somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিজয়ের অগ্নিশিখা অম্লান

২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শীত এবার একটু দেরিতে এসেছে। একাত্তরের ডিসেম্বরে ছিল হাড়কাঁপানো শীত। চুয়াল্লিশ বছর পরেও একাত্তরের শীতের অনুভূতি শরীরে টের পাই। আসলে একাত্তরের প্রতিটি মুহূর্ত আমি আজও অনুভব করি সমান অনুভবে। আমার বয়সী যারা তারাও নিশ্চয় আমারই মতো দেহমনে আজো একাত্তরের স্পর্শ-অনুভব করেন। একাত্তর ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, পাশ কাটিয়ে যাওয়াও আমাদের পক্ষে অসম্ভব। একাত্তর আমাদের অস্তিত্বে মাখামাখি হয়ে যাওয়া এক সুবর্ণ সময়।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহর্নিশ প্রেরণার উৎস। ডিসেম্বরের বিজয় আমাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। সর্বোত্তম সুখানুভূতি। বাঙালির হাজার বছরের শৃঙ্খলমুক্তির জলজ্যান্ত সাক্ষী আমি, আমার প্রজন্ম। পঁচিশে মার্চ থেকে ষোলই ডিসেম্বর। প্রতিটি দিনের ঘটনা নিয়ে হতে পারে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। লেখা হতে পারে কালজয়ী উপন্যাস। রচিত হতে পারে ধ্রুপদী চিত্রকলা।

একাত্তরের ডিসেম্বরের কনকনে শীতে জবুথবু হয়ে ঘরে বসে থাকেনি সাড়ে সাত কোটি মানুষ। ষোল তারিখের বিকেলে ঢাকার রেসকোর্সে নতজানু পাকিসেনাদের আত্মসমর্পণের খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ার পর ভয়ানক শীত উপেক্ষা করে আনন্দোল্লাসে মেতে ওঠা কোটি কোটি মানুষের রক্ত টগবগ করে উঠেছিল উষ্ণ বিজয়ানন্দে। উদ্বাহু নৃত্যে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করা জয়বাংলা ধ্বনিতে সেদিন কোথায় শীতানুভূতি! কোটি মানুষের আবেগ উত্তাপে উধাও রক্তজমাট করা প্রকৃতির শীতলতা।

পাকিস্তানের মৃত্যুগহ্বর থেকে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন বিজয়ের প্রায় এক মাস পর, বাহাত্তরের দশই জানুয়ারি। ঢাকার চেহারা তখন আজকের মতো ছিল না। দূরদূরান্ত থেকে লাখো মানুষ মাইলের পর মাইল হেঁটে পৌঁছে গেল তেজগাঁর পুরনো বিমানবন্দরে। উদ্দেশ্য একটাই– প্রাণপ্রিয় নেতাকে অভ্যর্থনা জানানো। বিমানবন্দর থেকে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে নিজ গৃহে না ফিরে নেতা সোজা গেলেন রেসকোর্সের সবুজ চত্বরে লাখো বাঙালির ভীড়ে। যেখান থেকে একাত্তরের সাতই মার্চ তিনি শুনিয়েছিলেন তাঁর অমর কবিতা– ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

এর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় নেতাকে হত্যা করা হল। সংবিধান থেকে কেটে দেওয়া হল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ধর্মনিরপেক্ষতার অধ্যায়। ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে জারি হল ‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনি। ‘রেডিও পাকিস্তান’এর আদলে বদলে গেল ‘বাংলাদেশ বেতার’এর নাম। হল ‘রেডিও বাংলাদেশ’। ইত্যাদি ইত্যাদি। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বরের পর থেকেই পরাজিত শক্তি গভীর ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে নিজেদের কব্জায় নেবার জন্য। ষড়যন্ত্র মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দর্শন ও ভাবমূর্তি ধ্বংস করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের দর্শনে মিশে থাকা লোকায়ত বাংলার শাশ্বত রূপ তাদের চক্ষুশূল ছিল। যে দর্শনে মিশে থাকে হাজার বছরের মানবতার সুর, দেশপ্রেম প্রকৃতিপ্রেম অসাম্প্রদায়িকতার শুভবাদী পীযূষধারা। তার মানে বাঙালি জাতিসত্তার শিকড়ে কুড়াল মারার কাজটি শুরু হল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে।

তারপর কত অঘটন, কত দুর্ঘটনা, কত রক্তপাত, কত শোক, কত পাপ। মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র ভূমি থেকে বাংলাদেশকে জোর করে দূরে সরিয়ে দেওয়ার কাজটি হয়েছে অত্যন্ত সুচতুর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। একাত্তরের রাজাকারদের অশ্লীল আন্দোলনে কেঁদেছে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী অসংখ্য মানুষের বিবেক। এক সময় মনে হচ্ছিল আমরা বুঝি জাতি হিসেবে নিশ্চিহ্ন হতে চলেছি। মনে হচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত প্রিয় বাংলাদেশ বুঝি ধ্বংসের কালো গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে। বিজয় দিবস, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মহান একুশ, বাংলা নববর্ষ পালনের উৎসবগুলো মলিন করার চক্রান্তও সহ্য করতে হয়েছে নীরবে নিভৃতে।

এখানেই সব শেষ নয়। ইতিহাস বলে, বাঙালি কখনও পরাভব মানেনি। সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে বাঙালি বজ্রকঠিন দৃঢ়তায় রুখে দাঁড়াতে জানে। নরম পলিমাটির মতো বাঙালির চরিত্রে কোমলতা আছে সত্য, কিন্তু চৈত্রের খরতাপে শক্ত হয়ে যাওয়া মাটির মতোই পাথর কঠিন হয়ে উঠতে পারে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা আর বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষা জনপদের মানুষ। যে রাখাল অলস মধ্যাহ্নে খোলা প্রান্তরে হাতের আঙুলের নিপুণ সঞ্চালনায় বাঁশির সুর তুলত, যুবকের সেই আঙুলই স্টেনগানের ট্রিগার চেপে শত্রু নিধন করেছে। খেয়া পারাপারের মাঝি বৈঠা ফেলে শক্ত হাতে ধরেছে রাইফেলের কঠিন বাঁট। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়ুয়া ছাত্র, তরুণী, সংগীতশিল্পী, সরকারি আমলা, স্কুল শিক্ষক, একাত্তরে সবাই মিলেছিল দেশমাতার মুক্তির ডাকে। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান– কে আসেনি একাত্তরের যুদ্ধে? সামরিক বাহিনীর সদস্য থেকে অতিসাধারণজনের মিলিত ঐক্যে যে মহাযজ্ঞ ঘটেছিল একাত্তরে– তার দৃষ্টান্ত বাংলার ইতিহাসে নেই। বিশ্বইতিহাসেও আছে কিনা আমার জানা নেই।

তবে প্রত্যাশা পুরোপুরি মেটেনি। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মিলন ঘটেনি। যার ফলে হতাশার কষ্ট কিছু তো আছেই। রাজনৈতিক ক্ষেত্রের ভুল সিদ্ধান্তে বহুবার হোঁচট খেতে হয়েছে। দুষ্টচক্রের প্রতারণার ফাঁদে বার বার পা জড়িয়ে গেছে। তাছাড়া ঘরের শত্রু বিভীষণদের সুচতুর শয়তানির কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ভাবমূর্তি। লুটপাট আর দখলদারি সংস্কৃতির ঔদ্ধত্য দেখে কষ্ট লাগে।

মেঘ দেখে ঘাবড়ে গেলে চলবে না। মেঘের কালো আঁধার সাময়িক। আলোর ঔজ্জ্বল্য থাকে অনন্তকাল। একাত্তরের বিজয়ে জ্বলেছিল যে অগ্নিশিখা তা অক্ষয়, চুয়াল্লিশ বছরে যা এতটুকু ম্লান হয়নি। ম্লান হয়নি বলেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত না থাকলে এটা সম্ভব হত না। দেশের যা কিছু অর্জন সবই সম্ভব হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও দর্শনের প্রতি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শ্রদ্ধা ও সমর্থন আছে বলেই। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:২৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তোমাকে লিখলাম প্রিয়

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০১


ছবি : নেট

আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

×