১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি পেল সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত প্রেক্ষাপট, মুক্ত সংস্কৃতি চর্চার একটি অনুকুল পরিবেশ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা এগিয়ে এলো সর্বাগ্রে। মৌসুমী নাট্যচর্চার আবর্তন ছেড়ে নাট্যকর্মীরা এবার নিয়মিত নাট্যচর্চায় এগিয়ে এলেন। নাট্যচর্চার এই আন্দোলনে যুক্ত হতে লাগল সচেতন তরুণ ছাত্রসমাজ। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জনের অভিজ্ঞতায় নাট্যরচনা এবং মঞ্চায়ন সুস্পষ্ট বক্তব্যের দিকে মোড় নিলো। নাটক হয়ে উঠলো সমাজের প্রতিচ্ছবি, তরুণ নাট্যকর্মীরাও নাটকের প্রতি অনেকবেশি দায়বদ্ধ হয়ে উঠলো। নতুন দেশের, নতুন কালের এই নাট্য জোয়ারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করলো - নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়, আরণ্যক নাট্যদল, থিয়েটার, নাট্যচক্র, ঢাকা থিয়েটার, বহুবচন সহ অন্যান্য দল।
শুরু হল দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যমঞ্চায়ন। এ দলগুলো সবই ঢাকা কেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের থিয়েটার ’৭৩, অরিন্দম, নান্দিকার, তির্যক, গণায়ন, অঙ্গন, রাজশাহীর সাংস্কৃতিক সংঘ, নাটোরের সাকাম, থিয়েটার চাপাই নবাবগঞ্জ, খুলনা থিয়েটার, ফরিদপুরের সুনিয়ম, বরিশালের খেয়ালি, বরিশাল নাটক, কুমিল্লার জনান্তিক, ময়মনসিংহের বহুরূপী, বগুড়ার বগুড়া থিয়েটার, বগুড়া নাট্যগোষ্ঠী, কুষ্টিয়ার চারণিক, ফেনীর সংলাপ প্রভৃতি দলগুলোও নিজ নিজ শহরে স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্যচর্চায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
১৯৭৩ সালে দর্শনী বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় বাংলাদেশে দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্যচর্চার সূচনা করে। তাদের প্রথম মঞ্চস্থ নাটকটি ছিলো বাদল সরকার রচিত বাকী ইতিহাস। ১৯৭৪ সালে আব্দুল্লাহ আল মানুনের সুবচন নির্বাসনে মঞ্চস্থ হয় অপর নাট্যদল থিয়েটার-এর প্রযোজনায়। সত্তরের দশকে ঢাকা থিয়েটার মঞ্চস্থ করে সেলিম আল দীনের সংবাদ কার্টুন, মুনতাসীর ফ্যান্টাসী, শকুন্তলা প্রভৃতি নাটক। এই দশকেই আরণ্যক নাট্যদল থেকে মঞ্চস্থ হয় মামুনুর রশীদের ওরা কদম আলী।
১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকার উল্লেখযোগ্য নাট্যদলগুলো আলোচনায় মিলিত হয় এবং তাদের মিলিত সিদ্ধান্তেই বাংলাদেশে গ্র“প থিয়েটার ফেডারেশন গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ফেডারেশনের প্রথম জাতীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে প্রথম নির্বাহী পরিষদ নির্বাচন করা হয়। এ সময় সভাপতিমন্ডলীর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন রামেন্দু মজুমদার এবং সেক্রেটারী জেনারেল হন নাসির উদ্দিন ইউসুফ।
বাংলাদেশের গ্র“প থিয়েটারের এই কনসেপ্ট সম্পর্কে ইঙ্গিত করতে গিয়ে নির্দেশক-মঞ্চ পরিকল্পক জামিল আহম্মেদ তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘‘১৮৮০-এর দশকে ইউরোপে নতুন এক নাট্যান্দোলন শুরু হয়েছিল বাস্তবধর্মী নাটককে কেন্দ্র করে। কমার্শিয়াল থিয়েটার কর্তৃক বর্জিত বাস্তবধর্মী নাটক খুঁজে পেল কিছু সংখ্যক অপেশাদার নাট্যকর্মী, যারা নিজেদেরে আদর্শকে তুলে ধরলেন ব্যবসার উপরে। ১৮৮৭ সালে প্যারিসে, আর্দ্রে আঁতোয়া ঞযবধৎব খরনৎব নামে একটি থিয়েটার এবং দল প্রতিষ্ঠা করলেন। ... দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন এবং তারপরে কোলকাতায় নবান্ন নাটকটিকে কেন্দ্র করে যে নবনাট্য আন্দোলন ঘটেছিল, সেটা যেন ইউরোপের নবনাট্যের পুনরাবৃত্তি। বাংলাদেশের গ্র“প থিয়েটারের শিকড় খুঁজতে গিয়ে, এই তথ্য প্রয়োজনীয় হতে পারে।’’
নাট্যচর্চা আশির দশকে পদার্পণ করলে জন্ম নিল আরো অনেক নতুন নাট্যদল। যরা পরবর্তী থিয়েটার চর্চায় অনেক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। এই সময়ে নাট্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে আরেকটি নবতর অধ্যায়ের সূচনা হয় - নাট্য বিষয়ক শিক্ষা গ্রহণকারী øাতকবৃন্দের পেশাদারী কাজের দ্বারা। দিল্লীর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা [এনএসডি] থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরে এলেন একদল তরুণ নাট্যকর্মী। এদের নিরলস পরিশ্রম এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রভাব পড়তে লাগলো বাংলাদেশের নাট্যচর্চায়। এ সময়েই বাংলাদেশেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নাটক স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয়।
আশির দশকের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনার মধ্যে সেলিম আল দীনের কিত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল চাকা, মামুনুর রশীদের ওরা আছে বলেই, ইবলিশ, এখানে নোঙর, খোলা দুয়ার, গিনিপিগ, আব্দুল্লাহ আল মামুনের সেনাপতি, এখনও ক্রীতদাস, মমতাজ উদ্দীন আহমেদের বিবাহ, কি চাহ শঙ্খচিল, রাজা অনুস্বারের পালা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
আশির দশকের অপর উল্লেখযোগ্য ঘটনা - বাংলাদেশের মঞ্চনাটক প্রসেনিয়ামের ঘেরাটোপ ভেঙে রাজপথে এসে ঠাঁই করে নিল। পথ নাটক চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশের নাট্যচর্চা রাজপথ থেকে শহীদ মিনার, পার্ক, ময়দানে ঠাঁই করে নিল। বাংলাদেশে পথ নাটকের সূত্রপাত ঘটে ঢাকা থিয়েটারে চর কাকড়ার ডকুমেন্টারী নাটকটির মাধ্যমে। সেলিম আল দীন রচিত ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্দেশিত এ নাটক মঞ্চস্থ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রের [টিএসসি] সড়ক দ্বীপে। নাটকটির উপর তৎকালীন স্বৈরসরকারের পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়। এরপর খায়রুল বাশার রচিত জনৈক ঈমান আলী, জীবন এখানে কোরাস গান প্রভৃতি পখ নাটকগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সড়ক দ্বীপে এবং বটতলায় মঞ্চায়িত হতে থাকে। এর মধ্য দিয়েই আশির দশকের শুরু থেকে নব্বই দশকের প্রান্তে এসে পথ নাটক বাংলাদেশের নাট্য জগতে নতুন মাত্রা সংযোজন করে থাকে। বিশেষ করে নব্বইয়ের স্বৈরশাসকের পতন ও গণআন্দোলনে পথ নাটক বিশেষ ভূমিকা রাখে।
নব্বইয়ের স্বৈরশাসকের পতনে বাংলাদেশ গ্র“প থিয়েটার ফেডারেশনের ভূমিকাও বিশেষ উল্লেখের দাবীদার। তৎকালের নাট্যচর্চায় বিশেষত নাটক রচনায় স্বৈরশাসকের রূপ এবং তার বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মমতাজ উদ্দিন আহমেদের সাত ঘাটের কানাকড়ি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাংলানাটক রচনার উৎকৃষ্ট দলিল। এ ছাড়াও সেলিম আল দীনের চাকা ও সৈয়দ শামসুল হকের গণনায়কের মতো সাহিত্য মানসম্পন্ন নাটকেও স্বৈরশাসনের দিনকালের প্রভাব পড়ে।
নব্বই দশকের আরেকটি নাট্য অর্জন বলা যায়, ঢাকা থিয়েটারের শিকড় সন্ধানী প্রযোজনাসমূহকে। দলের নাট্যকার সেলিম আল দীন ও নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফের প্রচেষ্টায় বাংলা নাটকের হাজার বছরের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার ও বাংলার নিজস্ব নাট্যরীতির সন্ধানের প্রক্রিয়া হিসেবে এ দল থেকে মঞ্চস্থ হতে থাবে যৈবতী কন্যার মন, হাতহদাই, বনপাংশুল প্রভৃতি নাটক। উল্লেখ্য এই মঞ্চনাটক সমূহের মাধ্যমেই ঢাকা থিয়েটার বাংলা নাটকের নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব সূত্রানুসন্ধান এবং বর্ণনাতœক নাট্যরীতি, পাঁচালির রীতির নাটক ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা করে। এ সময়ের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নাটক হিসেবে সৈয়দ শামসুল হকের এখানে এখন, ঈর্ষা, আব্দুল্লাহ আল মামুনের তিনটি পথ নাটক, কোকিলারা, নাসির উদ্দিন ইউসুফের একাত্তরের পালা, মান্নান হীরার মৃগনাভি, শেকল, আদাব, ঘুমের মানুষ, ময়ুর সিংহাসন, মামুনুর রশীদের লেবেদেফ, পাথর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
নতুন সহস্রাব্দে এসে বাংলাদেশের নাটক আন্তর্জাতিক নাট্যধারা সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে থাকে। নব্বইয়ের শেষপ্রান্তেই বাংলাদেশের একাধিক নাট্যদল তাদের প্রযোজনা নিয়ে যেমন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নাটক মঞ্চস্থ করতে যায় তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন নাট্যদলও এ দেশে আসে। বাংলা নাটক ও বাংলাদেশী নাট্যকর্মীদের সঙ্গে বিশ্বনাটকের আদান-প্রদান প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এর মধ্যে আমেরিকায় সেলিম আল দীনের চাকা, জার্মানীতে মামুনুর রশীদের ওরা কদম আলী, কোরিয়ায় সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় মঞ্চায়ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা। একবিংশ শতকের দ্বারপ্রান্তে ঢাকায় প্রফেশনাল থিয়েটার হিসেবে সিএটি [সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার] প্রতিষ্ঠিত হয়। এ দল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নির্দেশক, ডিজাইনার দিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করে। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনার মধ্যে ঢাকা থিয়েটারের হরগজ, আরণ্যকের সঙক্রান্তি, নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের রক্তকরবী, নাট্যকেন্দ্রে আরজ চরিতামৃত, সিএটির রাজা আলোড়ন সৃষ্টি করে।
ঢাকার মঞ্চে গ্র“প থিয়েটার চর্চার এই ইতিহাসে বিদেশি নাটকের অনুবাদ ও রূপান্তর নাটক এক বিশাল অধ্যায় জুড়ে রয়েছে। ১৯৭১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত স্যামুয়েল বেকেট, ইউজিন আয়ানেস্কা, ব্রেটল্ট ব্রেখট, জ্যঁ পল সার্ত, এলবেয়ার ক্যামু, এডওয়ার্ড এলবি, মলিয়ের, মোলনার, শেকস্পিয়র, হেনরিক ইবসেন প্রমুখের নাটক অনূদীত ও রূপান্তরিত হয়েছে। এরমধ্যে শেকস্পিয়র, মলিয়ের, ব্রেখট ও ইবসেনের নাটকের মঞ্চায়নই বেশি হয়েছে। ফরাসী নাট্যকার মলিয়েরের কমেডিসমূহ বাংলাদেশে প্রবলভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। লোকনাট্য দলের কঞ্জুস, কুশীলবের গিট্টু, নাট্যকেন্দ্রের বিচ্ছু বাংলাদেশে মঞ্চস্থ মলিয়েরের অন্যতম জনপ্রিয় নাটক। মলিয়েরের মতোই বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন জার্মান নাট্যকার ব্রেটল্ট ব্রেখট। নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের গ্যালিলিও, সৎ মানুষের খোঁজে, দেওয়ান গাজীর কিসসা, নাগরিক নাট্যাঙ্গনের জনতার রঙ্গশালা ব্রেখট মঞ্চায়নের আদর্শ উদাহরণ। শেকসপিয়রের ট্র্যাজেডি এবং কমেডি উভয়ই বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে একাধিকবার মঞ্চস্থ হয়েছে। ঢাকা থিয়েটারের মার্চেন্ট অব ভ্যানিস, নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের দর্পণ, থিয়েটারের ম্যাকবেথ, নাগরিক ও থিয়েটারের যৌথ প্রযোজনা ওথেলো উল্লেখযোগ্য শেকসপিয়র প্রযোজনা। বিদেশি নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মঞ্চে যেমন স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডোর মতো নিরীক্ষামূলক নাটক ঠাঁই পেয়েছে তেমনি সফোক্লিসের রাজা ইডিপাসের মতো ধ্র“পদী নাটকও ঠাঁই পেয়েছে।
বাংলাদেশের গ্র“প থিয়েটার চর্চা যেমন ক্রমশ তরান্বিত হচ্ছে তেমনি গ্র“প থিয়েটার ফেডারেশনের কার্যক্রমও বাড়ছে। নাট্যচর্চার সূচনা লগ্নে হাতেগোণা কয়েকটি দল নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও মাত্র তিরিশ বছরে গ্র“প থিয়েটার ফেডারশনভূক্ত নাট্যদলের সংখ্যা বর্তমানে দুইশতাধিক। ১৯৯৯ সালের নির্বাচন অনুযায়ী বাংলাদেশ গ্র“প থিয়েটার ফেডারেশনের সভানেত্রী সারা যাকের এবং সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী লাকী। নতুন এ সহস্রাব্দের সূচনায় বাংলাদেশের সকল নাট্যকর্মী প্রত্যাশা করে এ দেশের গ্র“প থিয়েটার চর্চা আরও বিকশিত ও বিস্তৃতি লাভ করবে এবং বাংলাদেশের নাটক বিশ্বমঞ্চে তার আপন আসন করে নেবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:২৯