মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে একটি আইন তৈরি করা হয়। এই আইনটিকে ২০০৯ সালে কিছুটা সংশোধন করে এর আওতায় ২০১০ সালের ২৫শে মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত করা হয় এবং প্রথম রায় হিসেবে ২০১৩ সালের ২১শে জানুয়ারি আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এর পরবর্তীতে, কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যা, মিরপুরের আলুব্দি গ্রামে ৩৪৪ জন মানুষ হত্যা করার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নেতা কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। রায় শেষে দেখা যায় কুখ্যাত এই রাজাকার মুখে হাসি আর আঙুলে ভি চিহ্ন দেখাচ্ছেন।এতো গুলো হত্যা, ধর্ষণ, সর্বোপরী গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে বাংলাদেশের সাধারন মানুষ কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। এই রায়ের দিন জামাত শিবির হরতালের ডাক দেয়। কিন্তু সাধারন মানুষ সবকিছু উপেক্ষা করে শাহবাগে এসে জড়ো হয়। সুত্রপাত হয় এক ঐতিহাসিক আন্দোলনের।
আনন্দের বিষয় সামহোয়্যারইন ব্লগের ব্লগাররা মানবতাবিরোধী অপরাধের দাবিতে অনেক আগে থেকেই সোচ্চার ছিলো, পিটিশনও সাইন করা হয়েছিলো আমাদের ব্লগারদের তরফ থেকে এবং এই আন্দোলনের শুরু থেকে নিঃস্বার্থভাবে, অকাতরে আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলো সামহোয়্যারইন ব্লগের ব্লগাররাই।
৫ তারিখ দুপুর পর্যন্ত ইমরান এইচ সরকারকে অনেকেই চিনত না। আমাদের সহ ব্লগার ছিলেন, মাহমুদুল হক মুন্সী বাঁধন ভাই। উনার শেয়ার করা ইভেন্ট আর ব্লগ পোস্ট দেখে শাহবাগ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। তখন বাজে প্রায় দুপুর ২ টা। তাঁর সাথে আগে কখনও দেখা তো দূরে থাক কথাও হয় নি।
উনাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই হরতাল চলছে, পুলিশ আবার কোন সমস্যা করবে না তো এই সব সমাবেশে।
তিনি উত্তেজিত হয়ে জবাব দিলেন, সমস্যা করলে করবে, যে ভয় পাবে সে ঘরে থাক, আপনি আসতেছেন?
বললাম জী, আসতেছি।
আস্তে আস্তে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে!
দল মত নির্বিশেষে সবাই তখন পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়েছে। সাধারন মানুষ ব্যানারের মারপ্যাঁচ বুঝে না।
আমি আরো কয়েকজন সহ ব্লগারের সাথে যোগাযোগ করে শাহবাগে গেলাম। দেখলাম, অনেকেই এসে উপস্থিত। মিডিয়ার কর্মীরা আসছে। তখনও ইমরান এইচ সরকারকে চিনতাম না। প্রথম দেখলাম তাঁকে জাদুঘরের সামনে। বেশ চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেকেই সেখানে পোস্টার বানাচ্ছিলো। আমাদের কয়েকজনকে অনুরোধ করলে পোস্টার বানানোর কাজে সাহায্য করতে।
চলছে পোষ্টার তৈরীর কাজ! সাধারন মানুষই বানাচ্ছে পোষ্টার! সাধারন মানুষই সকল ক্ষমতার উৎস!
তারপর মিছিল! স্লোগান!
ফাঁসি, ফাঁসি, ফাঁসি চাই! রাজাকারের ফাঁসি চাই!
ক তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!
অতঃপর শাহবাগ রাজপথ জনতার!
প্রথম যে ছাত্র সংঘটনগুলো এখানে এসে জড়ো হয়েছিলো্ তাঁরা কেউই কোন রাজনৈতিক ব্যানার বা স্লোগান দেন নি, শুধুই রাজাকারের বিচার চাই এই ব্যানার নিয়ে অংশগ্রহন করেছিলেন।
তারপর তো ইতিহাস। সাধারন মানুষের স্লোগানের গর্জনে সেদিন লজ্জা পেয়েছিল সমুদ্র! মানুষের গর্জনে ভেসে আসছিল-
তুমি কে আমি কে,
চাকমা মারমা বাঙ্গালী,
তোমার আমার ঠিকানা,
পদ্মা মেঘনা যমুনা।
তোমার দেশ আমার দেশ,
বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।
আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত
এই রক্ত কোনদিনো বৃথা যেতে পারে না।
দিয়েছি তো রক্ত, আরো দিব রক্ত
রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়!
আপোষ না সংগ্রাম? সংগ্রাম সংগ্রাম
চলছেই চলবে, জনতা সংগ্রাম।
একশ্যন একশ্যন, ডাইরেক্ট একশন
রাজাকারের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট একশন।
জ্বালোরে জ্বালো!
জ্বালো জ্বালো, জ্বালোরে জ্বালো!
জয় বাংলা! জয় জনতা।
জয় জাগরন! জয় আন্দোলন।
--------------------------------------------------------------------
কঠিন বাস্তবতার কিছু কথা!
শাহবাগ নিয়ে এখন আর কোন অনুভূতি কাজ করে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, লাখো মানুষের সৎ আবেগ সেখানে সঠিক মর্যাদা পায় নি, আমাদের যে প্রাপ্তির কথা ছিল তা পূর্ন হয় নি। এত বড় গণজাগরণ অনুপাতে শাহবাগের প্রাপ্তি এক হিসেবে খুবই সামান্য। শাহবাগের রেশ নিয়ে ভবিষ্যতে মুভমেন্ট করার মত কোন তেমন শক্ত ভিত্তিও আর নেই। সাধারন মানুষ আরো একবার দেখলো কিভাবে সোনার ডিমের লোভে কৃষক শেষ পর্যন্ত হাঁসটাকেই মেরে ফেলে।
সাধারন মানুষ রাজাকারের বিচার চায়। তারা রাজাকারদের দলীয়করন চায় না। রাজাকারদের একটাই পরিচয়- তারা রাজাকার। কিন্তু এই দেশে রাজাকাররাই রাজনৈতিক খেলার অংশ! ক্ষমতার অংশ হলে রাজাকার পরিচয় হারিয়ে যায় কিংবা ক্ষমতার জন্য রাজাকার তোষনও কম হয় না।
আর তাই দিনশেষে 'রাজাকারের বিচাই চাই' একটি প্রহশনের দাবি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই দেশের ক্ষমতাসীনরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সার্বজনীন করতে পারেন নি, গত বেয়াল্লিশ বছর এটাকে তারা রাজনৈতিকরন করে ভোট ব্যবসাই করে যাচ্ছেন।
আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। আমি স্বপ্ন দেখি আর এক মহাজাগরনের। যে জাগরনে আমাদের তরুনরা দলমত নির্বিশেষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যে কারো অন্যায় দাদাগিরি, সকল দলের দূর্নীতিবাজ ও অযোগ্য নেতৃত্বকে দূর করে দেশকে আলোর পথে নিয়ে যাবে, জাতি হিসেবে কারো উপর নির্ভরশীল নয় বরং মাথা উঁচু করেই দাঁড়াতেই সাহায্য করবে। আর যারা এই কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তারাই হবে নব্য রাজাকার! আর তাদের বিচার তখন নতুন প্রজন্মই করবে। শাহবাগ দেখিয়েছে কিভাবে গনমানুষ চাইলে একত্রিত হতে পারে, দাবি আদায় করতে পারে। শাহবাগ জেগে থাকে, শাহবাগ ঘুমায় না।
বিঃদ্রঃ পোস্টে তথ্য সংযুক্তির জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে উইকিপিডিয়ার সাহায্য নেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ২:২৯