আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী, সেই একুশে ফেব্রুয়ারীকে ঘিরে কত স্মৃতি, কত ঘটনা । একুশের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে খালি পায়ে ফুল হাতে প্রভাতফেরী, শহীদ মিনারের বেদীতে ফুল দেয়া চাই ই চাই । এ অভিজ্ঞতা ছাড়া কোন বাঙ্গালি ভাবাই অসম্ভব ।
সেই প্রভাতফেরীর জন্য কতোই না প্রস্তুতি, কতো আয়োজন । আমার জন্ম বেড়ে ওঠা ছোট্ট একটি শহরে, মফস্বলে । সেই ছোট্ট মফস্বলে কিংবা বোধহয় সেই সময়ের একুশে ফেব্রুয়ারীর আমেজটা ছিল এখনকার থেকে একবারেই আলাদা । আমার শৈশবকালটা আশির দশকের মাঝামাঝি । সেই সময় মফস্বলে কমবেশি প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায় ফুলের বাগান করার চল ছিল । সেই বাগানে নানা রঙের গোলাপ, ডালিয়া, পপি, চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী, জিনিয়া, রজনীগন্ধাসহ নানা মৌসুমী ফুল । আর একুশের রাতে দল বেধেঁ ভাইয়ারা, পাড়ার ছেলেরা বেরিয়ে পড়ত ফুলচুরির অভিযানে , পরদিন সকালে যে ফুল নিয়ে সবাই শহীদ মিনারে যাবে । আর সেজন্য সবাই নিজের বাড়ির ফুল রেখে যেতো অন্যের বাগানে ফুল চুরি করতে । আবার নিজেদের বাগানের ফুল বাচাতে থাকতো রাত জেগে পাহাড়া । রাতে বাগানে লাইট জ্বালিয়ে একুশের রাতের জন্য থাকতো আলাদা ব্যবস্থা । আমি তখন ছোট ছিলাম বলে ফুলচোরদের সংগী হতে পারিনি । কিন্তু ছোট ছিলাম বলে আমার জুটতো ভাইয়াদের চুরি ফুলের সবচেয়ে সুন্দর ফুলটা । সেই চুরি করা নানা বাহারি ফুল আর পাতাবাহারের পাতা দিয়ে নিজেরাই বানাতাম ফুলের তোড়া । সেই তোড়া সুতো দিয়ে বেধে নানা রঙের গোলাপ, ডালিয়া, পপি কিংবা চন্দ্র মল্লিকা দিয়ে সাজানো হতো । আর সন্তানের মতোন যত্নে লালন করা ফুলগুলো থেকে সুন্দর আরো বড় ফুল ছিড়ে নিয়ে যাওয়া হতো শহীদ মিনারে । ভোর হবার আগেই মাইকের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যেতো । দলে দলে প্রভাতফেরী দল মাইকে একুশের গান গাইতে গাইতে শহীদ মিনারে যেতো । সেই দল গুলোর কোন একটি দলে ভাইয়াদের সাথে ভিড়ে যেতাম । যদিও মা বলতেন তোমার যাবার দরকার নেই, ঠান্ডা লাগবে । স্কুলের গানের ক্লাসে কিংবা দলীয় সংগীতেও যেই আমি হেড়ে গলায় গান গাইবার সাহস করতাম না সেই আমি একুশের ভোরের প্রভাতফেরীতে পরম মমতায় গাই অমর একুশের গান । আমার হেড়ে গলাতেও কেন এই গানটি খারাপ শোনায় না । আর একটু বড় হয়ে যখন স্কুলে ভর্তি হলাম তখন তো স্কুলের ইউনিফর্ম পড়ে স্কুল থেকেই যাওয়া হতো আর সেই সময় আমাদের মাঝে চলত তুমুল প্রতিযোগিতা, কার ফুলের তোড়া, ফুল সবথেকে সুন্দর । আহা কি চমৎকার সেই সবদিন গুলি । আচ্ছা সেই ফুলচোরেরা কি আজও আসে ?? এভাবেই শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় শহীদ মিনারে ?? মনে হয় না । কেননা মফস্বলেও এখন আর প্রতিটি বাড়িতেই ফুলের বাগানের চলটি চোখে পড়ে না । তাই বোধহয় কালের বিবর্তনে সেই ফুলচোরেরা হারিয়ে গেছে, তাই বোধহয় আজ আর সেই ফুলচোরেরা আসে না ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ ভোর ৪:১৬