ভৌতিক বা আধিভৌতিক ঘটনা - মানুষের জীবনে অন্যতম ইন্টারেস্টিং একটি অভিজ্ঞতা। এই ধরনের অভিজ্ঞতা মানুষ নিজে অর্জন করার চাইতে অন্যদের অর্জিত অভিজ্ঞতার কথা শুনতেই সাধারনত বেশি পছন্দ করে। উপযুক্ত পরিবেশে অন্যদের মুখে এই ধরনের ঘটনার বর্ননা নিঃসন্দেহে অন্যরকম অতি প্রাকৃতিক এক আবহাওয়া তৈরী করে। তাই ভূতের গল্প যুগ যুগ ধরে নন্দিত একটি ব্যাপার।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি এই সব ভূতপ্রেতের গল্প বিশ্বাস করি না এবং একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে তা বিশ্বাস করার কোন সঠিক যুক্তিও নেই। তবে অনেক সময় পরিস্থিতির কারনে কিছু কিছু ঘটনা মনে গভীর দাগ সৃষ্টি করতে পারে। দূভার্গ্য হোক আর সৌভাগ্য হোক এমন কিছু বিরল অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আমি ব্যক্তিগত ভাবে গিয়েছি এবং অন্যদের মুখ থেকে কিছু অভিজ্ঞতার কথাও শুনেছি। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমি ঐ ঘটনাগুলোর একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সঠিক ব্যাখ্যার অভাবে বেশ অস্বস্তি বোধ করেছি।
ভূতের গল্প পছন্দ করেন না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই দূর্লভ একটি ব্যাপার। কাউকে যদি আপনি ভূতের গল্প শুনাতে চান, হোক সে শিশু কিংবা বৃদ্ধ, সবার কাছেই আপনি বেশ অভূতপূর্ব সাড়া পাবেন। এর সাথে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোন ব্যাপার নেই। এই পুরানো সূত্র মাথায় রেখেই আপনাদের সাথে ঘটনা গুলো শেয়ার করছি এবং পাশাপাশি আমার ব্যাখ্যাও দেয়ার চেষ্টা করেছি। যেগুলোর উপযুক্ত ব্যাখ্যা পাইনি তাও উল্লেখ্য করেছি। আমি দৃঢ়ভাবে যেমন বিশ্বাস করি, উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে কিছু ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা আমি দাঁড় করাতে পারি নি, তেমনি এটাও স্বীকার করি এই রহস্যময় পৃথিবীর রহস্যের ঠিক কতটুকুই বা আমরা জানি।
ঘটনা ০১
আমার এক দূর সম্পর্কের নানা ছিলেন যাকে আমরা ফকির নানা বলে ডাকতাম। তিনি ছিলেন যথেষ্ট বিদ্যান, অল্পভাষী এবং ধর্মজ্ঞান সম্পন্ন একজন সুফী মানুষ। আমরা শুনেছি যে তিনি সারারাত ধরে মসজিদের পাশের একটি ঘরে ইবাদত বন্দেগী করতেন। সেই সময় ঐ ঘরের আসেপাশে কারো যাওয়াটা তিনি পছন্দ করতেন না। কথিত ছিল, তার সাথে নাকি জীন আছে। আমাদের মা খালাদের এই বিশ্বাস আরো তীব্র হতো যখন তাঁর বাড়িতে বেড়াতে গেলে নানী আমাদেরকে মাঝে মাঝে কিছু চমৎকার ফল খেতে দিতেন যা বাজারে কখনও দেখতাম না। দীর্ঘদিন পরে এসে জানলাম, সেই ফলের নাম ছিল ড্রাগন ফল।
২০০২ সালে রোজার ঈদের পরদিন তিনি মারা যান। আমরা তখন ঈদ উপলক্ষে গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। সবাই মিলে তাড়াতাড়ি তার বাড়িতে গেলাম। তখন বাজে প্রায় রাতের দুইটা। ইতিমধ্যেই লাশকে গোসল দেয়া হয়েছে, কাফনের কাপড় পড়িয়ে বাড়ীর কাচারী ঘরে (গ্রাম দেশের বাড়ির সামনের বৈঠক ঘর) রাখা হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বাদ ফজর তাকে দাফন করা হবে। স্থানীয় মসজিদের মোয়াজ্জেম সাহেবের সাথে কয়েকজন লাশের পাশে বসে গুন গুন করে কোরান শরীফ পড়ছেন।
কাচারী ঘরের বারান্দায় চেয়ার দেয়া হয়েছে। আমরা কয়েকজন সেখানে বসে আছি। অক্টোবরের শেষ দিক হওয়াতে বাতাসে হালকা শীতের আভাস। বাতাসে আগরবাতি এবং কর্পূর মিশ্রিত এক অদ্ভুত রহস্যময় গন্ধ।
হঠাৎ টিনের চালে ধুম করে কিছু একটা পড়ার শব্দে কিছুটা চমকে উঠলাম। গ্রাম দেশে টিনের চালে মাঝে মাঝে ডালপালা বা ফল জাতীয় কিছু ছিঁড়ে পড়লে এমন শব্দ হতেই পারে। প্রাথমিকভাবে আমাদেরও তাই ধারনা হয়েছিল। ফলে বিষয়টা নিয়ে দ্বিতীয় কোন চিন্তা মাথায় আসে নি। এর বেশ কিছুক্ষন পরে আবারও জোরে ধুম করে কিছু একটা পড়ার শব্দ হলো। এবার মনে হলো পানি ভর্তি একটা ড্রাম টিনের ছাদে গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা লাফ দিয়ে উঠানে এসে কাচারী ঘরের ছাদের দিকে তাকালাম। আমি মনে মনে একটা ডাব গাছ আশা করেছিলাম। কিন্তু ডাব জাতীয় কোন গাছই দেখতে পেলাম না। একটা ছোট লিচু গাছ আর কয়েকটি মাঝারি সাইজের আমগাছ কাচারী ঘরকে ঘিরে রেখেছে।
কিছুক্ষন খোঁজাখুঁজি করে যখন শব্দের উৎস সম্পর্কে জানা গেলো না, তখন পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট হয়ে গেলো। এই যখন পরিস্থিতি তখন বাড়ির ভেতর থেকে খবর আসলো যে, নানা নাকি জীবিত কালে নানীকে বলে গিয়েছেন তার মৃত্যূর পর জানাযা দেয়ার আগে তাকে যেন কাচারী ঘরে কিছুক্ষনের জন্য একা রেখে আসা হয়।
মানুষের ভয় পাবার কিছু স্বভাবজাত ট্রিগার রয়েছে। ফলে আপনি যতই বিজ্ঞানমনস্ক হোন না কেন উপযুক্ত পরিবেশে যদি কোন কারনে সেই ট্রিগারে চাপ পড়ে তাহলে আপনি ভয় পেতে বাধ্য। বলাবাহুল্য আমিও এই তত্বের ব্যতিক্রম নই। কেন যেন আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো। গ্রামের মানুষজন এই ধরনের পরিস্থিতির সাথে বোধকরি বেশ পরিচিত। তাই তাদের মধ্যে সামান্য কিছু উত্তেজনা ব্যতিত আর কিছুই দেখলাম না।
সবাই মুরুব্বীদের পরামর্শ অনুযায়ী লাশটাকে কাচারী ঘরে রেখে এসে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে দূরে এসে দাঁড়াল। আমার জন্য বেশ নতুন একটা অভিজ্ঞতা। ভয়, অবিশ্বাস আর উত্তেজনার সংমিশ্রনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল যা ঠিক লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমি এদিকে সেদিকে তাকাচ্ছিলাম। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। গভীর রাত, দুর থেকে ভেসে আসা কান্নার শব্দ, অন্ধকার, গুনগুন করে মানুষের ধর্মীয় মন্ত্রপাঠের শব্দ এবং থেমে থেমে কুকুরের বিক্ষিপ্ত ডাক একটা অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।
এইভাবে বেশ অনেকক্ষন কেটে গেলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি প্রায় রাতের ৩টা বাজে। আমি কাচারী ঘরের বারান্দা বাদ দিয়ে সামনে উঠোনের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছি। মোয়াজ্জেম সাহেব কাচারী ঘরে ফকির নানার লাশ রেখে বাইরে বের হয়ে আসলেন।
এবার শুরু হলো অপেক্ষা। এই এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। আপনার শিক্ষা, আপনার ধর্ম জ্ঞান, আপনার বিশ্বাসের সাথে এক অসম লড়াই। হঠাৎ মনে হলো কাচারী ঘরের সাথের আমগাছটা বেশ অদ্ভুতভাবে নড়চড়া করছে। মনে হচ্ছে গাছের উপর দিয়ে বেশ জোরে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। আমার ছোট মামা আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। ফিসফিস করে বললেন, চলে আসছে। কিন্তু আমি গাছের পাতার নড়াচাড়া ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। দুই মিনিটের মধ্যে তাও থেমে গেলো। চারিদিক গ্রাস করল একটা শুনশান নীরবতায়। আমার মনে হচ্ছিল, কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। পরিস্থিতির সাপেক্ষে বেশ অতি প্রাকৃত ব্যাপারই বটে।
হঠাৎ 'ক্যাচ' করে দরজা খোলার মত একটা শব্দ পেলাম। আমি কাচারী ঘরের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার মনে হলো দরজাটা অল্প একটু ফাঁক হয়ে আবার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমাদের মাথার উপরেই হঠাৎএকটা সুখ পাখি ডেকে উঠল। তারপর আবারও সব চুপচাপ। আরো ১০/১৫ মিনিট অপেক্ষা করার পর সবাই একসাথে দোয়া পড়তে পড়তে কাচারী ঘরে প্রবেশ করল। বুঝলাম জীন দেখা পর্ব এখানেই শেষ। আগেই বলেছিলাম গ্রামের মানুষজন বুঝি এমন ঘটনার সাথে খুব পরিচিত। এখনও দেখলাম সবাই বেশ স্বাভাবিক আচরন করছে। পাশের বাড়ি থেকে ইতিমধ্যে চা চলে এসেছে। সবাই আয়েশ করে চা খেতে খেতে গল্প করছে।
মাঝে মাঝে আমার কাছে বিয়ে বাড়ি আর মরা বাড়ীকে একই রকম লাগে। বিয়ে বাড়িতে সবাই ছোট ছোট দল হয়ে গল্প গুজব করে মরা বাড়িতেও তাই। মাঝে মাঝে হাসি ঠাট্টা, মাঝে মাঝে আল্লাহ! বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষন থমকে যাওয়া তারপর আবারও হাসিঠাট্টা। এইভাবেই আসলে আমাদের জীবন চলে।
যাইহোক এরপরের ঘটনা সামান্য। আমরা ফজরের নামাজ পড়তে বাড়ির মসজিদে যাই। আমরা পোলাপাইনরা পিছনের সারিতে দাড়াই। নামাজের মধ্যেই হঠাৎ টের পাই আমার পিছনের সারিতে আরো কয়েকজন নামাজ পড়ছে। হাস্নাহেনা ফুলের চমৎকার একটা গন্ধ আমি পাচ্ছিলাম। কিন্তু সালাম ফেরানোর পর পিছনে তাকিয়ে আমি কাউকে দেখতে পাই নি। আমরা লাশ নিয়ে দাফন করার জন্য নানাদের পারিবারিক কবরস্থানের দিকে রওনা করলাম। বাড়ি থেকে বের হয়ে ডান দিকে সোজা একটা পথ ধরে প্রায় ১০০ গজ এগিয়ে গেলে পুকুর পাড়ে করবস্থান। লাশ দাফন করার পর যখন দোয়া হচ্ছিল, তখন উপস্থিত কয়েকজন মুরুব্বীর বিস্ময়মিশ্রিত চোখ অনুসরন করে দেখলাম কবরস্থানের দেয়ালের পাশেই তিনজন মানুষ দোয়ায় শামিল হয়েছেন। তখনও ভোরের আলো ঠিকভাবে ফুটে নি। পরিষ্কারভাবে তাদের চেহারা দেখা যাচ্ছিলো না তবে এই তিনজন মানুষকে আমার কেন যেন স্বাভাবিক লাগছিল না, যদিও আমি তাদের চেহারা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম না, তথাপি তাদের শারিরীক গঠন আমার কাছে কিছুটা অস্বাভাবিক লাগছিল। কেমন অস্বাভাবিক, আমি তা ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। হঠাৎ কেমন যেন একটা শিরশির অনুভুতি হচ্ছিলো। মনে হলো, কে যেন আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি পিছনে তাদের দেখার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পাশের এক মুরুব্বী আমাকে ইশারায় তাকাতে মানা করলেন। মুনাজাতের সময় মাওলানা সাহেব বললেন, হে আল্লাহ! আমরা তোমার দুই অনন্য সৃষ্টি এখানে উপস্থিত আছি। তুমি আমাদের দোয়া কবুল করো।
মুনাজাত শেষ করে আমরা বাড়ির পথ ধরলাম। কবরস্থান থেকে একটাই মাত্র রাস্তা প্রধান সড়কে উঠেছে। পুরো রাস্তা ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। দূরে ফসলের মাঠে হালকা কুয়াশাগুলো এমন ভাবে সরে যাচ্ছিলো মনে হচ্ছিল তিনটা মানুষ বুঝি ভেসে ভেসে যাচ্ছে।
ব্যাখ্যাঃ
ঘরের চালে ধুম করে শব্দের ব্যাখ্যা হতে পারে, হয়ত কোন বড় পাখি কোন শুকনা ডালে হঠাৎ এসে বসায় ভার নিতে না পারায় তা ভেঙে চালে পড়েছে। আমি যখন পরে বিষয়টা নিয়ে ভাবলাম, তখন মনে হলো মাঝারি সাইজের একটা আম গাছে কি এমন শুকনা ডাল থাকতে পারে? উত্তর - হ্যাঁ থাকলেও থাকতে পারে।
এমন বড় কোন পাখি হতে পারে?
- আমি জানি না! হয়ত বড় কোন পেঁচা বা নাম না জানা অন্য কোন পাখি।
এত শব্দ কেন হলো?
- আমার মতে শব্দটা স্বাভাবিকই হয়েছিল, যতটুকু হবার কথা ততটুকুই হয়েছিল। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে হয়ত তা হ্যালুসিনেট করে বেশি শুনিয়েছে।
ক্যাচ ক্যাচ শব্দে দরজার খোলার শব্দ?
- গ্রামের যৌথ পরিবারের বাড়ি। হয়ত লাগোয়া কোন বাড়ির দরজা মা খালারা সন্তর্পণে খোলার চেষ্টা করেছিলেন। সেই শব্দ আমার কানে আসার পর মনে হয়েছে তা কাচারি ঘর থেকেই আসছে।
নামাজের সময় পেছনের কারো উপস্থিতি?
গ্রামের মসজিদগুলো খুব একটা বড় হয় না। অনেক সময় চারিদিক যখন নিরব থাকে, সেই সময় এক সাথে সবাই মিলে রুকু বা সিজদায় যাবার শব্দ হয়ত মসজিদের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে পেছনে থেকে এপ্লিফাই হতে পারে, যাতে মনে হয় পেছনে কেউ আছে।
ফুলের গন্ধ?
এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। গ্রামে জানালা খোলা থাকলে স্বাভাবিক সময়েও ফুলের গন্ধ আসতে পারে। ফুলের গন্ধে অস্বাভাবিকতা খোঁজার বিষয়টি আমার নিজের কাছে কিছুটা হাস্যকরই লেগেছে।
তিনজন অপরিচিত ব্যক্তি?
- আমি জানি না! হতে পারে দুরের কোন পথচারী। লাশ দাফন করতে নিয়ে যাচ্ছে দেখে তারাও শেষ মুহুর্তে অংশ নিলেন। নিজেদের মত দ্রুত দোয়া করে আগেই চলে গেলেন।
আপনি কি এই সকল ব্যাখ্যা ১০০ভাগ বিশ্বাস করেন?
না, দুঃখিত। শতভাগ ব্যাখ্যা বিশ্বাস করে আমার দুর্লভ কিছু অতিপ্রাকৃতিক অভিজ্ঞতার ঝুলি নষ্ট করতে চাই না।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:০৮