somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যদি ছবি আঁকতে পারতাম! তবে....

২৬ শে অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানুষ কত সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকে, এসব দেখে মনে হয় আমিও যদি পারতাম ওরকম আঁকতে! তাহলে নিশ্চিত আমাদের পুরানো সেই জমজমাট বাড়িটির প্রতিটি আনাচে কানাচের চিত্র ক্যানভাসে তুলে আনতাম। বন্দী করে রাখতাম সাদা ক্যানভাসে। সাদা ক্যানভাসে বন্দী করতে না পারলেও মনের ক্যানভাসে ঠিকই বন্দী করে রেখেছি।
ঢাকা থেকে গেলেই যে চিত্র দেখতাম প্রায়-ই সেটা হল বাড়ীর সামনের রাস্তার ওপাশে বিশাআআআআআল জোড়া শিমুল গাছের নিচে আমার ছোটখাটো দাদু ঝাড়ু নিয়ে ব্যস্ত জ্বালানী পাতা জোগাড় করতে। কখনো তারও পরে পুকুরের ওপাশে কাচায় (গাছের প্রায় অন্ধকার বাগান) বিশা....ল বিশা...ল শিল কড়ই গাছের পাতা ঝাড়ু দিয়ে জমানোর কাজে ব্যস্ত। সেই শিমুল বা কড়ই গাছ এখন আর নেই। সেগুলো বিক্রি করে বাপ-চাচা, দাদী-ফুফুদের মাঝে বন্টন হয়ে গেছে।

বাড়ীর ভেতরের চিত্র ছিল এরকম: যেটা আমি প্রথম বা দ্বিতীয় ক্যানভাসে তুলতাম, দাদার আমলের ছোটকাকার ঘর পূর্ব পশ্চিম দিক করে পশ্চিম মুখী তোলা, আর তার লাগোয়া আমাদের ঘরটি উত্তর ভিটিতে দক্ষিন মুখী করে তোলা। দুই ঘরে কোনা দিয়ে দুজন মোটামুটি যাতায়াত করতে পারে এরকম জায়গা ছিল, যেটা দিয়ে আমাদের পেছনের শরিক ছোট দাদারা যেতো।

দাদু তার স্বামীর আমলের অর্থাৎ বর্তমানে যেটা ছোটকাকার; সেই ঘরেই থেকে গেছেন যত দিন নিজের শক্তি ছিল, কাজ করেছেন। শেষ চার-পাঁচ বছর আর নিজের শারীরিক শক্তি ছিলনা বলে ছেলেদের বাড়ী ছিলেন। এখনো মনেহয় দাদুর ঘরটি ঠিক আগের মতই আছে, বাড়ী গেলে সেরকম ই দেখতে পাবো।
আরেকটি ক্যানভাসে আমি তুলতাম, বারান্দার ছোট চৌকি যেখানে ছোট ফুফুরা এলে থাকতেন, ঘরের মাঝে এক পাশে বড় চৌকি যেখানে বড় ফুফু বা ছোট কাকারা এলে থাকতেন, মাঝে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা তারপরে আরেক প্রান্তে বড় একটি চৌকি এবং তার সাথে লাগোয়া ছোট্ট নামাজের একটি চৌকি। বড়টিতে খাওয়া হতো এবং ছোটটিতে দাদু থাকতেন। তার নামাজ, ঘুম, খাবার সময় বসা সব কাজ ছিল ছোট চৌকিতে। নামাজের চৌকির সামনে একটি পর্দা ছিল যেটা বেশির ভাগ সময় গোটানো থাকতো। আমরা সবাই বাড়ী গেলে ঐ পর্দার ভাজে হাত দিলে কমলা বা অন্য ফল পাওয়া যেতো যেগুলো সবাই নিতো।

চৌকির পাশেই এক কোনা দিয়ে দক্ষিন দিকে একটি দরজা বাইরে যাওয়ার আর সামনে পশ্চিম দিক লাগোয়া একটি বড় মাচা হাফ বেড়া দেওয়া যেটা ছিল আমার দাদুর আরেকটি জগত! অন্ধকার সেই মাচায় মা-কাকীরা তেমন কেউ ঢুকতো না সাপ-ব্যাং এর ভয়ে আর ঢুকলেও লাইট হরিকেন নিয়ে ঢুকতো। আম্মা তো একবার অন্ধকারে নোনা ইলিশের পাত্রে হাত দিয়ে ঠান্ডা লাগায় সাপ সাপ বলে দৌড়ে বের হয়ে আসে! দাদু অবলীলায় কোন বাতি ছাড়াই সেখানে ঘুরে বেড়াতো। ঐটুকু মানুষ লাফ দিয়ে অত উচুতে কিভাবে উঠতো আর নামতো সেটাও একটা ব্যাপার ছিল!

জীবনের প্রায় ত্রিশটি বছর স্বামী ছাড়া কাটিয়েছেন এই মহিলা, যার প্রায় পঁচিশটি বছর ছিলেন একেবারেই একা! কোন ছেলের কাছে যাননি ছোট বেলায় স্বামীর বাড়ী এসেছেন, মরবেন স্বামীর ভিটায় সেই আশায়! আমি ভেবে পাইনা এরকম ধৈর্য্যশীল, সংযমী হওয়া কিভাবে সম্ভব!

আরেকটি ক্যানভাসে আমি তুলতাম রান্না ঘরের চিত্র। আমাদের ঘরের পশ্চিম কোনায় ছিল রান্নার জায়গা। শুকনো মৌসুমে রান্নার জন্যে উপরে কোন রকম ছাউনি দিয়ে রান্না করা হতো। জায়গাটি ছিল অর্ধ বৃত্তাকার। পরবর্তীতে সেখানে আমাদের ঢেকি ঘর বানানো হয়।

দাদুর থাকার ঘরের ঠিক বিপরীতে ছিল রান্না ঘর। নৌকার ছইয়ের মতন বাঁশের চাটাই দিয়ে গোল করে চালা তার উপর নীল প্লাস্টিকের কাগজ দেয়া থাকতো রোদ-বৃষ্টির পানিতে যাতে তাড়াতাড়ি নষ্ট না হয়। চারপাশে ছিল পাট খড়ির বেড়া। এটা ছিল রান্নার ছাপড়া। আর একদম এর সাথেই লাগোয়া আরকটি ঘর ছিল সেটা আমাদের, যেটা ছিল ঢেকি ঘর।
প্রায় সারাক্ষন-ই ধুপ ধুপ আওয়াজ আসতো এই ঢেকি ঘর থেকে। ঢেকিটি এখন স্থান পেয়েছে আমাদের নতুন বাড়ীর ঢেকি ঘরে। সংসারের এই একটি জিনিসই আমার মা চেয়ে নিয়েছেন, শাশুড়ীর ঢেকিটি!

ঢেকিতে কোন কাজ করার সময় মাঝে মাঝে তার মাথায় গিয়ে বসে থাকা ছিল আমার খুব পছন্দের কাজ, এবং এখনো কাজটি করে থাকি সুযোগ পেলে।
আমি যদি ছবি আঁকতে পারতাম তবে অবশ্যই এই ছবিটি আঁকতাম, ঢেকিতে ধান বা চাল কুটা হচ্ছে, চারপাশে তা ছড়িয়ে আছে। মা-চাচী-ফুফুরা কেউ ঢেকির প্রান্তে দাড়িয়ে গল্প করছে, কেউ পাশে বসে পানি খাচ্ছে আর কেউ কুটা ধান বা চাল ঝাড়ছে বা চালছে। ফ্রক পড়া ছোট্ট একটি মেয়ে ঢেকির উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তার দাবি "আমি বসে থাকি তোমরা ঢেকিতে পাড় দাও" । তার ধারণা পাড়ের সাথে সাথে সে উপরে উঠবে আবার নিচে নেমে যাবে, দারুন একটি ব্যাপার হবে!

মেয়েটি রং, তুলি, ক্যানভাসে হাতে আঁকতে না পারলেও মনের ক্যানভাসে ঠিক সাজিয়ে রেখেছে!

দাদু নেই দেড় বছরের বেশী। বাড়িটিও আগের মত নেই। দাদু থাকতেই এর জমজমাট অবস্থা শেষ হয়ে গিয়েছিল প্রায় ১০/১২ বছর আগেই এখন একেবারেই শেষ। নড়বড়ে ঘরটিই আছে শুধু ঠিকনা দিয়ে দাড় করানো! সেই রান্না ঘর, ঢেকিঘর, কল পাড় কিচ্ছুই নেই এখন আর।

কলপাড়ের চিত্র মনে হলে ভেসে ওঠে একটি ব্যস্ত কলপাড়, যেটা ছিল রান্না ঘরের পাশেই, বাড়ীর মসজিদের সামনে। এক পাজা হাড়িপাতিল নিয়ে বাড়ীর দুই বউ সকালবেলা সেখানে গল্প করতে করতে হাড়িপাতিল ধুচ্ছে। একজন কল চেপে দিচ্ছে আরেকজন মেজে ধুয়ে রাখছে। কখনো অন্য বাড়ীর কেউ পানি নিতে দাড়িয়ে আছে পাশে।

মনের ভেতর খুব হাহাকার করে সেই চিত্র মনে করে।
আমি যদি পারতাম সত্যিই একেকটি চিত্র এঁকে ঘরে রাখতাম, মনের সাথে সাথে চোখেও দেখতে পাতাম!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৪:৫৬
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×