখ থেকে আর বৈশাখে। সর্দারের পো এখন একা নয়, সাথে আরো তিন জন ভ্যান নিয়ে বাড়ি বাড়ি ছোঁটে। সলেমান তার বন্ধুদের বীরত্বের কাহিনী শোনানোর পর তারাও ঘানির কাছে এসে বসে। রোজ রোজ ওই ছেলেদেরে বসে থাকতে দেখে ভবেশের বউ একদিন একটাকে ডেকে ঘরে আনে। অনিমার হাতে এক গ্লাস জল দিয়ে ঘরে ঠেলে দেয়। অনিমা বোঝেনা। ঝাঁপ দরোজাটা বন্ধ হয়ে যায়। ঘানিতে সর্ষে-তিল কিছুই নেই, তবুও ভবেশের বউ ঘানিটা ঘুরিয়ে দেয়। চোখ বাঁধা বেবোধ বলদটা ঘুরেই চলে.....ঘানিতে কড়ের তেল দেওয়া হয়না কতকাল, তাই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দটা নিখুঁত ভাবে ঢেকে দেয় অনিমার চাপা চিৎকারটা! ভবেশ উঠোনের কোণায় বসে হুকো টানার ভান করে। ভবেশের বউ এটা ওটা নাড়া নাড়ি করে নিজেকে বোঝায়, সে যেন মহা ব্যস্ত! ঘরে অনিমার শরীরে অন্য আর ঘানি অদ্ভুত বিজাতীয় শব্দে ঘুরে চলে। রোজ। নিয়ম করে। ঘানি ঘোরে ক্যাঁচোর ক্যাঁচোর করে, আর সেই শব্দে চাপা পড়ে যায় অনিমার নিত্যদিনের জারজ শব্দ। কিছুদিন বাদে গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে যায় ব্যাপারটা। এখন আর ঘানিটা না ঘোরালেও চলে, তারপরও অভ্যেস বসে ভবেশের বউ ঘানি ঘোরায়, পাছে লোকে কি বলে! কি লজ্জায়ই না পড়তে হবে!

আরো বছর তিনেক পর অনিমার কাহিনী সেই শুকিয়ে খাল হয়ে যাওয়া নদীটার মতই বিস্মৃত হয়ে ওঠে। পালা করে অনিমা ঘরে ঢোকে। শোয়। শিহরণের ভান করে। একটু হাসির ছোঁয়া ঠোঁটে লেপ্টে রাখে। ওঠে। নদীর সেই রায়ভাটার কাছটিতে চুপ করে বসে থাকে। এখন এর জলের তোড় নেই বলে রায়ভাটা নেই। ডাকানাটিও আসেনা। অনিমার শরীর বলে একটা শক্ত সমর্থ ‘সলেমান’ খুঁজে মা হয়ে যাওয়া, অথচ মন খুঁজে ফেরে সেই ডানকানা মাছটিকে! এই অদ্ভুত আয়ের পথেও ভবেশের সাত আটটি পেটের খেরাক কমে আসে। অনিমার ছোট বোনটিকে ‘অনিমা’ হতে বলে যেদিন সেই দিনই প্রথম জ্বলে ওঠে অনিমা! আধা ভর্তি জলের কলসি মায়ের মাথায় ভাঙ্গে। ভবেশ আর তার বউ খিস্তি করে......
-খানকি মাগী তর এত্তো দেমাগ ক্যান রে? তরে এহন আর কেউ নোচে না বুজিশ না?
-কি করবা? তাই বইলে শেফালীরে শোয়াবা? অতটুক মাইয়ে নিতি পারবে? তুমরা কি মানুষ না পশু?
-আর দেমাগ দেহাইস নে, প্যাটে খাতি পারতিছিস না আবার নিতি পারবি নে কইস ক্যান?
-শালা হারামির বাচ্চা, আর একবার শেফালরি কথা মুখি আনলি দাও দে এক কোপ দেব..

এই কথোপোকথন শেফালীর কানে গেলেও তার কোন ভাবান্তর হয়না। মাত্র দশ-এগার বছরের মেয়েটির বুঝে কেনই বা এই সব অতি মানবীয় বিষয়াদি আসবে? সে কলসি ভাঙ্গা চাড়া নিয়ে এক্কা দোক্কা খেলতে থাকে। এক্কা দোক্কার ভয়ানক ক্ষমতা! পেটে ভাত আছে কি নেই তাতে এক্কা দোক্কার কিছুই যায়-আসে না।

সেবার ঘন বর্ষার সময় ভবেশের দূর সম্পর্কের এক ভাইপো এলো। নিখিল। বাদায় যায়। গওনা নৌকা নিয়ে এক একবার বাদায় যায়, দুই তিন মাস পর ফেরে। গোলপাতা কাটার কাজ। ওই দুই-তিন মাসে নিখিল কত কিছু যে শেখে। এবার শিখেছে দুবলার চরে রাশ মেলায় তাড়ি আর হাড়িয়া খাওয়ার ধুম পড়ে। ওই খানে বড় বড় সওদাগরি নাও আসে। তারা নাও থেকে এটা ওটা নামায়। আবার যাবার সময় এটা ওটা ভরে নিয়ে যায়। অনিমাদের বাড়ি আসার আগে নিখিলকে এক সওদাগর কানে কানে কি কি যেন বলেছিল। নিখিল বাড়ি ফিরে চুপি চুপি একে ওকে ধরে ধরে লোক জোগাড় করে। এক নাও লোক হতে লাগে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন। নিখিলের গ্রামে ঠিক হয়ে আছে প্রায় পনের ষোল জন। নিখিল তিন চার দিন থেকে ভবেশ কে রাজি করিয়ে ফেলে।

-‘ভেইবে দেকো কাকা, তুমরা সক্কলে মিলে যাবা, সেইকেনে ম্যালা কাজ। তুমি কাকিমা কাজ করবা, আমি অনিমারে বে করবো। আমরা সংসার পাতব, কও, খারাপ কৈছি’?

অনিমাকে বিয়ে করার কথা বলায় ভবেশ আর তার বউ এক কথায় রাজি হয়ে যায়। নিখিল যা ভাবেওনি তাই ঘটে যায়। অনিমা নিখিলকে রাতে একসাথেই থাকতে দেয় ভবেশ। তলে তলে ঘানি, বলদ, ঘরের টুকিটাকি বিক্রি করে একদিন ভবেশরা খুব ভোরে বাড়ি ছাড়ে। সেই কাক ভোরে অনিমা একবার ছুঁটে যায় হিজল গাছটার নিচে! অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ডানকানা মাছটা আসেনা। ওই মাছটা যে গত এক দুই বছর ধরেই আসেনা সেটা যেনেও অনিমা আশায় আশায় শেষ বারের মত ঘোলা জলে চকচকে চোখে চেয়ে থাকে। হিজল গাছটাই শুধু একটা দোলা দিয়ে বলে দেয়- ভাল থাকিস রে অনিমা........।

রাশ পূর্ণিমার পর দিন দুবলার চরের খাড়ির ধারে নোঙ্গর ফেলা বড় গওনা নাওয়ে নিখিলের গ্রামের সেই পনের ষোল জনের সাথে উঠে বসে ভবেশ আর তার পরিবার। আগের রাতে পূর্ণিমা ছিল বলে সাগরের পানি ফুলে অনেকটা উপরে উঠে এসছিল। কুয়াশায় খুব কাছের মানুষকেও ছায় ছায়া মনে হয়। ভবেশ একে ওকে জিজ্ঞেস করে-‘আমরা কন যাচ্চি’? উত্তর আসে-‘জানিনে’। ভবেশ এটা বোঝে, তারা যেখানেই যাক না কেন সেখানে নিশ্চই ভাতের অভাব নেই। নাও ছাড়ার সময় কেন এই ভর সন্ধ্যে সেটা ভবেশ যেমন বোঝে না, তেমনি নিখিলও বোঝে না।

সূর্যটা টুপ করে ডুবে যেতেই মনে হলো সাগরের ভেতর কেউ যেন এক দোয়াত কালি ঢেলে দিয়েছে! ছোট ছোট ঢেউ গুলো সেই বড় দোয়াত কালির মধ্যেই দুলে দুলে উঠছে। মাঝে মাঝে জোনাকির মত কি যেন চিক চিক করে জ্বলছে। কে যেন একজন খুব শুদ্ধ ভাষায় পরিষ্কার গলায় বলে- ওগুলো ফসফরাস, রাত হলে ওভাবে জ্বলে। মা ভবতারিনী আর বদর বদর বলে নাওটা ছেড়ে দিল। ভট্ ভট্ করে ইঞ্জিনের শব্দে পাক পাখালি ঝটপট করে উড়ে গেল....অজানা এক কালো অচেনার দিকে ছুটে চললো কালো দৈত্যের মত নৌকাটা............

সাধারণত এখানেই এই ধরণের গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটে। এই ধরণের হা-ভাতে মানুষদের সাকিন এর পর আর কোথাও কোন অক্ষরেই লেখা হয়না। এই মানুষগুলো এমনি হঠাৎ করেই নো-বডি হয়ে যায়। এর পর এই ইতিহাস হয় মাটি চাপা পড়ে, নয়ত মুখে মুখে কিছুদিন ঘুরে ফিরে একসময় হাই তোলা অতীত হয়ে যায়। কিন্তু এই গল্পের অনিমা সেটি হতে দেয়নি। শরীরের মধ্যে আর এক শক্ত শরীরকে ঢুকতে দেখেছিল সেই ছোট্ট ডানকানা দেখে খুশিতে উচ্ছ্বলতার বয়সে। সেই শরীরই অনিমাকে রুখে দেয়। সেই হিজল,ডানকানা স্মৃতি আর কোথা থেকে পাওয়া এক বিজাতীয় ঘৃণা মেশানো জিঘাংশা অনিমাকে হঠাৎ জলে ঝাঁপ দিতে শক্তি যোগায়। নৌকো আর থামেনি। অনিমাকে ছাড়াই নৌকো চলে গেছিল। অনিমা ফিরে এসেছিল একা।

বছর দশেক পরে একটি ছেলে চোখ উল্টে মরো মরো হলে সদর হাসপাতালে ছোঁটে তার বাপ-মা। সাত দিন থাকার পর ডাক্তার বলে দেয় ‘বাড়ি নিয়ে যাও, ওর যে রোগ হয়েছে তার চিকিৎসা তোমরা করতে পারবে না, অনেক টাকার দরকার’। উদ্ভ্রান্ত বাবা-মা বাড়ি ফিরলে পড়শিরা পরামর্শ দেয় ‘কালি ভক্ত তারা মায়ের চরণে নে যাও, দেকপা তুমার ছেইলে ঠিক বেঁইচে ওটপে’। ঠিকই বাবা-মা তার ছেলেকে নিয়ে মায়ের পায়ে হত্যে দিয়ে পড়ে। সাক্ষাৎ কালিকে ভর করিয়ে মা সেই মুমূর্ষ ছেলেকে বাঁচিয়ে তোলে। খুশিতে মায়ের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে আর ওঠে না সেই রমণী, যার স্বামীর নাম সলেমান!‘বল মা, কি দেব তোরে? বল মা? জুড়া পাঁঠা দেব মা’! মা কিছুই বলে না। ভক্তরা বলে-‘যাও, ছেলে নিয়ে বাড়ি যাও, মায়ের এখন ভর আসার সময় হয়েচে’। ভর ওঠা শেষ হলে মা হিজল তলে গিয়ে বসেন রোজকার নিয়মে। তার পর এক ভাবে তাকিয়ে থাকেন কার যেন আসার আশায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৩৯
২৫টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×