(কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে
কাঁদালে তুমি মোরে
নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে
কাঁদালে তুমি মোরে...)
সাবানের ঠান্ডা গন্ধ, অবিরাম জল পড়ার শব্দ, আর স্নান করতে করতে আমার মায়ের খোলা গলায় নিজের মনে গেয়ে যাওয়া রবীন্দ্রসংগীতঃ- আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ মানে এইসব। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ মানে পঁচিশে বৈশাখের আনন্দ উৎসব নয়, বাইশে শ্রাবণের ব্যথা নয়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি কিংবা বোলপুরের বিশ্বভারতী আমি আর কোথাও- কোথাও তাঁকে তেমন করে পাই না; যেমন পাই আমার মায়ের খোলা গলার গানে। তবে তাও যেমন-তেমন কিংবা যখন-তখন নয়। সন্ধ্যায় অন্ধকার ঘনিয়ে আসা শেষ বিকেলে মা যখন অফিস থেকে ফিরে স্নান ঘরে শুদ্ধ হতে যান, তখন।
আমার মা কখনো গান শেখেননি। কেনো শেখেননি, এমন গলা! মা বলেন, "রবিঠাকুরের গান তো তানের নয়, প্রাণের"। আসলেই তাঁর মুখেই এমন কথা মানায়। "আর শেখার দরকার কী?" একথা বলেন আমার বাবা।
মা যখন কলঘরে তাঁর প্রাণের গান গাইতে থাকেন, তখন জলের ঝিরিঝিরি শব্দগুলো যেন সহস্র বীণা হয়ে গানের কথাগুলোকে সুরের সঙ্গে একাকার করে দিয়ে আমার শরীরে ঢুকে যায়। আমি বুঝতে পারি এখন আর আমার রক্ষে নেই। আমি এখন আর কিছুই করতে পারবো না শুধুই শুনে যাওয়া ছাড়া। তাই মা স্নান ঘরের দরজা বন্ধ করলেই আমি বাইরে থেকে কান পাতি।
আমি কিন্তু সব শব্দের অর্থ বুঝিনা। সেদিন মা গাইছিলো-
'যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইবো কতো আর?
আর পারিনে রাত জাগতে হে নাথ! ভাবতে অনিবার।'
এই অনিবার শব্দের অর্থে এসে আমি হোঁচট খেয়েছিলাম। আর আমার মা'রও বোধহয় সবগুলো কথ জানা না থাকায় ঘুরে ফিরে ঐ দুটো লাইন গাইছিলো। ফলে অর্থ বুঝতে না পারার যন্ত্রনায় আমি ছটফট করছিলাম। মাকে জিজ্ঞেস করতেই মা বললো, "এবার তোমার ক্লাস সিক্স হলো, সব শব্দের অর্থ জানতে চাইবে না। নিজে নিজে আবিষ্কার করো। ভাবো, আরো ভাবো।" আমি ভাবতোই থাকি। কুলকিনারা পাইনা। মা বলে, "সত্যিই তুমি ভাবছো?" একটুও না থেমে আমি বলি, "সত্যিই ভাবছি মা, ননস্টপ।" মা বলে, "ননস্টপ ভাবতে পারছো আর ভাবতে অনিবার এতো কঠিন হলো বোঝার পক্ষে।"
আসলে ইশ্কুলে আমরা অনেক উঁচু ক্লাসে এসে আমরা বাংলা পড়তে শুরু করি। তাই শক্ত কথায় এসে বারবার মুখ থুবড়ে পড়তে হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আর আমার মা’র গান। আমার মায়ের গান আর রবীন্দ্রনাথ- এই দুইয়ে মিলে আমার স্টকে এখন অনেক বাংলা শব্দ। সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু আমার মাস্টারমশাই, এমনকি আমার ডিক্শনারিও! রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে অনেককিছু!
আমার মা'র একটা প্রিয় গান-
'কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে
নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে
তোমার অভিসারে যাবো অগম পাড়ে'
দুএকদিন পরে পরেই মা'র মুখে গানটা শুনতে শুনতে এ গানটা যে আমার এমন আপনার হয়ে গেছে এর যে আলাদা কোন মানে থাকতে পারে তা-ই আমার মাথায় আসেনি কখনো। মা'র কাছেও জানতে চাইনি। কিন্তু সেদিন...
কিন্তু সেদিন হঠাৎ যেদিন বিকেল হতে না হতেই অন্ধকার ঘনিয়ে এলো! আমাদের একরত্মি বাগানের কচি কচি গাছগুলো ভেজা ভেজা বাতাসে উথালপাতাল হতে থাকলো, আমার হঠাৎই মনে এলো 'নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে' এই কলিটি। হঠাৎ মনে হলো প্রচন্ড ঝড়ো বাতাসে এই গাছগুলো তো এখনি ছিঁড়ে ছুটে যাবে তবু যেনো তারা দারুণ আনন্দে আছে! সেই প্রথম বুঝলাম- সেই প্রথম বুঝলাম কান্নার সঙ্গে ভালোবাসার একটা নিকট সম্পর্ক আছে; গভীর দুঃখের সাথে যেমন আনন্দের।
গাছেদের ভালোলাগা, চারপাশের প্রাকৃতিক উল্লাস আর আমার বুঝতে পারার ভালোলাগায় আমি কতোক্ষণ বুঁদ হয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম, জানি না। জলের ছাঁট থেকে ঘরদোর বাঁচাতে কখন যে মা জানালা বন্ধ করা শুরু করেছে টের পাইনি। টের পেতেই জানতে চাইলাম, "মা, ও মা, মাগো! অভিসার মানে কী?"
মা বললো,"অভিসার! অভিসার আবার কোথায় পেলে?"
"কেনো, তোমার গানে!"
"আমার গানে অভিসার... অভি... ও! তোমার অভিসারে যাবো অগম পাড়ে?"
"হ্যাঁ, ওখান থেকেই"।
মা বললো, "অভিসার মানে যাওয়া। অভিসার মানে যাওয়া- কিন্তু যাওয়া ততোটা নয়, যতোটা যেতে চাওয়া"। বলেই মা ঘরগেরস্থালি গোছাতে কোথায় যে উধাও হলো!
গমন মানে যদি যাওয়া হয়- গমন মানে যদি যাওয়া হয়, তাহলে অগম মানে যেখানে যাওয়া যায় না! এই অগম শব্দটার মানে বুঝতেই অভিসারে যেতে চাওয়া আর যেতে পারা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো। বুঝলাম- কেনো পরাণে বাজে বাঁশি, কেনোই বা নয়নে বহে ধারা। আরো বুঝলাম- দুঃখের মাধুরী মানে ভালো লাগা দুঃখ। আরো বুঝলাম- সব কেড়ে নিয়েও কেউ কিছুতেই ছাড়ে না, আবার যার কেড়ে নেয়া হলো, তার মনও সরে না যেতে। দরজার ছিটকিনি খুলে বাগানে নামতেই গাছেদের মতোই অবস্থা হলো আমার। 'সকলি নিবে কেড়ে দিবে না তবু ছেড়ে, মন সরে না যেতে ফেলিলে একী দায়ে'। ভিজতে ভিজতে বুঝতে পারলাম এই কথা আসল মানেটুকু। ঝরঝর বৃষ্টির অবিরাম ধারায় ভিজতে ভিজতে আমি মা'র মতোই খোলা গলায় গাইতে লাগলাম-
কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে
নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গেয়ে
তোমার অভিসার যাবো অগম পাড়ে
চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে
পরাণে বাজে বাঁশি নয়নে বহে ধারা
দুঃখের মাধুরীতে করিলো দিশাহারা
সকলি নিবে কেড়ে দিবে না তবু ছেড়ে
মন সরে না যেতে ফেলিলে একী দায়ে
কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে।।
জানালায় চোখ পড়তেই দেখি আমার মতো করেই মা আমার গান শুনছে। চোখাচোখি হতেই বললো,"হুম.. ঢের হয়েছে! ওঠে এসো এবার।" সপসপে ভেজা জামায় ঘরে ঢুকেই দেখি বাবা ফিরে এসেছেন কখন! বললেন, "বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বর্ষার গান এলো না মনে!" বাবাকে কী করে বুঝাই অভিসার শব্দের মানেটুকু এখন আমি জানি। আজই জেনেছি। জেনেছি ভালোবাসায় কেমন করে কাঁদা যায়।
এইসব নিয়েই আমার রবীন্দ্রনাথ। আমার রবীন্দ্রনাথকে আমি এইভাবেই মেঘলা আকাশে, বাদল বাতাসে, মা’র স্নানের শব্দে, সাবানের গন্ধে, বিকেলের মরে যাওয়া আলো অন্ধকারে বারবার, বারবার পেতে চাই। বছরের পর বছর, প্রতি বছর, যতোদিন যাবে.. যতোদিন যাবে।
-----
কমলিকার খাতাটা বন্ধ করে শান্তা দিদিমণি এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। টিচার্স রুমে অন্য দিদিমণিরা এতোক্ষণ সকলেই চুপ করে শুনছিলেন। শান্তাদি নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, "এবার আপনারা আমায় বলুন আমি কী করবো! প্রথাগত লেখা নয় বলে, সাল তারিখ মাসের ক্ষেত নয় বলে আস্ত একটা শূন্য বসিয়ে দেবো, নাকি লেখাটার উপযুক্ত মর্যাদার ব্যবস্থা করবো?"
তরুলতা দিদিমণি (বয়সে সবার বড়ো, আগামী বছরই বোধহয় ওঁর অবসর নেয়ার বছর) বললেন, "এ তো দেয়াল পত্রিকার লেখা! ইস্কুলের খাতায় এ ধরনের রচনা আমার মতে এ্যালাও না করাই উচিত"।
শান্তা দিদিমণি দৃঢ়স্বরে জানতে চাইলেন, "একশ পঁচিশতম জন্মজয়ন্তীতে রবীন্দ্রনাথকে জীবনমুখী করে তোলার প্রসঙ্গটা গতকাল আপনিই বলেছিলেন না!"
তরুলতাদি তবুও হার মানলেন না। বললেন, "বলেছিলাম। কিন্তু এখানে জীবনমুখী করে তোলার চেষ্টা কোথায়, এ তো নিছক কাব্য!"
এইভাবেই দুই দিদিমণিতে কিছুক্ষণ তর্ক চলে। শেষকালে মেজরিটির রায়ে সিদ্ধান্ত হয়, 'কমলিকার রচনাটি আমার চোখে রবীন্দ্রনাথ হয়েছে, রচনা রবীন্দ্রনাথ হয়নি'। সব বন্ধুরা কিছু না কিছু মার্কস পেয়েছে; কমলিকা কেবল লাল কালির একটি মন্তব্য 'আবার লেখো। রচনা রবীন্দ্রনাথ, আমার চোখে রবীন্দ্রনাথ নয়'। কমলিকা বুঝতে পারে না আমার চোখে আর আমার রবীন্দ্রনাথের তফাৎটা কোথায়! তার দুচোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। খাতার মলাট ভিজে যায়। বড়ো লজ্জা করে তার। যা তার একান্ত নিজের অনুভূতি তাকে সকলের সামনে এনে অপ্রস্তুত হয়ে যাবার ব্যথায় সে নীরবে কাঁদতে থাকে। শান্তা দিদিমণি সবই লক্ষ করেন। ক্লাস শেষে কমলিকাকে বাইরে ডেকে পিঠে হাত রেখে বলেন,"তুমি যেমন করে অভিসার শব্দের অর্থ খুঁজে পেয়েছো আর কেউ কি তা পেয়েছ? তুমি জানো তুমি এখন কতো ধনী! কাঁদছো কেনো?" কমলিকা আরো একবার বুঝতে পারে কাকে বলে 'কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে'। ঝেঁপে আসা চোখের জলকে সে দুচোখের পাতা দিয়ে শক্ত করে তাড়াতাড়ি বন্দী করে রাখতে চায়, তারা তবুও গাল ভরিয়ে ঝরে পড়ে। শান্তা দিদিমণি বলে, "বোকা মেয়ে!"
__________________________
__________________________
রচনাঃ সুনেত্রা ঘটক
আবৃত্তিঃ
রচনা রবীন্দ্রনাথ - শিমুল মুস্তাফা
__________________________
আমার খুব প্রিয় আবৃত্তি। গানটা তো এমনিতেই প্রিয় কিন্তু যেদিন প্রথম (৪/৫ বছর আগে) রচনা রবীন্দ্রনাথ শুনলাম সেদিন হতে গানখানা আরো বেশি প্রিয় হয় ওঠে। কাল শুনে শুনে আবৃত্তিকে অক্ষরে রূপ দিলাম। আশা করি সাবার ভালো লাগবে।
গানঃ
কাঁদালে তুমি মোরে - ইন্দ্রানী সেন
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০০৮ সন্ধ্যা ৭:০৯